ভেতরে বাহিরে পর্ব-৩০

0
1128

#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ৩০
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
ভয়াবহ নিস্তব্ধতা গ্রাস করে আছে৷ পিনপতন নীরবতা ঠেলে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আবেশ৷ মাধুর্যকে একহাতে টেনে নিয়ে বলল,

‘ কিছু হয় নি৷ শরীর দূর্বল থাকার জন্য সিড়ি থেকে পড়ে গেছেন উনি৷’

‘ জ্ঞান ফিরেছে? ‘ মাধুর্য নিমজ্জিত কন্ঠে বলল৷ আবেশ ক্লান্তিতে চোখ বোজে মাথা এলিয়ে দিলো পেছনের দেয়ালে৷ চোখ বোজে থাকা অবস্থায় উত্তর দিলো,

‘ না ফেরে নি৷ বয়স হয়েছে এইজন্য সামলাতে পারে নি৷ ঘুমের প্রয়োজন উনার৷’

‘ আচ্ছা৷’

মাধুর্য উত্তর দিয়ে চুপ করে ঠাই বসে রইলো৷ হসপিটালের করিডর নিষ্প্রাণ৷ আবেশ নিজেও চুপচাপ বসে রইলো৷ সকালে তখন চিৎকার শুনে সবাই ছুটে যায় সিড়ি ঘরের দিকে৷ গিয়ে লতা বেগমকে,নীচে রক্তে মাখা অবস্থায় পায় ৷ রক্তে ভেসে ছিলো সর্বাঙ্গ জুড়ে৷ মাথা দেয়ালের পাশে রাখা ৷ বাজে ভাবে আঘাত পেয়েছেন তিনি ৷ ছাদের সিড়ি থেকে নীচে গড়িয়ে পড়েছেন একদম৷ ব্যাথায় গোঙ্গাচ্ছিলেন ৷ মাধুর্য গিয়ে তাকে ধরতেই ভেঙ্গে আসা গলায় বলেছিলেন,

‘ অ..অ’ বলেই জ্ঞানহারা হয়েছিলেন৷ মাধুর্য সেই থেকে চিন্তায় বিভোর ‘অ’ মানে কী হতে পারে ! যতোক্ষণ লতা বেগমের জ্ঞান না ফিরছে মাধুর্যের মাথায় এই শব্দটা ঘুরেফিরে বেড়াবে৷
লতা বেগমকে গাড়িতে করেই হসপিটালে নিয়ে এসেছে,আবেশ,সে,নজরুল আর ইরা। মাধুর্যের প্রচন্ড খারাপ লাগছে লতা বেগমের অবস্থা দেখে । কতোটা রক্ত বের হয়ে গেছে।
সে আরো সচেতন হবে। যতই হোক,দায়িত্ব নিয়েছে সে।

‘ মাধুর্য..’ আবেশের ক্ষীণ স্বরের ডাকে সম্বিৎ ফেরে মাধুর্যের। ছোট করে জবাব দিলো,’ হু।’ মাধুর্যের জবাবে আবেশ নির্বিঘ্নে মাথা এলিয়ে দিলো তার কাধে। ক্লান্তিকর গলায় বলল,

‘ আর অল্প কিছু দিন। এরপরেই তুমি ঢাকা চলে যাবে।’

‘ ঢাকা কেন যাবো!’ মাধুর্য প্রশ্ন করতেই আবেশ তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় ভরে বলল,

‘ সিলেট থেকে ঢাকা প্রতিদিন যাওয়া আসা সম্ভব না। আমি ভেবেছি তোমার এডমিশনে সিলেকশন হলে হোস্টেলের সিটের জন্য আবেদন করে রাখবো।’

‘ আচ্ছা ঠিক আছে।’

মাধুর্য স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিতেই আবেশ চট করে মাথা উঠিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,

‘ ঠিক আছে মানে ! তোমার খারাপ লাগবে না আমাকে মানে আমাদের ছেড়ে থাকতে।’

মাধুর্য পিটপিট চোখ করে তাকিয়ে বলল,

‘ লাগবেই তো।’

‘ সমস্যা নেই । পড়াশোনার প্রতি ফোকাস করো।ছুটি হলেই বাসায় নিয়ে আসবো। আবার খারাপ লাগা শব্দ উচ্চারণ করলে বাসায় ফিরিয়ে আনবোই না।’ আবেশ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল। মাধুর্য ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ আপনি’ই তো আগে বলেছেন।’

‘ আমি বলেছি,তোমার খারাপ লাগা বাদ দিতে হবে।’

আবেশের কথা শুনে মাধুর্য ভাবুক হয়ে কিছুক্ষণ ভাবার চেষ্টা করলো,আবেশ কী বলেছিলো!
আবেশের চোখে তখন বিষাদ । নিজের করে পাওয়ার থেকে দূরে চলে যাওয়াটা বিষাদের। তার নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে গেছে মাধুর্যকে দেখার। কিছুদিন বাদে,মাধুর্য ভর্তি হলে চলে যাবে ঢাকা। এই কথাগুলো ভাবলেই আবেশের দম বন্ধ অনুভূতি হয়। সিলেটের সব কাজ ফেলে মাধুর্যের সাথে যাওয়ার কোনো সুযোগ তার নেই। ভেবেই গোপন দীর্ঘশ্বাসে জর্জরিত হলো তার মনের কোঠা।

_____________

ঘন কুয়াশায় আচ্ছাদিত হয়ে আছে সর্বত্র। শুভ্র চাদরে মুড়িয়ে আছে ধরণী তল । সূর্যের উত্তাপ যেন ঘুমিয়ে আছে নিরলস ভাবে। ঠান্ডায় কাঁপিয়ে দিচ্ছে মানবকুল। মাধুর্য সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। শিশির জমে আছে গাছের ডগায় ডগায়। খোলা বারান্দায় হাড় হীম করা ঠান্ডা।
তবুও যেন মাধুর্য স্বস্তি লাগছে। ঠান্ডায় জমে থাকা কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করেই শিউলির সুবাসে বিমোহিত হলো মৃদু বাতাসের সাথে প্রকৃতি । লম্বা শ্বাস টেনে নিতেই পেছন থেকে একজোড়া ঠান্ডা হাত মাধুর্যের পেট স্পর্শ করলো।
কেঁপে উঠলো সে। ঠান্ডার সাথে জমে গেলো হৃৎপিন্ডের গতি।
সেই স্পর্শ গভীর হতেই মাধুর্য মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,

‘ আপ..আপনার হাত ঠান্ডা।’

‘ তো!’

‘ ছাড়ুন। আমার ঠান্ডা লাগছে।’

‘ লাগুক।’

আবেশের সোজাসুজিভাব বলা কথায় ঘুরে তাকানোর চেষ্টা করলো মাধুর্য। তবে আবেশ তাকে ঘুরতে না দিয়ে জাপটে ধরে রেখেই বলল,

‘ কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছো কেন !’

‘ কুয়াশা শরীরে ছুঁতেই শিহরণ বয়। সারা বছর আমি শীতের অপেক্ষা করি কুয়াশা নিজের মধ্যে বিলীন করার জন্য।’ মাধুর্য উৎফুল্ল চোখে বলতেই আবেশ তার কানের কাছে কিছু একটা বলতেই থতমত খেয়ে যায় সে। লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠে মুখশ্রী। তবে কন্ঠে রাগ ধরে রেখে বলল,

‘ ছিঃ! আমাকে ছাড়ুন । নির্লজ্জ লোক।’

‘ তাহলে নির্লজ্জতার প্রমাণ করেই ফেলি।’ আবেশ নিমজ্জিত কন্ঠে বলতেই শীতের মাঝে উষ্ণতা বয়ে গেলো মাধুর্যের মাঝে।
সে লজ্জায় নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। আবেশের স্পর্শ তার কাছে দম বন্ধকারা অনুভূতি । মনে হয় ভেতর থেকে কেউ আটকে ধরে রেখেছে। বর্তমানের অবস্থা আরো শোচনীয় । আবেশ তার থুঁতনি ঠেকিয়েছে তার কাঁধে। মাধুর্য দম খিঁচে বলল,

‘ কো..চিং..কোচিং এর সময় হয়ে গেছে।’

‘ হোক।’ আবেশ ঘোরলাগা কন্ঠে বলতেই মাধুর্স বিমূর্ত হয়ে চাদর খামচে দাঁড়িয়ে কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

‘ আজ পরীক্ষা আছে।’

আবেশ থেমে গেলো। ভ্রুকুটি করে বলল,

‘ মিথ্যা বলছো।’

‘ মিথ্যা কেন বলবো। আপনার ওই বান্ধবী কে ফোন করে জিগ্যেস করতে পারেন,যদি বিশ্বাস না হয়।’

মাধুর্যের কথায় আবেশের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়লো। ভ্রু বাকিয়ে বলল,

‘ বান্ধবী ! ‘

‘ হ্যাঁ,আপনার বান্ধবী এশা মানে এশা ম্যামের কাছে জিগ্যেস করতে পারেন। তার সাথে তো আপনার প্রায়শই কথা হয় সে আমাকে বলে।’

আবেশ সরু চোখে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো। অতঃপর থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে গম্ভীর কন্ঠেই বলল,

‘ ইউ ফিল জেলাস?’

মাধুর্য উত্তর না দিয়ে রুক্ষ কন্ঠে বলল,

‘ আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

আবেশ মাথার পেছনে হাত দিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে হাসলো। মাধুর্যের রাগ তার চোখে পড়েছে। সেই অনুভূতি দারুন। সদ্য প্রেমে,পড়া অনুভূতির ন্যায়।

কোচিং থেকে ফেরার সময় মাধুর্য দাঁড়িতে আছে রাস্তায়। তার ইচ্ছা হচ্ছে,এশা নামক মেয়েটাকে মেরে দিতে। তার বায়োলজি পরীক্ষার সময় ,পরীক্ষা হলে ঢুকে তাকে বলে গিয়েছে,আজ সন্ধ্যা সময় এহসান বাড়িতে সে যাবে।

‘যাবি ভালো কথা ! আমাকে কেন বলবি।’

এই কথাটা মাধুর্যের জিহ্বায় এসেও ফিরে গিয়েছে। আজ নাজিফার জন্মদিন উপলক্ষেই ছোট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে । মাধুর্য সেটা একটু পূর্বেই এশার মুখে থেকে শুনেছে।
তার ভেতরে কেমন অস্থির লাগছে। বাসায় অনুষ্ঠার আর তাকে কেও বলেই নি। তবে কী সে পর !
এইদিকে লতা বেগমকে আজ হসপিটাল থেকে বাসায় নেওয়ার কথা। কাল তাকে জ্ঞানশূন্য অবস্থায় রেখেই মাধুর্য বাসায় চলে এসেছিলো। হসপিটালে ইরা ছিলো তাই।
তবে এখন আবেশ তাকে নিয়ে হসপিটালে যাবে দেখেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে ।
দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্তি ধরে যাচ্ছে মাধুর্যের। বারবার হাতঘড়ি দেখছে ।
প্রায় পনেরো মিনিট পর আবেশের গাড়ি মাধুর্যের সামনে দাঁড়াতেই কয়েক পা পিছিয়ে যায় সে। গাড়ি থেকে আবেশ নামতেই খানিকটা মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ায়। মাধুর্যের রাগ করার ধরণ দেখে আবেশ মুখ ফুলিয়ে হাসলো। সেই হাসির ঝংকার মাধুর্যের কর্ণগোচর হতে মাধুর্য মুখ ফুলিয়ে বলল,

‘ হাসবেন না।’

মাধুর্যের ধমক শুনে আবেশ হাসি থামালো না। মাধুর্যের রাগের ধরণ অদ্ভুত। গাল ফুলিয়ে থাকবে তবে চোখ হাসবে। এই ব্যাপার টা বাচ্চাদের মতো।
আবেশ হাসি থামিয়ে কোনোমতে বলল,

‘ আচ্ছা..বাবা..আচ্ছা হাসবো না।’

মাধুর্য সেই কথা শুনেও ভ্রুক্ষেপ না করে উল্টো রাস্তায় পা বাড়ালো।

চলবে..

সর‍্যি ফর বিয়িং লেট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here