#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ০৪
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
আবেশ মাধুর্যের একদম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে৷ যতোটা কাছে দাঁড়ালে নিঃশ্বাসের শব্দ নির্বিঘ্নে একে অপরের মুখে আছড়ে পড়ে,ঠিক ততোটুক কাছে৷ মাধুর্য অস্থির হয়ে আছে৷ ছুটে পালানোর পথ খুজছে ৷ তবে আবেশের যেভাবে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে পালিয়ে যাওয়ার উপায় নেই৷ মাধুর্যের অস্থিরতা দেখে আবেশ তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
‘ তুমি উত্তর দিতে বাধ্য৷ ‘
‘ বারবার বলছি কিছু হয় নি,সরে দাঁড়ান আমার সামনে থেকে৷’
‘ আমার উত্তর চাই।’ আবেশের একরোখা কথায় মাধুর্য মিইয়ে গেলো৷ ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে ৷ কেউ যদি শুনে নেয়! তাকে মেরে ফেলবে একদম ৷ মাধুর্য অনুরোধ করে বলল,
‘ বারবার এক কথা জিজ্ঞেস কেন করছেন? বলছি তো,আমি পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি ৷ ‘
আবেশের প্রচন্ড রাগ হলেও মাথা ঠান্ডা রেখে বলল,
‘ আমাকে তুমি বোকা ভেবেছো? তোমার পুরো শরীরে দাগ হয়েছে কী করে? ওকে,তুমি যদি না বলো,তোমার ফ্যামিলি বলবে৷ এস আ হিউম্যান বিয়িং,আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এইটা৷ ‘ বলেই আবেশ দরজার দিকে এগিয়ে যায় ৷ মাধুর্য চমকে উঠে৷ আবেশ ভুলেও এই কথা জিজ্ঞেসা করলে সব শেষ হয়ে যাবে৷ আবেশ দরজা খুলে বেরিয়ে যায় ৷
মাধুর্যের মা লতা বেগম বাইরেই দাঁড়ানো আছে৷ আবেশ ভণিতা না করে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করে,
‘ ওর শরীরের মারের দাগ কেন,আন্টি? ‘
মাধুর্যের মায়ের কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না৷ তবে মাধুর্য এসে আবেশের হাত টেনে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
‘ আবেশ রুমে আসুন,প্লীজ রুমে আসুন৷ ‘
‘ রুমে যাও বাবা,ঘুমিয়ে পড়ো৷ ‘ লতা বেগম নির্লিপ্ত গলায় বললেন৷ আবেশ অবাক হয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করতে গেলেই মাধুর্য একদম হালকা গলায় বলল,
‘ সব বলবো৷ রুমে চলুন প্লীজ৷’
আবেশ কথা বাড়ালো না৷ তবে লতা বেগমের এমন ব্যবহার প্রচন্ড ভাবাচ্ছে তাকে ৷ এতো স্বাভাবিক থেকেও সব যেন অস্বাভাবিক৷ তবে আবেশের এই ভুলটার জন্য মাধুর্যের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে৷ রুমে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
‘ খুব বড় ভুল করেছেন,আপনি৷ এই ভুলের মাশুল কারো উপর না পড়ুক৷ ‘
‘ ভুল সঠিক আমি জানি না৷ তবে সত্যিটা না জানলে তোমার পুরো পরিবারকে প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হবে ৷ আইনগত তুমি আমার পরিবারের দায়িত্বে এখন৷ ‘
আবেশের ছোট একটা কথায় মাধুর্যের ভয় এক নিমিষেই যেন মিশে গেলো ৷ সে হঠাৎ উপলব্ধি করলো তার চারপাশে হাজারো দিনের আলো ৷ নিকষ কালো আঁধারে ডুবে থাকা জীবনের সুন্দর সূর্যোদয় ৷
______
ছোট একটা বেলীফুলের চারাগাছ খুলে রাখা জানালার পাশে সযত্নে মাটির টবে রোপণ করা৷ চাঁদের আলো সদ্য ফোঁটা কলির উপর আদর মাখছে ৷ একটি বেলী ফুল থেকে সুবাস আসে? সেটা জানা নেই আবেশের ৷ তবে তার কাছে মনে হচ্ছে সুবাস আসছে ৷ তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবীর দিকে তাকাতেও চেয়েও তাকালো না সে৷ শুধু নম্র কন্ঠে বলল,
‘ তোমার ভয় নেই৷ দেখো কেউ নেই এখানে ৷ তোমায় কে মেরেছে? ‘
মাধুর্য কাঁদছে ৷ মুখে হাত চেপে দাঁড়িয়ে কাঁদছে ৷ যার ফলে কান্নার শব্দ আটকে আটকে আসছে৷ আবেশ বিরক্তি প্রকাশ করলো না ৷ সে একদৃষ্টিতে বেলীফুলের দিকে তাকিয়ে আছে ৷ খানিকটা সময় পর রাগী কন্ঠেই বলল,
‘ কান্না থামাও ৷ তুমি মুখ না খুললে আমি যাবো তোমার পরিবারের কাছে৷ ‘
‘ ভাই..য়া আর বাবা মেরেছে ৷ ‘
‘ কেন? ‘ আবেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করতেই মাধুর্য বলল,
‘ আর একটাও প্রশ্ন করবেন না,প্লীজ৷ পাশের রুমে ওরা আছে ৷ শুনে ফেলবে৷ ‘
‘ মেরেছে কেন? কতো জঘন্য ভাবে মেরেছে ৷’
আবেশ মাধুর্যের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল ৷ মাধুর্য মুখে হাত দিয়ে কান্না আটকানোর আবারো বৃথা চেষ্টা করছে ৷ তার ভয় হচ্ছে,এই কথা কেউ শুনলে আবেশকেও ছাড়বে না৷ নিজে কান্না থামিয়ে কোনোরকম বলল,
‘ আমায় নিয়ে চলুন এখানে থেকে ৷ একটু কাজের ব্যবস্থা করে দিবেন ৷ সত্যি বলছি আমি আপনার জীবন থেকেও চলে যাবো৷ ‘
‘ নিয়ে যাবো কিন্তু বলো তোমায় মেরেছে কেন? ‘
‘ আমি এতোকিছু আজ এই মূহূর্তে বলতে পারবো না৷ শুধু একটা অনুরোধ আমাকে কাল নিয়ে যাবেন এখানে থেকে ? দয়া করে,রেখে যাবেন না৷’
আবেশ নজর উঠিয়ে স্মিত চোখে তাকালো মাধুর্যের দিকে ৷ লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরা মেয়েটার জন্য তার খারাপ লাগছে ৷ খুলে যাওয়া লম্বা চুলের বেণীটা সামনে ঝুলে আছে অযত্নে ৷ ফর্সা শরীরের মারের দাগ গুলো স্পষ্ট ৷ কতোটা নির্মম ভাবে মেরেছে ভেবেই তীব্র রাগ হলো তার৷ কিন্তু কী জন্য এই জঘন্য আচরণ? সবকিছু তার আম্মা নিশ্চয়ই জানবে ৷ এই ভেবে মৃদু স্বরে বলল,
‘ কান্না থামাও৷ আমি সাথে করেই নিয়ে যাবো তোমাকে৷ ‘
‘ সত্যি? ‘ মাধুর্য ভেজা গলায় প্রশ্ন করতেই আবেশ স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিলো,
‘ আমি মিথ্যা বলা বা শোনা পছন্দ করি না৷’
মাধুর্য জবাব দিলো না ৷ সামনে থাকা মানুষটাকে যতোটা খারাপ ভেবেছিলো তার থেকে হাজার গুণ ভালো মনে হচ্ছে তার ৷ সে শুধু বাঁচতে চায় ৷ তার নিকৃষ্ট দুনিয়া থেকে মুক্তি পেতে চায় ৷
গাড়ি চলছে নীরব গতিতে ৷ দুইপাশে গাড়ির সাথে ছুটে চলা গাছ গুলো বাঁধন হারা৷ তার কথা রাখার জন্য আবেশ যে সকালেই নিজের বাড়ির উদ্দেশ্য যাবে ভাবতে পারে নি মাধুর্য৷ ফিরে আসার সময় তার মা লতা বেগমের সাথে শুধু দেখা হয়েছে৷হঠাৎ সকাল সকাল ফিরে আসার জন্য নাবিহা বারবার প্রশ্ন করলে আবেশ উত্তরে বলেছিলো, ‘ আমার কাজ আছে বড় আপু ৷ আর একটাও প্রশ্ন করবে না৷ ‘
নাবিহা প্রচন্ড রেগে আছে ৷ কী ধরণের ম্যানার্স এই গুলা? সে ভেবে পায় না ৷ সে ডিসিপ্লিন আর টাইম টেবিল মেইনটেইন করে ৷ এর বাইরে কোনো কাজ হেরফের হওয়া একদম পছন্দ না তার ৷ আবেশকে কিছু বলতে না পারলেও মাহমুদের সাথে তর্ক করছে ৷
আবেশ স্লো ড্রাইভ করছে ৷ সকালের স্নিগ্ধ আলো এসে পড়ছে জানালা ভেঁদ করে৷ মাধুর্য চুপচাপ বসে আছে ৷ শরীরে জ্বর আছে৷
‘ তোমার নাম কী? ‘ আবেশ হুট করে প্রশ্ন করলো মাধুর্যকে৷ মাধুর্য ভাবনায় ছিলো ৷ তাই শুনলো না।আবেশ শব্দ করে কেঁশে বলল,
‘ নাম নেই তোমার? ‘
মাধুর্য আবেশের কথা শুনে অবাক চোখে তাকালো৷ মাধুর্যের চাহনী দেখে আবেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো৷ লজ্জাজনক ব্যপার৷
মাধুর্য বেশ অবাক হয়েছে৷ আবেশ তার নাম জানে না? কী করে সম্ভব?
‘ মাধুর্য৷ ‘ মাধুর্য স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিলো ৷ আবেশ মাধুর্যের নাম বারদুয়েক নিজে নিজে আওড়িয়ে বলল,
‘ পড়াশোনা করো? ‘
‘ করতাম৷ ‘
মাধুর্য ধরে যাওয়া গলায় বলতেই আবেশ তাড়াহুড়ো করে বলল,
‘ এই মেয়ে একদম কাঁদবে না৷ কথায় কথায় কান্নার স্বভাব পাল্টাও ৷ তোমাদের মেয়েদের অভ্যাস বড্ড খারাপ৷ ‘
‘ কান্না আমার একমাত্র সাথী৷ সে যখন গাল বেয়ে নামে আমার ভেতরের সব কষ্ট লাঘব পায়৷’
আবেশ উত্তর দিলো না ৷ মাধুর্যের দিকে একনজর তাকিয়ে ড্রাইভিং-এ মনযোগ দিলো ৷ তার বাবা-ভাই কেন মারতো তাকে? এই প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেলো ৷ সব রহস্যের বেড়াজাল ঘুরেফিরে একটা প্রশ্ন মাথায় আসছে,
‘ মাধুর্য মিথ্যা কথা বলছে না’তো?’
_____
‘ বাবার বাসায় থেকে এসে ভালো লাগছে,মাধু মা?’ বললেন মাহফুজা হাসনায়েত ৷ মাধুর্য রুমের মাঝে বসে ছিলো একা৷ অনেকক্ষণ আগেই আবেশের বাসায় এসেছে তারা৷ মাধুর্য কী বলবে খুজে পেলো না ৷ তবে মহিলার সাবলীল কন্ঠে তার মনে প্রশান্তি বয়ে গেলো।উঠে দাঁড়িয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো মধ্যবয়সী মাহফুজার দিকে। মুখে বয়সের ছাপ অল্পবিস্তর পড়েছে। চোখে তার প্রগাঢ় চাহনী। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে মাহফুজা আবার বলল,
‘ আমি আবেশের মা। চিনতে পেরেছো ? ‘
‘ আসসালামু আলাইকুম,আন্টি।’ মাধুর্য ঘোমটা টেনে সালাম দিতে মাহফুজা হেসে বলল,
‘ আগে তো খুব আম্মুমা বলতি,মাধু।’
মাধুর্য অবাক হয়ে তাকালো।হ্ঠাৎ করেই কেঁদে ফেললো।মাহফুজা হাসছে ।মাধুর্য সোফায় বসে মুখ ঢেকে কাঁদছে।আবেশ রুমে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলো মাধুর্যের কান্না দেখে।কী মেয়েরে বাবা শুধু কাঁদে ।
‘ আম্মা ও কাঁদছে কেন ?’ আবেশ রুমে ঢুকে প্রশ্ন করতেই মাহফুজা বলল,
‘ পুরোনো মানুষ খুজে পেয়েছে,না কেঁদে উপায় কী ?’
আবেশ অবাক হলো। তবে কিছু বললো না।মাহফুজা মাধুর্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই আবেশ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ তোমার সাথে আমার কথা আছে,আম্মা।’
‘ আমি জানি তুমি কী বলবে,আবেশ।তাই ফ্রেশ হয়ে আমার রুমে এসো।’
আবেশ অবাক হলো। তারমানে তার আম্মাও জানে মাধুর্যের শরীরের মারের দাগের কথা?
চলবে….
[ তিন পার্ট শেষ হয়েছে মাত্র। কিছু কমেন্ট দেখে মনে হচ্ছে এখুনি গল্প শেষ চায় তারা।বড় গল্প এইটা।ভিন্ন কিছু ট্রাই করতে গিয়ে এতো কথার সম্মুখীন,কী আর বলবো। যাই হোক কেমন লাগছে জানাবেন।]