ভালোবাসি_প্রিয়
পর্ব_৩২
#সুলতানা_সিমা
দুই মাস পর
★
★
লাল নীল বাতি আর নানান ফুলে সাজানো হয়েছে শান্তি নীড়। চারদিকে হৈ চৈ ছোট ছোট বাচ্চাদের দৌড়াদৌড়ি। বাগানের পাশে খালি জায়গাটায় আরেকটা বাগান সাজানো হয়েছে ফুলের গেট দিয়ে। কিছুদূর পর পর একটা ছোট গেট পুরোটাই ফুলের তৈরি মনে হচ্ছে। প্রতিটি গেটের পরে দুটো টেবিল। চারিদিকে লাল সাদার সমাহার। বড় একটা জায়গায় অনেক সুন্দর করে স্টেজ সাজানো হয়েছে। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা “আজ দিশার গায়ে হলুদ”।
হ্যাঁ আজ দিশার গায়ে হলুদ। তার বড় চাচ্চুর পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার। দিশা এই বিয়েতে রাজি নয়, তাঁর অবুঝ মন এখনো শাওনের নামে থেমে থাকে। কিন্তু কী করার গুরুজনদের মুখের উপর কথা বলার সাহস যে তাঁর নেই। তাঁর পরিবার একবার অপমানিত হয়েছে আবার হোক এটা সে চায়না। তাই হাসি মুখে মেনে নিচ্ছে সবকিছু। কিন্তু ভেতরটা যে পুড়ে যাচ্ছে, সেটা কী কেউ দেখছে? আয়নার সামনে বসে এক ধ্যানে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে দিশা। গায়ে ফুলের গয়না। দামী একটা লেহেঙ্গা সাজগোজ করেনি এখনো তবুও তাকে অনেক সুন্দর লাগছে। তারপরও খুশি নয় সে, মুখে তাঁর নকল হাসি। দরজা খুলে এসে অরিন আর লারা ঢুকলো। দুজনই হলুদ শাড়ি পরেছে। তাদের উপস্থিতি পেয়ে দিশা তড়িঘড়ি করে চোখের পানিটা মুছে নিল। অরিন আর লারা তাকে সাজানোর জন্য বসালো। বিয়ে ঠিক হয়েছে থেকে অরিন দিশার সব কিছু দেখাশুনা করছে। দিশা কী খেলো না খেলো কী লাগবে তাঁর কী কী কেনা হয়নি। সব কিছু।
অরিন আগের থেকে কিছুটা ফর্সা হয়েছে। বিয়ের পরে মেয়েরা সুন্দর হয় এটা মনে হয় সত্যিই। অরিনের মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। শুধু অরিন নয়,এই দুইমাসে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে শান্তি নীড়েও। দিহানের বড় চাচ্চু আর আগের মতো রাগারাগি চেঁচামেচি করেন না। দিহানও পুলিশে চাকরি নিয়েছে। তবে এটা সে আপাতত করছে, এসব চাকরি বাকরি নাকি তাকে দিয়ে হবেনা, কোনো একটা ব্যবসার ব্যবস্থা করে সে চাকরি ছেড়ে দিবে। তবুও কারো কাছে হাত পেতে টাকা নিয়ে নিজের বউ চালাবে না।
লারা জিহানের সম্পর্কটাও আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে। জিহান লারাকে নিয়ে ঘাটাঘাটি করা একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। সে ভাবে যেভাবে বিয়ে হোক লারা তো আর খারাপ মেয়ে নয় থাকুক না এভাবে আমার কাছে।
এদিকে নীল এই তিন মাসে পারেনি লুপাকে মনের কথাটা বলতে। শাওন ও বলেনি সে লুপাকে ভালোবাসে, কারণ শাওন আন্দাজ করে নিয়েছে নীল লুপাকে ভালোবাসে। তাই সে চায়না নীলের মনটা ভেঙ্গে দিতে। লুপা আগের মতোই নীলকে বলে আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই, কিন্তু নীল এটা ওটার বাহানা দিয়ে বিষয়টা এড়িয়ে যায়। শোনেনা লুপার কথা। তার মনে ভয় হয় লুপা যদি তাকে ভালোবাসি বলে,তাহলে সে কীভাবে লুপাকে না বলবে আর শাওনের মনটাই বা কিকরে ভাঙ্গবে। তবে লুপার সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। লুপা মাঝে মাঝে নীলকে ঝাড়ি দেয় কারণ নীল তাকে একবার তুই একবার তুমি বলে। নীলও আরো ক্ষেপায় তাকে আর সেও নীলকে শাস্তি দেয়। মাঝে মাঝে কথা বলা বন্ধ করে দেয় তখন নীল কান ধরে ওঠবস করে ভিডিও বানিয়ে লুপাকে পাঠায়। লুপা এসব এসে অরিনের সাথে শেয়ার করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়।
এই দুইমাসে সব কিছু পরিবর্তন হলেও দিহানের মায়ের মাঝে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তিনি এখনো অরিনকে সয্য করতে পারেন না। এইতো সপ্তাহখানেক আগের কথা। অরিন রান্না করেছে শোনে তিনি না খেয়ে সারাদিন বসে থাকলেন তবুও অরিনের হাতের রান্না খেলেন না। পরে দিহান অরিনকে নিষেধ করে বলে আর যেন সে কিচেনের ধারে কাছে না যায়। এ নিয়ে কেউ কথা বললে সে যেন দিহানকে শোনায় যা করার দিহান করবে তবুও সে যেন চুপ থাকে। কিন্তু অরিন দিহানের কথা রাখতে পারেনা সে দিহানের মায়ের সাথে একদিন ঝগড়া করে। শুধু দিহানের মা নয় ইশির সাথেও দু’তিন দিন ঝগড়া হয় তার।
সেদিন ইশি আর দিশার কথা শোনার পর থেকে ইশিকে তার সয্য হয়না। ইশি দিহানের পাশে বসলে দিহানের সাথে কথা বললে তার মনে হয় কেউ যেন তার কলিজা ছিড়ে ফেলছে। দিহান অবশ্য এ নিয়ে অরিনকে বকাবকি করেনি ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়েছে। কিন্তু কে বুঝে কার কথা। দিহানের সাথে ইশি কথা বললেই অরিনের গা জ্বলে যায়। দিহান রুমে আসার পরে দিহানের সাথে কথা বলেনা। দুদিন আগে অরিনকে নিয়ে দিহান ডাক্তারের কাছে যায়। বাসায় ফেরার সময় দিহান চকলেট এটা ওটা তার বোনদের জন্য আনে। ইশি দিহানের সাথে চকলেট কাড়াকাড়ি করে একসাথে দুজন খাটে পড়ে যায়। সেই থেকে দিহানের সাথে রাগ করে আছে অরিন। সেদিন সারারাত ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না করেছে। দিহান টেনে টুনে বুকে এনে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। রাগে অরিন বলে সে ইশিকে খুন করে দিবে সয্য হয়না তার ইশিকে। দিহান হাসে অরিনের এমন পাগলামির কথা শোনে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দিহান অরিনকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয়না। চুপ মেরে বসে থাকে। সারাদিন দিহান পিছে পিছে হাঁটে কিন্তু সে দিহানের সাথে কথা বলেনি। রাগে তার মাথা ফেটে যায় ইশি আর দিহানকে একসাথে দেখলে। পরেরদিন রাতে অরিন দিহানকে ঝাপটে ধরে ঘুমায়, যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। দিহান ভাবে হয়তো রাগ ভেঙ্গে গেছে কিন্তু না,সকালে উঠে আবার সেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। দিহান তখন অসহায় চেহারা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। অরিনের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠে। দিহানের অসহায় মুখ তাকে অনেক কষ্ট দেয়। অরিন দিহানের সাথে কথা বলতে যাবে তখনই তাঁর ফোনে কল আসে।
সেদিন যে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল সে ডাক্তার কল দেয়। ডাক্তার জানায় সে প্রেগন্যান্ট। খবরটা শোনে খুশিতে সে কান্না করে দেয়। আর কথা বলেনি দিহানের সাথে, ভাবে দিহানকে সারপ্রাইজ দিবে সে। তখনই কথা হবে দিহানের সাথে। অরিন দিহানকে না খুঁজে লারার কাজে সাহায্য করতে চলে যায়। আর যাই হোক নিজের ননদের বিয়েতে তো আর হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে হবেনা।
_ভাবী তোমার ফোন ভাজতেছে।” দিশার চেঁচিয়ে বলা কথায় অরিন কেঁপে ওঠে। এতক্ষণ ধরে সে ভাবনায় ডুবে ছিলো। এভাবে দিশার চেঁচানো শোনে তাঁর কলিজা লাফাতে শুরু করছে। বুকে থু থু দিয়ে বলল”
_হ্যাঁ হ্যাঁ শো শোনছি তো।
_কই শোনছো কতক্ষণ ধরে তোমায় ডেকে যাচ্ছি।
_খেয়াল করিনি।” মৃদু গলায় বলল অরিন। দিশা বলল”
_যাও কথা বলে আসো।” অরিন ফোন হাতে নিয়েই থমকে যায় এটা কী দেখছে সে, সেই মুখোশধারী এতোদিন পরে আবার ফোন দিছে? এতোদিন ধরে মুখোশধারী কে সেটা খুঁজতে খুঁজতে ব্যর্থ হয়ে এক সময় হাল ছেড়ে দেয় সে আর লারা। অরিন শুকনো একটা ঢোক গিলে। লারার বুঝতে বাকি নেই কে কল দিচ্ছে লারা ইশারা দিলো কল ধরার জন্য। অরিন ফোন নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। ততক্ষণে কল কেটে যায়। আর কল আসেনা শুধু একটা মেসেজ আসে। মেসেজে লেখা “বাড়ির পেছনের পুকুর পাড়ে আসো”। মেসেজটা পড়ে অরিনের আত্মা শুকিয়ে যায়। মোবাইলে সময়টা দেখে নেয় সন্ধ্যা ৭টা বাজে। তারমানে অন্ধকার নেমে গেছে। এখন আবার কোন হুকুম করবে সে, দিহানকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলবে না তো? ভাবতেই কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠল অরিনের। ভয়ে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। চোখের জল টলমল করছে পলক পড়লেই সেটা গড়িয়ে পড়বে। পেটের উপর হাত রেখে ডুকরে কেঁদে উঠে অরিন। আজ কত খুশির দিন তাঁর। আজ সে জানতে পেরেছে সে মা হবে, দিহানের বাচ্চার মা হবে। এই খুশির দিনে এই ব্ল্যাকমেইলার কে আসতে হলো। আচ্ছা এখন যদি বলে দিহানকে ছেড়ে দিতে তখন? বললে বলুক সে দিহানকে ছেড়ে দিবেনা। দিহান যে তার রক্তে মিশে গেছে। দরকার হলে মেরে দিবে এই জানোয়ারকে, তবুও সে দিহানকে ছাড়বে না। চোখের পানি মুছে নিজেকে শক্ত করে দিশার রুমে যায় অরিন। দিশা চোখ বন্ধ করে আছে লারা তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। অরিন লারাকে মেসেজটা দেখাল। লারা মেসেজটা দেখে দিশাকে বলল”
_দিশা তুমি একটু বসো আমি অরিনকে একটা কাজ দিয়ে আসি।
_ভাবী এখানেই থাকুক কী কাজ করবে?
_না না সব কাজ সবাইকে দিয়ে হয়না। তুমি বসো আমি আসছি।” লারা অরিনকে নিয়ে তার রুমে গেল। দরজা বন্ধ করে এসে তার লাগেজ বের করল। লাগেজের সব কাপড় বের করে সব কাপড়ের নিচ থেকে একটা পিস্তল বের করল। পিস্তল দেখে অরিন আঁতকে উঠল। ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে চোখ বড় বড় করে থাকাল। লারা অরিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল”
_এটা নাও। উলটা পালটা কিছু বলছে দেখলেই শেষ করে দিবে তাকে।
_আ আ আ আমি।
_হ্যাঁ তুমি। আজ এতোদিন পরে কেন ডাকছে সে, বুঝনা তুমি? তার কাজ শেষ। এবার চলে যেতে বলবে তোমাকে। পারবা যেতে? আমি জানি পারবা না। তাই শেষ করে দিবে তাকে।
_আ আপু।
_ভয় কেন পাচ্ছো তুমি? আমি তো তোমার সেফটির জন্য এটা দিচ্ছি। নাও এটা।” কাঁপা কাঁপা হাতে অরিন পিস্তল হাতে তুলল। খেলনার পিস্তল ছাড়া সত্যিকারের পিস্তল সে কখনো চোখেই দেখেনি ছুঁয়া তো দূর। অরিন শাড়ীর আঁচলে লুকিয়ে নিলো। লারা লাগেজে সব কাপড় ঢুকিয়ে লাগেজ জায়গা মতো রেখে অরিনকে বলল” যাও এবার। ভয় পেয়না।” বলেই লারা চলে গেল। অরিনের মনে হচ্ছে বিষধর সাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। ছোট ছোট পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো অরিন। তাকে দেখলে যে কেউ বুঝে যাবে সে কোনোকিছু লুকাচ্ছে। আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নামলো অরিন। নীল শাওন আর দিহান মিলে কিসের যেন লিষ্ট করছে। সাথে আরো দুজন আছে তাদের চিনতে পারেনি অরিন। দিহান একবার আড়চোখে অরিনের দিকে তাকাল। তারপর নিজের কাজে লেগে গেল। যতই হোক বোনের বিয়ে ব্যস্ততা তো থাকবেই। অরিন সদর দরজা পেরিয়ে আসতেই তার হাতে হেচকা টান পড়ল। ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে অরিন। ভাগ্যিস শাড়ীতে পেছানো হাত ধরেনি দিহান। নয়তো এখানেই সব শেষ হয়ে যেত। অরিন দিহানের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করে। দিহান অরিনকে বলে”
_কী হইছে তোমার সকাল থেকে কিছু খাচ্ছো না কেন?
_আমার ইচ্ছা হাত ছাড়ুন। আমার কাজ আছে।
_এদিকে তোমার কী কাজ। আর না খেয়ে কিসের কাজ? যাও রুমে খাবার রেখে আসছি খাও গিয়ে।
_খাবনা আমি,আপনার আদরের চাচাতো বোনকে নিয়ে খাওয়ান।” অরিনের কণ্ঠ কান্নামাখা। চেহারা এমন বানিয়ে রাখছে যেন এবার কেঁদেই দিবে। দিহান বুঝে গেল এত সহজে অরিনের রাগ ভাঙ্গবে না। সে অরিনের কপালে চুমু দিয়ে বলল”
_আর কোনোদিন কোনো সময় ইশির হাতটাও ধরব না আমি। কথাও বলব না কখনো। হ্যাপি।
_কথা বলতে পারবেন কিন্তু ছুঁতে পারবেন না। ছুঁয়েছেন তাহলে কিন্তু,,
_তাহলে কিন্তু?
_মেরে দিবো।
_কাকে?
_সবাইকে।
_আচ্ছা আমার বউটা সবাইকে মেরে দিবে? কথা না বলে বলে যে স্বামীকেও মেরে দিচ্ছে সে দিকে খেয়াল রাখছে। এদিকে যে বউ খাচ্ছেনা বলে তার স্বামীটাও না খেয়ে আছে সেটা জানে সে?”
_সরি। আর হবেনা। যান আপনি আপনার কাজ শেষ করুন আমি আমার কাজ করে আসছি। তারপর একসাথে খাবো আমরা।
_তার আগে আমি অন্য কিছু খেতে চাই।” দিহান মুচকি হেসে অরিনের দিকে একটু ঝুকে। অরিনের ঠোঁটের দিকে তার দৃষ্টি। অরিন লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। ঠোঁটে তার লজ্জার হাসি চোখে মুখে লজ্জার আভা। দিহানে অরিনের ঠোঁট ছুঁই ছুঁই এরই মাঝে কেউ চিৎকার দিয়ে উঠে
_আহহহহহহহহ্।” দিহান অরিন দুজন দুইদিকে ছিটকে পড়ে। ইশি চোখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেচারি ভাবতেই পারেনি ভুল সময়ে তার এন্ট্রি হবে। এদিকে অরিন অগ্নি দৃষ্টিতে ইশির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে সে ইশিকে কেটে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। দিহান অরিনের দিকে তাকিয়ে শুকনো এক ঢোক গিলল। এই ঝড় যে তার উপর দিয়ে যাবে এতে তার কোনো সন্দেহ নাই। ইশি বলল”
_তোকে বড় ভাইয়া ডাকছে।” দিহান চুল ঠিক করে কলার ঠিক করে এদিক ওদিক তাকিয়ে চলে যেতে লেগে থেমে যায়। অরিনের দিকে আবার তাকায় অরিনের হাতের মধ্যে পিস্তল দেখে কপাল কুঁচকে ফেলে সে। অরিন এখনো ইশির দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে আছে। ঘরের ভিতর থেকে দিহানের ডাক এলো। দিহান অরিনের হাতের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চলে গেলো। কোনো বাচ্চার খেলনা হবে এটা। এটাই ভাবল দিহান। ইশিও ভিতু চোখে অরিনের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো সে। অরিন এখনো রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। আপাতত নিজেকে কনট্রোল করে চলে গেলো পুকুর পাড়ে।
__________________________________
বাড়ির পিছনের দিকটায় কখনো আসেনি অরিন,এই প্রথম আসলো। চারদিকটা তাকিয়ে দেখল অরিন। শুধু গাছ আর গাছ। বাড়ির পিছনে অনেক জায়গা আছে। দিহানরা চাইলে এখানে আরেকটা বড় বিল্ডিং করতে পারবে। বাগানের লাইটিংয়ের কিঞ্চিৎ আলো আসছে এদিকে। সে আলোতে দেখা যাচ্ছে পুকুর পাড়ে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। অরিন শাড়ীর কুঁচি ধরে হেঁটে এগিয়ে গেল। একটু এগুতেই তার ফোনে টুং করে একটা মেসেজ আসলো। অরিন তৎক্ষণাৎ মেসেজ চেক করলো। কারণ সে জানে ব্ল্যাকমেইলার যা বলবে মেসেজে বলবে মুখে নয়। মেসেজ ওপেন করতেই থেমে গেলো অরিন। কারণ মেসেজে লেখা ছিলো “ওখানে থামো”। অরিন দাঁড়িয়ে থাকল। মনে অজানা ভয় হচ্ছে। মুখোশধারী ঘুরে দাঁড়াল। অরিন কিঞ্চিৎ কাঁপা গলায় বললো ”
_দে দে দেখুন। তা তা তানভী আমার স স সৎ বোন। ওর ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিতে হয় দিয়ে দিন। আমার আর কিচ্ছু যায় আসেনা। তবুও আমায় আর জ্বালাবেন না। আমি দিহানকে ছাড়তে পারবো না।” অরিনের ফোনটা টুং করে বেজে উঠল। অরিন মেসেজ চেক করলো। “আজ তোমার শেষদিন”। মেসেজ টা দেখে অরিনের পৃথীবি থমকে গেল কারণ মেসেজটা অন্য নাম্বার থেকে এসেছে। আর এই নাম্বারটা তার ফোনে সেভ করা। অরিনের মাথা ঘুরে উঠে। বিশ্বাস হচ্ছেনা তাঁর যে এই নাম্বারের মানুষটা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অরিন কাঁপা গলায় বলল”
_আ আ আপনি আমাকে এখন মেসেজ দিয়েছেন?” অরিনের ফোনে আবারও এই সেভ নাম্বার থেকে মেসেজ আসলো। অরিনে চেক করে দেখলো “হ্যাঁ কেন?” অরিনের মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। এ কাকে দেখল সে? যাকে সে নিজের সব কিছু দিয়ে ভালোবাসতো। সব থেকে বেশি বিশ্বাস করতো। তাকে? অরিনের স্তব্ধ হয়ে যাওয়া দেখে মুখোশধারীর কিছুটা সন্দেহ হলো। তৎক্ষণাৎ ফোন চেক করে ৪৪০ ভোল্টের শকড খায় সে। এ ভুল কীভাবে করে ফেলল সে? এতক্ষণ ধরে সে 1সিম থেকে মেসেজ সেন্ড করছে? যে সিমটা দিয়ে সে অরিন লারাকে মেসেজ দেয় সে সিমটা 2সিম। ভুলেই গেছিলো সে। তাহলে অরিন তাকে চিনে ফেলল? নিজের উপর রাগ করে ফোনটা ছুঁড়ে মারল সে।
এদিকে অরিনের দম বন্ধ হয়ে আসছে। অদৃশ্য ধারালো অস্ত্র তার কলিজা টুকরো টুকরো কেটে দিচ্ছে। অতিরিক্ত কষ্ট পেলে নাকি মানুষ পাথর হয়ে যায়। অরিনও তাই হয়ে গেছে। মস্তিষ্ক শূন্য লাগছে তাঁর। সমস্ত শরীরের শক্তি যেন মাটি চুষে খেয়ে ফেলছে। হাত থেকে ফোন আর পিস্তল পরে গেল। ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো সে। চোখ থেকে অঝোর ধারা বৃষ্টি ঝরে পরছে। প্রাণশূন্য হয়ে গেছে সে। আজ মনে হচ্ছে এই পৃথীবির সব থেকে অসহায় হচ্ছে সে। অশ্রুভরা চোখ দুটি তোলে তাকাল উপরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে কান্নাজড়িত গলায় বলল”
_লুপা শেষ পর্যন্ত তুই?”
লুপার আর লুকিয়ে থাকার উপায় নেই মাক্স খুলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সে। এত বড় ভুল করে ফেলবে কল্পনাও করেনি সে। দুজনই পাথরের মতো বসে থাকে অনেক্ষন। অনেক্ষন পর লুপা এগিয়ে এসে অরিনের কাঁধে হাত রাখে। অরিন ঝাড়া দিয়ে লুপার হাত সরিয়ে চেঁচিয়ে বলে”
_এই পাপী হাতে ধরবি না আমায়। আমার ঘৃণা হচ্ছে তোর মতো এত নীচ একটা মানুষের সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিলো। আরে তুই তো হচ্ছিস বন্ধু জাতের কল,,,,,অরিন লারার মুখ চেপে ধরলো। অরিন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো লুপাকে। চেঁচিয়ে বলল ”
_এখন খারাপ লাগছে কেন শোনতে? কী ক্ষতি করেছিলাম তোর বলবি? কী শত্রুতা ছিলো তোর আমার সাথে? আরে তুই তো জানতিই আমার মা নেই আমার বাবা নেই আমি অনাথ। তবুও আমাকে তোর দাবার গুটি কেন বানালি? [কিছুক্ষণ কী একটা ভেবে] তু তু তুই আমাকে মারতে চেয়েছিলি তাইনা? তু তুই আমার দিকে ছুরি ছুঁড়ে মেরেছিলি? আমার গলা টিপে ধরছিলি?” চোখের পানিটা মুছে মাটি থেকে পিস্তল তুলে লুপারা হাতে দিয়ে বলল”
_নে মার? মেরে দে আমায়। এতো বড় ধোঁকা খেয়ে বেঁচে থাকার ক্ষমতা নেই রে আমার। মেরে দে। [চিৎকার করে] আরে মার না”।” লুপা পিস্তলটা অরিনের দিকেই ছুঁড়ে ফেলে চেঁচিয়ে বলল”
_মরার খুব শখ তোর তাহলে তুই নিজেই মর আমাকে মারতে বলছিস কেন?
অরিন কাঁদতে কাঁদতে বলে”
_আমাদের মনের কথাগুলা কার কাছে বলতে আমাদের কোনো দ্বিধা লজ্জা থাকেনা জানিস। বেস্টফ্রেন্ডের কাছে। একমাত্র এই একটা মানুষ যার সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্কের থেকেও গভীর সম্পর্ক থাকে। যে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেয়। কিন্তু সব বন্ধু যে বন্ধু নারে। কিছু বন্ধু বিষাক্ত সাপ। তুই বলতি না তুই আমার বোন হস? ওই যে লোকে বলেনা পর কখনো আপন হয়না। আজ আমার বিশ্বাস হচ্ছে সত্যি বলে মানুষ।”
অরিন ফোন আর পিস্তলটা তুলে দৌড়ে চলে আসে ওখান থেকে। লুপা অরিনকে হাত ধরে আঁটকাতে চায় অরিন ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে আসে। বাড়ির বাম দিকে আসে অরিন। ডান দিকে স্টেজ সাজানো হয়েছে তাই ওদিকে যায়নি সে। তার এখন একা থাকাটা বড্ড প্রয়োজন। ভিতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে তার। কলিজাটা পুড়ে যাচ্ছে।
ড্রয়িং রুমে সবাইকে ডেকে আনলেন দিহানের মা। দিহানকে আর জিহানকে বাইরের কাজ ভাগাভাগি করে দিচ্ছেন। সাথে নীল আর শাওন ও থাকছে। একে একে সবাইকে কাজ ভাগ করে দিচ্ছেন তিনি। পরিবারের সবাই এখানে আছে। লুপা ছিলনা এই মাত্র এসে ঘরে পা রাখলো। ইশি দিহানের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। দিহান সরে গিয়ে একটু দূরে দাঁড়ালো। ইশি আর দিহানের মা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। সবাই মনোযোগ দিয়ে দিহানের মায়ের কথা শোনছে এমন সময় হঠাৎ একটা গুলি এসে দিহানের মায়ের হাতে লাগে। ভয়ে সবাই চিৎকার দিয়ে উঠে। এরইমাঝে আরেকটা গুলি এসে লাগে ইশির ঠিক বুক বরাবর। সাথে সাথে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। ইশির মা লারা লুপা সবাই ইশিকে ধরে কান্না শুরু করে দেয়। চিল্লাচিল্লি শুনে দিশা রুম থেকে বেরিয়ে এসে এসব দেখে দৌড়ে নিচে নেমে আসে। লুপার মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন” আরে কেউ গাড়ি বের করো।” জিহান দৌড়ে গাড়ি বের করতে যায়। দিহান বাড়ির বাম পাশে দৌড়ে যায় গুলিটা এইদিক থেকেই এসেছে। এদিকে এসেই দিহান থমকে যায়। তার সামনে অরিন পিস্তল হাতে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে…..।