#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ০৬
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
আবেশকে হুট করে নিজের একদম কাছাকাছি পেয়ে কুঁকড়ে উঠলো মাধুর্য ৷ তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির পানি৷ আবেশ আলতো হাত রাখলো মাধুর্যের গালে৷ মাধুর্য চোখ বোজে ফেললো সাথে সাথেই ৷ টুপটাপ করে বৃষ্টির ফোঁটা ঝংকৃত হচ্ছে৷ তেজ বেড়েছে বৃষ্টির ৷ নিদারুন আবেশিত ছন্দ তুলছে পিচঢালা ঝকঝকে রাস্তায় উপর। অসময়ে বৃষ্টির জন্য সবাই মাথা গুজার আশ্রয় খুজতে ব্যস্ত৷ মাধুর্য হালকা ভাবে চোখ খুলে তাকালো ৷ আবেশ তাকিয়ে আছে তারদিকে৷ স্থির তার চোখের দৃষ্টি! মাধুর্য বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবাকের রেশ কাটিয়ে বলল,
‘ ঠিক আছেন,আপনি?’
‘ আমার হাজার রাতের ঘুম ফিরিয়ে দিতে পারবে,মাধবীলতা?’
মাধুর্য থমকালো৷ তার কানে ঝনঝন করে উঠলো মাধবীলতা ডাকটা ৷ অজানা সুখ মিশ্রিত হিমেল বাতাস প্রবাহিত হলো তার অন্তরে৷ মাধবীলতা! ডাকটা বহুকাল পর আবার শুনলো৷ শেষবার ডাকটা শুনেছিলো,সেই সাত বছর আগে একটা চিঠিতে৷সেই চিঠিটা যত্ন করে রেখেছে সে৷
সিলেট চলে আসার পর আবেশ প্রতিনিয়ত চিঠি দিতো তার মেহরুন আন্টির কাছে৷ মাধু’র জন্য! তার আম্মার পরী মায়ের জন্য ৷ তারা যখন গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে হঠাৎ সব এলোমেলো৷ একের পর এক চিঠি জমা হলো ডাক বাক্সে৷ সব হারিয়ে গেলো ৷ আবেশ সেইসব ভেবে গম্ভীর হয়ে উঠলো৷ মাধুর্যের দিকে প্রগাঢ় চাহনীতে তাকিয়ে বলল,
‘ পারবে?’
‘ আবেশ৷’ মাধুর্য কাঁপা গলায় ডাক দিতেই আবেশের হুশ ফিরে৷ মাধুর্যকে কাছাকাছি দেখে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সরে দাঁড়িয়ে থমথমে গলায় বলল,
‘ বাসায় চলো৷’
‘ আপনি ঠিক আছেন?’
‘ আমার ভালো আমি বুঝতে পারি৷ সেটা তোমার না ভাবলেও চলবে৷’ আবেশের অভিমান কন্ঠস্বরে মাধুর্যকে কাঁপিয়ে দিলো ভেতর থেকে৷ নির্লিপ্ত ভাবে চেয়ে রইলো আবেশের দিকে৷ আবেশ পাত্তা না দিয়ে মাধুর্যের হাত টেনে ধরে নিয়ে যায় গাড়ির দিকে ৷ মাধুর্য খুব করে বুঝতে পারছে আবেশে রাগ৷ কিন্তু সে যে নিরুপায়৷
__________
পশ্চিমা আকাশের কোলে সূর্য হেলে পড়েছে৷ সোনালী রোদ দোল খাচ্ছে হাওয়ার তালে তালে ৷ বিশাল ড্রয়িংরুমে আভিজাত্যের ছোঁয়া ৷ ড্রয়িংরুমের পাশ দিয়ে উঠে গেছে সিড়ি ৷ সিড়ির নীচে সাজানো বিভিন্ন পেইন্টিং সেই সাথে পরিবারের সবার ছবি ৷ মাহফুজা হাসনেয়াত,নজরুল হক,নাবিহা,মাহমুদ,নাজিফা,ইরা,ফয়েজ সবার ছবি পাশাপাশি৷ কিছুটা দূরেই আবেশের ছবি তার নীচে’ই মাধুর্যের সাত বছর বয়সী লাল ফ্রকের ছবিটা দেখে বেশ চমকালো মাধুর্য৷
‘ জানো,ছোট ভাবী? এই পিচ্চিকে আমি বড্ড হিংসে করি৷’ নাজিফা মাধুর্যকে পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলো৷ হঠাৎ ছবি গুলো দেখে মাধুর্য থমকে যায় তার ছবিটা দেখে৷ নাজিফার কথায় নিজের ছবি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল,
‘ কেন?’
‘ আম্মা,বড় ভাইয়া,ছোট ভাইয়া আমার থেকে এই বাচ্চাটাকে বেশি ভালোবাসে৷’ নাজিফা গাল ফুলিয়ে বলল৷ মাধুর্য অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ নাজিফা,এই বাচ্চাটাকে সামনে পেলে কী করবে তুমি?’
‘ তার লম্বা চুল গুলো কেটে ফেলবো৷ কারণ ছোট ভাইয়া বারবার বলে,দেখ কতোটুকু একটা মেয়ের চুল দেখলেই মনে হয় কালো মেঘমালা৷’
‘ তাহলে কেটে দেও৷’ মাধুর্য তার লম্বা চুল গুলো অগোছালো ভাবে ছেড়ে দিয়ে বলল৷ নাজিফা দুই লাফে পেছনে পিছিয়ে গেলো৷ মুখে হাত দিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল,
‘ তু..ততুমি! মাধু৷ হায় আল্লাহ..’ নাজিফা মাথায় হাত দিয়ে আফসোসের সুর তুলে আবার বলল,
‘ মাধুর্য থেকে মাধু ৷ ধ্যাৎ,নাজিফা তোর সিক্স সেন্স এতো ড্যামেজ হলো কবে? প্রথম নাম শুনেই তো ধরে ফেলা উচিৎ ছিলো৷’
‘ কাটবে না চুল?’ মাধুর্য হেসে বলতেই নাজিফা মাধুর্যের চুল ধরে বলল,
‘ ওই বাচ্চার চুল কাটতে চেয়েছি আমার ভাবীর না৷ তাই কথা কেটে-কুটে গেলো৷’
‘ কী হচ্ছে,আমাকে তো নাজি বুড়ি ভুলেই গেছে নতুন ভাবী পেয়ে৷’ ইরা ক্লান্ত গলায় মুখে হাসি নিয়ে বলল ৷ নাজিফা লাফিয়ে ইরার কাছে গিয়ে মিষ্টি সুরে বলল,
‘ বড় ভাবীকে ভুলে যাওয়া ইম্পসিবল৷ তবে ছোট ভাবীকে ভালোবাসা দিচ্ছি,নতুন তো তাই৷’
মাধুর্য হেসে ফেললো৷ ইরা নাজিফার গাল টেনে দিয়ে মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ ঘন্টা দুয়েক পর আমার রুমে এসো তো,মাধুর্য৷’
__________
চারদিকে অন্ধকার নেমেছে৷ বৃষ্টিরা কুন্ডুলি পাকিয়ে ধোঁয়ার মতো আকাশ বেয়ে ঝরছে৷ শীতল বাতাসে অভিভূত প্রকৃতি৷ মাধুর্য গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো ইরার রুমে ৷ রঙিন আলো জ্বলছে প্রত্যেকটা ঘরের কোণে ৷ মাধুর্য যে দিকে তাকায় সবদিকেই নতুনত্বের ছোঁয়া পায়৷ বিশাল জায়গা জুড়ে বানানো হয়েছে বাড়িটা৷ নজরুল হক হুট করে সিলেট এসে আমূল-পরিবর্তন হতে পারবে কে ভেবেছিলো?
মাধুর্য চারদিকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে এগিয়ে চলেছে ৷ মাধুর্যের খেয়াল নেই সে কোনদিকে যাচ্ছে৷ অন্ধকারের মাঝেই কারো সাথে ধাক্কা লাগতেই চেঁচিয়ে উঠে মাধুর্য ৷ আবেশ তড়িঘড়ি করে মাধুর্যের মুখ চেপে ধরে বলল,
‘ স্টপপপ..চেঁচাচ্ছো কেন?’
‘ ম..মুক..খের উপ..র থে..’ মাধুর্য বলার চেষ্টা করেও পারলো না৷ আবেশ বুঝতে পেরে হাত সরিয়ে শাসিয়ে বলল,
‘ চেঁচাবে না ৷ সন্ধ্যার পর উচ্চস্বরে কথা বলা আম্মা পছন্দ করেন না৷’
‘ মেরে ফেলেছিলেন,একদম ৷ এইভাবে কেউ আসে?’
‘ তুমি চোরের মতো করছো,কেন? যেকেউ দেখলে চোর ছাড়া অন্যকিছু ভাববে না তোমাকে৷’
আবেশের কথা শুনে প্রচন্ড অভিমান হলো মাধুর্যের৷ সে তো আশেপাশে সব দেখছিলো৷ তাই বলে চোর বলবে?
‘ কোথায় যাচ্ছো?’ আবেশ টাউজারের পকেটে হাত গুজে সটান দাঁড়িয়ে বলল৷ মাধুর্য জবাব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে শান্ত ভাবে ইরার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ আপু,আসবো?’
‘ এসো মাধুর্য৷ রুমের দরজা খুলে রাখাই৷’
মাধুর্য একবার আবেশের দিকে তাকিয়ে ভেতরে চলে গেলো ৷ আবেশ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে৷ হঠাৎ হলো টা কী,এই মেয়ের?
_______
‘ মাধুর্য,আমি এখন তোমায় যা যা কোয়েশ্চেন করবো তুমি সংকোচ না করে জবাব দাও৷’ ইরা প্রফেশনাল ডাক্তারের মতো বলল৷ মাধুর্য চুপ করে রইলো৷ এখানে আসা যে বড্ড ভুল হয়েছে সে বুঝতে পারছে৷ ইরা মাধুর্যের মুখভঙ্গি দেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
‘ তোমার পুরো শরীরে জখম হয়েছে,মাধুর্য৷ তোমার বিয়ের রাতেই আমি দেখেছি৷ আমি সিউর তোমাকে প্রায় প্রতিনিয়ত মারা হতো৷’
ইরার কথায় মাধুর্য ডুকরে কেঁদে উঠলো ৷ শরীরের ব্যথা হু হু করে বেড়ে গেলো যেন৷ অমানুষিক ভাবে তাকে মারা হতো সে কী ভাবে বলবে সেই কথা? তাও তার নিজের আব্বু মারতো।
‘ ডোন্ট ক্রাই মাধুর্য৷ আমরা তোমার সাথে আছি৷ টেল মি,কী দিয়ে মারতো তোমাকে?’
‘ কখনো বেল্ট দিয়ে,কখনো লাঠি দিয়ে৷’ মাধুর্য কাঁদতে কাঁদতে বলল৷ ইরা উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাধুর্য কে৷
‘ রিলাক্স মাধুর্য৷ কিছু হয় নি৷ সব ঠিক হয়ে যাবে৷’
‘ কিছু ঠিক হবে না ভাবী৷ আব্বু ফিরলেই আমাকে নিয়ে যাবে ওই নরকে৷’
‘ তোমার সাথে কী জোরজবরদস্তি করা হতো,মাধুর্য?’
ইরা কিছুটা মিইয়ে যাওয়া গলায় বলতেই মাধুর্য নিজ থেকে প্যাচিয়ে ধরলো ইরাকে ৷ তার বিয়ের দিন সকালে ফিজিক্যালি হ্যারাস করার চেষ্টা করেছিলো রাব্বির এক ভাই৷ সেদিন সে পাশে থাকা ইলেকট্রনিক টেবিল ল্যাম্প ছুড়ে দিয়েছিলো সেই কুৎসিত মানুষটার দিকে ৷ যার ফলে ওই ছেলেটার মাথা ফেটে যায়৷ এইজন্যই তার মা ইচ্ছা মতো মেরেছিলো সেই সাথে হাতে গরম ইস্ত্রি চেপে ধরেছিলো৷ সেই কথা মনে হতেই মাধুর্যের শরীরে জ্বর উঠে যায় ৷
মাধুর্য অনবরত কাঁপছে ৷ ইরা চিন্তিত গলায় বলল,
‘ মাধুর্য তুমি ঠিক আছো? মাধুর্য.. ‘
মাধুর্য চোখের সামনে তার আব্বুকে দেখতে পাচ্ছে ৷ যে মোটা বেল্ট নিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে৷ পাশে দাঁড়ানো হাসি মুখে লতা বেগম ৷ ইরাকে শক্ত করে ধরে রেখেই জ্ঞান হারায় মাধুর্য৷
‘ আবেশ.. এই আবেশ৷ কোথায় তুমি..’ মাধুর্যের অবস্থা বেহাল দেখে ইরা উচ্চস্বরে ডেকে উঠে আবেশকে ৷ আবেশ রুমের বাইরেই দাঁড়ানো ছিলো৷ দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকে মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে বুকে মোচড় দিয়ে উঠে তার৷ অস্থির কন্ঠে বলল,
‘ ভাবী,কী হয়েছে ওর?’
‘ প্যানিক হয়ে গেছে৷ অতিরিক্ত ভয় পেয়ে আছে৷ তুমি ওকে নিয়ে তোমার রুমে যাও৷’
আবেশ মাধুর্যকে ধরলো ৷ ইরা বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আম্মা উঠে গেলে কেলেংকারী হবে,আবেশ৷ আমি তার সাথে এইসব বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে সোজা মানা করেন,আমি যেন মাধুর্যকে কিছু জিজ্ঞাসা না করি৷’
‘ আম্মা আমাকেও এইটা বলেছে,ভাবী৷’
‘ কথা না বাড়িয়ে দ্রুত নিয়ে যাও৷ আমি আসছি৷’
ইরা আবেশকে তাড়া দিয়ে কিছু একটা খুজতে চললো৷ আবেশ মাধুর্যের দিকে পূর্ণ চোখে তাকালো৷ তার মাধু তো হাস্যোজ্জ্বল ছিলো৷ চঞ্চল পাখির ন্যায় ৷ আর উড়ার জন্য বিশাল আকাশ ছিলো তার বাবা শাহেদ ৷ সে কী ভাবে পারলো একজন পিতা হয়ে নির্মম আচরণ করতে?
.
.
খাটের মাঝামাঝি মাধুর্য শুয়ে আছে৷ একটু আগেই আবেশ কোলে তুলে নিয়ে এসেছে তাকে৷ ইরা কড়া ডোজের মেডিসিন দিয়ে গেছে ৷ মাধুর্যের মাথার পাশেই খুলে রাখা জানালা৷ ঘরের সব কৃত্রিম আলো নেভানো ৷ আকাশ পরিষ্কার তবুত হুট করে কালো মেঘ ভেসে আসছে নিয়ম বেঁধে ৷ হাজারো অন্ধকার ভেঁদ করে উড়ে এলো জোনাকিপোকা৷ টিপটিপ করে জ্বালাচ্ছে তাদের আগুনের শিখা৷ মুহূর্তেই অন্ধকারে ঢেকে থাকা রুম পরিপূর্ণ হলো একঝাঁক আলোতে৷ মাধুর্যের শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটের উপর একটা জোনাকিপোকা বসলো ৷ ঝলমল করে উঠলো মাধুর্যের মুখশ্রী৷ আবেশ বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে ৷ ক্লান্ত মুখে প্রসাধনীর ছাপ নেই তবুও যেন রুপকথার রাজকন্যা মাধবীলতা৷
নিজ মনে নামটা আওড়িয়ে লম্বা শ্বাস টেনে মাধুর্যের পড়ে থাকা হাতটা সযত্নে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
‘ মাধবীলতা! তোমার জন্য আমার অভিমান পাহাড়সম৷ হুট করে কেনো এলে আমার অগোছালো জীবনে? দূরে ছিলে বেশ ছিলে৷ ঝড়ো হাওয়ার মতো যখন এলেই সাথে করে কেন দুঃখ নিয়ে আসলে? আমি যে মানতে পারছি না,মাধু৷’
‘ আবেশ আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো আমি,এইতো আর কিছুদিন৷’
চলবে….
[ কেন মেরেছে? এই প্রশ্নের উত্তর প্রতিটা পর্বে বর্ণনা হবে৷আমি যেভাবে প্লট ভেবেছি আমি সেই ভাবেই দিবো৷ আর অবশ্যই বলবেন কেমন হয়েছে৷ সবাই কেমন সাইলেন্ট।ইয়া বড় পর্ব কেমনে দেয়?কাল আমিও দিবো]