#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব -১২]
#আফরোজা_আনজুম
সারাটাদিন আমার আনন্দে কাটলেও মনের কোথাও খারাপ লাগা কাজ করেছে। পরিবারের বড়রা জন্মদিন পালন করার পক্ষে না থাকলেও আমরা ছোটরা ফুল, কেক অর্ডার করে ছোটখাটো আয়োজন করে ফেলি। আমার জন্মদিনেও তাই হলো। সন্ধ্যায় আরিফ ভাইয়া, পিউ, পিচ্চিরা মিলে ফুল, বেলুন দিয়ে রুম সাজিয়ে, গান বাজিয়ে, কেক এনে সারপ্রাইজ দিয়েছে। কিন্তু নিঠুল ভাইয়ের কোনো খবর নেই। ভার্চ্যুয়ালে অনেকে উইস করেছে সে হিসেবে তার জানা আছে আজকে আমার জন্মদিন। সে একটু উইস পর্যন্ত করলো না। সন্ধ্যায় যখন রুমে গান বাজিয়ে নাচানাচি করছে ওরা তখন নিঠুল ভাইয়ের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। রুমে এসে সে অবাক কণ্ঠে বললো, ” এভাবে লাফালাফি করছিস কেন তোরা? সবাই একত্রে পাগল হয়ে গেলি নাকি!”
রুবা নিঠুল ভাইয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো, ” আজকে আপুর বার্থডে। তাই আমরা নাচছি। অনেক মজা করেছি। তুমিও আসো নাচতে।”
নিঠুল ভাই ভ্রু-কুচকে বললো, ” আপুর জন্মদিন হলে নাচতে হবে নাকি! নাচতে নাচতে তোমার আপুকে মাথায় তুলে ফেলতে হবে?”
তিশা খিলখিল করে হেসে বললো, ” নিতু ভাইয়া, আপুকে মাথায় তুলে নাচো। আমরা দেখবো।”
নিঠুল ভাইয়ের মুখে চরম বিরক্তি প্রকাশ পেল। খেতে বসে খাবারের আয়োজন দেখে সবার সামনে বললো সে নাকি জানেই না আজ আমার জন্মদিন। এতো রাগ লাগলো আমার বলার বাইরে। খেয়েদেয়ে রুমে গিয়ে বসে বসে মোবাইলে ভিডিওগুলো দেখছিলাম। এমন সময় নিঠুল ভাইয়ের ফোন এলো। পিউ আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ” নিঠুল ভাই তো ঘরেই আছে। ফোন করছে কেন তোকে?”
বলতে বলতে সে রিসিভ করে কানে নিলো ফোন। ওপাশ থেকে নিঠুল ভাই বললো, ” ছাদে আমার ইয়ার-ফোনটা রেখে এসেছি। ওটা এনে দে তো!”
বলেই সাথে সাথে লাইন কেটে দিলো। পিউ বললো, ” যা নিয়ে আয়।”
তার থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বিছানায় শুয়ে বললাম, ” তোকে বলেছে, তুই যা।”
” আমাকে বললো কখন? তোকে ফোন করেছে।”
” ফোন রিসিভ করেছিস তুই। তোকেই বলেছে। তুই যা।”
নিঠুল ভাই আবারও ফোন করলো। পিউ যাচ্ছে না। তাই আমাকেই উঠতে হলো বাধ্য হয়ে। কেমন সে! এতো রাতে একটা মেয়েকে ছাদে যেতে বলছে। মনে মনে একগাদা কথা শুনালাম তাকে। ছাদে গিয়েই দেখলাম মহাশয় সেখানেই আছে। আমি রেগে বললাম, ” তুমি তো ছাদে আছোই। আমাকে কেন আসতে বললে?”
সে ভাবলেশহীন হয়ে উত্তর দিল, ” ইয়ারফোনটা ঐখানে রাখা আছে। একটু এনে দে। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। ”
আশ্চর্য হলাম তার কথায়। ছাদের বিপরীত দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো ইয়ারফোন কোথায় আছে। দুই পা হেটে গিয়ে সেটা নিতে পারলো না! যাক কথা না বাড়িয়ে গেলাম সেদিকে। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। পায়ের সাথে তারের মতো কিছু লাগতেই সেটাতে হাত দিলাম। এতো বড় তার ইয়ারফোন হয় নাকি! তাকে বলবো তার আগেই সে বললো, ” দাঁড়া। আমি লাইট জ্বালাচ্ছি। ”
সাথে সাথেই আমি চমকে উঠলাম। মুহূর্তেই সামনের দেয়ালটা সোনালী রঙের ঝিলমিল বাতিতে আলোকিত হয়ে উঠলো। সেগুলোর আলোতে দেখতে পেলাম সিমেন্ট দিয়ে বানানো বসার উঁচু জায়গাটাতে ছোট একটা কেক, তার উপর একটা লাল গোলাপ। পেছন থেকে আওয়াজ আসলো তার। পেছনে ফিরে আরও আশ্চর্য হলাম আমি। নিঠুল ভাই হাঁটু গেড়ে বসেছে। হাতে তার সেদিনের কেনা রিংটা জ্বলজ্বল করছে। সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ” উইল ইউ ম্যারি মি?”
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করলো না সে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার বললো, “আই ক্যান্ট ওয়েট টু হিয়ার দ্যা অ্যানসার ‘ইয়েস’ অর ‘নো’। ইটস্ জাস্ট অ্যা ফর্মালিটি। দ্যা অ্যানসার ইজ ‘নো’ বাট ফর মি ইট হেজ টু বি ‘ইয়েস’। আই হেভ টু গেট ম্যারিড। বিকজ, আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ সো মাচ।”
আনন্দে কান্না আসলো আমার। নিজের অজান্তেই অশ্রু ঝরছে। গলার স্বর আটকে আছে। সে আমার হাত টেনে নিয়ে অনামিকা আঙুলে রিংটা পরিয়ে দিয়ে সেটাতে চুমু খেলো। উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছাকাছি এসে হাতদুটো তার হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, ” এই হাত জোড়ার মালিক আজ থেকে আমি। এই যে আমার ভালোবাসার চিহ্ন! আপাতত এটা দিয়ে আমার ভালোবাসার মানুষটাকে সিলমোহর লাগিয়ে অধিকারে নিয়ে নিলাম। খুব শীঘ্রই এই পুরো মানুষটাকে পরিপূর্ণরূপে আমার করে নিবো। একান্ত আমার। ”
তার ঘোরলাগা কন্ঠে আমিও যেন ঘোরে চলে গেলাম। হাত-পা কাঁপছে আমার। এই মুহূর্তের অনুভূতিগুলো সত্যিই অন্যরকম। ভালোবাসার মানুষটি যখন নিজের ভালোবাসাটা প্রকাশ করে তখন বুঝি এমন হয়! সে ততক্ষণে আমার হাত টেনে নিয়ে কেক কাটতে বসিয়ে দিল এবং কেক কেটে নিজেও খেয়ে নিল। পাশ থেকে গোলাপটা নিয়ে সেটা আমার মুখে ছোঁয়ালো। মৃদুস্বরে বললো, ” আরও একটা গিফট বাকী আছে। সেটার জন্য চোখ বন্ধ করতে হবে। ”
আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। তা দেখে সে বললো, ” চোখ বন্ধ করতে বলেছি। চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছিস কেন?”
আমি লাজুক হেসে বললাম, ” আমার জন্মদিনের সেরা গিফট পেয়ে গেছি। আর কোনো গিফট লাগবে না আমার।”
” কিন্তু আমার দেওয়া লাগবে। জলদি চোখ বন্ধ কর।”
চোখ বন্ধ করলাম তার কথায়। একটুপর অনুভব করলাম খুব কাছ থেকে তাকে। তার নিঃশ্বাস ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। চট করে চোখ খুলে ফেললাম। তার হাতদুটো আমার মুখে রাখা৷ এই মুহূর্তে সে কী করতে চায়ছে তা বুঝতে পারছি। ঠোঁট কাপছে, বুক ধুকপুক করছে আমার। নিজের অজান্তেই চোখ বন্ধ হলো৷ সে আলতো করে ঠোঁট বসালো আমার ঠোঁটে। আমার হাতদুটো আপনাআপনি তাকে জড়িয়ে নিলো। এক অন্যরকম, অসহ্যরকম অনুভূতির সাথে পরিচিত হলাম। লজ্জায় চোখ খোলার সাহস পেলাম না। কোমর জড়িয়ে আমার কপালের সাথে তার কপাল ঠেকালো। এভাবে ঘোরের মধ্যে কতক্ষণ ছিলাম জানি না। ধ্যান ভাঙলো তার কথায়।
” এইবার বল তো সেরা গিফট কোনটা? প্রথমেরটা নাকি একটু আগেরটা?”
লজ্জায় আরেকটা রাঙা হলাম। সে বুকে টেনে নিয়ে আমার লজ্জিত মুখটা লুকানোর সুযোগ করে দিলো। তার বুকে মাথা রেখে প্রচন্ড শান্তি অনুভব করলাম। সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে।
.
.
সকালে নাস্তা করতে বসে পড়লাম বিপদে। হাতের রিংটা দেখে পিউ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” এটা কোত্থেকে এলো? কাল রাতেও তো এটা ছিলো না।”
আমি স্বাভাবিকভাবে বললাম, ” আজ দিয়েছি। সেদিন ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে নিয়েছিলাম। ”
ছোট চাচী হাত টেনে নিয়ে দেখে বললো, ” বাহ্! সুন্দর তো। ডায়মন্ডের মনে হচ্ছে।”
আমি হাত টেনে নিয়ে তড়িঘড়ি করে বললাম, ” কী বলো এসব! পঞ্চাশ টাকা দিয়ে নিয়েছি ফুটপাতের দোকান থেকে। ”
বলেই নিঠুল ভাইয়ের দিকে তাকালাম। নিশ্চিন্তে খাচ্ছে সে৷ পিউর মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে বিশ্বাস করে নি।নিঠুল ভাইয়ের কথায় তার সন্দেহ আরো গাঢ় হলো বোধহয়।
নিঠুল ভাই বললো, ” কোনো ছেলেপুলে দেয় নি তো!”
কপট রাগ দেখালাম আমি। এমনিতেই তার জন্য ঝামেলায় পড়েছি। সে আবার উল্টাপাল্টা বলে ঝামেলা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। কেউ বুঝতে পারলে একবার তাহলে আমার আস্ত থাকবে না, মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। পিউ বললো, ” আমিও একটা নিবো। কোত্থেকে নিয়েছিস দেখিয়ে দিস তো!”
রুমে গিয়ে আবারও ধরলো পিউ। গতরাতে ছাদ থেকে আসার পর দেখলাম পিউ ঘুমিয়ে। সে নাকি আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি অতো সময় ছাদে কী করছিলাম এসব জিজ্ঞেস করছে। একটা বলে এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু পিউ তো পিউ। তার কথা আমি নাকি প্রেমে পড়েছি। রুমে তার জন্য পারছি না বলে ছাদে সুযোগ পেয়ে নিরিবিলিতে কারো কথা ভাবতে গিয়েছি।
.
.
আজকাল আম্মুও সন্দেহ করা শুরু করে দিয়েছে। সেদিন রিংটা দেখে আম্মুও জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। আজকে নিঠুল ভাইদের ডিপার্টমেন্ট থেকে কয়েকজন মিলে ট্যুরে যাচ্ছে। তাদের সাথে আমি আর পিউও যাচ্ছি। কয়েকদিন আগে ডিপার্টমেন্ট থেকে ট্যুরে গিয়েছিল। এতো করে বলার পরও সেখানে আম্মু যেতে দেয় নি। খুব মন খারাপ করেছিলাম৷ নিঠুল ভাইকে সুপারিশের জন্য বললে সে বলে তাদের সাথে নিয়ে যাবে।
সকাল সাতটা। তাড়াহুড়ো করে তৈরি হচ্ছিলাম। নিঠুল ভাই আসবে নিতে। পথে পিউকেও তুলে নিবে। নিঠুল ভাই এলো পনেরো বিশ মিনিটের মধ্যে। সে এলে আম্মু তাকে নিয়ে আমার রুমে ঢুকলো। ঢুকেই আমার মোবাইলটা নিলো। তারপর আমাকে বললো রুম থেকে যেতে। কিছুই বুঝলাম না আমি। জিজ্ঞেস করতেই ধমকে পাঠিয়ে দিলো। রুম থেকে বেরিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম আম্মুর এমন ব্যবহারের কারণ কী! রুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম নিঠুল ভাইয়ের হাতে আমার মোবাইল। সে কিছু করছে আমার মোবাইলে। তারপর আবার আম্মুর হাতে মোবাইলটা দিয়ে বলে, ” এমন কিছু নেই মোবাইলে।”
আম্মু চিন্তিত হয়ে বললো, ” তাহলে ও সবসময় মোবাইলের দিকে তাকিয়ে হাসে কেন? শুধু তাই নয়। সারাদিন দেখি একা একা হাসে পাগলের মতো, আর কী যেন ভাবে। ওর হাবভাব আমার ভালো ঠেকছে না। ওকে একটু দেখিস তুই।”
আম্মুর কথার মাঝে নিঠুল ভাইকে ঠোঁট টিপে হাসি এড়াতে দেখলাম। ব্যাটা মজা পাচ্ছে। হেসে আম্মুকে বললো, ” আচ্ছা, আমি দেখবো। তুমি চিন্তা করো না।”
পথে আমাকে বললো, ” তুই নাকি সারাদিন পাগলের মতো হাসিস! অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবিস! প্রেমিকের কথা ভাবিস নিশ্চয়ই! তার কথা ভেবে লজ্জা পেয়ে মিটিমিটি হাসিস তাই না!”
” আমার আর কাজ নেই তার কথা ভেবে ভেবে হাসবো! আমি তো এমনিই হাসি।”
” এমনি তো পাগলে হাসে। প্রেমিকের কথা ভাবতে ভাবতে আবার পাগল হয়ে যাস নি তো! কোনো পাগলিকে তোর প্রেমিক বিয়ে করবে না বলে দিচ্ছি।”
” তুমি বলার কে! সে করবে বিয়ে। এই দেখো, সিলমোহর লাগিয়ে আমাকে তার করে নিয়েছে,” হাতের রিংটা দেখিয়ে বললাম তাকে। সে হেসে আমার হাতটা তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়।
প্রায় দুপুর বারোটার দিকে কাপ্তাইয়ের নেভি ক্যাম্পে পৌঁছালাম। গাড়ি থেকে নেমে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলাম। লেক প্যাডাইস পিকনিক স্পটের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। চারপাশে গাছপালা সহ অসংখ্য পাহাড়। হিমেল বাতাসে পরিবেশটা উপভোগ করার মতো। সবুজ ঘাসের উপর ধুপ করে বসে পড়লাম। পিউ রুপম ভাইয়ার সাথে কথা বলছে। রুপম ভাইয়ার দিক থেকে প্রেমের সাড়া না পেলেও দুজনে কথাবার্তা চালিয়ে যায় সহজেই। নিঠুল ভাইকে ফ্রেন্ডরা ডাকছে ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। রুপম ভাইয়া, পিউ এসে বসে। রুপম ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো, ” কেমন লাগছে, রোজা? পরিবেশটা সুন্দর না?”
আমি হেসে বললাম, ” অনেক সুন্দর। ভীষণ ভালো লাগছে আমার।”
পিউ উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে রুপম ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ” কায়াকিং করতে যাবো না? ”
” এখন না। খাওয়াদাওয়ার পরে।”
” অনেক মজা হবে। রোজা তোরও যেতে হবে।”
” কোনোদিনও না। আমার পানিতে ভয় করে।”
” যাহ! এটাই তো মজার। যেতে হবে তোর।”
আমি কিছু বললাম না। দেখলাম নিঠুল ভাই আর মিষ্টি আপু আসছে। চকোলেট কালারের চেক শার্টে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে নিঠুল ভাইকে। গলায় ঝুলানো ক্যামেরাটা এক হাতে ধরে সেটাতেই দৃষ্টি রেখে হেঁটে আসছে। পিউ দের আড়ালে নিজের মোবাইলে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম তার। ছবিগুলো দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। তার পাশে মিষ্টি আপুও উঠেছে। দুজনকে একসাথে চোখে লাগছে খুব। নিঠুল ভাই আমার পাশে বসে বললো, ” এসেই বসে গেছিস! খবরদার ঘাসে শুয়ে আবার ঘুমিয়ে যাস না। তোর তো আবার যেখানে সেখানে ঘুমানোর অভ্যাস।”
অন্যরা হেসে উঠলে লজ্জা পেলাম আমি। সাথে রাগও হলো। নিঠুল ভাই আমার আর পিউর অনেকগুলো ছবি তুললো তার ক্যামেরায়। নিঠুল ভাই তার সাথে কাপল পিক তুলার কথা বললে তুলতে দিই নি। পিউর নজরে পড়লে সন্দেহ করবে। তাও শুনলো না সে। রুপম ভাইয়াকে দিয়ে ছবি উঠালো দুজনের। দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই জড়ো হয়ে নাচ গান হলো। কায়াকিং করতে যাওয়ার সময় জোর করলেও গেলাম না আমি। পিউ রেগে বললো, ” তুই না গেলে আমি আর ফিরে আসবো না দেখিস!”
আমি হেসে বললাম, ” ঠিক আছে। আমি ফুপিকে জানিয়ে দিবো।”
নিঠুল ভাই জানে পানিতে আমার ফোবিয়া আছে। তাই সে বললো, ” পিউ তুই যা রুপমের সাথে। ও থাক এখানে। রুপম, ওকে দেখিস।”
” তুই যাবি না? ” রুপম ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো।
” না। ওর সাথে আছি আমি। ”
রুপম ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে চলে গেলো। আমি নিঠুল ভাইয়কে জিজ্ঞেস করলাম, ” ভাইয়া হাসলো কেন ওভাবে?”
নিঠুল ভাই হেসে বললো, ” আমি কীভাবে জানবো? জিজ্ঞেস করিস নি কেন? ”
” রুপম ভাইয়া কী জানে আমাদের কথা?”
” আমাদের কী কথা? ” নিঠুল ভাই ভ্রু-কুচকে জিজ্ঞেস করলো।
” কিছু না। তুমি যাও নি কায়াকিং করতে? মিষ্টি আপু তো অনেকবার ডাকলো।”
” মিষ্টি ডাকলেই মিষ্টির পেছনে পিঁপড়ের মতো সুড়সুড় করে চলে যেতে হবে নাকি!” বলে সে ঘাসের উপর শুয়ে পড়লো।
” লেকের পাড়ে চলো না! ওদের দেখি!”
” বোটে না চড়লে যাওয়ার দরকার নেই,” কথাটা বলে সে আমার হাতটা টেনে নিলো। চমকে তার দিকে তাকালাম আমি। সে আপনমনে আমার হাত নিয়ে খেলছে। আমি হাত নিয়ে নিলে সে আমার দিকে রেগে তাকালো। তারপর আবারও হাত টেনে নিয়ে চুমু খেয়ে তার বুকের ওপর রাখলো। চোখ বন্ধ করে উচ্চারণ করলো, “শান্তি।”
লজ্জায় রাঙা হলাম আমি। সেই রাতের পর থেকে তার সামনাসামনি হলেই লজ্জা লাগে, অন্যরকম অনুভূতি হয়। আর সে! হঠাৎ হঠাৎ রেগে গিয়ে ধমকা ধমকি করে ভয় পাইয়ে দেয়, আবার হঠাৎ হঠাৎ অদ্ভুত কর্মকাণ্ডে লজ্জা পাইয়ে দেয়। একটু পর দেখলাম মিষ্টি আপু ফিরে এসেছে। তাকে দেখে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম৷ কিন্তু সে হাতটা বুক থেকে সরালেও হাত ছাড়লো না। মিষ্টি আপুর চোখদুটো আমাদের হাতের দিকেই নিবদ্ধ। নিঠুল ভাইয়ের সেদিকে ধ্যান নেই। সে জিজ্ঞেস করলো, “চলে এলে যে! কায়কিং করো নি?”
” উহুম। দুজন দুজন হয়ে গেছে। তাই যাই নি। তুমি চলো না আমার সাথে! ”
নিঠুল ভাই চট করে উঠে বসলো। লেকের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। নিঠুল ভাই আর মিষ্টি আপু কায়াকিং করছে। অন্যরা ততক্ষণে নেমে এসেছে। আরও বেশ কিছুক্ষণ পর রুপম ভাই এসে পিউর হাত আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ” রোজা, এই পাগলটাকে ধরো তো! সে আজ বোটে থাকার পায়তারা করছে।”
পিউ রেগে বললো, ” আমি আবার যাবো। একা একা কায়াকিং করবো।”
বলতো বলতে সে আবারও সেদিকে চললো। ততক্ষণে নিঠুল ভাইরা ও চলে এসেছে। সবার উচ্ছ্বাস দেখে আমারও ইচ্ছে করছে বোটে চড়তে। কিন্তু সাহস করতে পারলাম না। নিঠুল ভাই হয়তো বুঝতে পেরেছে। সে এসে আমার হাত ধরে বললো, ” চল আমার সাথে। ”
” না, না। আমি জীবনেও না।” ভয়ে ভয়ে বললাম আমি।
” আমি আছি না! কিচ্ছু হবে না। চল।”
ভরসা পেলাম তার কথায়। পিউ লাফিয়ে উঠে বললো, ” আমিও যাবো। ভাইয়া, তোমার বন্ধুকে বলো আমাকে আবার নিয়ে যেতে নিজ দায়িত্বে।”
রুপম ভাইয়া হাত তুলে বললো, ” আমি আর নেই এর সাথে। নিঠুল তুই ওকে নিয়ে যা নিজ দায়িত্বে আবার নামিয়েও নিস নিজ দায়িত্বে।”
পিউ অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিল। নিঠুল ভাই পিউকে নিচু স্বরে বললো, ” পিউ তুই উঠে বস। দেখবি সুড়সুড় করে সেও চলে আসবে।”
বোটে পা রাখতেই ভয়ে আঁতকে উঠলাম আমি। আমার মনে হচ্ছিল তখনই উল্টে পড়ে যাবো। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম নেমে যাবো। নিঠুল ভাই টেনে আমাকে বসিয়ে দেয়। তবে অন্যদের মতো দুজন দু’দিকে নয়। তার সামনেই বসালো। তাও আমি নেমে যেতে চাইলাম। সে আমার মাথাটা তার বুকের সাথে চেপে ধরে বললো, ” এভাবেই থাক চুপচাপ। কিচ্ছু হবে না। ”
প্রথমে একটু একটু ভয় লাগলেও পরে বেশ উপভোগ করলাম।
” ভয় লাগছে? ” কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো নিঠুল ভাই। আমি মুচকি হেসে এদিক ওদিক মাথা নাড়ালাম। পাশের বোট থেকে পিউ পানি ছুড়ে বললো, ” এবার কোথায় পালালো ভয়!”
যেহেতু আমার ভয় ছিলো তাই পিউ আমাদের দুজনকে এভাবে দেখে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে।
আসার সময় মিষ্টি আপু আমাকে একা ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ” নিঠুলের সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন?”
অন্যদিনের তুলনায় আজকে সে আমার সাথে খুব কমই কথা বলেছে। আমি নিশ্চিত সে নিঠুল ভাইকে ভালোবাসে। সেও হয়তো বুঝতে পেরেছে আমার আর নিঠুল ভাইয়ের সম্পর্কটা কেমন।
” কেমন মানে? বুঝলাম না আপু।”
” না মানে তোমাদের মাঝে কী বিশেষ কোনো সম্পর্ক আছে নাকি এমনিতেই.. ”
” কই না তো আপু৷ ” এড়িয়ে গেলাম আমি।
সে বিশ্বাস করে নি আমার কথা। অন্যদিনের তুলনায় আজকে সে আমার সাথে খুব কমই কথা বলেছে। আমি নিশ্চিত সে নিঠুল ভাইকে ভালোবাসে। সেও হয়তো বুঝতে পেরেছে আমার আর নিঠুল ভাইয়ের সম্পর্কটা কেমন।
#চলবে…
#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব-১৩]
#আফরোজা_আনজুম
পুরো বাড়িতে মানুষ গিজগিজ করছে। সন্ধ্যা হতেই আরমান ভাইয়ার বিয়ে উপলক্ষে মেহমানের আনাগোনা বেড়ে বাড়িটা পরিপূর্ণ বিয়ে বাড়ির রূপ নিয়েছে। বিকেলের পর নিঠুল ভাইয়ের কণ্ঠটাও শুনতে পেলাম না;দেখা তো দূর। দুই হাতে মেহেদী পরে রুমে বসে ছিলাম। পাশে পিউ নিজ হাতে দিচ্ছে। হঠাৎ কোত্থেকে সানা দৌড়ে আসলো। এসেই আমার মেলে রাখা দুই হাতে মুখ লুকালো। সে মুখ তুলে সেখানে হাত দিয়ে দৌড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। তারপর শুরু হলো গলা ফাটিয়ে কান্না। তার আচমকা কাণ্ডে হতভম্ব হলাম আমি। নিজের হাতের অবস্থা দেখে আবারও তার দিকে নজর দিলাম। বেচারির পুরো মুখ রঙে লেপটানো। পিউও বোকার মতো তাকিয়ে আছে। সানার কান্নার আওয়াজ পেয়ে বড় আপু দৌড়ে আসলো। সে নিজের মেয়েকে ঐ অবস্থায় দেখে আমাদের দিকে তাকালো। আমার অবশ্য তখন করুণ। সানা মা’কে দেখে দৌড়ে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ” মাম্মি, আন্তি মুখ কালাল কলে দিছে।”
কথাটা বলে আবারও কাঁদতে থাকলো। আমারও কান্না এলো তার অবস্থা দেখে। আপু তাড়াতাড়ি বাথরুমে গেলো তাকে নিয়ে। আমাকে কাঁদতে দেখে পিউ বললো, ” হাত ধুয়ে আয় জলদি। কাঁদছিস কেন পাগলের মতো? ”
আমি ওয়াশরুমের দরজায় গিয়ে দাড়িয়ে আপুকে বললাম, ” আমি একদমই খেয়াল করি নি আপু। ও কোত্থেকে দৌড়ে এলো আর…।”
” হাত ধুয়ে ফেল। কাঁদছিস কেন? ”
” আমার তো ওর জন্য কষ্ট লাগছে। আমি নিজের জন্য কাঁদছি নাকি!”
আপু হেসে সানাকে বললো, ” আম্মু, তুমি কাঁদছো তাই তোমার আন্টিও কষ্ট পেয়ে কাঁদছে দেখো। একটা পাপ্পি দাও তো আন্টিকে! ”
আমি নিচু হয়ে বসতেই সে এগিয়ে এসে আমার চুল টেনে ধরে ‘পঁচা, পঁচা’ বলতে লাগলো। হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। আপু বললো, ” একদম তোর মতো হয়েছে দুষ্টু, অভিমানী। ”
” হুহ! কয়েকদিন পর আম্মু বলে ফেলবে আমার কাছ থেকে শিখেছে সব। অথচ জন্মের পর থেকে দেখাই হয় নি ওর সাথে।”
.
.
নিঠুল ভাইকে দেখতে পেলাম আটটা বাজছে তখন। আন্টি তার হাত ধরে রুমে নিয়ে গেলো দেখলাম। আমিও গেলাম সেদিকে। আন্টি আমাকে দেখে বললো, ” রোজা, নিঠুর জন্য নাস্তা নিয়ে আয় তো!”
শুনে আমি দৌড়ে আসতেই নিঠুল ভাই বললো কিছু খাবে না সে। শুধু পানি নিতে। আন্টি বকাঝকা করছে শুনলাম। ছোট চাচীকে বলে রঙ চা বানিয়ে আনলাম। রুমে গিয়ে দেখি সে একাই বসে আছে। আন্টি নেই। আমাকে দেখে বললো, ” সকাল থেকে শান্তিতে বসতে পারি নি একটুও। তোর বাপ বিনা পারিশ্রমিকে খাটিয়ে নিচ্ছে। এখানেও নিঠু,ওখানেও নিঠু।”
” আব্বু তোমাকে ভরসা করে বলেই তো সবকিছুতে তোমাকে চায়।”
” হুম। ভরসা করে নিজের মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিলেই হয়।”
” তুমি এর আগে পারিশ্রমিকের কথা বললে কেন? টাকা লাগবে নাকি তোমার!”
” বাপের মতো টাকা ছাড়া কিছু চিনিস না তাই না! টাকা কেন লাগবে! তোর আব্বার আদরের মেজো মেয়েকে লাগবে। সারাজীবনের জন্য তোর আব্বার কাছ থেকে নিয়ে যাবো।”
তার কথায় লাজুক হাসলাম আমি। চায়ের কাপটা তার হাতে দিলে রঙ চা দেখে তার মুখে হাসি মৃদু হাসি দেখলাম। চায়ের কাপে চুমুক দিলো। হাতের দিকে নজর পড়তেই মুখের চা বেরিয়ে এলো তার। আমার হাত টেনে ধরে লেপ্টানো মেহেদী দেখে হাসতে লাগলো শব্দযোগে। আন্টি এলো তখন। আন্টিকে দেখে আমি হাত টেনে নিতে চাইলে সে ধরে আন্টিকে বললো, ” আম্মা, ডিজাইনটা সুন্দর না!”
” ডিজাইনারের মুখটা দেখেছিস! আরও সুন্দর। ” আন্টি বিছানায় বসে বললো।
” কার কথা বলছো?”
” সানার কথা বলছি। ও-ই তো করেছে এগুলো। হাতে মুখে মাখিয়ে কেঁদেকেটে কী অবস্থা! ”
আন্টি তখনের ঘটনাটা বললো তাকে। শুনে সে হেসে উল্টো আমাকে পঁচাতে লাগলো। একটু পর আব্বু ডাকলে সে দৌড়ে চলে যায়। আমার সামনেই আব্বুকে নিয়ে এটা ওটা বলে অথচ সে নিজেই এগিয়ে যায় আব্বুর সব কাজে। আব্বুও ভরসা করে তাকে।
সাকিব এসে আমার কানে ফিসফিস করে বললো, তৌফিক ভাই আসছে। ”
আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললাম, ” মানে! তাকে কেন আনলি? নিঠুল ভাই যদি দেখে না…।”
” নিঠুল ভাইয়ের ভয় দেখাস না। সে এমন করে কেন তোকে নিয়ে! আমি তো এমনিই এনেছি। আত্নীয় স্বজনের বিয়েশাদি হলে এভাবে যাই আমরা। তুই নাস্তা নিয়ে আয় ওদের জন্য। ”
” পারবো না আমি। ” সোজাসাপ্টা বললাম।
সে শুনেও না শোনার মতো করে বললো, ” চারজন এসেছে। জলদি নিয়ে আয়।”
ট্রে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম নিঠুল ভাই আসছে। আমাকে দেখে রাগী গলায় বললো, ” দেখেছিস কেমন বেয়াদব তোর খালাতো ভাই! তৌফিক্কাসহ তার চামচাগুলোকে নিয়ে এসেছে। সাহস তো কম না তার।”
” সমস্যা কী? বন্ধুদের নিয়ে এসেছে ও। এভাবে নাকি যায় ওরা।”
” তুই কোথায় যাচ্ছিস এসব নিয়ে? ”
আমি ভীতু গলায় বললাম, ” সাকিব এসে বললো ওদের জন্য…। ”
” মেহমানদারী করা হচ্ছে না! কোনো কিছু দেওয়ার দরকার নেই। না খেয়ে ফিরে যাবে। সাকিপ্পার প্রেস্টিজ কোথায় যায় দেখবো।
আবার জিজ্ঞেস করলো, ” ওদের সামনে গিয়েছিস?”
” না তো।”
” তোকে দেখেছে?”
না বললাম আমি। সে বললো, ” একদম সামনে পড়বি না ওদের। নজর খারাপ এক একটার।”
” আচ্ছা। এখন এগুলো তো দাও! মেহমান তো ওরা! ”
” যা তুই। ওদের নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। ” ঝাঁঝালো কণ্ঠে কথাটা বলেই ট্রে হাতে নিয়ে গেলো সেদিকে। আশ্চর্য হলাম আমি। কোনো দোষ নেই তাও আমার উপর দেখালো সব রাগ।
.
.
শাড়ি পরে তৈরি হয়ে ছাদের দিকে গেলাম। গান বাজনায় ছাদ ফাটিয়ে ফেলছে। আব্বু সামনে পড়তেই লজ্জায় পালাতে চাইলাম। আব্বু হেসে এগিয়ে এসে বললো, ” মাশআল্লাহ। আমার মেয়েটাকে দেখছি শাড়িতে অনেক সুন্দর লাগছে।”
মাথা নিচু করে রইলাম আমি। শাড়ি পরে বাবার চাচাদের সামনে যেতে কেমন যেন লাগে। আব্বু বুঝতে পেরে আমাকে যেতে বললো। ছাদে সবাইকে দেখলাম মজা করছে। নিঠুল ভাই চেয়ারে বসা ছিল। তার দিকে নজর পড়তেই হাসলো সে। তার পরনে নীল পান্জাবি। চোখ সরিয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। ভয়ে আছি যদি কেউ বুঝে যায়! আমার পরনেও নীল শাড়ি। অন্যরা মিল রেখে হলুদ শাড়ি পরেছে আর ছেলেরা হলুদ পান্জাবি। সবার থেকে আমি আর নিঠুল ভাই আলাদা আর শুধুমাত্র দুজনেই ম্যাচিং। এটা তারই প্ল্যান। শপিংয়ের সময় সে-ই তার পান্জাবির ছবি দিয়ে বলেছে ঐ রঙের শাড়ি নিতে। আমি না করলেও পরে কী মনে করে নিয়ে নিই। ভয় লাগছে সবার নজরে পড়বে সেটা।বড় ভাইয়ারা দেখে দুষ্টুমি শুরু করেছে বড় হয়ে গেছি, এরপর আমার বিয়ের সানাই বাজবে এসব বলে বলে। সবার সামনে পিউ বলে বসলো, ” তুই আর নিঠুল ভাই তো পুরোপুরি ম্যাচিং হয়ে গিয়েছিস। এটা কীভাবে হলো?”
আমি ঢোক গিললাম ভয়ে। নিঠুল ভাই কিছু জানে না এমন অবাক হয়ে বললো, ” হ্যা, তাই তো! দুজনে কেমন মিলে গেলাম। এটা কীভাবে?”
আরিফ ভাইয়া বললো, ” যা-ই বলো দুজনকে কিন্তু কাপল মনে হচ্ছে। পাশাপাশি দাঁড়াও তো একটু দেখি!”
তাড়াতাড়ি অন্যদিকে সরে গেলাম আমি। নিঠুল ভাইয়ের আশেপাশেও গেলাম না আর। তার চোখাচোখি হয়েছি অনেকবার। সানা নিচের রুমে ঘুম ছিলো। অনেকক্ষণ পর আপু বললো সানাকে রুমে গিয়ে দেখে আসতে উঠেছে কি না। সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে পেছনে ধুপধাপ আওয়াজ পেয়ে ফিরে দেখলাম নিঠুল ভাই নামছে। সে নেমেই আমার হাত টেনে পাশের রুমে নিয়ে যায় আমি কিছু বুঝে উঠার আগে। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ” এখানে নিয়ে এসেছো কেন? কেউ দেখলে কী হবে? ”
” শাড়ি পরে, সেজেগুজে ঢং করে করে বড়দের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিস। আমাকে দেখেও দেখছিস না কী ব্যাপার?”
বলতে চাইলাম তোমার আশেপাশে থাকি আর সবার নজরে পড়ি না! কিন্তু বলতে পারলাম না। এতো কাছে দাঁড়িয়ে সে! চোখে তুলে একনজর তাকালাম তার দিকে। নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে আছে। লজ্জা পেয়ে আমিই নামিয়ে নিলাম চোখ। শাড়ির আঁচল হাতের মুঠোয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললাম, ” সরো। আমি যাবো।”
সে সরলো না। আচমকা আমাকে টেনে সামনে এনে শাড়ির আঁচল টেনে ঘোমটা দিয়ে দিলো। লজ্জায় আমি পিছিয়ে যেতেই সে এক হাত দেয়ালে দিয়ে আরও কাছে এসে দাঁড়ালো। মৃদুস্বরে বললো, ” নীল শাড়িতে তোকে এতো সুন্দর লাগবে বুঝি নি। ঘোমটা দেওয়ায় এখন একদম বউয়ের মতো লাগছে। আমার বউ। সবাই কী বলছিল শুনেছিস! আমাদের নাকি কাপলের মতো লাগছে।”
তার ফিসফিস কণ্ঠে কেঁপে উঠলাম আমি। লজ্জায় পেছনের দিকে সরে আসলে সে দেয়ালে এক হাত দিয়ে আরো এগিয়ে আসলো৷
আমি নিচু স্বরে আবারও বললাম, ” কেউ আসবে। আমি যাবো।”
” উহুম। আমি দেখবো তোকে।” ঘোরলাগা কন্ঠে বললো সে। মুখটা কাছে আনতেই দুই হাতে নিজের মুখ ঢাকলাম আমি। অনেকক্ষণ তার সাড়াশব্দ না পেয়ে হাত সরালাম। সে সামনে থেকে তেড়ে আসার মতো করে এসে চুমু খেয়ে নিল আমার গালে। চোখ বড় বড় করে তাকালে আরেক গালেও চুমু খেয়ে নিল। তখনই পিউর কণ্ঠ শুনতে পেলাম রুমের বাইরে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। নিঠুল ভাইয়ের কোনো ভাবান্তর নেই। সে আমার গালে আরও একটা চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেলো। এদিকে ভয়ে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। নিজেকে ঠিক করে রুম থেকে বেরুতেই পিউর সামনে পড়লাম। সে আমাকে দেখেই প্রশ্ন শুরু করলো, ” এখানে কী করছিস তুই? সেই কখন পাঠালো সানাকে দেখতে। এই রুমে কী করছিলি?”
” দেখেছি তো, দেখেছি ওকে। ঘুমাচ্ছে ও। যাওয়ার সময় দেখলাম এই রুম লাইট জ্বলছে তাই।” আমতা আমতা করে বললাম আমি।
সে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো।বললো, ” নিঠুল ভাইকে দেখলাম ছাদের দিকে যাচ্ছে। তখন তোর পিছু পিছু নেমে এলো।”
” খালি নিঠুল ভাই, নিঠুল ভাই করিস কেন? আমি জানি নাকি তার খবর! সে কখন এলো, কখন গেলো সব দেখি তুই খেয়াল করিস।” খানিকটা রাগী গলায় বললাম যাতে সে অন্যকিছু মনে না আনে।
” এভাবে রাগছিস কেন তুই? আমি তো এমনিতেই জিজ্ঞেস করছি।”
আমি কিছু না বলে রুমে গেলাম সানাকে দেখতে গেলাম। দেখলাম সে বিছানায় বসে কাঁদছে। দৌড়ে গিয়ে কোলে নিলাম। আসার সময় পিউ বললো, ” আমার মনে হচ্ছে নিঠুল ভাইয়ের সাথে তোর কিছু চলছে। তার ফেসবুক ওয়ালে দেওয়া ছবিটাতে হাতগুলো তোদের দুজনের। তোর রিংটাও আছে আঙুলে। আজকে দেখলাম দুজনে ম্যাচিং কাপড়, এতক্ষণ নিঠুল ভাই নিচে ছিল। এর মানে কী দাঁড়ায়? ”
” তোকে আগেও বলেছি ঐ হাতটা আমার না। তার তো গার্লফ্রেন্ডের অভাব নেই। কার হাত বুকে নিয়ে ছবি তুলেছে কে জানে! এমন রিং ফুটপাতে হাজার হাজার পাওয়া যায়। শুধু আমার হাতেই কেন থাকবে! আর ম্যাচিংয়ের ব্যাপারটাও অজান্তে। এখন তুই বিশ্বাস করলে কর না করলে নেই।” বেশ জোর গলায় কথাগুলো বললাম। নিজের মিথ্যে কথায় নিজেই অবাক হলাম। পিউ বিশ্বাস করে নিয়েছে। সে গলা জড়িয়ে ধরে বললো, ” আচ্ছা, আচ্ছা রাগ করিস না। নিঠুল ভাই যে তোকে একদমই সহ্য করতে পারে না, তোদের ঝগড়ার সম্পর্ক তা তো আমি জানি। তাও এমনি জিজ্ঞেস করলাম। ”
রাগে নিঠুল ভাইয়ের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করলো। সেদিন কাপ্তাই লেকে যখন ঘাসে শুয়ে আমার হাত টেনে নিয়েছিল তখনের তুলা ছবিটা ফেসবুক ওয়ালে ছবি দিয়ে রেখেছে বারণ করা সত্বেও। যে কেউ দেখলে বুঝে যাবে। তাকে বললে সে বলে ‘আমার অ্যাকাউন্টে আমার যা ইচ্ছে তা দেবো, আমার যেটা মনে হয় সেটাই করবো। তুই লুতুপুতু প্রেমিকাদের মতো প্রেমিকের জীবনে হস্তক্ষেপ করছিস!”
আর আজ! সে যেটা বলে সেটাই। সেদিন সবাইকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানাবে বলে কী ভয়টাই না দেখিয়েছিল।
সবার ছবি তুলতে ব্যস্ত সে। আরমান ভাইয়া আমাদের ডেকে তার পাশে বসালো। ছবি তুলা শেষে আরিফ ভাইয়া আমাকে নিঠুল ভাইয়ের পাশে দাঁড় করিয়ে তার হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে বললো, ” দুজনে দাঁড়াও। ছবি তুলি তোমাদের। তোমাদের দেখে পারফেক্ট কাপল মনে হচ্ছে। ”
লজ্জায় সরে দাঁড়ালাম আমি। নিঠুল ভাই মহাখুশি। এটাই চাচ্ছিল সে অনেকক্ষণ ধরে। কয়েকবার কানে কানে বলেছিলও, ” আমাদের দুজনেরও উঠাবো ছবি।”
না না বলে বারণ করেছিলাম। আপু বললো, ” লজ্জার কী আছে? দাঁড়া সুন্দর লাগছে দেখতে। ”
আরিফ ভাইয়া সেখান থেকে সরে নিরিবিলি জায়গায় যেতে বললো। সাথে আপুও বললো। নিঠুল ভাইয়ের কোলে সানা ছিল। সে আমাকে দেখেই মারতে চাইলো। আপু তাকে নিতে চায়লে আরিফ ভাইয়া বললো, ” ও থাক নিঠুল ভাইয়ের কোলে। ছবি সুন্দর আসছে। হ্যাপি ফ্যামেলির মতো লাগছে। ”
নিঠুল ভাইকে বললো, ” ভাই, ছবিগুলো তোমার সুইটির কাছে গেলে কী হবে ভেবে দেখেছো? বুঝতেই পারবে না এগুলো এমনিতে ফটোশুট করা।”
নিঠুল ভাই গম্ভীর স্বরে বললো, ” ওর কাছে যেন না যায় এগুলো। দেখলে মহা সমস্যা হবে।”
তারপর পেছন থেকে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, ” এভাবে ছবি সুন্দর আসবে। তোল এবার।”
মনে মনে হাসলাম আমি। কী চালাক সে! সানাকে ছাড়াও অনেক ছবি তুললো দুজনের। নিঠুল ভাই এমনভাবে বললো আরিফ ভাইয়া বুঝতেই পারে নি। সে চিন্তায় আছে ছবিগুলো সুইটির চোখে পড়লে নিঠুল ভাইয়ের কী হবে তা নিয়ে।
এতোবার স্যরি বলার পরও সানার রাগ ভাঙাতে পারলাম না। লাল লাল মুখে চোখ বড় বড় করে তাকায় আমাকে দেখলেই। নিঠুল ভাইয়ের কোল থেকে আসছেই না। নিতে গেলেই নাক মুখ খামছে ধরে। নিঠুল ভাইয়ের সামনেই সে আমার চুল টেনে ছিড়ে নিল হাতে। কোনোমতে ছাড়িয়ে নিয়ে নিঠুল ভাই বললো, ” কী রাগ বাবা! একদম তোর মতো হয়েছে। রাগ, অভিমান সব পেয়েছে তোর মতো।”
এবার আমি চলে আসতে চাইলাম। সে সানাকে জোর করে আমার কোলে তুলে দিয়ে বললো, ” এখন থেকেই সামলানো শিখ। আমার বাচ্চারাও তোর মতো এমন হবে দেখিস। তাই আগে থেকেই শিখে রাখ।”
সানাকে সামলাতে পারলে তো! এতো সান্ত্বনা দিলাম তাও সে গলা ফাটিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। এদিকে আমার নিজের ভবিষ্যৎ ভেবেই ভয় লাগছে। কীভাবে সামলাবো, কী করবো!”
বিয়ের দিনটাও কেটে গেলো আনন্দে। সবার সামনেই কথা বলা, হাত ধরা, ছবি তোলা সবকিছু কৌশলে করে গেলো নিঠুল ভাই। তবে পিউর চোখে কয়েকবার পড়েছে। সে বুঝতে পারছে না আমাদের মধ্যকার সম্পর্কটা কী! এই নিঠুল ভাই কথা শোনালো- রাগী চোখে তাকালো, আবার এই হাত ধরলো- প্রেম চোখে তাকালো। বুঝবে কীভাবে পিউ!
#চলবে…