#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ১২
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
নরম রোদের আলো হাসছে৷ ভুবনমোহিনী রুপে সেজেছে প্রকৃতি৷ মাধুর্য ডাইনিং এর এক কোণে আনমনে বসে আছে ৷ তার কোনো হেলদোল নেই৷ আবেশ অফিসের ফর্মাল ড্রেসআপে এসে বসলো মাধুর্যের পাশে৷ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
‘ মাধুর্য..’
মাধুর্য চমকে উঠলো৷ পাশ ফিরে তাকিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করলো,
‘ কাল রাতে কে কাঁদছিলো,ওইভাবে?’
‘ কখন?’ আবেশ নির্বিঘ্নে জবাব দিলো৷ তার কন্ঠে স্পষ্টতা৷ মাধুর্য অবাক হলো৷ অবাক কন্ঠেই বলল,
‘ কেঁদেছিলো আর আপনি নিজেও শুনেছিলেন৷ অস্বীকার করছেন কেন?’
‘ ভুল শুনেছো৷ সেটা বেড়ালের কান্না ছিলো মানুষের না৷’
আবেশ স্বাভাবিক ভাবে’ই জবাব দিলো৷ মাধুর্য ভাবনায় পড়ে গেছে৷ গভীর ভাবে ভেবে আবেশের দিকে তাকালো৷ আবেশ নিজেও শুনেছিলো! তাহলে মানা করছে কেন!
নাজিফা ঘুম থেকে সবেমাত্র উঠেছে৷ আলুথালু পায়ে ধপ করে একটা চেয়ারে বসে হাই তুলে বলল,
‘ ছোট ভাইয়া? ভাবী রাতে কাঁদছিলো কেন? তুই বকেছিস?’
মাধুর্যের চোখমুখ চিকচিক করে উঠলো৷ আবেশের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ নাজিফাও কান্নার আওয়াজ শুনেছে,দেখুন৷’
আবেশ নাজিফার দিকে কড়া চোখে তাকালো৷ নাজিফার কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না সে ব্রেড খেতে খেতে বলল,
‘ আবার অনেক দিন পর কান্নার আওয়াজ শুনলাম৷ এর আগে মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলাম৷ তবে আজ রাতে তোমাদের রুম থেকে স্পষ্ট আওয়াজ এসেছে৷’
‘ আশেপাশে বাড়ি-ঘরের অভাব নেই৷ আর রাতের শব্দ দূরে হলেও মনে হয় আমার আশেপাশে হচ্ছে৷ হয়তো দূরে কোনো বাসায় কেউ কাঁদছিলো৷ এইটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কী আছে,নাজিফা?’
মাহফুজা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন৷ নাজিফা দমে গেলো৷ তবে মাধুর্য বলল,
‘ আম্মু’মা আমি শুনেছি সেই আওয়াজ৷ কেউ করুন কন্ঠে কাঁদছিলো৷ আমার ভেতর এখনো কাঁপছে৷’
‘ নিজের ভেতর মজবুত করতে,শেখো৷’ আবেশ একরোখা ভাবেই বলল৷ মাধুর্য বুঝতে পারছে না তাদের আচরণের মানে৷
‘ ইরা তোর চোখমুখ ফুলে গেছে,কেনো?’
মাহফুজার প্রশ্নে সবাই তাকালো ইরার দিকে৷ মেডিক্যালের ব্যাগ হাতে সবেমাত্র এসে দাঁড়িয়েছে ইরা৷ মাহফুজার প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গেলো সে। আমতা আমতা করে বলল,
‘ কিছু না আম্মা! কাজের প্রেশার পড়ছে বেশি।এইজন্য হয়তো এমন দেখাচ্ছে৷’
ইরার কন্ঠে আজ উৎফুল্লতা নেই৷ মাধুর্য গভীর চোখে তাকালো৷ স্পষ্ট কান্নার দাগ লেগে আছে ইরার চোখের নীচে৷ চোখেমুখে নেই কোনো আনন্দের রেশ ৷ মাহফুজা কিছুটা বিরক্ত হলেন৷ মাধুর্য উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ ভাবী,কাল রাতে তুমি কান্ন…’
‘ আম্মা হসপিটালে ইমারজেন্সি আছে আমি যাচ্ছি৷’
ইরা দ্রুত বেরিয়ে গেলো৷মাহফুজা বাধা দিলেন না৷ মাধুর্য অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো,ইরার যাওয়ার দিকে৷ আবেশ থমথমে গলায় বলল,
‘ চুপচাপ বসে খাবার খাও,মাধুর্য৷’
‘ কাল রাতে ইরা ভাবী কাঁদছিলো,আবেশ৷’
‘ কাঁদতেই পারে! ফয়েজ ভাইয়ার জন্য হয়তো মন খারাপ ছিলো৷’
‘ তাহলে তখন কেন অস্বীকার করলেন?’
মাধুর্যের প্রশ্নে আবেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
‘ ব্যাপারটা মাথায় ছিলো না৷’
মাধুর্য দোটানায় পড়ে গেছে৷ সত্যি’ই কী ইরা ফয়েজের জন্য কাঁদছিলো? কিন্তু মাধুর্য নিজ চোখে দেখেছে ফয়েজের সাথে সন্ধ্যার দিকেও ইরা হাসিমুখে ফোনে কথা বলছিলো৷ মাহফুজার বিরক্তি নিয়ে তাকানোটা মাধুর্যকে আরো ভাবাচ্ছে৷ কেন কাঁদছিলো ইরা?
আজ ইরা আসলে সে সরাসরি প্রশ্ন করবে বলে ঠিক করলো৷
_____________
ড্রয়িং রুমে পেরিয়ে বিশাল এরিয়া ৷ নানা বাহারি গাছ দেয়াল ঘেঁষে লাগানো৷ সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর বাড়ি একদম ফাঁকা হয়ে যায়৷ এতো বড় বাড়ি দেখাশোনার জন্য আলাদা কাউকে রাখা হয় না৷ কেন হয় না!সেটা মাধুর্য জানে না৷ সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে ডানদিকে পরপর পাঁচটা রুমের মাঝে তালা মারা৷ বা পাশে তাদের সবার রুম৷ মাধুর্য ধীর পায়ে তালা দেওয়া বদ্ধ রুম গুলোর দিকে এগিয়ে গেলো ৷
মৃদু হাওয়া দিচ্ছে আশেপাশে৷ মাধুর্য অবাক চোখে সব তাকিয়ে দেখছে৷ নজরুল যখন সিলেট এসেছিলেন সম্পূর্ণ শূন্য ছিলেন৷ মাহফুজা টিউশনি করাতেন৷ তবে এতো আমূল পরিবর্তন কী করে করেছেন তারা? ভেবে পায় না মাধুর্য!রূপগঞ্জে যখন সবাই থাকতো তখন তারা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার ছিলো৷ হেসেখেলে জীবন চলতো তাদের৷ সুখ ছোঁয়া দিন ছিলো৷
মাধুর্য ভাবতে ভাবতেই বিশাল একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো৷ কাঠের কারুকাজ করা বড় দরজা৷ রাজকীয় ছাপ তাতে৷ সব রুম তালাবব্ধ থাকলেও এই রুমটা খোলা ৷ হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেললো মাধুর্য ৷ আরেকদফা অবাক হলো,যখন দেখলো পুরো রুম ফাঁকা৷ কোথাও কোনোকিছু নেই৷
মাধুর্য কৌতুহল নিয়েই রুমে ঢুকে আরো অবাক হলো৷ কারণ কাঁচের দরজা ৷ একদম ঘেরা৷ বাইরে থেকে দেখার বুঝার উপায় নেই ভেতরে কাচ ঘেরা রুম আছে ৷ মাধুর্য বিরবির করে বলল,
‘ রুমের ভেতর রুম! বাহ! সুন্দর তো৷’
মাধুর্য কৌতুহল দমাতে না পেরে দরজা খোলার চেষ্টা করলো৷ কিন্তু দরজাটা বন্ধ দেখে মাধুর্যের মন খারাপ হয়ে উঠলো৷ তড়িঘড়ি করে বাইরে বেরিয়ে মাহফুজার রুমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো জিগ্যেস করার জন্য,চাবি কোথায়! আর এমন রুম কেন?
তবে পাশের রুমের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো ৷ আরেকটা সরু গলি সেই রুমের পাশ দিয়ে চলে গেছে৷ মাধুর্য পাঁ বাড়ালো সেইদিকে৷ সোজাসুজি রুমটা গিয়ে ঠেকেছে খোলা একটা রুমে৷ যেখানে কাগজ পত্র আর বইয়ের স্তূপ দিয়ে পরিপূর্ণ৷
পুরোনো লাইব্রেরির মতো অনেকটা৷ মাধুর্য কোনোকিছু না ভেবেই ছুটে গেলো সেখানে৷ বই তার প্রাণ৷ হাজারো বিষাক্ত রাতের সঙ্গি৷
মাধুর্য ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে সব বই৷ বিভিন্ন কাগজে ঠাসা ৷ হুট করেই একটা মলাট বাধানো লাল রঙের ফাইল চোখে পড়ে মাধুর্যের৷ চোখ ধাঁধানো সুন্দর৷ অন্যসব বইয়ে ধূলোময়লা থাকলেও সেটার উপর নেই দেখে খানিকটা অবাক হলেও হাত বাড়িয়ে ধরলো সেই ফাইলটা ৷
উপরে লেখা,’অমীমাংসিত’৷ মাধুর্যের ভ্রু কুঁচকে এলো মুহূর্তেই৷ এইটা আবার কেমন নাম? শক্ত মলাট উল্টাতে’ই তার নানা ভাইয়ের ছবি দেখে আরো অবাক হলো মাধুর্য ৷ সাথে সাথে উল্টে ফেললো পরের পাতা ৷ সেখানে দলিলে লেখার মতো লেখা যা অস্পষ্ট৷
মাধুর্য বুঝতে না পেরে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টিয়েও বুঝতে পারলো না,কী লেখা! তবে খুব করে বুঝতে পারলো এইটা একটা দলিল ৷ তার নানা ভাইয়ের ছবি আছে তারমানে এইটা তার নানা ভাইয়ের সাথে কোনো মিলিত।কিন্তু কীসের দলিল এইটা? আর এখানে কী করছে?
‘ মাধু..কোথায় তুই?’ মাহফুজার ডাকে চমকে উঠলো মাধুর্য৷ দ্রুত রেখে দিলো ফাইলটা৷ মনের কোণে ভেসে উঠলো শাহেদের বলা দলিলের কথা ৷ আচ্ছা এইটা’ই কী সেই দলিল? যে দলিলের জন্য তার জীবন হয়েছে অভিশপ্ত?
যদি সেই দলিল এইটা হয়ে থাকে তাহলে এই বাড়িতে কেন?
মাধুর্য হিসেব মেলাতে গিয়ে অগোছালো হয়ে গেলো৷ হতেও তো পারে এইটা অন্যকোনো দলিল! হাত বাড়িয়ে ফাইলটা নিতে চেয়েও নিলো না,মাধুর্য।বেরিয়ে গেলো লাইব্রেরি থেকে ৷ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে শাহেদের কথা৷ শেষবার যখন মেরেছিলো তখন বলেছিলো,
‘ তোর মা যেমন ফাঁকিবাজি করেছে দলিল নিয়ে তার প্রত্যেকটা শাস্তি তুই পাবি৷ আমার জীবন শেষ করে দিয়েছিস তোরা দুইজনে। নরক বানিয়ে দিয়েছিস৷ আমাকে যতোটা যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে তারচেয়ে বেশী তোর সহ্য করতে হবে৷’
মাধুর্য কেঁপে উঠলো৷ কী আছে দলিলে? যার জন্য এতো রহস্য! সব উত্তর মাহফুজা নিশ্চয়’ই দিতে পারবেন? অবশ্যই পারবে৷
_____________
দুপুরের তপ্ত রোদ মেঘের আড়ালে থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে৷ গরম হাওয়া বইছে আবার থেকে থেকে শীতল বাতাসের মিষ্টতা ছড়াচ্ছে৷ নাম না জানা পাখির আর্তনাদ ভেসে বেড়াচ্ছে উন্মুক্ত আকাশে৷ এসির শীতল হাওয়া শরীরের উত্তাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে মনে হচ্ছে,আবেশের কাছে৷ আবেশ গাড়ির কাচ তুলে দিলো৷ এই অসময়ে অফিসের কাজে তাকে কক্সবাজার যেতে হবে৷ সামুদ্রিক মাছের বড় একটা জাহাজ আটকে গেছে সমুদ্রে ৷ মাধুর্যের ট্রোমাটা নিয়ে চিন্তিত সে! এর মাঝে তাকে একা রেখে যাওয়াটা কী ঠিক হবে?
নজরুল এহসান আরো পনেরো দিন পর ফিরবে এইটা শোনার পর থেকেই তীব্র আক্ষেপে ভরে উঠছে আবেশের মন৷ সব ব্যবসায়ের দায়িত্ব তার উপর দিলেও নজরুল সাহেব আলাদা কাজ করেন৷ সেই সূত্রের জন্যই মাঝেমধ্যেই বাইরের দেশে পাড়ি জমাতে হয় তাকে ৷ আবেশের ভাবনার সুতো ছিড়ে মোবাইলের আওয়াজে৷ ভ্রু কুঁচকে তাকায় সেইদিকে৷ ইরার নাম ভেসে উঠতেই খানিক চমকালো আবেশ৷ ইরার ডিউটি আওয়ার চলছে৷ এখন হঠাৎ ফোন? আবেশ কানে ব্লুটুথ কানেক্টে করে,’হ্যালো’ বলতেই ইরা হড়বড় করে বলল,
‘ আবেশ তুমি দ্রুত হসপিটালে আসো৷’
‘ এনিথিং সিরিয়াস,ভাবী?’
‘ আবেশ বেশি কোয়্যাশ্চেন,করো না৷’
‘ কী হয়েছে,সেটা তো বলো।’
ইরা হাঁপাচ্ছে৷ তার কন্ঠে ভয়ের ছাঁপ৷ আবেশ চিন্তায় ভ্রু কুঁচকে গাড়ি থামিয়ে দিলো৷ ইরা চুপ করে আছে৷ আবেশ বলল,
‘ ভাবী,কথা বলছো না কেন? হসপিটালে যাবো কেন,এখন?’
‘ আবেশ এতোকিছু ফোনে বলা সম্ভব না৷ তুমি দ্রুত আসো৷’
আবেশের কঁপালে চিন্তার রেখা ফুঁটে উঠেঁছে৷ দ্রুত বলল,
‘ মাধুর্য..মাধুর্য ঠিক আছে তো,ভাবী?’
‘ কিছু ঠিক নেই,আবেশ৷ তুমি প্লীজ দ্রুত আসো৷ আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে৷’
চলবে….
[ সবার বাহিরে যেমন আদেও কী ভেতরে তেমন? ভাবুন! টুইস্ট শেষ হবার নয় আমি আগেও বলেছি৷ যাদের বোরিং লাগে তাদের কিছু বলার নেই আমার৷]