ভালোবাসি_প্রিয় পর্ব_৩৫

0
1848

ভালোবাসি_প্রিয়
পর্ব_৩৫
#সুলতানা_সিমা

হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে দিহান। মাথায় আর হাতে ব্যান্ডেজ। তাঁর বেডের পাশে চেয়ারে বসে আছে শাওন, আর নীল বসে আছে বেডে। কাল সকাল থেকে আজ সকাল পর্যন্ত তাঁরা হাসপাতালে আছে। কিন্তু সেটা শান্তি নীড়ের কেউ জানেনা। এমনিতেই তাঁরা কষ্টে আছে,এর মধ্যে যদি শোনে দিহান এক্সিডেন্ট করেছে, তাহলে সবার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাবে। তাই আর জানায়নি বাড়িতে। একবার ফোন এসেছে বাসা থেকে, নীল বলেছে তাঁরা শাওনদের বাসায় আছে।

পিটপিট করে চোখ খুললো দিহান। চোখ খুলতেই নীল আর শাওন হন্তদন্ত হয়ে, তার কেমন লাগছে,কষ্ট লাগছে কিনা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। দিহান নীল ও শাওনের কোনো জবাব দিলোনা। তাঁর ঠোঁট মুখ শুষ্ক। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্ষীণস্বরে বলে উঠল”
_অরিন।” নীল আর শাওন একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। আজ সকালে নিউজে দেখিয়েছে অরিন নাকি জেল থেকে পালিয়েছে। নীল দিহানকে বলল”
_এখন কেমন লাগছে রে? ” দিহান উঠতে চেষ্টা করলো। শাওন আর নীল ধরে বসালো। কিন্তু দিহান বসেও থাকতে চাইছে না, সে বেড থেকে নামতে চাইলো। নীল বললো” আরে নামছিস কেন? ওয়াসরুমে যাবি?” দিহান কোনো জবাব দিলোনা। ফ্লোরে পা রাখতেই তার মাথায় একঝাঁক ব্যথা এসে ঝেঁকে ধরলো। দিহান চোখ খিঁচে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে। নিজেকে কিছুটা শক্ত করে হাঁটা ধরে সে। তারপর বেরিয়ে আসে রুম থেকে। নীল শাওন পিছু পিছু দৌড়ে আসে। শাওন বলে ” আরে কই যাচ্ছিস তোর রেস্টের প্রয়োজন।” ডাক্তার এসে দিহানকে থামতে বলে সে থামেনা। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এসে দেখে নীলের বাইক পার্ক করা। দিহান হাত পেতে ইশারা করলো চাবি দিতে। নীল কিছু বলতে যাবে দিহান হাত বারিয়ে থামিয়ে দেয়। তারপর আবার ইশারা দেয় চাবি দিতে। মুখে কিছুই বলছেনা। নীল চাবি বের করে দিহানের হাতে দিলো। দিহান বাইক নিয়ে চলে গেলো। শাওন আর নীল একটা ট্যাক্সি করে দিহানের পিছু নিলো।

বাইক চলছে দিহানের দেওয়া গতিতে, কিন্তু তাঁর চোখের জল ঝরছে তাঁর নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। এতোবড় ভুল সে কী করে করতে পারলো। তাঁর ভালোবাসাকে সে এভাবে নিজের হাতে কষ্ট দিলো? তাঁর সন্তান যার গর্ভে তাঁকে সে জেলে দিয়ে আসলো? কোনো যাচাই বাচাই ছাড়াই? বাবা হওয়ার খবর শোনাটা যে কতটা খুশির তা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য কারো নেই। আর সে কিনা সেই সুখটাই নিজের হাতে দুঃখের সাগরের ছুঁড়ে মারলো? দিহানের ইচ্ছে করছে নিজের কলিজায় নিজে ছুরি চালাতে। শেষ করে দিতে নিজেকে। কে সে এতোটা পাষাণ? কাল সকালে যখন শোনলো সে বাবা হবে, তখন মনে হয়েছিলো পৃথীবির সব সুখ তার হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে। তারপর আবার যখন শোনলো অরিন খুন করেনি, তখন সে পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছিলো অরিনের কাছে। তারপর মাঝ রাস্তায় এসে কী হলো কিছু মনে নেই তাঁর।

_________________________
কাল যা ঘটেছেঃ

ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ভাতের প্লেট ছুঁড়ে ফেলে রুমের অনেক জিনিস ভাংচুর করে দিহান। তারপর কান্না করতে করতে বলতে লাগে “এমনটা কেন করলে অরিন। কী করিনি তোমার জন্য? নিজের সব ছেড়ে দিয়েছিলাম। তবুও কেন ঠকালে আমায়? কেন বেইমানি করলে? তোমাকে বিশ্বাস করেই তো আমি জানতেও চাইনি কেন বিয়ে করেছিলে আমায়। তারপরও কেন আমার বিশ্বাস নিয়ে খেললে?” কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে খাটে এলোমেলো হয়ে শুয়ে পড়ে দিহান। মিনমিন করে আওড়াতে লাগে “কেন ঠকালে আমায় অরিন। খুব ভালোবাসি তোমায়, কেন বুঝলেনা সেটা।” এগুলা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে দিহান। ফোনের তীক্ষ্ণ রিংটোনের সকালে তাঁর ঘুম ভাঙ্গে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ডাঃ ফারহান কল দিয়েছে। ডঃ ফারহান তাঁদের আত্মীয় তাই কোনো কারণ ছাড়াই মাঝে মাঝে কল দেয়। বর্তমানে সে সিংগাপুর আছে। টাইম টা দেখে নিলো দিহান, সকাল 9টা বাজে। প্রথমে ফোন ধরতে চায়নি, পড়ে কী মনে করে যেন রিসিভ করে ফেলল। ফোন ধরতে ওপাশ থেকে উত্তেজিত গলায় বলল।”

_Congratulations দিহান।” ফারহানের কথাটা দিহানের কাছে বিদ্রুপের মতো শোনালো। রাগে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। দিহান ফোন কাটতে যাবে তখনই ফারহান বলে উঠল”
_কী ভাই আমাদের মিষ্টি খাওয়াবে না?
_কিসের মিষ্টি?” গম্ভীর গলায় বলল দিহান।
_কিসের মিষ্টি মানে? প্রথম বার বাবা হচ্ছো। বাংলাদেশ থেকে সিংগাপুর পর্যন্ত মিষ্টি খাওয়ানোর কথা, আর তুমি বলছো কিসের মিষ্টি। আরে ভাই হোয়াটসঅ্যাপে ফটো দিলেই আজকাল চলে। ” ফারহানের কথাটা দিহানের ভেতর খুব গভীরে গিয়ে স্পর্শ করে। লাফ দিয়ে উঠে বসে উদ্বিগ্ন গলায় বলে ” ক্ক ক্ক কী বলছো এসব বা বাবা হচ্ছি মানে?”
_কেন রিপোর্ট পাওনি? ডঃ মুন আমাকে বলল তোমার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট।” দিহানের মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি ফুটে উঠলো। অরিন প্রেগন্যান্ট? তারমানে সে বাবা হবে? খুব খুশি খুশি লাগছে তাঁর। মনে হচ্ছে যেন সুখের রাজ্যে রাজত্ব করছে সে। সেই সুখের রাজ্যের সুখের সমুদ্রের সুখের নৌকায় চড়ে সুখের জলের উপর ভাসছে। চারদিকে শুধু সুখ সুখ আর সুখ। খুশিতে চোখ চিকচিক করে উঠল। খুশিতে যেন কথা বলা ভুলে গেছে সে। এতো খুশি লাগছে কেন তাঁর? ঠোঁটে হাসি চোখে জল নিয়ে কাঁপা বলল”
_আ আ আমি বা বাবা হবো?
_কেন রিপোর্ট আননি এখনো?
_না আজই আনবো গিয়ে, আমি রাখছি।” দিহান ফোন রেখে দৌড়ে রুম থেকে বের হলো। রুম থেকে বেরিয়েই পা থেমে গেলো তাঁর, মূহুর্তেই সব হাসি উধাও হয়ে গেলো। ভুলেই গেয়েছিলো অরিন কোথায় আছে।

মাঝে মাঝে যেমন আকাশে একঝাঁক পাখির বসে,আবার মূহুর্তেই তা উড়তে উড়তে চলে যায়। ঠিক তেমনি যেন তাঁর মনের এই সুখ। এই এলো আবার এই উড়ে চলে গেলো। শুকনো কয়েক ঢোক গিলে কান্না আটকাতে চাইলো সে। কিন্তু পারলো না। সুখের জলের সাথে দুঃখের জলের মিশ্রণ হয়ে গেলো। পা পিছিয়ে আবার রুমে চলে আসে দিহান। রুমে ঢুকেই জোরে একটা চিৎকার দিলো যা পৌছালো বাড়ির সবার কান পর্যন্ত। তারপর চিৎকার করে বলতে লাগলো” আমি নিজেকে শেষ করে দিবো অরিন। তোমাকেও শেষ করে দিবো।” বলেই কাঁদতে লাগে দিহান।

একটু পরে দিহানের ফোনে আবার কল আসে। ইন্সপেক্টর আহসান কল দিয়েছেন। দিহান চোখের পানিটা মুছে ফোন ধরে।

_হ্যালো।
_হ্যাঁ দিহান, তোমার বাবাকে ফোন দিলাম ধরেন নি। একটা ব্যাপার তো ঝাপসা হয়ে গেলো।
_কী ব্যাপার স্যার?
_খুনটা তোমার ওয়াইফ করে নি। অন্যকেউ করেছে।” কথাটা শোনে দিহান শকড খায়। অরিন খুন করেনি মানে। কিছুক্ষণ সে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে। ফোনের ওপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো শোনে দিহানের ধ্যান ভাঙ্গে। তারপর কাটা গলায় বলে
“কী বলছেন স্যার। তাহলে কে খুন করেছে?
_তা জানিনা।
_স্যার আমাকে একটু খোলে বলুন প্লিজ।
_দিহান আসামির হাতে যে পিস্তল পাওয়া গেছে। ওই পিস্তলের গুলির সাথে ডেড বডিতে পাওয়া গুলির কোনো মিল নেই। কেবল তাই নয় এই গুলি পিস্তল থেকে নয় রিভলবার থেকে করা হয়েছে।

[সরি সেদিন আমি জামিল খানের হাতে রিভলবার না লেখে পিস্তল লেখে ফেলছি]

ইন্সপেক্টর আহসান রাজের কথা শোনে বড়সড় একটা ধাক্কা খায় দিহান। অরিনের হাতের পিস্তলে দুটো গুলি ছিলো না, যা দিহানের সন্দেহ আরো গাঢ় করে দিয়েছিলো। দিহান হন্তদন্ত হয়ে বলে”
_এসব কী বলছেন স্যার? আপনি সিয়র তো?
_অবশ্যই দিহান, আমি সিয়র না হয়ে তোমায় ফোন করিনি। আমার প্রথমেই মনে হয়েছিলো এটা পিস্তলের গুলি নয়। পিস্তল থেকে রিভলবার অনেকগুণ শক্তিশালী, শরীররে ড্যামেজ ক্ষতের পরিমাণ বেশি, রিভলবারে পিস্তল থেকে গুলি করার সময় রিকয়েল (ধাক্কা) পরিমাণ বেশি। পৃথিবীতে স্মিথ এন্ড ওয়েসন এর তৈরী ৫০০ ম্যাগনাম সিরিজ ব্যাপক জনপ্রিয়। যা ব্যবহার হয়েছে মৃত ইশির বেলায়। পিস্তল থেকে রিভলবারের গুলিতে বারুদের পরিমাণ বেশি থাকতে পারে এবং থাকে। তাই বলে পিস্তলেও কম থাকে তা কিন্তু নয়। তবে এখন তো রিপোর্ট সব পরিষ্কার করে দিচ্ছে। খুনটা পিস্তল দিয়ে নয়, রিভলবার দিয়ে হয়েছে। যা আসামির হাতে আমরা পাইনি।”

দিহানের মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। এসব কী শুনছে সে? তাহলে কী অরিন সত্যি খুন করেনি ইশিকে? বুকের ব্যথাটা তীব্র হয়ে গেলো দিহানের। শুকনো ঢোক গিলে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলো। ফোনের ওপাশ থেকে ইন্সপেক্টর আবার বলে উঠলেন।

_আজ তোমার আব্বু আর চাচ্চুদের নিয়ে একবার আসবে। রাখছি এখন।” টুট টুট করে ফোন কেটে গেলো। দিহানের মাথা ভনভন করছে। শূন্য মস্তিষ্কে কিছুই আসছে না তাঁর। অরিনের কান্না ভেজা মুখ চোখে ভেসে উঠছে। কত কাকুতি মিনতি করেছিলো অরিন। পায়ে ধরে কেঁদেছিলো, আর সে কিনা। কেমন ভালোবাসা তাঁর যে ভালোবাসায় বিশ্বাস নেই। দিহান আর এক মূহুর্ত বসে থাকল না, উঠে দৌড়ে বের হলো ঘর থেকে। এভাবে দিহানকে বের হতে দেখে শাওন আর নীল অবাক হয়, তারাও বের হয় দিহানের পিছে। ততক্ষণে দিহান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দেয়। নীল আর শাওন বাইক নিয়ে দিহানের পিছু নেয়। দিহান একটু আগে চিৎকার করে বলেছিলো, শেষ করে দিবে সে নিজেকে। শেষ করে দিবে অরিনকে। নীল আর শাওনের ভয় হচ্ছে, যদি উল্টা পাল্টা কিছু করে ফেলে। কিছুদূর যাওয়ার পরে দিহানের গাড়ি একটা বাসের সাথে ধাক্কা খায়। আল্লাহর রহমতে কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে গুরুতর আহত হয়েছে অনেকে। দিহানের মাথা ফেটে যায়। তারপর নীল আর শাওন মিলে দিহানকে নিয়ে হসপিটাল আসে।

______________________________________
বর্তমান

থানায় এসে দিহান সোজা যায় অরিনকে যেখানে রেখেছিলো ওইখানে। কিন্তু ওখানে কেউ নেই। দিহান সবাইকে ডাক দেয়৷ সবাই দৌড়ে এসে দিহানের সামনে দাঁড়ালো। দিহান জিজ্ঞেস করলো অরিন কই, কেউ কথা বলল না, সবাই মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকল। দিহান চেঁচিয়ে বলে উঠলো” কথা কানে যায়না, অরিন কোথায়?” দিহানের চিৎকারে সবাই কেঁপে ওঠে। পুলিশ অফিসারের ছেলে যে নিজেও পুলিশ। তাঁকে ভয় পাবেনা তো কাকে পাবে? ভয়ার্ত গলায় এক হাবিলদার বলে ”
_স্যার মেয়েটা পালিয়েছে।” কথাটা দিহানের বুকে এসে পাথরের পাহাড় হয়ে হয়ে ধাক্কা দিলো। তাঁর হাড়গোড় যেন সব ভেঙ্গে যাচ্ছে। কষ্ট আর রাগে তার শরীর কাঁপছে। পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল তাঁর। রাগে একটা চেয়ার হাতে নিয়ে আছাড় মেরে ফেলে মেঝেতে। তারপর চেঁচিয়ে বলল ”
_তোমরা এতোগুলা মানুষ থাকতে এইটুকু একটা মেয়ে পালায় কীভাবে?
_স্যার আমরা মেয়েটাকে অনেক খুঁজছি স্যার। কিন্তু খুঁজে পাইনাই।
_জাস্ট সেট আপ ড্যাম ইট। কাকে মেয়ে মেয়ে ডাকছো? শী ইজ মাই ওয়াইফ। জাস্ট কল হার মেডাম।” জোরে কথা বলায় দিহানের মাথায় ব্যথা শুরু হয়ে যায়। মনে হচ্ছে কেউ তার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছে। দিহান দাঁতে দাঁত চেপে মাথা চেপে ধরে। তারপর মাথা ছেড়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে ” খোঁজ লাগাও। পত্রিকায় ছবি ছাপাও। টিভিতে খবর দাও। দেশের প্রতিটি কোণায় কোণায় খুঁজো। ২৪ ঘন্টার ভেতরে খুঁজে বের করো। যদি খুঁজে না পাও তাহলে তোমাদের সবার চাকরি হারাবে।

রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে দিহান বেরিয়ে গেলো থানা থেকে। তারপর খোঁজতে লাগলো অরিনকে। সারাদিন খুঁজলো, রাত খুঁজলো পেলোনা অরিনের সন্ধান। তবুও থামলো না সে। নিদ্রাহীন উপবাসে কেটে যাচ্ছে সময়, তবুও মিলছেনা অরিনের কোনো খোঁজ। কই গেলো অরিন? কোথায় আছে সে? কেমন আছে এখন? ঠিক আছে তো সে? প্রশ্নগুলো খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে দিহানকে। চোখ জোড়া বার বার ভিজে যাচ্ছে। এ কেমন অসহনীয় যন্ত্রণা। এ কেমন বিষাক্ত সময়। কেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে দিহানের? অপরাধী বলে অরিনের দিকে তো আঙুল সে নিজেই তুলছিলো, তাহলে কেন এতটা পোড়ছে সে?

চলবে……।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here