“রোজ রাতে আমার হাজবেন্ড আমার শাড়ী,ব্লাউজ,গয়না পড়ে রুমে রুমে ঘুরে বেড়াতো। যখন তার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে সে মেকাআপ লাগিয়ে বসতো তখন মনে হতো কোন গোলাপি শূকর বসে রয়েছে।পুরু পুরুষালি ঠোঁটে লাল লিপস্টিক লাগানো দেখে একদম বমি আসতো।প্রত্যেকদিন অশ্লিল ভঙিমায় শাড়ী পড়ে নাচতো।এক জানোয়ারের নাচ।অনেকদিন ধরে সহ্য করেছি।আর না পেরে আজকে গলায় কাঁটা চামচ বিঁধিয়ে দিয়েছি।খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাংসও বের করে দিয়েছি।”
সামনে বসে থাকা ত্রিশ পেরিয়ে যাওয়া রমণী বেশ সুন্দর করে তার স্বামীকে কীভাবে আঘাত দিয়েছেন তা বর্ণনা করছেন। একদম অভিনয় করে করে।তার চোখ দুটো গোল আলুর মতো বড় বড় করে রাখা।যাতে এখুনি আবার সে পুরো ঘটনাটা পুনরাবৃত্তি করবেন।পুরো বিষয়টাতে কোন পাঞ্চ পেলেন না ইনায়া।উল্টো তার কাছে এগুলো এখন বিরক্ত লাগছে।পেশায় একজন সে মনোবিজ্ঞানী।এজন্য এরকম কেস বহু আগেও এসেছে।মানুষ যে কতো প্রকারের পাগল হতে পারে তা ইনায়া এ পেশায় না আসলে বুঝতে পারতেন না।
“Dissociative Identity Disorder!এই নামের সাথে আমরা খুব বেশী পরিচিত নই কিন্তু একই রুপ ভিন্ন নামকে খুব ভালোভাবে চিনি।Spilt Personality বা Multiple Disorder. যখন এক ব্যক্তির মধ্যে দুটি স্বত্ত্বা বসবাস করে।একটা আসল এবং অন্যটি বিকল্প।মস্তিস্কের স্মৃতি মাঝেমধ্যে মুছে দেয় এবং তা শারীরিক ভাবে ওভার পাওয়ার হতে পারে।তার স্বামীরও সেম রোগ ইন্সপেক্টর।হি নিড কাউন্সিলিং এন্ড প্রোপার ট্রিটমেন্ট।আদার ওয়াইজ এটা ছাড়ানো সহজ নয়।”
কথা বলতে বলতে ইনায়া খেয়াল করলেন ইন্সপেক্টর কোনো খেয়াল করছেন না তার কথাগুলো।আয়েশ করে চায়ে চুমুক বসাচ্ছেন।
“আপনি কি আমার কথা শুনছেন জনাব?”
বিরক্ত হয়ে ইন্সপেক্টর জবাব দিলেন–
“কি শুনবো ম্যাডাম?লোকটা পাগল তো তাই?ব্যাস একটা রিপোর্ট করে দেন কেস ক্লোজ হয়ে যাবে।”
ইয়ানার মনে হলো ঘুরে একটা জবাব প্রদান করুক ইন্সপেক্টরকে।কিন্তু লাভ নেই।বাংলাদেশের প্রশাসনের লোকগুলো এমনি হয়।
বিরক্তিতে মুখ তেতো হয়ে এসেছে ইনায়ার।অনেকটা মুড খারাপ করে সে পুলিশ স্টেশন থেকে বের হলেন।ইনায়া খান। পেশায় একজন সাইকিয়াট্রিস্ট।দেখতে একটু নয় একটু বেশীই সুন্দরী।ব্যক্তিত্ব নগ্ন তরবারির মতো ধারালো।যখন মুখ খুলবেন তখন এমন কথা বলবেন যা সরাসরি এক পাহাড়সম ব্যক্তিকেও টলাতে সক্ষম।বর্তমানে বাবা, মা এবং পরিবার ব্যতীত এক বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে একা অবস্থান করছেন।
লিফট থেকে বের হয়ে একটু অবাক হলেন ইনায়া।তার ফ্ল্যাটের দরজা হাঁট করে খোলা।ভীত হওয়ার মতো মেয়ে সে নয়।এজন্য সহজেই নির্ভয়ে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলো সে।
ড্রয়িং রুমের কাউচে এক পুরুষ বসে রয়েছেন। বয়স ত্রিশের এসপার। তার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে অজান্তে রমণীরা নিজের হাতও কেঁটে ফেলতে পারে।আর সে হচ্ছে ইয়াদ ইউসুফ।পেশায় একজন ব্যবসায়ী।নানা মাল্টিপাল ন্যাশনাল কোম্পানির ওনার।যদিও সবটুকু সে বংশগত সূত্রে পেয়েছেন।
একটু বাঁকা হাসলেন ইনায়া।
“তুমি কি জানো ইনায়া?তোমার ঠোঁট প্রসস্থ করলে তোমাকে টাইটানিক মুভির রোজের মতো লাগে?”
“ওহ হো ইউসুফ সাহেব!আমি তো এটা জানতাম না।”
ইনায়া ইউসুফের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে একথা বললেন। চন্দন কাঠের মারাত্বক বিমোহিত সুগন্ধি ভেসে আসছে ইয়াদের থেকে।নিজের ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ইনায়ার হাত স্পর্শ করালেন ইয়াদ।
“উহু!ইয়াদ বলেন ইউসুফ নয়।”
“আমার তো আপনাকে ইউসুফ বলতেই ভালো লাগে।”
কথাটা শেষ হতে দিলেন না তার আগে ইয়াদ বসা থেকে উঠে মুহুর্তেই ইনায়াকে পিছন দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। নাক তার গলার কাছে নিয়ে একটা লম্বা নিশ্বাস ছাড়লেন।
“আপনার গন্ধ প্রজাপতির মতো তা কি জানেন?”
“না তো। প্রজাপতির গন্ধ হয় নাকী?”
“হুম হয়তো এই যেমন আমার প্রজাপতির গন্ধ গন্ধরাজের মতো।”
“আচ্ছা!”
“হুম।”
ইনায়া ইয়াদের দিকে সোজা হয়ে ফিরলো।একটু ঝুঁকে ইয়াদ তার কপালের সাথে কপাল মিশালো।
“আপনাকে খুব মিস করছিলাম প্রজাপতি।তাই এসে পড়লাম।আপনি করেননি?”
ইনায়া কোন জবাব দিলোনা।সে ইয়াদের এ কণ্ঠস্বর অভিব্যক্তি সম্পর্কে পূর্ব থেকে অবগত।একটু হেসে পরস্পর গাঢ় চুম্বনে আবদ্ধ হয়ে গেলো দুজনে।
,
,
“আপনি কি ঠিক আছেন রমণী?”
একজোড়া চাঞ্চল্যকর চোখ ইয়াদের এ প্রশ্নে বিচলিত বোধ করলেন।একটু আগে একটা বাইকের শো রুমে বাইক ট্রায়াল দিতে এসেছিল ইয়াদ।সেটা নিয়েই রাস্তায় বের হয়ে ছিলেন।একটু থেমে আবার যখন বাইকে উঠতে যাবেন তখন তার পা পাশে চলতে থাকা এক রমণীর পেটে গিয়ে লাগে।এবং তা বেশ জোড়েই।আচমকা ভয়ে ও ব্যাথায় রমণীটি হাঁটুগেড়ে নিচে বসে পড়েন।
“আপনি ঠিক আছেন? ”
হালকা মাথা নাড়ালো সাইরাহ্।
“আসলে আমি ইচ্ছে করে দেইনি।আপনি কিছু মনে করেননি তো?”
এবারও না বোধক মাথা নাড়ালো সাইরাহ্।
এই মাথা নাড়ানো তে প্রচন্ড বিরক্ত হয় ইয়াদ।এক ধমকের সুরে বললেন
“মুখে বলেন।”
চমকে উঠে একটু ধীম আওয়াজে সাইরাহ্ বললেন
“সমস্যা নেই।”
“আপনার যদি কোন সমস্যা থাকে তো বলেন।ব্যাথা পেয়েছেন?”
“উহু!”
“ঠিক আছে হাত দেন।উঠতে সাহায্য করছি।”
ইয়াদ সাহায্য করার আগে কোথা থেকে একটা ছেলে এসে সাইরাহ্কে উঠিয়ে দাঁড়া করালো।ছেলেটার সংস্পর্শে এসেই কেঁদে দিলো সাইরাহ্ ।
“ঠিক আছিস তো?কাঁদছিস কেন?”
ইয়াদ খেয়াল করলো ছেলেটাকে সে চিনে।তার কোম্পানির ইমপ্লয় সে।
“তারেক?”
তটস্থ হয়ে তারেক জবাব দিলো–
“স্যার কিছু মনে করবেন না।আমার বোন সাইরাহ্ ছোট তো।”
“এটা কি ঠিক তারেক।দোষটা তো আমার।এখন একটু সরো তো।”
তারেক একপাশ হয়ে সরে দাঁড়ালো।কেঁদে কেঁদে নাক রেড চিলি বানিয়ে ফেলেছে সাইরাহ্।
“আপনার নাম?”
“সাইরাহ্!বলেন তো আপনার নামের অর্থ কি?”
“উহু জানিনা।”
“যে ভ্রমণ করে।আপনি জানেন আপনি মানসিকভাবে অনেক দূর্বল।”
সাইরাহ্ জবাব দেওয়ার আগে পাশ থেকে তারেক বললেন–
“আসলে স্যার ওর কিছু সমস্যা রয়েছে।আপনি ব্যাপারটা কালকে ক্লিয়ার করবো।”
“অফ থাকো করতে হবেনা।”
ইয়াদ সাইরাহ্ এর কিছুটা নিকটে আসলেন।এক গোলাপের নির্যাস আসছে তার শরীর থেকে।দমবন্ধ ময় নিশ্বাস।হাতটা হালকা করে সাইরাহ্ এর মাথায় রাখলেন ইয়াদ।
“তারেক!”
“জ্বী স্যার?”
“তোমার বোনের বয়স কতো?”
“২১।”
“বিবাহ উপযুক্ত হয়েছে তাই নাহ?”
“সেরকমই।”
“কালকে তুমি আমার কেবিনে আসবে।”
“কেন স্যার?”
“সময় আসলে বলবো।এখন আসি।”
ইয়াদের যাওয়ার পর তারেক সাইরাহ্ এর দিকে তাঁকালেন। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত ভেবে তার চোখ চকচক করে উঠলো।
,
,
ফ্লাওয়ার ভাসে ফুল রাখতে রাখতেই পিছন থেকে শক্ত পুরুষালি হাত বেষ্টন করে ফেললেন জেরিনকে।তার বুঝতে বাকী রইলো না হাতটা কার।একটু মৃদু হেসে পুরুষের বুকে পিছন থেকে মাথা ঠেকালো সে।বুক ভরে চন্দন কাঁঠের ঘ্রাণ নিলেন।
“আজকে এতো তাড়াতাড়ি আসলেন যে ইয়াদ?”
“কি করবো বলেন বিবি সাহেবান আপনার থেকে দূরে থাকা যায় নাকী বেশী সময়।”
সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ইয়াদের কলার ঠিক করতে করতে জবাব দিলেন জেরিন।
“তাহলে রোজ কেন আগে আসেন না?”
“কি করবো বউ অফিসে চাপ থাকে।এইই মহারাণী রাজকন্যা কেমন আছে?”
জেরিন দুমাসের অন্তস্বত্তা।ইয়াদের লিগ্যাল ওয়াইফ।দুই বছর হলো বিয়ে হয়েছে।প্রেমের বিয়ে কিন্তু এখনও দুনিয়া থেকে অগোচরে সব।সম্প্রতি মা হতে চলেছেন জেরিন।ইয়াদের প্রথম সন্তান।
“আপনি কীভাবে জানলেন এটা রাজকন্যে?”
“বাবা তো বুঝি।”
“আচ্ছা বসেন আমি পানি নিয়ে আসছি।”
“কৃতার্থ হবো বউ।”
জেরিন চলে গেলে কাউচে ধপ করে বসে পড়লো ইয়াদ।গলা বন্ধনী হালকা খুলে দিলো।এখনো মনে হচ্ছে সাইরাহ্ এর গোলাপ গন্ধ তার চারপাশে মিশে রয়েছে।যে হাত সাইরাহ্ এর মাথায় রেখেছিলেন তা উঁচু করলেন ইয়াদ।বিরবির করে বললেন–
“She walks in a beauty like tha night (Lord Byron)
মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে সে সাইরাহ্তে।বিমোহিত মুগ্ধ।
চলবে,
#ভ্রমণ
#পর্বঃ১
লিখাঃসামিয়া খান
#ছবিয়াল_মুহাম্মাদ ওমর