ভালোবাসার সন্ধিক্ষণ পর্ব ১১

0
298

#ভালোবাসার_সন্ধিক্ষণ
#গল্পছোঁয়া Jannatul Ferdous Mahi
#পর্ব_১১

–এই প্রতিদান দিলে তুমি?
আমার ভালোবাসা কি এতটাই সস্তা মনে হয় তোমার কাছে যে বাচ্চার জন্য ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে দেব,বিকিয়ে দেব নিজের ভালোবাসা।আমার সম্বন্ধে তুমি এই ধারণা পোষণ করো,এতদিনে তুমি এই চিনেছো আমাকে,আমার ভালোবাসার ওপর এই বিশ্বাস তোমার প্রতিভা,আমিকি এতদিনেও তোমার মনে আমার জন্য এতটুকু ভালোবাসা তৈরি করাতে পারিনি

কথাগুলো বলার সময় ইয়ামিনের গলা ধরে আসছে,চোখ থেকে ইতিমধ্যে কয়েকফোটা পানিও ঝরে পরেছে,কতটা কষ্ট পেলে ছেলেমানুষ কাঁদতে পারে,ইয়ামিন আজকে প্রতিভার কর্মে মাত্রাতিরিক্ত কষ্ট পেয়েছে,এই মৌনকষ্টের জের ধরেই তার কান্নার উৎপত্তি।
এদিকে প্রতিভাও নিজের কর্ম আর মানসিকতার জন্য অনুতাপে ভুগছে,ওর দ্বারা আজকে অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে,ইয়ামিনের ভালোবাসার দিকে প্রশ্নবোধক চিহ্ন তুলেছে ও,কি করে সহ্য করবে ইয়ামিন,এমনতো নয় যে প্রতিভা জানেনা,বোঝেনা,ইয়ামিন ঠিক কতটা ভালোবাসে ওকে।ইয়ামিনের কথার প্রতিত্তোরে ওর কিছুই বলার নেই,কিইবা বলবে ও,সত্যিই তো চরম রকমের ভুল+অন্যায় করে ফেলেছে ও।প্রতিভা চুপচাপ মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে আর চোখের পানি ফেলছে,লামিয়াও চুপচাপ মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে প্রতিভার মতো।
ওরও কিছু বলার নেই,প্রতিভাকে সাপোর্ট করে এতদূর আসা ওরও যে ভুল হয়ে গেছে।বড্ড বেশিই লোভি হয়ে পরেছিল সে,ইয়ামিনকে পাওয়ার লোভ,এখন সেও আন্তরিক ভাবে অনুতপ্ত।


কেটে গেলো কয়েকটা দিন,এইকয়দিনে ইয়ামিন প্রতিভার কেয়ার করলেও যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে ওকে।ঠিকমতো সময় দেয়না,রাত করে বাড়ি ফেরে যখন প্রতিভা ঘুমিয়ে পরে,সকালেও তাড়াতাড়ি করে উঠে অফিসে চলে যায়।প্রতিভার টেককেয়ারের জন্য একটা নার্স রেখে দিয়েছে যাতে প্রতিভার যত্নআত্তির কোনো ত্রুটি না হয়।প্রতিভার মা মিসেসঃফাতেমা বেগমসহ সবার সঙ্গে নরমাল বিহেভিয়ার করলেও প্রতিভার সঙ্গে কোনো কথা বলেনা ইয়ামিন,ও-ই দিনের ওই ঘটনার পর থেকে প্রতিভার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি তার,কি করে কথা বলবে,বড্ড অভিমান হয়েছে যে।
এদিকে প্রতিভাও ইয়ামিনের সঙ্গে কথা বলার সাহস পায়না,একটা সরি বলবে সেই ক্ষমতাটাও নেই,কেমন ইতস্তত বোধ হয়,ইয়ামিনের এমন ইগনোর্ডের জন্য প্রতিভাও কষ্ট পাচ্ছে।
কষ্টতো পাচ্ছে দুজনেই,একজন অভিমানে আর আরেকজন অপরাধবোধে।এইকয়দিনে প্রতিভা বহুবার চেষ্টা করেছে ইয়ামিনের সঙ্গে কথা বলার কিন্তু সেই সুযোগটাই পাশনি,কারণ ইয়ামিন রাতে দেরি করে ফেরে,হাই পাওয়ারের ওষুধের জন্য প্রতিভা জেগে থাকতে পারেনা,আবার সকালে প্রতিভার ঘুম ভাঙার আগেই ইয়ামিন চলে যায়।


অফিসে নিজের ডেস্কে বসে আছে ইয়ামিন,ল্যাপটপে নতুন এক গেম সফটওয়্যার তৈরি করার চেষ্টা করছে সে।লামিয়া এসে ইয়ামিনের পাশে দাঁড়ালো।

–ইয়ামিন স্যার

–হুম বলো (টাইপিং করতে করতে)

–আমি সত্যিই লজ্জিত ওইদিনের জন্য, আসলে আমি…

–ইট’স ওকে,বাদ দাও এসব,আমি কিছু মনে করিনি

–তাহলে প্রতিভার সাথে এমন করছেন কেন,ও তো বাচ্চা মেয়ে,একটা ভুল করে ফেলেছে,ওকে কি ক্ষমা করা যায়না,আপনিওতো ওকে ভালোবাসেন।প্রতিভাও আপনাকে ভালোবাসে,কষ্ট তো দুজনেই পাচ্ছেন,ওকে ক্ষমা করে দিননা

–ভালোবাসলেই ক্ষমা করতে নেই।
কখনো কখনো নিজের ব্যক্তিত্ব,সততা,আত্মসম্মানবোধ এবং নিজস্বতা কে শ্রদ্ধা করার জন্য হলেও নিজ হৃৎপিণ্ড কে কষ্ট দিতে হয়

লামিয়া আর কিছু বললোনা,ইয়ামিনের কথার পরিপ্রেক্ষিতে ওর কিছুই বলার নেই,তাই চুপচাপ ইয়ামিনের কাছে থেকে চলে আসলো ও।
রাত ১১টার পর অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় আসলো ইয়ামিন,নিজেদের বেডরুমে ঢুকে দেখে রুমে বাল্ব জ্বলছে,প্রতিভা বিছানায় নেই।এখন তো ওর ঘুমিয়ে থাকার কথা,গেলো কোথায় মেয়েটা।হয়তো ওর মায়ের রুমে আছে,ইয়ামিন মিসেসঃফাতেমা বেগমের রুমের দিকে যেতে গিয়েও গেলোনা,বৃদ্ধা মানুষ,হয়তো মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে পরেছে,এতরাতে ডাকাডাকি করা ঠিক হবে না।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইয়ামিন বিছানায় বসে নিজের পায়ের মোজা খুলতে লাগলো,অনেক বেশি টায়ার্ড লাগছে ওর।ইয়ামিন মোজা খুলে ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াসরুমের দিকে পা বাড়াতেই ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে আসলো প্রতিভা,চোখমুখ ভেজা,আর কেমন একটা ফ্যাসফ্যাসে ফোলাফোলা লাগছে,হয়তো কান্না করেছে,প্রতিভাকে এভাবে দেখে ইয়ামিনের বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভুত হলো,মনে হচ্ছে একটু বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ও প্রতিভাকে,তবুও মেয়েটাকে এতটুকু শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল।

–(নাহ আর কষ্ট দেওয়া যাবেনা,অনেক হয়েছে।ফ্রেশ হয়ে এসেই ওর সাথে কথা বলবো।এতরাতে জেগে আছে কেন ও,জেগে থাকার তো কথা না)

ভাবতে ভাবতে ইয়ামিন প্রতিভাকে ক্রস করে চলে যেতে লাগলে প্রতিভা নিজে থেকেই ইয়ামিনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।

–আই এম সরি,আমি বড্ড বড় ভুল করে ফেলেছি,আমাকে কি ক্ষমা করা যায়না,প্লিজ ক্ষমা করে দিননা,আর রাগ করে থাকবেননা প্লিজ,আমি আর সহ্য করতে পারছিনা।
কেউ নিজের ভুলটা বুঝতে পারলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত,একটাবার সুযোগ দেওয়া উচিত।প্লিজ আমাকে ২য় বার সুযোগ দিন,আমি আর কখনো এধরণের কাজ করবনা,আমি যে ভালোবাসি আপনাকে।অনেক বেশিই ভালোবাসি,হয়তো আপনার মতো এতটা ভালোবাসতে পারিনি,তবুওতো ভালোবাসি,আমাকে ক্ষমা করে দেওয়া যায়না,আমিকি ক্ষমার অযোগ্য (কাঁদতে কাঁদতে)

প্রতিভার এমন আচরণে বুকের ভেতরে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে ইয়ামিনের,মানঅভিমান দূরে ঠেলে সেও বুকে আগলে নিলো নিজের প্রেয়সীকে।কাঁদতে কাঁদতে একসময় কান্না থামিয়ে ফোঁপাতে লাগলো প্রতিভা,ইয়ামিন প্রতিভাকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে তার কপালে চুমু দিলো।

–কাঁদেনা পাগলি,আমি আছিতো।

–ক্ষমা করেছেন তো (ছলছল চোখে)

–আমিতো রাগ করিনি,তুমি রাগ আর অভিমানের পার্থক্য বোঝোনা,আসলেই বুদ্ধি কম।
খাবার খেয়েছো??

–(নিশ্চুপ)

–কি হলো,খাওনি?

প্রতিভা ডানেবামে মাথা ঝাকালো,যার অর্থ সে খাবার খায়নি।

–খাওনি কেন তুমি,এমন করলে কি হবে?
তোমার কতোরকমের ঔষধ রয়েছে,তু…

–ওষুধ খেলে ঘুম পায়,জেগে থাকতে পারিনা,তাই আজকে খাবার ওষুধ কিছুই খাইনি,যাতে আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি

–ওফফ শিট,বিউটি(নার্সের নাম) এত কেয়ারলেস কি করে হতে পারলো,ওর ওপর পুরো রেসপনসেবলিটি দিয়েছিলাম আমি (রেগে)

–বিউটি আপুকে কিছু বলবেননা প্লিজ,ওনার কোনো দোষ নেই,আপু অনেক চেষ্টা করেছে আমাকে খাওয়ানোর,আমিই খাইনি।আম্মুও বলেছিলো খাওয়ার জন্য,আমি কারোর কথা শুনিনি।

–খুব ভালো করেছো,এখন খাবে এসো।
নিজের প্রতি এতো কেয়ারলেস হলে চলবে,তুমি তো এমন ছিলেনা প্রতিভা,মানুষ উইকেনেস থেকে স্ট্রং হয় আর তুমি দিনদিন স্ট্রং থেকে উইক হয়ে যাচ্ছো।

প্রতিভা প্রতিত্তোরে কিছু না বলে টেডি স্মাইল দিলো,প্রতিভার মাথায় এখন অনেককিছু চলছে,কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।
নিজেই কনসিভ করবে,ওর আর ইয়ামিনের সন্তান পৃথিবীতে আনবে।এমনতো নয় যে ১০০% শিওর বাচ্চা থ্যালাসেমিয়া রোগ,বা এ রোগের বাহক হয়ে জন্য নেবে,২৫% ক্ষেত্রে সুস্থ বাচ্চা ভূমিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও আছে।আর বাচ্চা গর্ভে থাকাকালিন সময়েই চেক-আপ করে টেস্ট করে জানা যায় বাচ্চা আদৌও সুস্থ কিনা।আল্লাহ তো ওদের ভাগ্যে সুস্থ বাচ্চাও রাখতে পারে,একবার রিস্ক নিয়ে দেখাই যাক,বাকিটা আল্লাহ ভরসা।


কেটে গেলো ৩টা মাস।
ইয়ামিন দুপুরে লাঞ্চ টাইমে মসজিদে নামাজ আদায় করার পর বাসায় এসেছে খাবার খাওয়ার জন্য।বাসায় এসে দেখে মিসেসঃরাজিয়া,রিম,ঝিম এসেছে।ইয়ামিনকে দেখে রিম,ঝিম দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো।

–সুখবর সুখবর আঙ্কেল

–কিসের সুখবর সোনা

–আমরা বলবোনা,আম্মু,মামনি বলতে নিষেধ করেছে,তুমি তোমার রুমে যাও মামনি নিজেই বলবে

–তাই নাকি,সারপ্রাইজ আছে মনে হচ্ছে

–হুম হুম,তাইতো

–রিমঝিম,কি বলছো তোমরা আঙ্কেলকে? (রাজিয়া)

–আমরা কিছু বলিনি সত্যি

–ইয়ামিন,তুমি রুমে যাও।
প্রতিভা তোমার জন্য ওয়েট করছে

–কি হয়েছে ভাবি

–হয়েছেতো অনেককিছুই,প্রতিভার থেকেই জেনে নিও কেমন।

ইয়ামিন কিছু না বলে নিজের রুমে গেলো,রুমে গিয়ে এদিকওদিক তাকিয়ে প্রতিভাকে খোঁজার চেষ্টা করছে সে,বেলকনির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো প্রতিভা নীল শাড়ি পরে বেলকনির রেলিঙ ধরে দাড়িয়ে আছে,ইয়ামিন নিজের শার্টের কলারের ট্রাই ঢিলা করতে করতে সেদিকে এগিয়ে গেলো,প্রতিভার পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রতিভা এদিকে ঘুরে মিষ্টি হাসি দিলো।ইয়ামিন বুঝতে পারছেনা আসলে হচ্ছে টা কি,প্রতিভার এমন সাজগোজ,সবার এমন আচরণের কারণ কি।
ইয়ামিন প্রতিভাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রতিভা একটা লালগোলাপ আর গোল করে মোড়ানো একটা কাগজ ইয়ামিনের দিকে এগিয়ে ধরলো।

–কি এটা?

–আগে খুলে দেখুন

ইয়ামিন প্রতিভার দিকে একবার সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো,কাগজের ফিতা খুলে কাগজটা খুলে দেখতেই অবাক হয়ে প্রতিভার দিকে তাকালো সে,প্রতিভাবার মুখে লেগে আছে মিষ্টি হাসি,ইয়ামিন ইতিমধ্যে ঘামতে শুরু করেছে,কপাল বেয়ে চিকন ঘাম গড়িয়ে পরছে,কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না সে।ইয়ামিনের থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে প্রতিভা নিজেই ইয়ামিনের গলা জড়িয়ে ধরে বললো…

–কংগ্রাচুলেশনস মিঃইয়ামিন চৌধুরী,আপনি বাবা হতে চলেছেন….

To be continue…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here