#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:১৭
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
মাধুর্য কাঁপছে। তার শরীর কম্পয়মান।ঠোঁট অনবরত কেঁপে কেঁপে উঠছে।লাল হয়ে উঠেছে গাল।অগোছালো চুল গুলো দোল খাচ্ছে গালের পাশে।চোখে টলমল করছে অশ্রুবিন্দু।
জানালার বাইরে টুপটাপ ঝড়ছে বৃষ্টিবিন্দু।মাধুর্য বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ইরা চিঠিটা দিয়ে গিয়েছে অনেকটা সময় আগেই। সেই সাত বছর আগে যেমন অনুভূতি হয়েছিলো আজও অনুভূতিটার প্রগাঢ়তা আছ।কিন্তু অভিমানের পাহাড় সুউচ্চ। মাধুর্য ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো বারান্দার দিকে। তার বুকে কেমন ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে।
বৃষ্টিতে ভিজে আছে বারান্দা।সবুজ পাতা গুলো চকচক করছে বৃষ্টিতে ভিজে। মুক্তোর মতো ফোঁটা গুলো জ্বলজ্বল করছে ডগায় ডগায়।দিনের আলো বিলীন হচ্ছে আঁধারের কাছে। ধূসর রঙে ছেয়ে আছে প্রকৃতি। ব্যস্ত রাস্তায় হাজার মানুষের ছুটোছুটি। মাধুর্যের তাড়া নেই! সে নীরস দৃষ্টিতে চেয়ে আছে চারভাজ করা সাদা পৃষ্ঠার দিকে।তার অনুভূতি আজ শূন্যের কোঠায়। জাগ্রত হচ্ছে না অনুভূতি। শুধু মনে হচ্ছে,এমনটা হওয়ার ছিলো,তাই হচ্ছে! তবে আবেশের প্রতি অভিমান একদম কমছে না আর সেটা কমার ও নয়!
মাধুর্য ধীর হাতে খুললো কাগজের ভাজ। আজও রজনীগন্ধার সুবাস ভেসে এলো চিঠির ভাজে থেকে ঠিক যেমনটা সাত বছর আগেও পেয়েছিলো মাধুর্য। মাধুর্য কাঁপা হাতেই চিঠি উঁচিয়ে চোখ বুলালো। সেখানে স্পষ্ট ভাষায় লেখা,
মাধবীলতা,
আমার মাধবীলতা! যে ডাকটা ডাকার অধিকার আমি অনিশ্চিত কালের জন্য খুইয়েছি।আমার ভুল গুলো ক্ষমাযোগ্য না,আমি জানি।আমি অপরাধী আমার মাধবীলতার চোখে।যে চোখে আমার জন্য একরাশ ভরসা আর একরাশ শ্রদ্ধা দেখতে পেতাম সেই চোখে আজ আমি ভয় আর অভিমান দেখতে পাচ্ছি।
আমি অপরাধী! আমি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি।তবে আমি জানি আমার মাধবীলতা আবার হাসবে। সে আবার আমায় ভরসা করবে।আমি অপেক্ষায় আছি,থাকবো।
ইতি,
তোমার অভিশপ্ত জীবনের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো একজন ঘৃণ্য অপরাধী।
মাধুর্য চিঠিটা নিয়ে বসে পড়লো বারান্দায় রাখা বেতের মোড়ার উপর।আবেশের লেখা প্রতিটা কথার ভাজে তার অপরাধবোধ প্রকাশ পাচ্ছে। তবে মাধুর্য বিষাক্ত স্মৃতি ভুলতে পারছে না। তার জীবনের নয়টা বছর কেটেছে অন্ধকারে।সেখানে একরাশ আশার আলো ছিলো আবেশ! সেও তাকে তার আব্বু আর রাব্বীর মতো ভুল বুঝেছে। ছুড়ে ফেলতে চেয়েছে। এতো সহজে সব কি ভুলে যাওয়া সম্ভব!
না,সে ভুলবে না! আর ক্ষমাও করবে না তাদেরকে যারা তার প্রতিটা মুহূর্ত বিষাক্ত করে তুলেছিলো।সে সব সত্য বের করবে। তার মা মেহরুন কোথায়! কী জন্য হারিয়েছে সব বের করবে। নিজের প্রতি হওয়া প্রতিটি দিন,প্রতিটি ক্ষণের অন্যায়ের হিসেব চাইবে। সবার কাছে চাইবে!
___________
নাজিফা রবীন্দ্রসংগীত ছেড়ে বই নিয়ে বসে আছে মাধুর্যের কাছে। তার চোখেমুখে উঁপচে পড়ছে চিন্তার ছড়াছড়ি। মাধুর্য নিজেও চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। বারবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। তার হ্ঠাৎ করেই অস্বস্তি হচ্ছে। সেটা আবেশ কে না দেখার জন্যই কী? সেটা সে উপলব্ধি করতে পারছে না বরং চাইছে না।
একবার বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় যাচ্ছে তো আরেকবার বিছানায় এসে বসছে। নাজিফা পড়া ছেড়ে আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে মাধুর্যের দিকে। মাধুর্যের অস্থিরতা দেখে বিরাট এক হাসি দৃশ্যমান হয় তার ঠোঁটের কিনারায়। কলম কামড়ে রসিকতা করে বলল,
‘ ভাবী.. কাওকে খুজছো!’
মাধুর্য আবারো দরজার দিকে তাকালো। নাজিফার কথা শুনে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে বলল,
‘ ক..ক.কই না তো! তুমি পড়ো। কাল না তোমার পরীক্ষা!’
‘ আমি জানি,সব জানি।’
‘ কী জানো?’ মাধুর্য স্থির ভাবে বসে প্রশ্ন করলো। নাজিফা মুখে জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব এনে বলল,
‘ তুমি খুব করে চাইছো ছোট ভাইয়া আসুক,তাই না?’
‘ একদম না! আমার শরীর ব্যথা করছে সারাদিন শুয়ে বসে থেকে। তাই হাটছি। বাইরে বের হলে আম্মু’মা বকবে তাই যাচ্ছি না।’
‘ কিন্তু তোমার চোখমুখ অন্য কথা বলছে।’ নাজিফা এক ভ্রু উঁচু করে বলল । মাধুর্য সাথে সাথে চোখেমুখে হাত দিতেই নাজিফা উচ্চস্বরে হাসলো। সাথে সাথেই মুখে হাত দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে নিজে বলল,
‘ হুশশ! নাজিফা।সন্ধ্যার পর এতো জোরে হাসলে ভুত আসবে।’
মাধুর্য নাজিফার কথা শোনে তাকালো।এতো বড় মেয়ে ভুতে ভয় পায় দেখে হাসলো মনে মনে।তবে সেও ভয় পেতো সত্যিকারের ভুতদের দেখে। যারা ছিলো হিংস্র,জালেমের মতো অত্যাচার করা ব্যক্তি।
মাধুর্যকে অন্যমনস্ক দেখে নাজিফা শাসনের সুরে বলল,
‘ ভাবী তুমি না হাসলে ছোট ভাইয়া মারবে আমাকে।’
‘ মারবে কেন।’
‘ যাবার আগে আমাকে বলে গেছে,
এই নাজিফা,তোর ভাবীকে একা রাখবি না।ও যেন হাসিখুশি থাকে সেই দায়িত্ব তোর।সারাদিন এতো বকবক করিস সেই বকবক যদি আজ কাজে না লাগে! কাল তোকে ধরে এলাচি পাগলের ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবো।’
নাজিফা পুরো আবেশের মতো বলল।একহাত উঁচিয়ে। মাধুর্য হেসে ফেললো নাজিফার মুখভঙ্গি দেখে।নাজিফা হাফ ছেড়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে বলল,
‘ এইভাবেই হাসো।তোমার হাসিতে মধু আছে আম্মা বলে। দেখলে তার প্রশান্তি হয়।’
মাধুর্যের মনে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো।তার আম্মু’মা তাকে ছুড়ে ফেলে নি। তাকে সব সময় সমান ভাবে ভালোবেসে গেছে ভেবে শান্তি লাগছে তার। সম্পত্তি পেয়ে ভুলে যায় নি তাকে। যখন তাকে পেয়েছে নিয়ে এসেছে তার কাছে।বেইমানী করে নি।এইটা সবচেয়ে বড় পাওয়া মাধুর্যের।
‘ বুড়ি আমাকে তো ভুলেই গেছিস।’
এক অতি পরিচিত কন্ঠস্বরে মাধুর্য চমকে তাকায়। পায়ে ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় ইরার হাত ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফয়েজ।মুখে তার স্পষ্ট হাসি। মাধুর্য উঠে দৌড়ে গেলো ফয়েজের কাছে। ফয়েজের সামনে গিয়ে বলল,
‘ ফাজ ভাইয়া! আমার ফাজ ভাইয়া।কতোদিন পর।ভাইয়া আমি মাধুর্য তোমার বুড়ি মনে আছ?’
ফয়েজ হাসলো। ইরা বেশ অবাক হচ্ছে। তবে মাধুর্যের উৎফুল্লতা যেন তাকে খুশি দিচ্ছে। মেয়েটা হাসি লুকিয়ে রাখে। কেমন গুমরে মরে।
‘ না মনে নেই।আমি আসার পর দেখা করতে গিয়েছিলি তুই?’
‘ ও অসুস্থ ফয়েজ।’ ইরা রাগ করে বলল। ফয়েজ নিজেক পকেট থেকে চকলেট বের করে মাধুর্যের হাতে দিয়ে বলল,
‘ আমাদের ভাই-বোনের ব্যাপার। বাড়ির বউয়ের এন্ট্রি চলবে না এখানে। যাও ফুটো।’
‘ আচ্ছা,চলে যাচ্ছি।’ ইরা ফয়েজের হাত ছাড়িয়ে দিতেই ফয়েজ ভয় পেয়ে বলল,
‘ করছো কি! মেরে টেরে দিবে না-কি।’
‘ তুমি’ই তো বললে চলে যেতে।’
ইরার সোজা জবাব। মাধুর্য হাসছে তাদের কথা শুনে।চকলেট দুই হাতে ভর্তি। ঠিক ছোট বেলার মতো। ফয়েজ তার আর নাবিহা আপুর জন্য চকলেট আনতো।কতো আনন্দকর মুহূর্ত ছিলো সেইসব দিন।
মাধুর্য মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বলল,
‘ আমাকে কখনো মনে পড়ে নি ফাজ ভাইয়া?’
‘ এইযে তুই ফাজ ভাইয়া বলছিস সেই ডাক আমি মনে করেছি। ছোট মাধুর্য নাম উচ্চারণ করতে হিমশিম খেয়ে আমায় ফাজ ভাইয়া বলতো। বহুকাল এই ডাক শুনি নি। আমি তো প্রায়শই আম্মাকে নিয়ে তোকে খুজতে রুপগঞ্জ যেতাম। কিন্তু কোথাও পাই নি রে!’
মাধুর্য আরেকদফা অবাক হলো। তার বাবা শাহেদ আর রাব্বী যে ইচ্ছা করেই তাকে আটকে রেখেছিলো এইটা বেশ বুঝতে পারলো মাধুর্য।
মাধুর্যের মাথায় ফয়েজ হাত বুলিয়ে বলল,
‘ আমি আছি মাধু। তোর ফাজ ভাইয়া তোর সাথে আছে। সব শুনেছি আমি। মেহরুন আন্টিকে খোজার দায়িত্ব আমার। আর শাহেদ আঙ্কেল আর ওই ছেলেটাকে আমি জাস্ট মেরে দিবো।’
‘ মারতে হবে না ফাজ ভাইয়া। আমি শুধু জানতে চাই আমার মা কোথায়! রাব্বী আমাকে কেন মারতো! আমার বাবা কেন আমাকে মারতো।’
‘ সব জানা হবে।আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি।শুধু তুই ভয় পাবি না মাধুর্য।’
মাধুর্য কিছু বললো না। সে জানে ফয়েজ আর্মিতে আছে এবং ভালো একটা পোস্টে আছে। নিশ্চয় রাব্বীর থেকেও শক্তিশালী। ফয়েজ নিশ্চয় পারবে কারণ উদ্ধার করতে!
মাধুর্য আজ ভয় পাচ্ছে না। তার ইচ্ছা হচ্ছে মেহরুনকে খুজে বের করতে।তার প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিচার চাইতে।সে পারবে! অবশ্যই পারবে!
_______
দেয়ালের ঘড়িটা নিয়মমাফিক সময়ের কাটা টেনে নিয়ে চলছে। রাত বাড়ছে।নিশুতি শক্তি গ্রাস করে আছে সর্বদিক। মাধুর্যের টেনশনে হাঁত-পাঁ কাঁপছে। সে কাওকে জিগ্যেস ও করতে পারছে না আবেশ কোথায় গিয়েছে। ঘুম নামক শব্দটা ধরা দিচ্ছে না তার চোখে। ফয়েজদের সাথে অনেকটা সময় গল্প করেছে সে। মনের ভেতরের বিষাক্ত কিছু বিষাক্ত কিছু অধ্যায় আজ দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে৷ তবে আবেশ কোথায়? নাজিফা ঘুমোচ্ছে পাশে৷ মাধুর্য থাকতে না পেরে ডাক দিলো নাজিফাকে৷ নাজিফা মাধুর্যের ডাক শুনে হুড়মুড় করে উঠে বসে বলল,
‘ কী হয়েছে!কোথায় হয়েছে! ভুত এসেছে? তুমি ভয় পেয়েছো!’
‘ কিছু হয় নি৷’
‘ তাহলে!’
‘ ওনি কোথায় গিয়েছে!’ মাধুর্য থম মেরে বসে থেকে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল ৷ নাজিফা ঘুম চোখেই অবাক হয়ে বলল,
‘ আমাদের বাসায় ওনি নামের কেউ তো নেই!’
‘ ওনি মানে তোমার ছোট ভাইয়া৷’
মাধুর্যের কথা শোনে নাজিফা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো ৷ হুট করেই পেট চেপে হাসতে হাসতেই বলল,
‘ তোমার জামাই মানে ওনি মানে আমার ভাই ঢাকা এয়ারপোর্টে গিয়েছে বাবাকে আনতে৷’
নাজিফার কথা শুনে স্বস্তি পেলো মাধুর্য ৷ রাব্বীকে নিয়ে ভয় হয় তার৷ যদি আবেশকে কিছু করে এই ভয়ে কুঁকড়ে থাকে সে ৷ নাজিফা নিজের গায়ে কাথা টেনে বলল,
‘ ঘুমিয়ে পড়ো ভাবী! তোমার ওনি জানতে পারলে আমায় মারবে৷’
মাধুর্য শোয়ার জন্য যেতেই করুন স্বরে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে৷ ধড়ফড়িয়ে উঠে নাজিফা৷ মাধুর্য ভয় পেয়ে যায় ৷ মানুষটা এমন ভাবে কাঁদছে মনে হচ্ছে কোনো আত্মা কাঁদছে৷ মাধুর্যের হার্টবিট বেড়ে গেলো কয়েকশত গুণ ৷ নাজিফা চিৎকার দিতে গেলেই মাধুর্য নিজেকে সামলে বলল,
‘ চিৎকার দিয়ো না নাজিফা৷’
‘ ভাবী..বী ভু..ত ভুত৷’
‘ ভালো করে শোনো নাজিফা! এইটা কোনো মানুষের কান্নার আওয়াজ৷’
নাজিফা শান্ত হলো না৷ তরতর করে ঘামছে৷ এর আগেও সে একদিন শুনেছিলো এই আওয়াজ ৷ মাধুর্য খুব মনোযোগ দিয়ে আওয়াজ শুনে বলল,
‘ ডান পাশের প্রথম রুম কার নাজিফা?’
নাজিফা কাথা মুড়ি দিয়ে বসে ছিলো৷ মাধুর্যের কথা শুনে কাথার ভেতর থেকে মুখ বের করে বলল,
‘ ওইটা নাবিহা আপুর রুম৷’
‘ আজ আপু এসেছে তাই না?’
‘ হ্যাঁ মাঝেমধ্যেই আসে৷ কখন আসে কখন যায় জানি না৷ ভাবী আমি আম্মার কাছে যাবো আমার ভয় লাগছে৷’
মাধুর্য চিন্তিত ৷ তার চোখেমুখে উঁপচে পড়ছে চিন্তা৷ তার জানামতে নাহিবার এমন কোনো কষ্ট নেই যার জন্য এইভাবে কাঁদবে সে! তবে কান্না টা নাবিহার৷ মনোযোগ দিয়ে শুনলে বুঝা যায়৷ কেন কাঁদছে মানুষটা?
চলবে..
[ কেন কাঁদছে অবশ্যই জানবেন৷ বলেছিলাম না রহস্য খুলবে আজ থেকে৷ এইটা প্রথম রহস্য৷ এর পরের প্লট যেভাবে তখন সেভাবেই জানবেন কান্নার কারণ৷ যারা বলেন,শেষ করেন শেষ করেন! আমার গল্পের যখন পরিপূর্ণ পরিণতি আসবে তখন আপনারা না বলললেও আমি ইতি টানবো]