#ভেতরে _বাহিরে
পর্বঃ০২
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
সাজানো গোছানো বাসর ঘর অগোছালো৷ পাশেই অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে নববধূ৷ আবেশ অস্থির কন্ঠে বারবার ডাকছে৷ নিজের হাতের তালুতে মাধুর্যের হাত নিয়ে ঘষতেই বুঝতে পারলো মাধুর্যের শরীর অত্যাধিক গরম৷ লাইটের আলোতে আবেশ ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো মাধুর্য কে৷ শরীরের যে অংশটুকু বেরিয়ে আছে সেখানে কালো কালো দাগ,নয়তো রক্ত জমাট বেঁধে আছে৷ গলার ঠিক পাশেই রক্ত জমাট বেঁধে আছে৷ আবেশ চমকে উঠলো মাধুর্যের শরীরে এতো মারের দাগ দেখে ৷ হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেলেও পাশে থাকা গ্লাস থেকে মাধুর্যের মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এই মেয়ে উঠো৷ তোমার কোথায় কষ্ট হচ্ছে?’
‘ আমার হা..ত হাতে..’ মাধুর্য বিড়বিড় করে বলতেই আবেশ দেখলো একটু একটু জ্ঞান ফিরছে মাধুর্যের৷
‘ তোমার এই অবস্থা হলো কী ভাবে? এই মে..
মেয়ে উচ্চারণ করতেও গিয়েও থেমে গেলো আবেশ৷ খুব করে মনে করার চেষ্টা করলো মেয়েটার নাম৷ বিয়ের আসরে শুনেছিলো তবে একদম মনে আসছে না৷
‘ আম্মু আমি পানি খাবো৷ আম্মু পানি দেও৷ আম্মু আমি যে মারা যাচ্ছি৷’ মাধুর্য চোখ বোজা অবস্থায় অস্থির কন্ঠে বলতেই আবেশ পানি এগিয়ে দিলেও মাধুর্য আবার জ্ঞান হারায়৷ আবেশ বারবার ডাকছে ৷ হাত উঠিয়ে পুড়ে যাওয়া জায়গায় ফুঁ দিয়ে দিচ্ছে ৷ কোনো উপায় না পেয়ে মাধুর্য কে কোলে তুলে নেয়৷
আবেশ অনুভূতি শূন্য৷ তার বিরক্ত লাগছে আবার সহানুভূতি ও হচ্ছে৷
আলতো হাতে অগোছালো বিছানায় মাধুর্য কে শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে৷
বিয়ে বাড়িতে মোটামুটি হই-চই আছে৷ ড্রয়িংরুম থেকে কথার আওয়াজ আসছে৷ আবেশ কোনো কিছু না ভেবে আড্ডার আসরে বসে থাকা ইরা কে বলল,
‘ ভাবী আই নিড টক টু ইউ ৷ ইট’স আর্জেন্ট৷ ‘
‘ বাসর ঘরে বেড়াল মারা শেষ,শালাবাবু?’ টিটকারি মেরে বলল আবেশের দুলাভাই মাহমুদ।আবেশের কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না৷ সে আবারো গম্ভীর স্বরেই বলল,
‘ ভাবী,ইট’স আর্জেন্ট৷ তুমি আসতে পারলে বলো না হলে আমি বাইরে যাচ্ছি৷ ‘
মাহমুদের কথা শুনে হাসির আসরে যোগ দিয়েছিলো ইরা৷ আবেশের থমথমে মুখে দেখে কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো৷ আবেশের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলল,
‘ বিয়ে করতে চেয়েছিলে না,কিন্তু সঠিক কাজ টা ঠিক করে ফেলেছো,তাই না? ‘
‘ আম্মাকে ডাকো ভাবী৷ ‘ আবেশ একটা রুমের দিকে ইশারা করে বলতেই ইরা সিরিয়াস গলায় বলল,
‘ এই আবেশ,কী হয়েছে বলো তো?’
‘ তুমি আম্মাকে ডেকে আমার রুমে নিয়ে আসো৷ তারপর বলছি৷ ‘
আবেশ অপেক্ষা না করে গটাগট পা ফেলে চলে গেলো৷ ইরা হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তারা যা সন্দেহ করেছিলো সেটা’ই কী হয়েছে?
_____
আবেশ থমথমে মুখে বসে আছে মাধুর্যের পাশে৷ মেয়েটা কাঁপছে৷ জ্বর এসেছে বোধহয়৷ কী জ্বালা! ওইদিকে ইরা,আম্মা কেউ আসছে না৷ দরজার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে মাধুর্যের হাত ধরে পুড়ে যাওয়া জায়গায় মেডিসিন লাগিয়ে দিলো৷ মাধুর্য নড়েচড়ে উঠছে৷ সিল্কের বেনারসি বারবার সরে যাচ্ছে মাধুর্যের শরীর থেকে।আবেশ বিরক্ত হয়ে উঠলো ৷
‘ আম্মা তো স্লিপিং পিল নিয়েছেন,আবেশ৷ ঘুমিয়ে গিয়েছেন৷’
ইরা রুমে এসে দাঁড়িয়ে বলল ৷ চারদিকে তাকিয়ে আৎকে উঠলো সে । পুরো ঘর অগোছালো ৷ খাটের মাঝ বরাবর শুয়ে আছে মাধুর্য৷ মুখ শুকিয়ে গেছে৷ ইরা অস্থির কন্ঠে বলল,
‘ ওর কী হয়েছে ? এই আবেশ ওকে তুমি মেরেছো? ‘ ইরা জলদি মাধুর্যের পাশে বসে আবারো অস্থির কন্ঠে বলল,
‘ কথা বলছো না,কেন? তুমি ওকে মেরেছো ? ছিঃ! তুমি এমনটা করবে আমি ভাবতে পারি নি,আবেশ ৷’
‘ প্লীজ,স্টপ ভাবী৷ লুক হার,ওর শরীরে নতুন পুরোনো মারের দাগ৷ কেন ? কী ভাবে ? আই ডোন্ট নো৷’
‘ মানে? ‘ ইরা অবাক চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করতেই আবেশ মাধুর্যের গলার দিলে ইশারা করে বলল,
‘ দেখো ওখানে ৷ আর হাত দেখো৷ মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছা করে পুড়িয়েছে ৷’
আবেশের কথা শুনে ইরা মাধুর্যের গলা আর হাত দেখে বিস্ময়ে পড়ে গেলো৷ মৃদু আর্তনাদ করে বলল,
‘ এতো মারের দাগ ৷’
‘ হ্যাঁ,সেটাই তো বলছি৷ কেন?’
‘ আমি জানি না আবেশ৷ মেয়েটাকে আগে সিকিউর করি৷ ওর শরীরে জ্বর৷ তুমি কাইন্ডলী আমার মেডিকেলের কিটস টা নিয়ে এসো৷’
আবেশ কথা না বাড়িয়ে দ্রুত পা ফেলে চলে গেলো৷ মেয়েটার শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন কেন? না,সে ভাবতে পারছে না ৷ তীব্র খারাপ লাগা জেঁকে ধরলো মনে ৷
_____
‘ আবেশ ওর শরীরের প্রত্যেকটা জায়গায় মারের দাগ৷ তাকে কেউ প্রতিদিন মারতো৷ ইভেন,আজকেও মারা হয়েছে৷’ ইরা রুমের দরজা খুলে সরাসরি আবেশকে সব বলতেই আবেশের কঁপালে চিন্তার ভাজ পড়লো৷ চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘ কে মারবে,ভাবী? ‘
‘ জানি না৷ তবে ও প্রচন্ড ভয় পেয়ে আছে৷ সেই সাথে শারীরিক মানসিক ভাবে উইক ৷ ‘
‘ মেয়েটাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও ভাবী ৷ ‘
‘ বাসা ভর্তি মেহমান আবেশ ৷ প্লীজ নিজের রাগ কন্ট্রোল করো৷ আর এই ইঞ্জেকশন টা রাতে পুশ করে দিয়ো ৷ আমার দোহাই লাগে তোমার ৷’
ইরা আবেশের হাতে ইঞ্জেকশন গুজে দিয়েই চলে যায়৷ আবেশ পিছু ডাকলেও না শুনে এগিয়ে যায় ৷ আবেশ দোটানায় পড়ে গিয়ে রুমে ঢুকে যেখানে তার বিবাহিত স্ত্রী আছে ৷ কে এইভাবে মারতে পারে তাকে ? তবে কী,তার বাড়ির কেউ ?
.
.
সূর্যের হালকা মিষ্টি কিরণ মাধুর্যের মুখে উষ্ণ পরশ দিতেই ঘুম ভেঙে যায় তার ৷ শরীরে হালকা ব্যথায় পিটপিট চোখে তাকিয়ে নিজেকে নতুন পরিবেশে আবিষ্কার করতেই ভড়কে যায়৷ তড়িঘড়ি করে উঠে বসতে গেলেই সামনে থেকে গম্ভীর কন্ঠে ভেসে আসে,
‘ রিলাক্স৷ হাইপার হওয়ার কিছু নেই৷ ‘
মাধুর্য আরেকদফা অবাক হয় ৷ নিস্তেজ চোখে তাকাতেই শ্যাম বর্ণের মুখের অবয়ব তার সামনে ভেসে উঠে৷ গালে থাকা চাপ দাড়ি গুলো সেই সাথে ঘন পল্লবে ঢেকে থাকা চোখের সাদা অংশের মাঝে কালো কুচকুচে একটা তিল যেন চোখ ধাঁধানো ৷ মাধুর্য অবাক চোখে একনজরে তাকিয়ে আছে৷ আবেশ অপ্রস্তুত হয়ে চেয়ারের হেলান ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ৷ গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে বলল,
‘ আমার দায়িত্ব শেষ৷ নিজের যত্ন নিজে নিতে শেখো৷ ও হ্যাঁ,শরীরের ব্যথা আছে?’
আবেশ উত্তর না পেয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।মাধুর্য ঘোরের মাঝে আছে ৷ কাল কী হয়েছে মনে করার চেষ্টা করলো ৷ সেই বিভৎস ঘটনা তারপর বিয়ের আসর,বাসর ঘরে আবেশের ব্যবহার সব কিছু মনে পড়তেই ভয়ে চুপসে যায় সে৷ অস্থির হয়ে উঠে৷ শরীরে টানটান ব্যথার অস্তিত্ব পায়৷ বেল্টের আঘাত যেন ধেয়ে আসছে তারদিকে ভেবেই চিৎকার করে বলল,
‘ মেরো না আমায়! মেরো না ৷ ছেড়ে দাও৷ ‘
আবেশ সবেমাত্র ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হয়েছে৷ মাধুর্যের এমন চিৎকার শুনে কাছে এসে বলল,
‘ কে মারবে? এই মেয়ে চিৎকার করছো কেন? থামো বলছি৷ ‘
আবেশের কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে৷ অনুনয়ের সুরে বলল,
‘ আমায় বাঁচান আবেশ ভাইয়া,বাঁচান ৷ আমার কষ্ট হচ্ছে ৷ প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে৷ ‘
‘ আমি আছি৷ এই দেখো আমি আছি৷ কিচ্ছু হবে না৷ কে মারতে চায় তোমায়,বলো আমায়!’ আবেশ নরম কন্ঠে বলতেই মাধুর্য চুপ হয়ে যায় ৷ নিজেকে স্বাভাবিক করে বসে রইলো ৷
‘ সারারাত বাসর ঘরে থেকেও কাজ শেষ হয় নি? দিন ও লাগবে না’কী ছোট ভাইয়া ? ‘
দরজার বাইরে থেকে ভেসে আসা কন্ঠে আরো বিরক্ত হলো আবেশ। হুংকার দিয়ে বলল,
‘ ফাজলামো করবি না ৷ ভাগ এখান থেকে ৷ ‘
নাজিফা দরজার বাইরে থেকে বড় ভাইয়ের উদ্দেশ্য আরো কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই থামিয়ে দেয় তাদের আম্মা মাহফুজা হাসনেয়াত।দরজার বাইরে থেকেই আবেশের উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ বউকে নিয়ে এসো আবেশ। একটু পর তাদের বাড়ির উদ্দেশ্য যেতে হবে আজ। নিয়ম আছে।’
আবেশ হাতে রাখা তোয়ালে ছুড়ে মেরে বলল,’ সব কিছু আমার উপর চাপিয়ে দেও কেন,আম্মা? ‘
‘ আবেশ যা বলেছি তাই করো।’
আবেশ রাগে আজও লাথি মারলো পাশে থাকা ল্যাপটপ ডেস্কে। মাধুর্য সব শুনে ভেতর থেকে কেঁপে উঠলো। চেনা ভয়ে কেঁপে উঠলো মন।কাঁপা কন্ঠে বলল,
‘ আমি যাবো না,আবেশ ভাইয়া।’
আবেশ অবাক চোখে তাকালো।ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ তোমার তো আনন্দ হওয়ার কথা। আমাকে জ্বালিয়ে শান্তি পাচ্ছো না ? ফাজলামো করো আমার সাথে ?’
‘ মানা করে দিন,আমি যাবো না।’
আবেশ রাগে কালকের মতো এগিয়ে যেতে চাইলেও পিছিয়ে গেলো। হাতে সদ্য উঠানো ঘড়িটা ছুড়ে মারতে ইচ্ছা করলেও মারলো না। ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বুক ভারী হয়ে উঠলো।কতোশত সৃত্মি জড়িয়ে আছে এই ছোট একটা ঘড়ির মাঝে ভেবেই ঘড়িটাকে আঁকড়ে ধরলো হাতে।
________
নিয়ম পালনের উদ্দেশ্য মাধুর্যদের বাড়ির উদ্দেশ্য আবেশ ম্যের আদেশেই যাচ্ছে। পাশে মাধুর্য গুটিসুটি মেরে বসে আছে ঘোমটা টেনে। আবেশ একনজর তাকিয়েও চোখ ফিরিয়ে নিলো। পেছনের গাড়িতে,তার বড় আপু নাবিহা,দুলাভাই সাথে
নাজিফা আছে।আবেশের সব কিছু বিরক্তি লাগছে। রাগে দপদপ করছে মাথা । ইচ্ছা হচ্ছে সব ভেঙে গুড়িয়ে দিতে। হাই স্পীডে ড্রাইভ করছে সে । মাধুর্য চুপ করে বসে আছে তার কোনো ভাবান্তর নেই।গাড়িটা এক্সিডেন্ট করুক আর সে মারা যাক এইটা বারবার চাইছে সে। কিন্তু সেই ইচ্ছা পূরণ না হয়েই তারা পৌছে যায় মাধুর্যদের বাড়িতে।মাধুর্য গাড়ি থেকে নেমেই ভয়ে শিউরে উঠে।বাসার ভেতর প্রবেশ করেই আবেশকে হুট করেই জড়িয়ে ধরে ভয়ার্ত গলায় বলল,
‘ আমাকে নিয়ে চলুন…নিয়ে চলুন না,প্লীজ… ‘
চলবে…
[ সবাই বলবেন কেমন হয়েছে। রহস্যের জট খুলবে আস্তেধীরে।ভালোবাসা নিবেন সবাই❤️]