ভেতরে বাহিরে পর্ব-১৫

0
1632

#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:১৫
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
আবেশের গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে মাধুর্যের বোজে থাকা চোখের উপর। চাঁদের আলো বারান্দায় লুটিয়ে পড়ছে। নরম কোমল আদর মাখছে প্রতিটা পরশে। মাধুর্র নির্বাক! সে কী বলবে খুজে পাচ্ছে না। মাথার মধ্যে ঝেঁকে আছে হাজারো বিষাদের ছায়া । এই মুহূর্তে আবেশের এই ধরণের ব্যবহার তার বোধগম্য হচ্ছে না।
আবেশ যেন ঘোরে আছে। তার কল্পনায় আঁকা মাধবীলতার সামনে। যার জন্য সাজিয়েছে তার ভেতরে সুখের আঙ্গিনা।
যে মাধবীলতার চোখেমুখে ছিলো চঞ্চলতা,ছিলো একরাশ মুগ্ধতা ।মাধুর্য কেঁপে উঠছে,আবেশের এতোটা ঘনিষ্ঠতার ছোঁয়া পেয়ে।কাঁপা কন্ঠেই বলল,

‘ আবে..শ…!’

আবেশের কোনো ভাবান্তর নেই। সে ঝুঁকে আছে মাধুর্যের দিকে। প্রাণভরে পর্যবেক্ষণ করছে তাকে।মনে আঁকা মাধবীলতার সাথে মেলাচ্ছে। যার চোখেমুখে ছিলো দীপ্তিময় উচ্ছ্বাস,জাম রাঙা ঠোঁটে ছিলো দুষ্টুমির হাসি।
আবেশ ঘোর লাগা কন্ঠেই বলল,

‘ কেন আমাকে নীরব আঘাত করেছিলে,মাধবীলতা!’

মাধুর্য বুঝতে পারলো না। এতোক্ষণ সে যে ভয় পাচ্ছিলো সেটার সম্ভবনা নেই দেখে ধীর কন্ঠে বলল,

‘ আঘাত!’

‘ হ্যাঁ,আঘাত। তুমি বেইমানি করেছিলে মাধবীলতা। সেই ছোট বয়সে এতোটা জঘন্য কীভাবে হয়েছিলে তুমি?’

মাধুর্য আজ চমকে উঠছে বারেবারে। সে মিথ্যা সাজিয়েছিলো! প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ আমি বেইমানি করেছি।কিন্তু কবে! আপনার সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো,আবেশ।’

আবেশের শান্ত চোখে রাগ ধরা পড়লো। শক্ত করে চেঁপে ধরলো মাধুর্যের দুই হাতের বাহু। রাগী কন্ঠে বলল,

‘ করেছো! আমাকে মিথ্যা বলেছো তুমি। আমার অনুভূতি নিয়ে প্রতারণা করেছো তুমি। ছোট বয়সে কী করে পারলে এতোটা জঘন্য হতে। বলো মাধুর্য! আমার চিঠির প্রত্ত্যুতরে তুমি কী লেখেছিলে মনে নেই,তোমার?

‘ চিঠি,কীসের চিঠির কথা বলছেন আপনি!’

‘ লাস্ট চিঠি,যেটা সাত বছর আগে আমি তোমায় দিয়েছিলাম।’

মাধুর্য বেশ অবাক হলো। সাত বছর! কথাটা বারবার আওড়ালো নিজ মনে। কিন্তু তার কাছে আবেশের সর্বশেষ একটা চিঠি গিয়েছে যেটা আটবছর আগে। তখন সে তেরো বছরের কিশোরী। আবেশের দিকে তাকিয়েই মনে করার চেষ্টা করলো সব। আবেশ নিজেও তাকিয়ে আছে মাধুর্যের দিকে। তার মনের দুয়ারে কড়া নাড়ছে সেইসব দিনের কথা। দূরে থেকেও যেন কাছে ছিলো তারা।
মনের দুয়ারে ঝলকানি দিয়ে ঊঠলো ১৯৯৯ সালের ১৯ ডিসেম্বরের স্মৃতি,
সময়টা ১৯৯৯ এর ১৯ ডিসেম্বর,চারদিকে কুয়াশার আস্তরণে ঢেকে আছে। বিশাল সাদা চাদরে মুড়িয়ে আছে রুপগঞ্জ।আবেশদের সিলেট চলে যাবার কয়েকদিনের মাথায় আবেশ চিঠি দেয় রুপগঞ্জের পোস্ট অফিসে। সেটা ছিলো নজরুলের সাহায্যে।মেহরুন থাকতে সে চিঠি নিয়ে এসে পড়ে শোনাতো মাধুর্যকে।ছোট বয়সী মাধুর্যের সবটা ঘিরে ছিলো তার মা মেহরুন আর বাবা শাহেদ।
আবেশরা সিলেট আসার পর তিন বছরের মাথায় মানে ২০০২ সালের মাঝামাঝি সময়ে মেহরুন উধাও হয়ে যায়। তার মা মেহরুন হারিয়ে যায় তখন মাধুর্য দশ বছর বয়সে পা দিয়েছে সবেমাত্র। যখন মেহরুন ছিলেন ওই তিনটে বছর চিঠি দেওয়া নেওয়া চলতো সিলেট থেকে রুপগঞ্জে।
সবটা জুড়ে ছিলো আবেশের ছোট ছোট অনুভূতি ।মেহরুন খুব হাসতেন আবেশের চিঠি পড়ে। তার ধারণা ছিলো,আবেশ তার মেয়েকে ভালোবাসে,যত্ন করে। মেহরুন কখনো খারাপ নজরে দেখে নি সেই সম্পর্ক। বাচ্চামো ঘিরে থাকা সম্পর্কটা ছিলো মধুর।
আর চিঠির উত্তর ছোট মাধুর্য নিজ হাতে লেখে দিতো। যেখানে ছিলো শুধুই বাচ্চামো কথার ছড়াছড়ি। আবেশের চিঠিতে সুন্দর গোছানো কথা।মাধুর্যের জন্য উপদেশ।
আবেশ বরাবর গোছালো ধাঁচের ছেলে ছিলো।সে চিঠি দিতো খোজ খবর নেওয়ার জন্য। তখনো তার ভেতরে অনুভূতি শূন্যের কোঠায়। মাথায় চলতো,মাধুর্য ছোট বাচ্চা একটা মেয়ে। যার সঙ্গে আত্মিক একটা সম্পর্ক বেঁধে গিয়েছে সে।
প্রতিটা চিঠি দেওয়ার পনেরো দিনের মাথায় তিনটে বছর মাধুর্যের চিঠি আসলেও পরবর্তিতে হ্ঠাৎ করেই ইতি ঘটে মেহরুন হারিয়ে যাবার পর।
একের পর এক চিঠি টানা দুই বছর দিয়েও উত্তর পায় নি আবেশ।একেকটা চিঠি দেওয়ার পর কলেজ ছুটির পর বসে থেকেছে পোস্ট অফিসে গিয়ে। তবে তার আশায় পানি ঢেলে দিতো প্রতিবার। তবুও সে চিঠি দিতো মাধুর্যকে। থেমে থাকে নি কখনো। একরাশ একাকীত্ব ঘিরে ধরে আবেশকে তখন।
মাথায় ঘুরেফিরে বেড়ানো শুরু করে মাধুর্যকে তার চাই। যে কোনো উপায়ে তার মাধুকে চাই। তার আম্মা মাহফুজার কাছেও কোনো খোজ ছিলো না মাধুর্যদের। তবে,থেমে থাকে নি আবেশ। একের পর এক চিঠি দিতো প্রতি বছর! প্রতিটা সময়।
একটু খোজ নেওয়ার জন্য। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কেটে যায় তিনটে বছর। কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিতে পা দিয়েছে আবেশ। হাজার হাজার মেয়ের ভীড়ে তার চোখ আটকে থাকতো মাধুর্যের টানা চোখ,জোড়া ভ্রু,ঢেউ খেলানো চুলে। দিনশেষে মাধুর্যের মায়ায় বেঁধে গিয়েছিলো সে। নিজের আবেগ,অনুভূতি তুলে ধরা শুরু করলো চিঠিতে।সেই চিঠি জমা হয়ে আবার ফেরত আসতো আবেশের কাছেই।তবে ২০০৫ এর জুলাই মাসের উত্তপ্ত গরমে লেখা এক চিঠি আর ফেরত আসে নি। যে চিঠিতে ছিলো তার মাধবীলতা কে নিয়ে লেখা হাজারো অনুভূতির ছড়াছড়ি। যে চিঠিতে ছিলো আবেশের মোহময় সব অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ।
আবেশ যখন খোজ নিয়ে জানে চিঠি নিয়েছে কেউ একজন অফিসে এসে। আশার আলো জাগে আবেশের মনে।সে উৎফুল্ল হয়। মাহফুজাকে জানান।
তিনিও খুশি হয় অনেকটা। আবেশকে বলে আবার চিঠি দিতে। আবেশ দেয়! হ্যাঁ,আবেশ সেই চিঠি দিয়েছিলো।

রুপগঞ্জের ছোট গ্রাম মুয়াপাড়া।মেহরুন হারিয়ে যাওয়ার এক বছরের মাথায় রুপগঞ্জ সদর ছেড়ে মুড়াপাড়ায় গিয়ে উঠে শাহেদ।তবে,চিঠি আসতো পোস্ট অফিসে।মেহরুন হারিয়ে যাবার পর মাধুর্য কখনো আর আবেশ ভাইয়ার চিঠি পড়তে পারে নি। দিনশেষে হাজার নির্যাতনের পর ছুটে যেতে ইচ্ছা হতো আবেশের কাছে,তার আম্মু’মায়ের কাছে।
সে পারে নি ছুটে যেতে।২০০৫ সালের ২৭ আগষ্ট কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে পুরো তিনটে বছর পর পেয়েছিলো তার আবেশ ভাইয়ার চিঠি। দরকারী কী যেন একটা কাজে রাব্বী নিয়ে গিয়েছিলো পোস্ট অফিসে। সেখানে একটা দরকারেই রাব্বী তার নাম জোরে উচ্চারণ করতেই পিয়ন চমকে উঠে তাকিয়ে বলে,

‘ তুমি মাধুর্য…’

রোগাটে চেহারার ব্যক্তিটি তার নাম ধরে ডাকতেই বেশ খানিক চমকে উঠেছিলো মাধুর্য। পেছন ফিরে রাব্বীকে দেখে নিলো। সে ব্যস্ত। কারণ কারো সাথে কথা বলতে দেখলেই সে বাসায় নিয়ে মারতো লোকটার কথায় ভ্রু কিছুটা বাকিয়ে ফেললো মাধুর্য। লোকটা মাধুর্যকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একদলা থু থু মাটিতে ছিটেয়ে দিয়ে বলল,

‘ যদি মাধুর্য হইয়া থাহো তাইলে,তোমার লাই একখান চিঠি আছে।মেলা দিন হইলো পইড়া আছে।দেহো তো তোমার লাই আইছে কি’না!’

মাধুর্য কোনো কথা না বলে পিয়নের পিছু পিছু সেদিন গিয়েছিলো।ভয়ে তার আত্মা কাঁপছিলো থেকে থেকে।চট করে মাথায় আসে আবেশের কথা। সাথে সাথেই চোখেমুখে ফুঁটে উঠে এক চিলতে হাসি।
পিয়ন যখন মাধুর্যের হাতে চিঠিটা দেয় মাধুর্য খপ করে ধরেই কেঁদে উঠে। তেরো বছর বয়সী ছোট একটা মেয়ে হাজার নির্যাতন থেকে মুক্ত পাবার জন্য ছটফটিয়ে উঠে। নাকের কাছে চিঠিটা নিয়ে গন্ধ নেয়। ঠিক রজনীগন্ধার সৌরভ ভেসে আসছিলো।
তার রজনীগন্ধা খুব প্রিয় বলেই আবেশ ফুল জুগিয়ে আনতো প্রায়শই। মাধুর্য প্রাণ ভরে সেদিন চিঠিটা দেখছিলো। পিয়ন অনেক কিছু বললেও সে কোনোটাই শুনে নি।
চিঠির উপর প্রেরকের নাম দেখে আবারো কেঁদে উঠেছিলো মাধুর্য। সে ধরেই নিয়েছিলো তার মা মেহরুন আবেশদের কাছে আছে।
তবে সেই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয় আবারো। আবেশের অনুভূতি মাখানো চিঠিটা পড়ে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি গ্রাস করে ছোট মাধুর্যের মনে।হাজারো প্রজাপতি ডানা ঝাপটা দেয় কিশোরী মাধুর্যের মনে।
লুকিয়ে বাড়িতে নিয়ে এসে হাজার বার পড়েছিলো সেই চিঠি। তবে শেষ রক্ষা হয় নি! রাব্বীর চোখে পড়তেই চুল টেনে ইচ্ছা মতো মেরেছিলো রাব্বী। বিশ্রী ভাষায় গালী দিয়েছিলো। প্রথম অনুভূতি মাখানো চিঠিটা ছিড়ে ফেলেছিলো।
শাহেদ এসে জিগ্যেস করতেই রাব্বী বলে,পালানোর ধান্ধায় আছে মাধুর্য।
শাহেদ সেদিন না মেরে প্রেরকের নাম দেখে থমকেছিলো। কিছু না বলেই বেরিয়ে গিয়েছিলো বাড়ি ছেড়ে। রাব্বী টানা দুইদিন মাধুর্যকে ঘরে আটকে রেখেছিলো খাবার পানি ছাড়া।
মাধুর্য মৃত্যুসম যন্ত্রণা সহ্য করেও বেঁচে ছিলো আবেশের আশায় তার আম্মু’মায়ের আশায়।
কিন্তু আবেশ বলছে সে প্রতারণা করছে! পুরোনো সৃতি থেকে বেরিয়ে মাধুর্য আরেকদফা থমকালো। দেখলো আবেশের চোখ লাল হয়ে আছে।
মাধুর্যের হাতের বাধন আলগা করে দিয়েছে। মাধুর্য অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ আপনি কাঁদছেন আবেশ!’

‘ ত..তোমাকে বলেছে।’ আবেশ চোখ ঘুরিয়ে বলল। তার চোখ জ্বলছে। মাধুর্য তার অনুভূতিকে অপমান করেছিলো। এই কথা মনে হলেই তার রাগ লাগছে। সে যখন জানতে পারলো,চিঠিটা আর ফেরত আসে নি তখন সে কতোটা খুশি ছিলো তার ভেতর জানে। এর পরেই পুরো ছয় পৃষ্ঠার একটা চিঠি আবারো দিয়েছিলো মাধুর্যকে।
সেই কথা মনে হতেই আবেশ ঘুরে তাকিয়ে আবারো ধরলো মাধুর্যের হাত। রাগী কন্ঠে বলল,

‘ তোমাকে আমি ফাঁসাতে চাই! তোমাকে শহরে এনে বিক্রি করতে চাই। আমি তোমাকে ভোগ করতে চাই। তাই তো,মাধুর্য!’

‘ কী বলছেন আপনি! এইসব কথা কে বলেছে আপনাকে।’

‘ বাহ..খুব তো নাটক করতে পারো মাধুর্য। এখন বলছো কে বলেছে।’ আবেশ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল। মাধুর্য হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে বলল,

‘ আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না,আমি।’

‘ বুঝবে কেন! তোমার তো প্রেমিক আছে। শেইম অন ইউ মাধুর্য। তা সেই প্রেমিক বুঝি ছেড়ে গেছে! অতোটুকু একটা মেয়ে এতো নোংরা কী ভাবে হয়েছিলে,বলো তো।’

’ কী যা তা বলছেন আবেশ। উল্টাপাল্টা কথা একদম বলবে না।’

মাধুর্য আবেশকে ধাক্কা দিয়ে বলল। এতে আবেশ বেশ রেগে গেলো। মাধুর্যকে হুট করেই চেপে ধরলো দেয়ালের সাথে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ আমি বলছি উল্টাপাল্টা কথা..আমি! নিজে বলে আমা দোষ দিচ্ছো। এতোদিনে বুঝেছি কেন শাহেদ আঙ্কেল তোমায় মারতো। নিশ্চয় খারাপ কাজ করতে গিয়ে ধরা খেয়েছিলে তোমার প্রেমিকের সাথে।’

‘ ছাড়ুন আবেশ আমার লাগছে। আর প্রেমিক! কার প্রেমিক। কী বলছেন আপনি।’

মাধুর্য ব্যথাতুর কন্ঠে বলল। আবেশ যেন আরো ক্ষিপ্র হয়ে উঠলো। আরো চেপে ধরলো মাধুর্যের হাত তার ভেতরে জমে থাকা রাগ প্রকাশ পাচ্ছে। মাধুর্যকে খুন করে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে। মাধুর্য কাঁপা কন্ঠে বলল,

‘ আ..বে..শ আমার হাত ছাড়ু..’

মাধুর্য কথাটুকু শেষ করতে পারলো না তার আগেই আবেশ হুট করেই..

চলবে…

[ আমি মেন্টালি ডিস্টার্ব! সত্যি বলছি।এই জন্য একটু অগোছালো]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here