ভালোবাসি_প্রিয় পর্ব_২

0
3252

ভালোবাসি_প্রিয়
পর্ব_২
#সুলতানা_সিমা

পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবেছে মাত্র মিনিট দু’য়েক হবে। সন্ধে নেমেছে পুরো শহর জুড়ে। দক্ষিণা বাতাস বইছে চারিদিকে। মসজিদে মসজিদে আজানের ধ্বনি শুনা যাচ্ছে। বিশাল বড় পাচঁতলা বিল্ডিংয়ের তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাতক পাখির মতো ছেলের পথ চেয়ে আছেন সুমনা চৌধুরী। এই বড় বাড়িটার নাম শান্তি নীড়। এটা উনার শশুরের দেওয়া নাম। শান্তি নীড় নাম দেওয়ার পেছনে একটা কারন আছে। সেটা হলো এই বাড়িতে কখনো ঝগড়াঝাটি হয়না। উনাদের যৌথপরিবার। উনার দেবর বাশুড় সবাই সবার বউ বাচ্চা নিয়ে এক সাথে থাকে। এতে নাকি সুখ আছে। সুমনা নিজেও এতে সুখ পান। নিজের স্বামীর পরিবার নিয়ে গর্ববোধ করেন। কিন্তু উনার মনে হয় এই বাড়ির নাম শান্তি নীড় না হয়ে আইনজীবী ভিল্লা হওয়া উচিত ছিল। এটা মনে হওয়ারও একটা কারন আছে। সেটা হলো এই বাড়ির সবাই আইনের লোক।

উনার শাশুড় ছিলেন একজন সেনাবাহিনী। উনার স্বামী হচ্ছেন পুলিশ অফিসার। উনি নিজেও পুলিশে চাকরি করতেন। বাচ্চা কাচ্চার জন্য চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়েছে অনেক আগে। উনার দেবর ভাশুর দুজনই পুলিশে চাকরি করেন। উনার বাশুরের ছেলে সি আই ডি পুলিশ। উনার বড় জা একজন উকিল। এক কথায় এই বাড়িতে শুধু আইনজীবী দিয়ে ভরপুর।

উনার দুই মেয়ে আর এক ছেলে। বড় মেয়ে দিশা অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ে। ছোট মেয়ে দিয়া ক্লাস টেনে পড়ে। আর উনার একমাত্র ছেলে দিহান সে এইবার অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে।

এতোক্ষন ধরে এই দিহানেরই পথ চেয়ে আছেন তিনি। কাল সন্ধ্যায় দিহান গিয়েছিল বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। আজ আরেক সন্ধ্যা হয়ে গেলো এখনো দিহান বাড়ি ফিরেনি। ফোনটাও বন্ধ কল যাচ্ছেনা। সুমনার মনে বার বার কুঁ ডাকছে। উনার ছেলে ঠিক নেই বলে বার বার মনে হচ্ছে। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ উনার কাধে হাত দিল। চোখের কোনে জমে থাকা জলটা মুছে পিছন ঘুরে তাকালেন তিনি। উনার স্বামী হানিফ চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন।

_নামাজ পড়বে না?
_হুম পড়ব তো। [একটু থেমে] বলছিলাম কি। ছেলেটা কই গেল একটু খুঁজে দেখনা। সারাদিন পেরিয়ে গেলো এখনো আসলো না। চারিদিকে শত্রুর ভিড় আমার ছেলেটা নিরাপদে আছে কিনা আল্লাহই জানে।
_তোমরা মায়েদের এই কারণে আমার বিরক্ত লাগে। সব কিছু এত নেগেটিভ মাইন্ডে ভাবো কেন? পজিটিভলি ভাবো। হতে পারে তার ফোনে চার্জ নেই। বন্ধুরা ছাড়ছেনা বলে আসতে পারছে না। তোমার ছেলে কি ছোট রয়েছে? ও এখন যথেষ্ট বড় চিন্তা করনা চলে আসবে।

সুমনা চৌধুরী কিছুই বললেন না শুধু বুক ছিড়ে আসা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। সন্তানের অনুপস্থিতি ভিতরটা কিভাবে খোঁড়ে খোঁড়ে খায় সেটা মা ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারেনা। স্বয়ং বাবাও না। চোখ থেকে চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে রুমে চলে আসলেন। তিনি।

_____________

_কি গো বারো বেটার বউ? শুধু শুয়ে ঘুমিয়ে দিন পার করলে চলব? কাজ কাম কিছু করন লাগব নাকি? রান্নাবান্না কে করবো? তর বারো জামাই আইসা কইরা দিবো?

সৎ মায়ের মুখে এমন তীক্ষ্ণ কথা শুনেও কিছু বললো না অরিন। বইয়ে মুখ গুজে বসে থাকল। রোজ রোজ এমন কথা শুনতে শুনতে সে অভস্ত্য হয়ে গেছে। তার মা যখন তাকে চার বছরের রেখে মারা যান। তারপর তার বাবা এই মহিলাকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন। সেই থেকে এই পর্যন্ত উনি এক দিনও অরিনের সাথে ভালো ব্যবহার করেন নি। ওর বাবা থাকতে কিছুটা কম বকাঝকা করতেন। উনি মারা গেছেন থেকে উনার বকাঝকা অত্যাচার বেড়ে গেছে। ওর বাবা মারা গেছেন তখন সে ক্লাস টেনে পড়ে। উনি মারা গেছেন থেকে তাকে লেখাপড়ার খরচ দেয়না তার সৎ মা।

এই তিন বছর ধরে অরিন নিজের টাকা দিয়ে চলে। টিউশনি করিয়ে কিছু টাকা পায় সেগুলা দিয়ে ওর লেখা পড়া চালায়। মাঝে মাঝে কম দাম দিয়ে কিছু জামা কাপড় কিনে। প্রতিদিন কলেজে যেতে হয় জামা তো লাগবেই। ওর সৎ দুইটা বোন একটা ভাই। তার আর তার সৎ ভাই বোনদের মাঝে আকাশ পাতাল তফাত। ওদের পোশাকে আভিজাত্য আছে। চেহারায় সুখি ভাব আছে। আর সে? ভাবতেই তাচ্ছিল্য হাসলে অরিন।

অরিনের পড়তে ভালো লাগছে না মন খারাপ হয়ে গেছে তার। এখন একমাত্র লুপার সাথে কথা বললে মনটা ভালো হবে। অরিন ফোন হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। লুপাকে ফোন দিতে হবে। লুপা তার বেস্টফ্রেন্ড। খুব অভিমানী মেয়েটা। অল্পতেই অভিমান করে বসে। আবার অল্প কিছুতেই তার অভিমান ভেঙে যায়। তিন চারবার কল দেওয়ার পরে রিসিভ করলো লুপা।

লুপা কল রিসিভ করেই ঝাঝালো গলায় বললো”
_ওই কুত্তি তুই আমারে কল দিলি কেন?
_সরি ইয়ার ভুল হয়ে গেছে।
অরিনকে ভ্যাঙ্গ করে লুপা বললো “”সরি ইয়ার ভুল হয়ে গেছে। ফোন রাখ তুই আর কোনোদিন আমাকে ফোন দিবিনা।
_বললাম তো সরি। দেখ তুই শুধু শুধু রাগ করছিস। এটা রাগের কোনো কারন হলো বল?
_অবশ্যই রাগের কারন আছে। আমি প্রতিদিন কলেজ যাওয়ার সময় তর জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করি। আর তুই কলেজ শেষেই ফুড়ুৎ করে উড়াল দিস। বুঝলাম প্রতিদিন তর টিউশনি থাকে তাই আমাকে ফেলে চলে যাস। আজ তো তর টিউশনি ছিলনা। তাহলে আজ কেন আমায় ফেলে আসলি?
_আজ বাসায় অনেক কাজ ছিল ইয়ার।
_তুই থাক তর কাজ নিয়ে আমি রাখলাম।

রাখলাম বলেই ফোন কেটে দিলো লুপা। কিছুক্ষণ পরে আবার অরিনকে কল দিবে দিয়ে সরি বলবে। এটাই এই মেয়েটার সভ্বাব। অরিন রুমে আসতেই দেখলো তার সৎ বোন তানভি টেবিলের উপর পা তুলে পায়ে নেইল পলিশ দিচ্ছে। তানভির পা বার বার বইয়ের সাথে লাগছে। অরিন বড় বড় পা ফেলে দ্রুত হেটে এসে তার বইটা হাতে নিয়ে কিঞ্চিৎ ধমকের স্বরে বললো

“” তানভি তুই কি দিন দিন ছোট হচ্ছিস? বইয়ে যে তর পা লাগছে সেদিকে খেয়াল নেই তর? আর সারা বাড়ির জায়গা থাকতে আমার টেবিলের উপর এসে কেন তোকে নেইল পলিশ লাগাতে হবে?
“” অরিনের মা চেচিয়ে তেড়ে আসলেন “” কার টেবিল? কার টেবিল বলছিস? এটা তর টেবিল? আমার বাবা আমাকে সব মালামাল দিয়ে বিয়ে দিয়েছে। এটা আমার বিয়েতে এসেছে। তর মায়ের মতো ফকিন্নি বেশে আসিনি আমি।
_মা তুলে একটা কথা বলবা না। আমার মা এখানে কি করছে যে আমার মাকে টানছো?
_একদম মুখে মুখে তর্ক করবি না। নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে।
_করব তর্ক। কি করবা? কি করবা তুমি? “”” বলতে না বলতেই অরিনকে টাস টাস করে থাপ্পড় দিতে শুরু করলেন জহুরা (অরিনের সৎ মা)। একটু আগে যে অরিন রান্না করতে যায়নি সেই রাগটা এই সুযোগে ঝেড়ে দিচ্ছেন তিনি। অরিনের চুলে মুঠি ধরে বললেন “বলছিলাম না তর্ক করবি না। খেয়েদেয়ে যে বেঁচে আছিস এই শুকরিয়া আদায় কর। ” অরিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেয়েকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। ধাক্কা খেয়ে নিচে পরে যায় অরিন। কপাল টা গিয়ে খাটের সাথে বারি খায়। কপাল থেকে হাত এনে সামনে তুলে ধরতেই দেখে পুরো হাত রক্তে লাল হয়ে আছে।

চলবে……..।
রিচেক করিনি ভুল ক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here