#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:১৫| #পরবর্তী_অংশ |
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
আবেশ শক্ত হাতে ঘুরিয়ে নিলো মাধুর্যকে। তার বুকের উপর মাধুর্যের পিঠ ঠেকিয়ে মাধুর্যের হাত ছেড়ে দিয়ে শক্ত করেই জড়িয়ে ধরলো তাকে।আবেশের উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে মাধুর্যের ঘাড়ে। মাধুর্য বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে আছে। তার শ্বাস ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসছে। আবেশের মতিগতি একদম বুঝতে পারছে না,মাধুর্য! আবেশের একটু আগের রাগ আর এখনকার রাগ ধরতে পারছে না সে। তবে আবেশের হাতের বাঁধন কেমন আড়ষ্টভাব এনে দিচ্ছে মাধুর্যের মাঝে। তীব্র শিরশিরে অনুভূতি গ্রাস করছে ভেতরে।
মাধুর্য চোখ বন্ধ করেই কাঁপছে। আবেশের হাত তখন তার পেটের মাঝামাঝিতে। আবেশ স্তব্ধ,নির্বাক!
মাধুর্য চোখ বন্ধ করেই আবেশের আগের বলা চিঠির কথা মনে করলো। তার কাছে আবেশ আবার চিঠি দিয়েছিলো! তবে সেটা কোথায়? আর যদি দিয়েও থাকে সেই চিঠির উত্তর কে দিয়েছে!
আবেশের কোনো ভাবান্তর নেই। তার গরম নিঃশ্বাস ভারী ঠেকছে তার কাছে। ওইদিলে ক্রমাগত কম্পয়মান মাধুর্যের মধ্যকার ভাব বুঝতে পারলো না সে। আবেশ তার ভেতরকার রাগ দমানোর চেষ্টায় আছে! মাধুর্য আবেশের হাতের উপর থেকে নিজের হাত সরিয়ে ফেলে বলল,
‘ আপনি ঠিক আছেন!’
আবেশ উত্তর দিলো না। নীরব ভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো মাধুর্যকে ধরে। আকাশে তখন মেঘ জমেছে। চাঁদ লুকিয়ে পড়ছে মেঘের আড়ালে। আবেশ নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগ সংযত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তার মাথায় মাধুর্যের বলা সাত বছর কথাটা ঘুরছে! তারমানে মাধু এর পরের চিঠিটা পায় নি। তবে,সেই চিঠির উত্তরে জঘন্য কথা গুলো কে লেখেছিলো!
আবেশ ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করলো। রাগ হলে সব এলোমেলো লাগে তার কাছে। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে উঠে। স্বাভাবিক কথা অস্বাভাবিক লাগে। এইজন্য নিজের রাগ থামানোর চেষ্টার জন্য মাধুর্যকে ঘুরিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে সে। তবে মাধুর্যকে বুঝতে না দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে জিগ্যেস করলো,
‘ ছয় পাতার চিঠিটা তুমি রিসিভ করেছিলে,তাই না মাধুর্য?’
আবেশের কথায় ঘুরে তাকানোর চেষ্টা করলো মাধুর্য। কিন্তু পারলো না। তবে গলায় জোর এনে বলল,
‘ আপনার দেওয়া শেষ চিঠি পেয়েছিলাম ২০০৫ সালের আগষ্টে।এর পর আমার কাছে কোনো চিঠি যায় নি! না আমি কোনো চিঠির উত্তর দিয়েছি।’
‘ তবে…
‘ কী তবে! বলুন আবেশ। আমার জীবন তো নাটকীয়। এখানেও না হয় আরেকটু নাটক হোক।আমি মেনে নিবো,গুছিয়ে নিবো। আবার ভাঙ্গবো তবে মরবো না। কারণ,সবার মৃত্যু থাকলেও দুঃখের সাগরে ভাসমান ছেড়া পাতা ভাসে তারা ডুবে না। ভাসতে ভাসতেই তীরে গিয়ে ঠেকে আবার কারো পায়ে দুমড়ে মরে।’
মাধুর্যের কথার রেশ আবেশের কান অবধি পৌছালেও সে চুপ করে আছে। হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছে।চট করে কিছু একটা মনে হতে মাধুর্যকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ তুমি এতো বোকা কেন,মাধুর্য!’
আবেশের এমন কথায় থতমত খেয়ে যায় মাধুর্য।ভ্রু জোড়া খানিক বাঁকিয়ে ফেলে।অবাক হয়েই বলল,
‘ বোকা!’
‘ অবশ্যই বোকা! তোমার উচিৎ ছিলো প্রথম দিন সব বলা।’
‘ আপনি সেই সুযোগ দিয়েছিলেন?’
‘ সুযোগ করে নিতে হয়! এইজন্যই তুমি বোকা। আর আমি চিঠির কথা বলার সাথে সাথে তুমি সব বললে আমার রাগ দেখতে হতো না তোমায়।’
‘ আপনি কী বলছেন,আবেশ! আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
মাধুর্য গলার খাদ নামিয়ে বলল। আবেশ তার হাতের বাঁধন আলগা না করে আরো শক্ত করে ধরলো।রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
‘ তুমি যদি আমার দেওয়া ২০০৬ এর চিঠি না পেয়ে থাকো তাহলে নিশ্চয় সেটা অন্যকেউ পেয়েছে! আর সেই চিঠি যে পেয়েছে সে গেম খেলেছে আমার সাথে।তুমি হয়ে আমাকে ভুল বুঝিয়েছে।’
মাধুর্য চুপ করে শুনছিলো আবেশের কথা। যে চিঠি সম্পর্কে সে জানে না তাই আগ বাড়িয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার মতো কাজটা করতে তার একদম ইচ্ছা হলো না। চুপ করে রইলো আবেশের হাতের বাঁধনের কাছে। আবেশ নিজ মনে সব ভাবছে। তার দৃষ্টি সামনে। যেখানে সব কিছু ধোঁয়াটে আবার খোলা জানালার মতো। তবে দীর্ঘতর ভুল বুঝে মাধুর্যের জন্য জমানো রাগ,অভিমানের পাহাড় হ্ঠাৎ করেই ভেঙ্গে যেতে শুরু করলো। কে দিয়েছে সেই চিঠি! তবে যে দিয়েছিলো তাকে সামনে পেলে মাটিতে পুঁতে ফেলবে সে।
এতো জঘন্য ভাবে মাধুর্য হয়ে তার কাছে চিঠি লেখেছিলো যার জন্য মেয়েটাকে সে কতোকিছু বলেছে। এইসব ভেবে নিজের প্রতি তীব্র রাগ জমা হলো তার। একটু ঠান্ডা মাথায় সব ভাবলেই পানির মতো স্বচ্ছ হয়ে যেত তার সামনে।
মাধুর্য যেখানে পদে পদে নির্যাতিত হয়ে গুমরে মরছিলো সেখানে এইসব চিঠি দেওয়া তার সাধ্যের বাইরে। আবেশ সব ঠান্ডা মাথায় ভেবে নিজস্ব অপরাধবোধে শিউরে উঠলো। হাত গুলো গুটিয়ে নিয়ে সরে দাঁড়ালো মাধুর্যের থেকে। মাধুর্য স্থির দাঁড়িয়ে আছে। আবেশের দিকে তাকাতেই আবেশ শান্ত চোখে তাকিয়ে ভেতরে যাওয়ার জন্য পাঁ বাড়িয়ে বলল,
‘ সব কিছুর ভেতরে জঘন্য একটা মিথ্যা আছে মাধুর্য! যেই মিথ্যার আড়ালে হারিয়েছিলাম আমি। তবে কথা দিচ্ছি,দিনের প্রস্ফুটিত আলোর মতো রঙিন হবে তোমার জীবন। আর মিথ্যা গুলো টেনে বের হবে রাতের অন্ধকারে।’
মাধুর্য অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । একটু আগে এতো রাগ হ্ঠাৎ করে উধাও হলো কী করে?
তবে আবেশ যে বরাবর ঠান্ডা মাথার মানুষ যেটা বেশ জানে মাধুর্য।বহুদিন পর আবারো সেই আবেশকে দেখতে পাচ্ছে মাধুর্য!
_________
পূর্ব আকাশে রঙটা আজ কমলা রঙ ধারণ করেছে। সরু সাদা মেঘের বিন্দু বিন্দু টানা রেখা আবছা হয়ে কমলা রঙে মেতেছে। পাখির কলতানে বিভোর প্রকৃতি। আজকে ঘুম ভেঙ্গেই আবেশ উঠে দেখলো মাধুর্য তার দিকেই তাকিয়ে আছে। খাট থেকে সোফা বিশেষ একটা দূরে নয়। মাধুর্যের এমন চাউনিতে ভড়কে গেলো আবেশ। কাল রাতে সে সোফায় শুয়েছিলো। তবে সকাল সকালে মাধুর্যের এমন অন্য ধরণের চাউনি দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো তার। আড়মোড়া ভেঙে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘ কী হয়েছে!’
‘ আমি স্বপ্ন দেখছি!একটু পর ঘুম ভাঙবে,তাই না?’
মাধুর্যের এলোমেলো কথা শুনে আবেশ কি বলবে খুজে পেলো না। তবে মাধুর্যের চোখের নীচে কান্নার রেখা দেখতে পেয়ে রাগী সুরে বলল,
‘ কাল রাতে কেঁদেছো কেন?’
মাধুর্য উত্তর দিলো না। আবেশ ধমকে উঠলো আবার।মাধুর্য কেঁপে উঠে বলল,
‘ আমি ঘুমাতে পারি না,আবেশ। অনেক দিন ঘুমাই নি।কাল রাতে ও ঘুমাই নি।’
আবেশ কিছুটা ভড়কে গেলো। মনে করার চেষ্টা চালালো সে উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে কী’না? কাল রাতে চিঠির ব্যাপার টা সে ঠান্ডা মাথায় বুঝে নিতেই মাধুর্যকে দোষী ভাবার জন্য অনুতপ্ত হয়ে আছে ।সেই চিঠিটা নিশ্চয় কোনো কলুষিত ব্যক্তি দিয়েছিলো। না হলে অতোটুকু একটা মেয়ের নামে এতো জঘন্য কথা কীভাবে লেখে?
আবেশ উঠে দাঁড়ালো।মোলায়েম কন্ঠে বলল,
‘ মাধুর্য..’
‘ আবেশ আজ আমি বলবো আপনি আজ শুনবেন।আপনি এতো সহজে আমাকে বিশ্বাস করে নিবেন আমি কখনো কল্পনা করি নি।’
মাধুর্যের কথায় আবেশের কেমন অসহায় লাগছে। ওই এক পৃষ্ঠার চিঠি পড়ে সে মাধুর্যকে মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টায় মত্ত্ব ছিলো।মাধুর্য ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,
‘ আমি ভাবতাম সব ভুল আমার! কিন্তু সব ভুল আমার নয়। সবাই নিজেদের মতো আমাকে ভুল বুঝে,আবেশ। যেখানে আপনি নিজেও আমাকে ভুল বুঝে ছিলেন এতো বছর।’
‘ চিঠির লেখা আমি তোমার ভেবে ভুল বুঝেছি,মাধু।’
‘ কেন বুঝেছেন ভুল? সবাই কেন আমাকে ভুল বুঝে।সবার নিজেদের মতো ভাবা ভুল আমার উপর চাপিয়ে আমাকে দোষী করে। আমি ভাবতাম আমার আবেশ ভাইয়া আমাকে কখনো ভুল বুঝবে না। কিন্তু সেই আপনি নিজেও আমাকে ভুল বুঝে ছিলেন।’
আবেশ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে থাকা মানবীটির হাহাকার তার ভেতর দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। আবেশ এগিয়ে যেতে চাইলে মাধুর্য তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আসবেন না আমার কাছে! একদম আসবেন না।প্রথম যেদিন আপনার নাম শুনেছিলাম বিয়ের আসরে তখন আমি জানতাম আপনিই আমার আবেশ ভাইয়া। যার কাছে আমার ভরসা,আমার ভালোথাকা। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।শরীরে ব্যথা নিয়ে ঘোমটা টেনে বসে ছিলাম।যখন আপনি রুমে এসেই আমাকে টেনে নামাতে চাইলেন খাট থেকে তখন আমার সমস্ত ভাবনা ভুল হয়। কারণ আমার আবেশ ভাইয়া আমার নাম শুনে কখনো আমাকে ছুড়ে ফেলতে পারবেই না। কিন্তু আপনি ছুড়ে ফেলতে গিয়েছিলেন। আমি যখন বারবার বলছিলাম,আমায় স্পর্শ করবেন না আমার শরীরে ব্যথা। তখন আপনি আমার কাছে কারণ জিগ্যেস করতে চান নি কারণটা।বরং আমায় টেনে নীচে নামিয়েছে পুড়ে যাওয়া হাত ধরে। তখন আমার সামনে দাঁড়ানো আবেশ ভাইকে আমি চিনতে পারছিলাম না। এক মুহূর্তে ভেবে নিয়েছিলাম আপনি হয়তো অন্যকেউ। কিন্তু না! আপনি আমার আবেশ ভাই ছিলেন। যে আমার পরিচয় পেয়েও অহেতুক কারণে আমাকে শাসিয়ে গেছে। কাল যখন কারণ জানতে পারলাম তখন আমার কী ইচ্ছা হয়েছিলো জানেন?
ওই বারান্দা থেকে লাফিয়ে মরে যাই। চিঠিটা আমি দিয়েছি কী’না সেটা আমাকে না জিগ্যেস করেই আমাকে ভুল বুঝে ছিলেন। কেন? আমি মাধুর্য বলে? আমার মা বেইমানি করেছে,আব্বু পরিবর্তন হয়ে আমার যম হয়েছে। কী কারণ! যেটা আমি জানিও না। আমিই কেন সব সহ্য করবো?
আমি আর সহ্য করবো না। চাই না আমার সম্পত্তি। চাই না কারো মিথ্যা ভালোবাসা। আমি মুক্তি চাই। মুক্তি চাই এই জীবন থেকে।’
বলেই মাধুর্য উঠে দাঁড়ালো। আবেশ মাথা নীচু করে সব অভিযোগ শুনছিলো। তার অপরাধ সবচেয়ে বেশি এখানে। সে কেন আগে সব মাধুর্যকে কিছু জিগ্যেস করে নি?
‘ আবেশ,আপনার জীবনে আসার জন্য আমি খুব করে চাইতাম। আপনার সেই চিঠি পাবার পর থেকে চাইতাম।তবে যে মানুষটা আমায় ভুল বুঝে অবিশ্বাস করে গেছে তার জীবনে আমি আর থাকতে চাই না। মাধুর্য চলে গেলে সব স্থির হয়ে যাবে।আমি চাই চলে যেতে! সেই সাত আসমানে।’
শেষের কথাটুকু শুনে আবেশ চমকে তাকালো। মাধুর্য খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।আবেশের বুকের ভেতর কেঁপে উঠে। আজ মাধুর্য হাসছে।ভুবনমোহিনী মনকাড়া সেই হাসি। হাসতে হাসতেই বলল,
‘ আপনার জন্য সারপ্রাইজ আছে,আবেশ। আপনার জীবনের সেরা সারপ্রাইজ।’
চলবে…
[ কালকের পর্বের এই অংশ! কাল লেখতে পারি নি এতোটুকু তাই দিই নি। আর অনেকে না,পড়েই কতোকিছু বলে দিলেন]