#ভালোবাসার_সন্ধিক্ষণ
#পর্ব_০৩
#গল্পছোঁয়া Jannatul Ferdous Mahi
–আমাদের খাদ্যের একটা তালিকা আছে আন্টি,কম আয়রনযুক্ত খাবার আমরা খেতে পারবো।
–বলো,তোমাকে না খাইয়ে আমরা ছারছিনা (মিষ্টির বাবা এগিয়ে এসে)
মিষ্টির বাবা একজন ব্যাঙ্কার।ওনার বস মিষ্টির বাবার থেকে প্রতিভার সম্পর্কে অনেক কথাই শুনেছেন তিনি,প্রতিভার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে তার অনেকদিনের,কিন্তু সময়ের অভাবে হয়ে উঠেনা,আজকে দেখা হয়েই গেলো।
–কিরে মাহমুদ,এটাই সেই প্রতিভাবান মেয়ে নাকি (বস)
–জ্বি স্যার,এটাই প্রতিভা
–দারুণ মিষ্টি দেখতেতো,কেমন আছো মা
–আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল,আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ যেমন রাখছেন।আপনি কেমন আছেন। (প্রতিভা)
–আলহামদুলিল্লাহ
তুমি দেখতে ভারি মিষ্টি,তোমাকে দেখলে বুঝা যায়না তুমি এতো জটিল একটা রোগে আক্রান্ত
–জ্বী আঙ্কেল,আমার প্লীহা নেই জন্য বুঝা যায়না ততটা,আমি থ্যালাসেমিয়া রোগে ভুগছি ঠিকই তবে আলফা থ্যালাসেমিয়ায়।আলফা থ্যালাসেমিয়ায় রোগের উপসর্গ ও তীব্রতা অনেকটাই কম,সবার ক্ষেত্রে সব লক্ষন থাকেনা।
–মামনী,তোমার থেকে আমার কিছু জানার ছিল।আসলে আমার ছোট ছেলে,এই ধরো বয়স আড়াই বছর চলছে,জন্মের পর ২বছরের মতো বেশ স্বাস্থবান,সুস্থ ছিল কিন্তু ইদানিং আমার ছেলের এই বয়সেই শ্বাসকষ্টের পরিমাণ তীব্র,ত্বকও ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে,প্রস্রাব হলুদ,বয়স অনুযায়ী দৈহিক বৃদ্ধি খুবই কম, পেট কেমন ফুলে যাচ্ছে। এই বয়সী বাচ্চারা যতটুকু খেলাধুলা করে আমার ছেলে সেখানে একটু হাতপা ছোরাছোরি করলেই হাঁপিয়ে যায়।
আমার সন্দেহ হচ্ছে ও এ রোগে আক্রান্ত কিনা
–ডক্টর দেখিয়েছেন আঙ্কেল?
–আমার ওয়াইফ কিছুতেই ডক্টরের কাছে যেতে দেবেনা,সে কবিরাজে বিশ্বাসী,আমি অনেকবার বলেছি শোনেনি
–আঙ্কেল,এটা সত্যিই চিন্তার বিষয়।
আমার মনে হয় আপনার ছেলের টেস্ট করানো উচিত।দুটি টেস্ট করিয়ে আপনি নিশ্চিত হয়ে নিতে পারবেন আপনার ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ নাকি থ্যালাসেমিয়া জিন বহন করছে।টেস্ট দুটো হলো সিবিসি টেস্ট এবং হিমোগ্লোবিন টেস্ট।
সিবিসি টেস্ট হলো একটি সামগ্রিক রক্ত পরিক্ষা,এই পরিক্ষায় রক্তে উপস্থিত হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কেমন,রক্তকণিকা স্বাভাবিক আছে কিনা প্রভৃতি বুঝতে এই টেস্টটি গুরুত্বপূর্ণ।
হিমোগ্লোবিন টেস্টের মাধ্যমে জানতে পারবেন রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কতো,সাধারণত পুরুষদের জন্য প্রতি ডেসিলিটারে ১৩.৫-১৭.৫ গ্রাম,মহিলাদের জন্য প্রতি ডেসিলিটারে ১২.০-১৫.৫ গ্রাম,আর শিশুদের ক্ষেত্রে প্রতি ডেসিলিটারে মিনিমাম ৭-৮গ্রাম।
থ্যালাসেমিয়া দু প্রকারের রয়েছে,বিটা থ্যালাসেমিয়া ও আলফা থ্যালাসেমিয়া।
বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজরের অপর নাম কুলিস অ্যানিমিয়া,যেসব নবজাতক বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজরে আক্রান্ত তারা জন্মের সময় বেশ স্বাস্থবান থাকে,তবে জন্মের ১ম দুইবছরের মধ্যে বা এরপরে রোগের উপসর্গ দেখা দেয়,বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৬০-৮০মিলিয়ন মানুষ বিটা থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করছে।আপনার কথানুযায়ী লক্ষনগুলো বিটা থ্যালাসেমিয়ার,আপনার বলা লক্ষনগুলে ছারাও আরও কিছু লক্ষন রয়েছে যেমন ধরুন যকৃৎ বড় হয়ে প্লিহার আকৃতি বৃদ্ধি পায়,এর জন্য পেট ফুলে যায়,নাকের হাড় দেবে যায়,মুখের গড়নের পরিবর্তন আসে,দৈহিক বৃদ্ধিও ব্যহত হয়,দিনেদিনে জটিলতা বাড়তেই থাকে।
আমার মনে হয় আপনার ছেলের যত দ্রুত সম্ভব টেস্ট করানো প্রয়োজন,যদিও থ্যালাসেমিয়া রোগের স্থায়ী কোনো চিকিৎসা নেই,জেনারেলি এটা নিরাময়যোগ্য কোনো রোগ নয় তবে আমরা চাইলে এর প্রতিরোধ করতে পারি,এ রোগের চূড়ান্ত চিকিৎসা হলো বোনম্যারো প্রতিস্থাপন।বোনম্যারো বা অস্থিমজ্জা কে বলা হয় রক্ত তৈরির কারখানা।বোনম্যারো প্রতিস্থাপন একধরনের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা,রোগির রোগাক্রান্ত অস্থিমজ্জা মানে বোনম্যারো কেমোথেরাপির মাধ্যমে নষ্ট করে ডোনার থেকে বিশেষ ধরনের রক্তকোষ বা স্টেমসেল কালেক্ট করে রোগির শরীরে প্রবেশ করানো হয় অনেকটা ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মতো।
থ্যালাসেমিয়া যেহেতু বংশগত রোগ,তাই আপনি আর আন্টিও নিজেদের টেস্ট করিয়ে নেবেন যে আপনারা এ রোগের বাহক কিনা।
–থ্যাঙ্ক ইউ প্রতিভা,এতগুলো ইনফরমেশন দেওয়ার জন্য,কতো জানো তুমি
–কি করবো বলুন,আমি যেহেতু এ রোগে আক্রান্ত,জানি এর কষ্টটা কতটা তীব্র,সময় পেলে আমি এরোগের যাবতীয় ইনফরমেশন কালেক্ট করার চেষ্টা করি,যাতে আমার দ্বারা আমি নিজের সহ অন্যদেরও উপকারে আসতে পারি।
–আসলেই তুমি একজন প্রতিভাসম্পন্ন মেয়ে প্রতিভা,ভালো থাকো,সুস্থ থাকো দোয়া করি (প্রতিভার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যেতে লাগলেন)
–আঙ্কেল শুনুন
–জ্বী মা,বলো
–আঙ্কেল আমি আলফা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত,জেনারেলি বিটা থ্যালাসেমিয়ার থেকে আলফা থ্যালাসেমিয়া কম তীব্র।আমাদের আলফা থ্যালাসেমিয়া বিশিষ্ট রোগিদের ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি প্রকৃতির হয়ে থাকে অন্যদিকে বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা ও প্রকোপ অনেক বেশি,এক-দুই বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে ঠিকমতো চিকিৎসা না করালে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণও হতে পারে, তাই প্লিজ যতদ্রুত সম্ভব মনে করে টেস্ট করিয়ে নিয়েন,ভালো থাকবেন।
আসসালামু আলাইকুম
মিষ্টির বাবার বস মুচকি হেসে চলে গেলেন,প্রতিভা বসে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
–আমার বসের কাছে তোমাকে নিয়ে অনেক কথা বলতাম,তাই উনি তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন
–এসব কথা রাখো,প্রতিভা বললেনা কি খাবে তুমি? (মিষ্টির মা)
–অনেক কিছুই রয়েছে,এখানে সম্ভবত মিষ্টি,পাউরুটি পাওয়া যাবে তাইনা আন্টি??
–হুম,আছে
–এটা কম আয়রনযুক্ত খাবার,খেলে খুব একটা অসুবিধা হবেনা,আপনি বরং আমাকে একটু মিষ্টি আর পাউরুটি এনে দিতে পারেন
–কমলার জুস খাবে??
এতে তো কম আয়রন রয়েছে?
–ওকে ঠিক আছে।
★
পরদিন সকাল ১১ঃ০০
প্রতিভা ম্যাডিকেলে ওয়েটিং রুমে বসে আছে,নার্সের সঙ্গে কথা হয়েছে,ডোনারের আসার কথা ছিল ১০টার দিকে,কিন্তু ১১বেজে গেছে এখনও ডোনারের আসার কোনো খবর নেই,অপেক্ষা করতে করতে প্রতিভা এবার সত্যিই ক্লান্ত,বিরক্ত লাগছে এবার।
হঠাৎ ওর সামনে দিয়ে একটা মাস্ক পড়া লম্বা সুঠামদেহি লোক শার্টের ট্রাই খুলতে খুলতে চেম্বারে প্রবেশ করলো,এরকম কত লোক আসছে যাচ্ছে,সবাই ব্লাড ডোনার,কিন্তু অন্য ব্লাডগ্রুপের,দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রতিভা।
এদিকে প্রতিভার মা বারবার মেয়েকে কল করছে রক্ত পেয়েছে কিনা,তিনি একটুব্যস্ত থাকায় আসতে পারেননি,অবশ্য প্রতিভাই ওনাকে সঙ্গে নিয়াসেনি।ব্যাগ থেকে নিজের বাটন ফোন বের করে ওর মা’কে কল ব্যাক করলো প্রতিভা..
–আসসালামু আলাইকুম আম্মু
–ওয়ালাইকুম আসসালাম,রক্ত পেয়েছিস তুই??
–নাহ,আম্মু এখনও ডোনার আসেনি
তুমি এত ঘনঘন কল করোনাতো,ব্লাড পেলে আমিই তোমাকে কল করে জানাবো,চিন্তা করোনা
–চিন্তা হয় রে,বুঝবিনা তুই।আচ্ছা রাখছি।
প্রতিভা কল কেটে ফোন ব্যাগে রেখে মাথা নিচু করে বসে আছে,আর কত সময় অপেক্ষা করতে হবে আল্লাহ জানে।
এরমধ্যেই নার্স চেম্বারের বাইরে এসে প্রতিভাকে ডাক দিলো..
–মিসঃ প্রতিভা আহাম্মেদ
–জ্বী আমি
–আপনার ডোনার এসে গেছে,আপনি আমার সঙ্গে আসুন।
প্রতিভা নার্সের সাথে টু-বেডের কেবিনে চলে আসলো,নার্স প্রতিভাকে একটা বেডে সুইয়ে দিলো,সবকিছু ঠিকঠাক করতে করতেই একটা ছেলে কেবিনে প্রবেশ করলো,শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে পাশের বেডে বসলেন তিনি।
–ইয়ামিন স্যার,ফ্রেশ হয়ে এসেছেন তো?
–ইয়াহ,তো এই মেয়েটিকেই ব্লাড দিতে হবে তাইতো
প্রতিভা ছেলেটির দিকে একবার তাকিয়েই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে,এটা ওর প্রতিবারের স্বভাভ,ব্লাড ডোনার কোনো পুরুষমানুষ হলে প্রতিভা তার দিকে তাকায়না।
–জ্বি,উনার কথাই বলেছিলাম আপনাকে।
আসলে O- ব্লাড অনেকটাই রেয়ার,প্রতি মাসে ওনার জন্য এই ব্লাড কালেক্ট করা অনেকটাই টাফ হয়ে যায়,তাই উনি ডোনারের নম্বর চেয়েছিলেন।
–ওকে ফাইন,আমি ওনার সঙ্গে কথা বলে নিব,নাম কি ওনার
–মিসঃ প্রতিভা আহাম্মেদ
–ওও আই সি,ওকে সব ঠিকঠাক করুন।
ডান হাত থেকে ব্লাড নেবেন বুঝলেন
–ওকে স্যার
নার্স ইয়ামিনের ডান হাতে স্যালাইনের সূঁচ ঢুকিয়ে দিলো,একেএকে সবটা সেট করে প্রতিভার হাতে আরেকটা সূচ ঢুকালো,এবার ইয়ামিনের থেকে ব্লাড প্রতিভার শরীরে প্রবেশ করবে,সবটা ঠিকঠাক করে নার্স কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।
ইয়ামিনের কেন জানিনা এই প্রতিভা নামের মেয়েটাকে কেমন যেন পরিচিত মনে হচ্ছে,যদিও এখনও মেয়েটির মুখ দেখেনি,তবুও বারবার মনে হচ্ছে এই মেয়েটিকে আগেও কোথাও দেখেছে ও,ইয়ামিন আর চুপ থাকতে পারলোনা,সে এবার ডাক দিলো প্রতিভাকে…..
To be continue….