ভালোবাসি_প্রিয় পর্ব_৪৮

0
1963

ভালোবাসি_প্রিয়
পর্ব_৪৮
#সুলতানা_সিমা

বন্ধু ছোট্ট একটি শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ সৌহার্দ্য বা কল্যাণকামী ব্যক্তি। কিন্তু এর ব্যাপকতা অনেক। আত্মীয়তার সম্পর্কের বাইরে যে সম্পর্কটি মানুষের সবচেয়ে কাছের, সেটা হলো বন্ধুত্ব। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে নতুন নতুন সম্পর্ক আমাদের জীবনে এলেও একমাত্র বন্ধুত্ব শব্দটিই আমাদের জীবনে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকে। বন্ধুত্বের কোনো গণ্ডি নেই। বন্ধ সব বয়সে সবসময়ই গ্রহণীয়। বন্ধুই একমাত্র সম্পর্ক যা মানুষকে বিশ্বাস, আস্থা আর সাহস জোগায়। কিন্তু এই বন্ধু যদি বেইমানি করে? এই বন্ধু যদি হয় জীবনের সব থেকে বড় কষ্টের কারণ? এই বন্ধু যদি হয় বিশ্বাস ভাঙ্গার কারণ? আস্থা ও সাহস যদি হয় এই বন্ধুত্বের কাছে হাস্যকর শব্দ? তাহলে এই বন্ধু ও বন্ধুত্বের প্রতি চলে আসে একরাশ ঘৃণা। বন্ধু শব্দ মনে হয় বিষাক্ত কাটার মতো।

স্কুলের মাঠে বসে অজনি একটা মেয়ের সাথে খেলা করছে। অরিন মেয়েকে নিতে এসেছে। এসে যখন এ দৃশ্য দেখলো তাঁর মেজাজ বিগড়ে গেলো। ঘৃণা হয় বন্ধু শব্দটা তাঁর খুব ঘৃণা হয়। সে যেভাবে ঠকেছে তাঁর মেয়েও একদিন সেভাবে ঠকুক এটা চায়না সে। হেচকা টান দিয়ে অজনিকে দাঁড় করিয়ে টেনে নিয়ে এসে গাড়িতে উঠে চলে আসলো অরিন। বাসায় এসে রুমে নিয়ে অজনিকে টাস করে থাপ্পড় মেরে দিলো। দিহান ওয়াসরুম থেকে মাত্র বের হয়েছে। এটা দেখে দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে বলল “আরে আরে মারছো কেন ওকে?” অরিন রাগে গিজগিজ করতে করতে বলল “ওকে নিষেধ করেছি আমি কারো সাথে না মিশতে তবুও কেন মিশলো।
_কারো সাথে মিশেছে বলে তুমি আমার মেয়েকে মারবা?
_হ্যাঁ মারবো। আমার অবাধ্য হবে কেনো?
_এইটুকু মেয়ে ও কী বুঝে অবাধ্য আর বাধ্যতার কথা।” অরিন কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে বলল”
_কেন বুঝবে না। সব বুঝলে এটা কেন বুঝবে না।”

অরিনের চেঁচানোতে অজনি কেঁপে ওঠে। কান্নার বেগ বেড়ে যায় তাঁর। দিহান এবার নিজেকে কনট্রোল কর‍তে পারলো না। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে অরিনকে টাস করে থাপ্পড় দিলো। গালে হাত দিয়ে অরিন ছলছল চোখে তাকালো দিহানের দিকে। রাগে দিহানের শরীর কাঁপছে। চোখ গুলা আগুনের রূপ ধারন করেছে। কপালের রগ ফুলে উঠেছে। অরিন মাথা নিচু করে ফেলল। দিহান অজনিকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। অরিন বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল। এই প্রথম অজনির গায়ে হাত তুলেছে সে। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে।

ড্রয়িংরুমে মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে দিহান। তাঁর মুখটা বিষন্ন। এ নিয়ে অরিন চার বার হবে দিহানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে চলে গেছে। কথা বলার সাহস পায়নি। দিহানও মাথা তুলে থাকায় নি। অনেক্ষণ পরে অজনি দিহানকে বলল “পাপা খিদা লাগছে।” দিহান অজনিকে বসিয়ে রেখে কিচেন থেকে প্লেটে করে ভাত নিয়ে আসলো। অজনিকে খাওয়াতে লাগলো। অজনি দিহানকে বলল “পাপা তুমি খাবেনা?” দিহান ম্লান হাসলো। অজনি আবার বলল “পাপা মাম্মাম কে মেরো না। মাম্মাম সব সময় কাঁদে, মারলে আরো কাঁদবে।” দিহানের বুক ছ্যাৎ করে উঠলো। অরিনকে মেরে সে নিজেও তো কষ্ট পাচ্ছে। দিহানের চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। অজনি তাঁর ছোট ছোট কোমল হাতে দিহানের চোখের পানি মুছে দিলো। কষ্টের সময় কারো আহ্লাদ পেলে কষ্ট আরো উথলে পড়ে। দিহানের কষ্টটা এবার যেন আরো বেড়ে গেলো। বাম হাতে মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে কেঁদে দিলো।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অরিন। তাঁর কষ্ট হচ্ছে দিহান এভাবে দূরে দূরে থাকছে বলে। দিহান কী বুঝেনা তাঁর কষ্ট হচ্ছে। অজনিকে মেরে নিজেও তো কষ্ট পেয়েছে একা দিহান তো পায়নি। হঠাৎ পেছন থেকে এসে দিহান তাকে জড়িয়ে ধরলো। আচমকা এভাবে ধরায় অরিন কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে। কিন্তু একটুও নড়েনা। দিহান অরিনের ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে দিলো। দিহানের গরম নিঃশ্বাসের ছোঁয়ায় অরিনের গায়ে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। শাড়ি সরিয়ে দিহানের হাত দুটো অরিনের পেটের উপর রাখলো। ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায় অরিন কিঞ্চিৎ নড়ে ওঠল। হাত ছাড়াতে চাইলে দিহান আরো জোরে আঁকড়ে ধরে। অরিনের ঘাড়ে গরম তরল কিছু পড়লো। হাত দিয়ে এনে দেখল পানি। তাহলে দিহান কাঁদছে? পিছনে ঘুরতে চাইলে দিহান আরো শক্ত করে ধরে রাখে,ঘুরতে পারেনা পিছনে। অরিন দিহানকে বলল “কাঁদছেন কেন?” দিহান কিছু বলল না। অরিন দিহানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে পিছন ঘুরে তাকাল। দিহানে চোখ ফুলে আছে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। অরিনের কলিজা মুচড় দিয়ে উঠল। দিহান অরিনের দুগাল ধরে বলল “খুব লেগেছে তাইনা বউ?” অরিন ছলছল চোখে দিহানের চোখে তাকিয়ে না সূচক মাথা নাড়াল। দিহান বলল “ক্ষমা করে দাও সোনাপাখি প্লিজ। অজনিকে তুমি কতো কষ্ট করে এতটুকু করেছো। কত কষ্ট করে লালন পালন করেছো, এটা তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ জানেনা। আমার থেকে তোমার বেশি অধিকার ওর উপর। আমি তো ওর নামে মাত্র পাপা। তুমি ওকে মারলে কাটলে আমার কিছু বলা যাবেনা অরি। কারণ তুমি ওর বাবা মা হয়ে ওকে বড় করেছো। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি ওর কান্না দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনা। আমার রাগ হচ্ছিলো সোনা। কী থেকে কী করে ফেলছি নিজেও জানিনা। প্লিজ ক্ষমা করে দাও।”

অরিন দিহানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। কষ্টে কাঁদেনি সে, সুখের কান্না এটা। দিহান অরিনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল “খুব ব্যথা পেয়েছিলা তাইনা?”
_উঁহু।
_আমি জানি ব্যথা পেয়েছো। আমি তো এমনই। জানোই তো। রেগে গেলে আমি ঠিক থাকিনা। দাওনা ক্ষমা করে।
_ক্ষমা নাই।” দিহান অরিনকে ছেড়ে অরিনের কোমর জড়িয়ে ধরে। চোখে তাকিয়ে বলে “ক্ষমা নাই?” অরিন না সম্মতি মাথা নাড়াল। দিহান অরিনের আঙুল দিয়ে ঠোঁটে স্লাইড করতে করতে বলল “ঠিক আছে ক্ষমা লাগবে না। অন্যকিছু লাগবে।” অরিন নিজেকে ছাড়াতে ছটফট করে বলল” না কিচ্ছু দেওয়া যাবেনা ছাড়েন” দিহান হুম ছাড়ছি বলে “অরিনের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো।

কিছুক্ষণ পরে অরিনের ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলল ” বউ চলোনা নীলের বিয়েতে যাই। আন্টি রাগ করে ফেলছে।
_আমি বললাম না আমি যাবো না।” অরিনের কণ্ঠে রাগ। দিহান অরিনকে বলল “বউ প্লিজ আর না করনা। আমরা তো আলাদা বাসায় থাকবো। তোমার স্বামীর এখন নিজের বাড়ি গাড়ি সব আছে। কারো কাছে হাত পেতে আর চলেনা সে।” অরিন কিছুক্ষণ চুপ থাকল তারপর বলল”ওকে যাবো। কিন্তু আপনার পরিবারের কারো সম্মুখীন হতে পারবো না।

সকালে ঘুম থেকে উঠে লাগেজ গুছানো শুরু করলো অরিন। তানভীকে বলে দিলো লাগেজ গুছাতে। দিহান অজনিকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বাইরে হাঁটতে নিয়ে গেছে। অরিনকে বলে গেছে এসে যেন রেডি পায়। অরিনের কাজে মন বসছে না। আজ তাঁর খুব মনে পড়ছে লুপার কথা। সে লুপাকে ঘৃণা করে, খুব বেশি ঘৃণা করে। কিন্তু তবুও কেন জানি লুপার জন্য খুব খারাপ লাগছে তাঁর। লুপা নীলকে ভালোবাসতো। আজ ২২ তারিখ। ২৫ তারিখ নীলের বিয়ে। নীলের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে লুপা কীভাবে এটা মেনে নিবে। এত বছর পরেও কী লুপা নীলকে ভালোবাসে নাকি ভুলে গেছে। অরিনের বুক ফুঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

_________________________

কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে নীল। ফোনের রিংটোন শুনে কপাল থেকে হাত সরিয়ে ফোন হাতে নিলো সে। লুপা ফোন দিচ্ছে। নীল বারান্দায় গিয়ে ফোন রিসিভ করলো। ফোনের ওপাশ থেকে লুপার কান্নার শব্দ শুনা যাচ্ছে। নীলের বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। লুপাকে ছাড়া যে সেও অনেক কষ্টে আছে। তার মনটাও যে লুপার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু কী করবে সে। কাউকে পেতে গিয়ে কাউকে হারাতে চায়না নীল।

অনেক্ষণ ফোন কানে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল নীল। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে গলা স্বাভাবিক করে বলল ” কী ব্যাপার কিছু বলছো না যে,কেন ফোন দিছো?” লুপা কিছু বলল না তাঁর ফুঁপিয়ে কান্না করার শব্দ শুনা যাচ্ছে। নীল বলল “আব,,,আমি রাখছি।” লুপা কান্নাজড়িত গলায় বলল”
_না রাখবে না প্লিজ।
_কথা বলছো না তো ফোন রাখবো না কেন?” ডুকরে কেঁদে উঠে লুপা। কাঁদতে কাঁদতে বলল ”
_আমি পারছি না থাকতে। প্লিজ ভেঙে দেন না বিয়েটা। আমি মানছি আমি খারাপ। আমি এটাও মানছি আমি সবার জীবনটা নরক করে দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি যা করেছি জেদের বশে করেছি। আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না প্লিজ। আমি পারছি না আর থাকতে।
_চে চে চেষ্টা করো পারবে।
_ আমি ভেবেছিলাম চেষ্টা করলে পারবো। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু আমি পারিনি। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আমি পারছি না আপনাকে ছাড়া থাকতে।
_কেন পারবে না লুপা? আমাদের মধ্যে তো ওই রকম কোনো সম্পর্ক ছিলো না। আজ থেকে ছয় বছর আগে আমরা শুধু বন্ধু ছিলাম। এতোদিন আমাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিলোনা। আর না ছিলো আমাদের মধ্যে আর বন্ধুত্ব। না কখনো তোমাকে আমি ভালোবাসি বলেছি। তাহলে কেন তুমি এমন পাগলামি করছো লুপা? আমি তো কখনো তোমাকে এমন আশা দেইনি। তুমি বি বি বিয়ে করে নাও লুপা। তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।” শেষের কথাটা বলে চোখ খিঁচে লম্বা দম ছাড়লো নীল। লুপাকে এতোকিছু বলে তাঁর বুক পোড়ে যাচ্ছে। ফোনের ওপাশ থেকে লুপার কোনো সাড়াশব্দ নেই। নীল ডাক দিলো। “লুপা।” লুপা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। নীল ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলো,কিন্তু পারলোনা। গাল গড়িয়ে দুফোঁটা জল পড়লো। খুব ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলতে “লুপা খুব ভালোবাসি তোমায়। খুব বেশি ভালোবাসি।” কিন্তু বলতে পারবে না। কারণ সে অসহায় খুব অসহায়। চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে নীল বলল “ক্ক ক্ক কেঁদোনা লুপা। বিয়ে করে নাও দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।” লুপা বলল “একটা সত্যি কথা বলবেন?”
_হুম। বলো কী কথা।
_আপনি কী সত্যি আমায় ভালোবাসেন না? “নীল জবাব দিলো না। লুপা বলল ” বলুন না প্লিজ। আমার কেন এটা মনে হয় আপনি আমায় ভালোবাসেন? কেন এটা মনে হয় আপনার চোখ আমায় কিছু বলছে? কেন মনে হয় আপনি আমার খুব আপন কেউ? বলবেন প্লিজ।
_তু তুমি ওগুলা ভাবো তাই তোমার মনে হয়।
_একটা কথা রাখবেন?
_বলো।
_একটা বাচ্চা দিবেন আমায়। “নীলের কান ঝা ঝা হয়ে গেলো। লুপা এসব কী বলছে? নীলের রাগ হলো লুপার উপর। লুপা আবার বলল ” আপনার কাছে আমাকে খুব খারাপ লাগছে জানি। আমার কাছেও আমাকে খারাপ লাগছে। কিন্তু বিশ্বাস করেন আমি পারবো না কারও সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে। পারবো না আপনাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছি সেটা অন্য কারো সাথে পূরণ করতে। আমি আপনাকে নিয়ে বাঁচতে চাই। আপনাকে তো পাবোনা। তাই আপনার একটা চিহ্ন নিয়ে বাঁচতে চাই। একা বাঁচতে পারবো না আমি। মরে যাবো। সত্যি মরে যাবো। দেননা একটা বাচ্চা আমায়। হ্যাঁ সমাজ আমায় খারাপ বলবে। কিন্তু তাতে আমার কিচ্ছু যা আসে না। আমি তো এমনিতেই খারাপ। খারাপ বলেই তো আপনাকে পেলাম না। দেননা একটা বাচ্চা আমায়। একটা রাত ভিক্ষে চাইছি আমি। প্লিজ।
_তুমি আর কোনোদিন আমায় ফোন দিবেনা লুপা।”

ঝাঁজালো গলায় কথাটা বলে ফোন কেটে দিলো নীল। লুপা যে তাঁর জন্য কতটা পাগল হয়ে গেছে সেটা লুপার এই কথাগুলো প্রমাণ করে দিলো। মাথার চুল মুঠোয় ধরে কাঁদতে লাগলো নীল। কেন সে তাঁর মা এতটা নিষ্ঠুর। কেন বুঝেন না তিনি তাঁর কষ্টটা। বাবা হারিয়ে এতিম হয়েছে মা হারিয়ে অনাথ হতে চায়না সে। তাই তো এতটা কষ্ট মুখ বুজে সয্য করে যাচ্ছে। তাই বলে কী তাঁর কষ্টটা বুঝবে না কেউ। রাগে চেয়ার তুলে আছাড় মেরে ফেলল নীল। এই রাগটা তার নিষ্ঠুর মায়ের উপর। আজ লুপাকে এত ভালোবাসার পরেও বার বার ফিরিয়ে দিচ্ছে। শুধু মাত্র নীল জানে ভালোবাসার মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়ার কষ্ট কতটা বিষাক্ত।

রুহান একটা দোকানে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন বাসায় যাওয়ার সময় লুপার জন্য আইসক্রিম নেয় সে। “ভাইয়া আমাকে একটা ভ্যানিলা আইসক্রিম দেন তো।” হঠাৎ পিছন থেকে মেয়েলী গলা শুনে পিছন ঘুরে তাকাল রুহান। দিয়া দাঁড়িয়ে আছে। দিয়াকে দেখে রুহান ঠোঁট কামড়ে হাসলো। দিয়া রুহানকে দেখেই সেদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো সে। দোকানদার আইসস্ক্রিম বের করার পরে দিয়া ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে লগলো। রুহান বলল “তোকে দিতে হবে না আমি দিচ্ছি।” দিয়া শুনলো না। টাকা বের করে দোকানদারের দিকে বাড়িয়ে দিলো। রুহান দিয়ার হাত থেকে টাকা নিয়ে আবার দিয়ার ব্যাগের ঢুকিয়ে রাখলো। তারপর কয়েক রকমের চকলেট,চিপস আরো কয়েকটা আইসক্রিম কিনলো। ব্যাগটা দিয়ার হাতে দিয়ে বলল “নে ধর।” দিয়া হা করে তাকিয়ে বলল। “এতোকিছু নিয়ে বাসায় যাবো কেমনে?”
_হেঁটে হেঁটে নিয়ে যাবি।
_আমি পারবো না।
_থাপ্পড় চিনিস? ধর এটা।
_এটা আমি নিবো কিভাবে? আম্মু মাত্র একশো টাকা দিছে আমায়। এগুলা নিলে প্রশ্ন করবে না আমি টাকা পেলাম কই?
_বলবি তোর কাছে ছিলো টাকা।
_আমার কাছে ছিলোনা বলেই তো আজ টাকা চেয়ে আনছি।
_আমি এতোকিছু বুঝিনা, এটা ধর। “রুহানের ধমকে দিয়া ব্যাগ হাতে নিলো, কিন্তু তাঁর ভয় লাগছে। তাঁর মা যা চালাক। উনার সন্দেহের চোখে পড়লে খবর আছে।

রুহান দোকানদারের টাকাটা দিয়ে দিয়ার হাত ধরে নিয়ে বেরিয়ে আসলো দোকান থেকে। রুহানের হাতের ছোঁয়া দিয়ার শরীরে আবারও শীতল শিহরণ জাগিয়ে তুললো। রুহানের ছোঁয়াতে সে এতো সুখ পায় কেন এটা তাঁর জানা নেই। দোকানের বাইরে এসে রুহান দিয়ার হাত ছেড়ে দিলো। সেইম অবস্থা তো তাঁরও হচ্ছে। দিয়ার লজ্জা লাগছে। লজ্জায় লাল হয়ে আছে সে। সেদিনের কথা মনে পড়ছে বার বার। রুহান দিয়াকে বলল” রিকশা দিয়ে যাবি নাকি সি এন জি দেখে দিবো।” দিয়া বলল “না আমি যেতে পারবো।” রুহান বলল” যেতে তো পারবি বুঝলাম। কিন্তু কীভাবে যাবি? রিকশা দিয়ে যাবি নাকি সি এন জি দিয়ে যাবি? ” দিয়া কিছু বলল না। আসলে সে কিছু বলতে পারছে না। তাঁর মনের মধ্যে অন্য রকম অনুভূতি জেগে ওঠেছে। যে অনুভূতিগুলা চাইছে রুহানকে কাছে পেতে। মাথায় শুধু রুহান ঘুরপাক খাচ্ছে আর কিছুই ঢুকছে না মাথায়।

রুহান বাইকে উঠে দিয়াকে বলল “উঠ আমি তোকে পৌঁছে দিবো।” প্রথমে দিয়া উঠল না। রুহান ধমক দেওয়ার পরে উঠে বসলো। রুহানের সাথে ঘেঁষে বসলো না দিয়া। রুহানের ছোঁয়া লাগলে তাঁর নিজেকে সামলাতে কষ্ট হয়। রুহান বলল রুহানকে ধরে বসতে। দিয়া ধরলো না। রুহান স্টার্ট দিয়ে খুব জোরে বাইক টান দিলো। দিয়া ঝাপটে ধরলো রুহানকে। এমনিতেই তাঁর হার্টবিট বেড়ে আছে তাঁর উপর আবার এমন ভাবে রুহানকে ধরে বসা। দিয়ার এবার এই অনুভূতিগুলা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। রুহান দিয়াকে বলল “দিহান ভাই কবে আসবে রে দেশে?” দিয়া কিছু বলল না। তাঁর ঘোর লেগে আছে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে রুহানের সাথে অনেক গভীরে ডুব দিতে। রুহান বলল “ওই এতো জোরে জোরে শ্বাস ফেললে তো মরে যাবি। সাথে আমাকেও মারবি।” দিয়া লজ্জা পেলো। রুহানকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে রুহানের কাঁধে হাত রেখে বসে থাকল।

কিছুদূর গিয়ে রুহান বাইক থামালো। দিহাকে নামতে বলে নিজেও বাইক থেকে নামলো। দিয়া চারদিকে তাকিয়ে বলল “জায়গাটা কেমন নির্জন। এটা কোন রাস্তা?” রুহান দিয়ার হাত ধরে দিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ায়। দিয়ার চোখে চোখ রেখে বলে, ” তোকে মিথ্যে বলব না দিয়া, যে কাউকে কোনোদিন ভালোবাসি নি। একটা মেয়েকে খুব ভালোবাসতাম আমি। সেই ক্লাস নাইন থেকে। হঠাৎ করে তাঁর পরিবার তাঁর বিয়ে ঠিক করে ফেলে। পরিবারের অবাধ্য না হতে পেরে সে বিয়ে করে নেয়। তারপর থেকে আমার আর কাউকে ভালো লাগেনি। জানিস দিয়া, যেদিন তোকে হসপিটালে দেখেছিলাম। সেদিন সারারাত ঘুম হয়নি আমার। তোর কান্নাভেজা মুখটা বার বার চোখে ভেসে উঠছিলো। তোকে দেখলে আমার অন্য রকম ফিলিংস হয়। তোর ছোঁয়া আমায় অন্য রকম সুখ দেয়। এসব কেন হয় দিয়া বলবি প্লিজ?” দিয়া কিছু বলতে পারলো না। অতি খুশীতে যেন ভাষা ভুলে গেছে সে। দিয়ার মুখ হাস্যজ্বল, চোখে পানি। রুহান দিয়ার কানের নিচে হাত রেখে দিয়ার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে গেলো। দিয়ার ঠোঁট জোড়া ছোঁতেই সে হারিয়ে গেলো এক সুখের রাজ্যে।

দিয়াকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে রুহান মাত্র বাসায় এসেছে। মুচকি হেসে হেসে উপরের দিকে যাচ্ছে। তাঁর মা দেখে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললেন “কী ব্যাপার ঘটনা কী হাসছিস কেন?” মায়ের কথায় চমকে ওঠে রুহান। থমথমে হয়ে বলে “ক্ক ক্ক কই নাতো। হাসবো কেন?” বলে ঘাড় ম্যাসেজ করতে করতে চলে গেলো। রুমে গিয়ে ব্যাগ রেখে লুপার আইসক্রিম নিয়ে লুপার রুমে গেলো। দরজাতে নক করলো কারও শব্দ নেই। গলা উঁচিয়ে মাকে বলল “আম্মু আপ্পি কী হসপিটালে?” সায়রা জানালেন আজ যায়নি। রুহান দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। রুমে ঢুকে থমকে গেলো রুহান। তাঁর হাত থেকে পরে গেলো, বোনের জন্য কেনা আইসক্রিম। শরীরের শক্তি যেন ক্ষয়ে গেছে ধপ করে বসে পড়লো ফ্লোরে। চোখ থেকে টুপ করে গড়িয়ে পড়লো একফোঁটা জল। চিৎকার দিয়ে বলে উঠল “আপ্পিইইইইইইইইইইই”।

চলবে……।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here