ভালোবাসি_প্রিয়
পর্ব_৪১
#সুলতানা_সিমা
উপরে যেতে পা বাড়াচ্ছিলো অরিন। কাঁচ ভাঙার শব্দে পিছন ঘুরে ফ্লোরের দিকে তাকালো। পুরো ফ্লোর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটকে আছে কয়েকটা গিফট বক্স। কাঁচের পুতুল একটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আছে। সামনেই পরে আছে বড় একটা টেডিবিয়ার। টেডিবিয়ারের সামনে এক জোড়া পা। অরিন পা থেকে মাথা পর্যন্ত্য তাকালো। চিরচেনা মুখটা চোখে পরতেই ৪৪০ ভোল্টের শকড খেল সে। আকাশ ভেঙে বাজ এসে যেন তাঁর মাথায় পরলো। চোখ কচলে আবার তাকালো অরিন। এখনো এই মানুষটা সে দেখছে। মূহুর্তেই গায়ের পশমগুলা দাঁড়িয়ে গেলো। নিশ্বাস ভারি হয়ে গেলো। খুব দ্রুত শ্বাস ফেলছে অরিন। থরথর করে কাঁপতে লাগল। মাথার ভেতর ভনভন করছে। নিজের চোখে দেখা মানুষটা তাঁর কাছে মিথ্যে মনে হচ্ছে। সামনে যাকে দেখছে আসলে কী সত্যি দেখছে?
আমাদের জীবনে মাঝেমাঝে এমন সময় আসে, যা আমরা সত্যি বলে মেনে নিতে পারিনা। আবার মনের গভীর থেকে চাই, এটাই যেন সত্যি হয়। সময়টা স্বপ্নের মতো লাগে, কখনো দুঃস্বপ্নের মতো,আবার কখনো সুখের স্বপ্নের মতো। তখন যেন চারদিকের সবকিছু আমাদের কাছে অন্যরকম হয়ে যায়। দিহানের বিশ্বাস হচ্ছেনা তাঁর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অরিন। হোয়াইট গাউন পরা অরিনের মাঝে কোনো পরিবর্তন নেই ছয় বছর আগের সেই অরিনের। পা দুটো অবশ হয়ে এলো দিহানের। ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো সে। অরিনের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। এ কান্না শুধু কষ্টের নয়, সুখেরও। কতো বছর পরে অরিনের দেখা পেলো। উপরওয়ালা মনে হয় এতোদিনে মুখ তোলে চাইলেন।
উপস্থিত সকলের দৃষ্টি দিহানের দিকে। শাওন এখনো শকডের উপর আছে। অরিনকে দেখছে বলে সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। দিহানের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। দুজনের চোখ দিয়ে অঝোর ধারা বৃষ্টি ঝরছে। অরিনের মামার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সব কিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। অরিন দু’পা এগুলো দিহানের দিকে। সাথে সাথে তাঁর চোখে ভেসে উঠল সেই দিনের দিহানের সেই নিষ্ঠুরতা। অরিন থেমে গেলো। দিহান উঠে এসে অরিনের সামনে দাঁড়ালো। এইটুকু সময় কেঁদেই তাঁর চোখ লাল হয়ে গেছে। অরিনের দিকে দিহানের হাত বাড়িয়ে দিল। তাঁর হাত কাঁপছে। অরিনের হাত ধরতেই তাঁর শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেলো। সেই চেনা অনুভূতি তাঁর প্রতিটি অঙ্গে প্রতঙ্গে শিহরণ জাগিয়ে তুললো। হৃদকম্পন বেড়ে গেলো। অরিনের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কাটা গলায় বলল”
_অ অ অ অরি।” অরিন ঠোঁট কামড়ে কেঁদে যাচ্ছে। দিহানের হাতের ছোঁয়া পেয়ে সে একদম শীতল হয়ে গেছে। তাঁর শরীরে যেন এই শক্তি টুকু নেই যে দিহানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়াবে। দিহান তাঁর দুহাত দিয়ে অরিনের মুখ তুলে ধরে বলল” ক্ক ক্কই হারিয়ে গেছিলো বলো? ক কতো খুঁজেছি তোমায়? এতই বড় ভুল ছিলো যে আমার থেকে নিজেকে আড়াল করে নিলে?” দিহানের কথা শুনে চট করে সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল অরিনের। ধাক্কা দিয়ে দিহানকে দূরে সরিয়ে দিলো। তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে নিয়ে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল” মামা কে উনি? বের করে দিন উনাকে।” অরিনের কথায় দিহানের মাথায় বাজ পড়লো। অরিনের বাহু চেপে বলল” অরি কী বলছো তুমি? পাগল হয়ে গেছো? আমি তোমার দিহান।” দিহানের হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে অরিন চিৎকার করে বলল”
_ কে দিহান? আমি কোনো দিহানকে চিনিনা। বের হয়ে যান আপনি এখান থেকে।
_খুব রাগ হচ্ছে তাইনা? খুব অভিমান জমে আছে?” অরিনের হাত নিয়ে তাঁর গালে আঘাত করতে করতে বলল”নাও মারো আমায়, ইচ্ছেমতো মারো। তবুও এমন করনা অরি। ছয় বছর পর তোমার দেখা পেয়েছি। পাগলের মতো খুঁজেছি তোমায়। কত বার মরতে গিয়েও ফিরে এসেছি, তুমি ফিরে আসবে ভেবে। ভাবতাম তুমি যদি ফিরে এসে আমায় পাওনা, তখন তুমি অনেক কষ্ট পাবে। কিন্তু তুমি আসনি অরি। একে একে ছয়টা বছর পার হয়েছে,শুধু তোমার পথ চেয়ে। ছোট একটা ভুল অরি, শুধু মাত্র ভুল বুঝাবুঝি। এই ভুলের এতোবড় সাজা? তাহলে তোমার কতটা সাজা হওয়া উচিত? তুমি যে আমাকে জেনে বুঝে কষ্ট দিয়েছো। আমার প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে পালিয়েছো। তোমার কতটা সাজা পাওয়া উচিত বল?
_ছা ছাড়ুন আমায় ছুঁবেন না আপনি। বেরিয়ে যান। দয়া করে বেরিয়ে যান এখান থেকে।” দিহান কান্নাভেজা চোখে অরিনের দিকে তাকিয়ে থাকল। অরিনের মামা কিছুই বলছেন না। যা আন্দাজ করার তা উনি আন্দাজ করে ফেলছেন। উপস্থিত সকলও চুপ থাকলো। যেখানে অরিনের মামার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই সেখানে তাঁরা কী কথা বলবে? দিহান আবার অরিনের দুহাত ধরলো। অরিনের ইচ্ছে হলো কড়া কয়েকটা কথা শুনাতে, কিন্তু তাঁর স্বামীকে অপমান করতে চায়না সে। তাই সে চুপ থাকলো। তবে তাঁর মনে হচ্ছেনা সে বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারবেনা। কয়েকটা কথা দিহানকে বলতে খুব ইচ্ছে করছে। কথাগুলা ঠোঁটে এসে বার বার ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু এখন যদি বলে তাহলে তাঁর স্বামী ছোট হবে। তার থেকে না হয় সে নিজেই ছোট হলো।
দিহানের থেকে হাত ছাড়িয়ে, সকল মেহমানের উদ্দেশ্যে বলল” I’m really sorry! আপনাদের সবার মূল্যবান সময় নষ্ট করানোর জন্য আমি লজ্জিত। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আজ কোনো অনুষ্ঠান হবেনা আপনারা এবার আসতে পারেন।” শেষের কথাটা বলতে অরিনের গলা কেঁপে ওঠে। নিজেই দাওয়াত দিয়ে আবার নিজে তাড়িয়ে দিলো। বিষয়টা তাঁর নিজের কাছেও কেমন জানি লাগছে। একে একে সবাই চলে গেলো। দিহানের দিকে কঠিন চোখে তাকালো অরিন। দিহান তাঁর দিকে তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। দিহানের কান্নাভেজা চোখে অরিনকে দেখার তৃষ্ণা ফুটে ওঠছে। অরিনের চোখ শীতল হয়ে এলো। কঠিন কথাগুলা জিভে এসে আবার পেটে চলে গেলো।
দিহান অরিনকে বলল” আমার বাচ্চা কই অরি?” দিহানের প্রশ্নে জ্বলে ওঠল অরিন। এই কষ্ট তাঁকে সব ভুলে যেতে দেয়না, বাচ্চার কষ্ট। অরিন রাগে ফুঁসতে থাকলো। দিহান আবার জিজ্ঞেস করলো ” বলো অরি, কই আমার বাচ্চা?” অরিন শাওনকে উদ্দেশ্য করে বলল” ভাইয়া, আপনার ফ্রেন্ডকে নিয়ে এখান থেকে যান প্লিজ।
দিহান রাগে একটা ফুলের টব নিয়ে আছাড় মেরে ফেললো ফ্লোরে। আচমকা রেগে যায় দিহান, এটা অরিনের অজানা নয়। কিন্তু তাঁর রাগ যে এর থেকেও দিগুণ। দিহান অরিনকে চেঁচিয়ে বললো “জবাব দাওনা কেন,কই আমার বাচ্চা? ” দিহানের থেকে কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে অরিন বললো”
_গলা নিচু করে কথা বলুন মিষ্টার দিহান চৌধুরী। আপনার রাগ দেখতে আমি বসে নেই। আপনার বাচ্চা? আপনার? আপনার বাচ্চা না। শুধুমাত্র আমার বাচ্চা।
_শুধুমাত্র তোমার বাচ্চা? এ বাচ্চার উপর আমার কোনো অধিকার নেই?
_না নেই। কোনো অধিকার নেই আপনার।
_দেখো অরি আমি রাগ করতে চাইনা। আমার বাচ্চা কই?
_আজ কেন বাচ্চার খোঁজ নিতে এসেছেন? আপনার মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন আপনার বাচ্চা কই।
_আমার মাকে টানছো কেন? আমার বাচ্চা কোথায়?
_বাহ মাকে টানতে কলিজায় লাগছে তাইনা? আপনি জানেন আমি কতটা খুশি হয়েছিলাম, এটা শুনে যে আমি প্রেগন্যান্ট? আমি আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম আমি। মনে মনে কত কত প্ল্যান করে ফেলছিলাম মূহুর্তেই। হ্যাঁ আপনাকে আগে শুনাবো ভাবলেও আগে আপনাকে শুনাতে পারিনি আমি। আগে শুনিয়েছিলাম আপনার মাকে। উনি আমায় কী বলেছিলেন জানেন? অ্যাবরশন করাতে। “দিহানের মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো। তাঁর মা তাঁর বাচ্চাকে মেরে ফেলতে বলছিলো? অরিন আবার বলল” একটা মা হয়ে তাঁর সন্তানের অনাগত বাচ্চাকে কীভাবে মেরে ফেলতে বলে? আর এটা তো আপনার অস্তিত্ব ছিলো। আপনার ভালোবাসার চিহ্ন ছিলো এটা। উনি কীভাবে এটা বলতে পেরেছিলেন?”একটু থেমে লম্বা দম ছাড়লো অরিন তারপর আবার বললো” জানেন আমি তবুও উনার কথা কানে নেইনি, আমি ভাবলাম আমার স্বামী তো খুশি হবে, তাহলে কে কী বললো না বলল এসব কেন আমি খুঁজবো। কিন্তু না, আমার স্বামী নিজ হাতে আমায় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করালো। একটাবার কী জিজ্ঞেস করতে পারতেন না আপনি,আমি খুন করেছি কিনা? চোখ বন্ধ করে যাকে বিশ্বাস করেন বলেছিলেন, তাঁকে চোখ খোলা রেখেই আসামি বানিয়ে দিয়েছিলেন। আপনি না-হয় জানতেন না আমার পেটে আপনার বাচ্চা ছিলো। কিন্তু আপনার মা তো জানতেন। কই, তিনি তো একবারও আমায় আটকানোর চেষ্টা করেননি। দুই দুইটা দিন আমি জেলে ছিলাম। কই,আপনারা কেউ তো একবারও আমায় গিয়ে দেখেন নি। আপনারা সবাই চেয়েছিলেন আমি যেন ফাঁসির দঁড়িতে ঝুলি। আরে লুপা ওতো পারতো সবকিছু সমাধান করে দিতে,কিন্তু করেনি। আসলে কী জানেন? আপনারা কেউ কখনো আমায় মানুষ বলেই ভাবেন নি। সব সময় সবাই আমাকে নর্মদের কিট ভেবেছেন। আজ দেখুন মিষ্টার দিহান, আমি একজন সাফল্য ডক্টর। আজ কেউ বলতে পারবে না আমি অযোগ্য। বলুন আপনার মাকে এসে বলতে,আমি রাস্তার মেয়ে। কেউ পারবে না বলতে আর। আজ আমি নিজের পরিচয়ে পরিচিত। না কোনো বস্তির মেয়ে আর কোনো রাস্তার মেয়ে।
অরিনের কথাগুলা শুনে দিহান বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। অরিনকে অনেককিছু বলার আছে। অনেক প্রশ্নের উত্তরও আছে কিন্তু সে বলতে পারছেনা। সব কথা গলায় এসে দলা পেকে গেছে। বার বার চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসছে তাঁর।
দিহান অরিনের সামনে হাত জোড় করে বসলো। তারপর ভেজা কণ্ঠে বললো” মায়ের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি অরি। আমি জানতাম না অরি বিশ্বাস করো। নয়তো ভুলে আমার মা হন। যে মা তাঁর সন্তানকে সন্তান হারা করতে চায় সে মা মা হয়না। আর আমি কীভাবে ক্ষমা চাইবো বলো। কীভাবে ক্ষমা চাইলে আমায় ক্ষমা করবা? ছয় বছর কম নয় অরি। অনেক অনেক যুগের সমান। এতটা দিন আমায় কষ্ট দিয়েছো, এবার ক্ষমা করে দাও প্লিজ। সেদিন যদি একবার পিছন ফিরে থাকাতে তাহলে তুমি দেখতে অরি। তোমার দিহান কুকুরের মতো ছুটাছুটি করছে। শুধুমাত্র তোমাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য। শুধু একটাবার পিছন ফিরে তাকালে তুমি দেখতে অরি দিহান তোমার অভাবে মেন্টাল হসপিটাল পর্যন্ত গিয়েছে। সব থমকে গিয়েছে অরি শুধু তুমি নাই বলে। এতোদিনে আজ তোমার দেখা পাবো আমি ভাবিনি অরি। প্লিজ আর দূরে ঠেলে দিওনা। একবার বেঁচে গেছি বলে বার বার বাঁচতে পারবোনা আমি অরি। প্লিজ অরি ফিরে আসো আমার জীবনে আবার। প্লিজ।” ডুকরে কেঁদে উঠল দিহান। অরিন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। কষ্ট হচ্ছে তাঁর। প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। দিহানের কান্না সয্য হচ্ছেনা তাঁর। জোড় হাতে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে যাচ্ছে দিহান।
হঠাৎ অজনির গলা এসে কানে বিঁধল। মাম্মাম মাম্মাম বলে ডাকছে। দিহান চোখ তোলে তাকাল। অরিনের সাথে ম্যাচিং করে সেইম একটা হোয়াইট গাউন পরা। সাথের একটা ২০-২১বছরের একটা মেয়ে আছে। খুব চেনা চেনা লাগছে তাঁকে। অজনি দৌড়ে এসে অরিনের কোলে উঠে বলল”মাম্মাম দেখোনা খাম্মনি আমায় বকে। আমি সাজবো না গো মাম্মাম। খাম্মনি সাজতে বলে।” অজনির কথা শুনে দিহানের চেহারা জ্বলজ্বল করে উঠল। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখা ফুটে উঠলো। অজনি তাঁর মেয়ে?
দিহান শাওনকে বলল “শা শা শাওন অ অ অজনি আমার মে মেয়ে।” খুশিতে গলায় কথা আটকে গেছে দিহানের। এতো বেশি খুশি লাগছে যে চোখ দিয়ে টুপ করে খুশির অশ্রু ঝরে পরলো। কষ্ট খুশির জল একাকার হয়ে তাঁরাও যেন হাসছে। ভেজা গাল চিকচিক করছে তাঁর। অজনি দিহানকে দেখে বিশ্বজয়ী হাসি দেয়। দিহানের কাছে আসার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই অরি থামিয়ে দেয়। চোখ গরম করে মেয়ের দিকে থাকায়। অজনি চুপসে গেলো। সে তাঁর মাকে খুব মানে। দিহান অরিনকে ধমক দিয়ে বলল”
_ অরিন তুমি আমার মেয়েকে আমার থেকে দূরে রাখতে পারো না।
_আমি আমার মেয়েকে কোথায় রাখবো না রাখবো সেটা আমি জানি। এবার আপনি আসতে পারেন।
_বাড়াবাড়ি করছো অরি,যা মোটেও আমার পছন্দ না।
_হ্যাঁ করছি বাড়াবাড়ি তো কী করবেন আপনি? চিনিয়ে নিবেন? তাহলে নিন। ও যদি আপনার কাছে যায় তাহলে নিয়ে নিন।” অরিন অজনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। অরিনের মামা এগিয়ে অজনিকে নিতে চাইলেন কিন্তু অরিন হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো। তাঁর পুরো বিশ্বাস আছে তাঁর মেয়ের উপর। সে জানে আর যাইহোক তাঁর মেয়ে তাঁর হুকুম ছাড়া একটুও নড়বেনা। ছোট হোক তাতে কী তাঁর মেয়ে যথেষ্ট বুঝদার। মায়ের কথার অবাধ্য কখনোই হয়না সে। মা চোখ রাঙিয়েছে, মানে মা নিষেধ করছে এটা তাঁর ছোট মাথায় ঢুকে গেছে।
দিহান অজনির সামনে বসলো। অজনির দুগাল ছোঁয়ে স্নেহমাখা চোখে তাকিয়ে থাকলো। এই এঞ্জেলটা তাঁর? কত্ত কিউট একটা বাচ্চার বাবা সে। বিশ্বাস হচ্ছেনা দিহানের। স্বপ্নের মতো লাগছে সব। মেয়ের গালে কপালে অসংখ্য চুমু এঁকে দিলো। যেন সাত রাজার ধন পেয়েছে সে। অজনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর চোখ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে সে দিহানের কোলে উঠতে চায়। দিহান অজনিকে কাঁপা কোমল গলায় বলল” পা পা পাপা আমি তোমার। তো তো তোমার পাপা। একবার পাপা বলে ডাকবা?” অজনি অরিনের দিকে তাকাল। অরিন ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। দিহান আবার বললো “প্লিজ,একবার পাপা বলে ডাক দাও। তুমি যা চাইবে তাই এনে দিবো আমি। প্লিজ একবার পাপা বলে ডাকো।” দিহানের গলা কাতর। কাকুতি স্বর। অজনি এবারও চুপ। দিহান বলল” ঠিক আছে ডাকতে হবেনা পাপার সাথে চলো। পাপার সাথে থাকবে তুমি।” অজনি নড়লো না। শুধু শূন্য চোখে দিহানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। দিহান অনেকবার বলেও কোনো লাভ হলোনা। অরিন অজনিকে কোলে নিয়ে বলল” এবার যান।
_যাবোনা। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাবো।
_আমি দিবো না। ও যদি যায় তাহলে আপনি নিতে পারেন। কিন্তু আপনি চেষ্টা করেও ওকে নিতে পারেন নি। তাই দয়া করে এবার যান। ” দিহান কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলো। তারপর বলল”
_হুম যাচ্ছি। কিন্তু আমি আবার আসবো। আমার সন্তান আমি আমার কাছে নিবোই নিবো। সাথে বউকেও।”
অরিনের কোলে রাখা অজনির গালে একটা চুমু খেল। মাথা নিচু করে চুমু দেওয়ায় দিহানের চুল অরিনের গাল ছুঁয়ে গেল। দিহানের একটা হাতে অজনিকে ধরছে। সেই হাতটাও কিছুটা ঘষা লাগে তাঁর হাতে। কেমন জানি একটা শিহরণে কেঁপে ওঠল অরিন। অজনির গাল থেকে মুখ তোলে অরিনের দিকে তাকালো দিহান। দুজনের চোখে চোখ পরতেই অরিন চোখ নামিয়ে নিলো। খুব কাছাকাছি আছে দুজন। দুজনের নিশ্বাসের তীর দুজনের গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। সেটা জেনো গা ছুঁয়ে কলিজায় গিয়ে বিঁধছে। জেগে উঠছে মনের পুরনো অনুভূতি। ভারি নিশ্বাসের শিহরণ। অরিন আবার চোখ তোলে তাকালো। দিহান এখনো তাকিয়ে আছে। তৎক্ষণাৎ চোখ নামিয়ে নিলো সে। দিহান আর দাঁড়ালো না। বড় বড় পা ফেলে বেড়িয়ে গেলো বাসা থেকে।
শাওন এগিয়ে এসে অরিনকে বলল” কেমন আছো অরিন?” অরিন জবাব দিলোনা। শাওন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল” অতীত ভুলে যেতে শিখো অরিন। নয়তো জীবনে যতই এগিয়ে যাবে তোমার এক পা পিছনে থেকেই যাবে। যেটা তোমাকে সামনে এগুতে দিবেনা। অতীতের দুঃসময়গুলো যত মনে করবে, ততই তুমি পোড়বে আর ততই তোমার মনে জাগবে ক্ষোভ। আর সেই ক্ষোভ নিয়ে চলতে গিয়ে হারিয়ে ফেলবে তুমি তোমার জীবনের সুন্দর মূহুর্তগুলা। যা অবশেষে আফসোস হয়ে সামনে দাঁড়াবে। তাই অতীতকে ছুঁড়ে ফেলে বাঁচতে শিখো। দেখবে সব কিছুই সুন্দর। আসছি আজ। বাই।
চলবে….।
পর্ব ছোট হওয়ায় সরি।❤