ভালোবাসার রোজ,পর্ব:১১+১২

0
4131

#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব-১১]
#আফরোজা_আনজুম

ইদের সারাটা দিন নিঠুল ভাইয়ের অপেক্ষায় ছিলাম। বছরের দুই ইদ তারা তাদের গ্রামে কাটায়। এবারও তাই হলো। প্রতিবার ইদের দিন বিকেলে বা সন্ধ্যার পরে আমাদের এখানে আসে। ভেবেছিলাম এবারও তাই হবে। তাই সবাই বেড়াতে যেতে বললেও আমি বের হলাম না। নিঠুল ভাই যদি চলে আসে! দেখা না হয় তার সাথে! বিকেলের দিকে রান্নাঘরে গিয়ে তার পছন্দের পায়েস রান্না করলাম,সমুচাও বানালাম নিজ হাতে। রান্নাঘরে খুঁচাখুঁচি করায় আম্মু বিরক্ত হলো। জিজ্ঞেস করলে বললাম, ” তোমাদের এতো মেহমানের রান্না করতে কষ্ট হবে তাই হেল্প করছি।”

ছোট চাচী জানালো তারা রান্না করেই ফেলেছে। শুনে আমতা আমতা করে বললাম আমার খেতে ইচ্ছে করছে তাই। আম্মু সরু চোখে তাকালো আমার দিকে। তা দেখেই আমার মনে পড়লো আমি তো পায়েস খাই না। খেলেই বমি আসে। হাসার চেষ্টা করে বললাম তোমাদের জন্য রাঁধছি আম্মু। কখনো রাঁধি নি তো তাই সরাসরি বলতে লজ্জা লাগছে। বিকেলে ইদের জামা পড়ে হালকা সাজ দিলাম। সেটা দেখেও আম্মুর সন্দেহ হলো। বললো, ” সারাদিন এতো করে বললাম ইদের জামাটা পর। পরিস নি। এখন জামা পড়ে কোথায় বের হচ্ছিস আমাকে না জানিয়ে?”

কী আর করার! আম্মুর সামনে থেকে পালিয়ে রুমে বসে রইলাম। এলো না নিঠুল ভাই। ভীষণ কান্না পেলো আমার। কতো কিছুই না করলাম আর সে এলোই না। সে এলো পরদিন বিকেলে। রুম থেকে বের হলাম না আমি দেখা দেবো না বলে। কিছুক্ষণ পর আম্মু এসে বকে গেলো অসামাজিক, একঘরে বলে। বকা শুনে ফ্রিজ খুলে কালকের রান্না করা পায়েসের বাটি নিতে গেলাম। এতো কষ্ট করে রাঁধলাম তার জন্য সেটা তাকে জানাতে হবে না! কিন্তু কোথাও বাটি দেখতে পেলাম না। ছোট চাচী জানালো তাদের জন্য রেঁধেছি তাই তারা খেয়ে ফেলেছে। আমি খাই না বলে রাখে নি। কী বলবো বুঝতে পারলাম না। নিঠুল ভাইয়ের সামনে যেতেই সে প্রথমে বললো, ” কী রে তুই এমন ফকিরের মতো হয়ে আছিস কেন? ইদের তুন জামা কিনিস নি?”

আমি কাটকাট গলায় জবাব দিলাম, ” না, কিনি নি।”

সে যেন আমার কথাটা বিশ্বাস করেছে এমনভাবে বললো, ” কী বলিস! তোর আব্বু তোকে জামা কিনে দেয় নি ইদে? এতো কিপ্টে! কতোটা কিপ্টে হলে বাবা মেয়েকে ইদে জামা কিনে দেয় না। ও মাই গড! এতো টাকা কী করবে তোর আব্বু?”

তার সামনে যাওয়ায় ভুল হয়েছে আমার। চলে আসলাম সেখান থেকে। ঘন্টা খানেক পর রোবাকে দিয়ে ডাকলো আমায়। রোবা এসে বললো, ” সালামি না পেয়ে রুমে বসে কাঁদছো? নিঠু ভাই চলে যাচ্ছে। তোমাকে ডাকে।”

দুইবার এসে ডাকার পর গেলাম। আম্মু বলে, ” সালামি দেয় নি বলে রাগ করে রুমে বসে থাকবি? ছোট নাকি তুই? তোর সালামি নেওয়ার বয়স আছে? ”

নিঠুল ভাই পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে আমার সামনে আসলো। কচকচে, নতুন দশ টাকার নোট কতক গুলো বের করে আমার হাতে গুঁজে দিলো। আম্মু দিতে বারণ করছে। নিঠুল ভাই গা জ্বলানো হাসি দিয়ে বললো, ” ছোট বাচ্চা! মন খারাপ করেছে দেখছো না?”

আম্মু চলে গেলে আমিও হাঁটা ধরলাম। অসভ্যটা আমার নামে কীসব বলেছে! সালামির জন্য মন খারাপ,রাগ করেছি! সে আমার হাত টেনে বললো, ” সালাম না করেই সালামি নিয়ে পালাচ্ছিস কেন বেয়াদব?”
আবার হাত উল্টিয়ে নিয়ে বলে, ” মেহেদী পরেছিস! আমার নাম লিখতে পারিস নি?”
তার হাত দেখিয়ে বললো, ” এই দেখ আমার হাত! আমাদের পিচ্চিকে দিয়ে আঁকিয়েছি। তুই আমার নামের প্রথম অক্ষরটা পর্যন্ত লিখতে পারিস নি! এই তোর ভালোবাসা!”

” আমি তোমাকে ভালোবাসি কে বললো? আমি বলেছি নাকি!”

সে হেসে বললো, ” আমি কখন বলেছি তুই আমাকে ভালোবাসিস! আমি তো বলেছি ‘ এই তোর ভালোবাসা ‘! তুই নিজেই আগ বাড়িয়ে জানিয়ে দিলি যে তুই আমাকে ভালোবাসিস। ”

” একদম না। তোমার মতো নিষ্ঠুরকে আমি কখনো ভালোবাসি নি,ভালোবাসবোও না।”

সে আমার হাতে টুপ করে চুমু খেয়ে হেসে বললো, ” এগুলো তোর মুখের কথা। আমাকে দেখার জন্য কে ছটফট করে, লুকিয়ে লুকিয়ে আড়চোখে দেখে কে তা আমার জানা আছে। এমন আরেকবার বললে চুমু দেওয়ার বদলে কামড় দিবো।”

#চলবে.

#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব -১২]
#আফরোজা_আনজুম

সারাটাদিন আমার আনন্দে কাটলেও মনের কোথাও খারাপ লাগা কাজ করেছে। পরিবারের বড়রা জন্মদিন পালন করার পক্ষে না থাকলেও আমরা ছোটরা ফুল, কেক অর্ডার করে ছোটখাটো আয়োজন করে ফেলি। আমার জন্মদিনেও তাই হলো। সন্ধ্যায় আরিফ ভাইয়া, পিউ, পিচ্চিরা মিলে ফুল, বেলুন দিয়ে রুম সাজিয়ে, গান বাজিয়ে, কেক এনে সারপ্রাইজ দিয়েছে। কিন্তু নিঠুল ভাইয়ের কোনো খবর নেই। ভার্চ্যুয়ালে অনেকে উইস করেছে সে হিসেবে তার জানা আছে আজকে আমার জন্মদিন। সে একটু উইস পর্যন্ত করলো না। সন্ধ্যায় যখন রুমে গান বাজিয়ে নাচানাচি করছে ওরা তখন নিঠুল ভাইয়ের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। রুমে এসে সে অবাক কণ্ঠে বললো, ” এভাবে লাফালাফি করছিস কেন তোরা? সবাই একত্রে পাগল হয়ে গেলি নাকি!”

রুবা নিঠুল ভাইয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো, ” আজকে আপুর বার্থডে। তাই আমরা নাচছি। অনেক মজা করেছি। তুমিও আসো নাচতে।”

নিঠুল ভাই ভ্রু-কুচকে বললো, ” আপুর জন্মদিন হলে নাচতে হবে নাকি! নাচতে নাচতে তোমার আপুকে মাথায় তুলে ফেলতে হবে?”

তিশা খিলখিল করে হেসে বললো, ” নিতু ভাইয়া, আপুকে মাথায় তুলে নাচো। আমরা দেখবো।”

নিঠুল ভাইয়ের মুখে চরম বিরক্তি প্রকাশ পেল। খেতে বসে খাবারের আয়োজন দেখে সবার সামনে বললো সে নাকি জানেই না আজ আমার জন্মদিন। এতো রাগ লাগলো আমার বলার বাইরে। খেয়েদেয়ে রুমে গিয়ে বসে বসে মোবাইলে ভিডিওগুলো দেখছিলাম। এমন সময় নিঠুল ভাইয়ের ফোন এলো। পিউ আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ” নিঠুল ভাই তো ঘরেই আছে। ফোন করছে কেন তোকে?”

বলতে বলতে সে রিসিভ করে কানে নিলো ফোন। ওপাশ থেকে নিঠুল ভাই বললো, ” ছাদে আমার ইয়ার-ফোনটা রেখে এসেছি। ওটা এনে দে তো!”

বলেই সাথে সাথে লাইন কেটে দিলো। পিউ বললো, ” যা নিয়ে আয়।”

তার থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বিছানায় শুয়ে বললাম, ” তোকে বলেছে, তুই যা।”

” আমাকে বললো কখন? তোকে ফোন করেছে।”

” ফোন রিসিভ করেছিস তুই। তোকেই বলেছে। তুই যা।”

নিঠুল ভাই আবারও ফোন করলো। পিউ যাচ্ছে না। তাই আমাকেই উঠতে হলো বাধ্য হয়ে। কেমন সে! এতো রাতে একটা মেয়েকে ছাদে যেতে বলছে। মনে মনে একগাদা কথা শুনালাম তাকে। ছাদে গিয়েই দেখলাম মহাশয় সেখানেই আছে। আমি রেগে বললাম, ” তুমি তো ছাদে আছোই। আমাকে কেন আসতে বললে?”

সে ভাবলেশহীন হয়ে উত্তর দিল, ” ইয়ারফোনটা ঐখানে রাখা আছে। একটু এনে দে। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। ”

আশ্চর্য হলাম তার কথায়। ছাদের বিপরীত দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো ইয়ারফোন কোথায় আছে। দুই পা হেটে গিয়ে সেটা নিতে পারলো না! যাক কথা না বাড়িয়ে গেলাম সেদিকে। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। পায়ের সাথে তারের মতো কিছু লাগতেই সেটাতে হাত দিলাম। এতো বড় তার ইয়ারফোন হয় নাকি! তাকে বলবো তার আগেই সে বললো, ” দাঁড়া। আমি লাইট জ্বালাচ্ছি। ”

সাথে সাথেই আমি চমকে উঠলাম। মুহূর্তেই সামনের দেয়ালটা সোনালী রঙের ঝিলমিল বাতিতে আলোকিত হয়ে উঠলো। সেগুলোর আলোতে দেখতে পেলাম সিমেন্ট দিয়ে বানানো বসার উঁচু জায়গাটাতে ছোট একটা কেক, তার উপর একটা লাল গোলাপ। পেছন থেকে আওয়াজ আসলো তার। পেছনে ফিরে আরও আশ্চর্য হলাম আমি। নিঠুল ভাই হাঁটু গেড়ে বসেছে। হাতে তার সেদিনের কেনা রিংটা জ্বলজ্বল করছে। সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ” উইল ইউ ম্যারি মি?”

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করলো না সে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার বললো, “আই ক্যান্ট ওয়েট টু হিয়ার দ্যা অ্যানসার ‘ইয়েস’ অর ‘নো’। ইটস্ জাস্ট অ্যা ফর্মালিটি। দ্যা অ্যানসার ইজ ‘নো’ বাট ফর মি ইট হেজ টু বি ‘ইয়েস’। আই হেভ টু গেট ম্যারিড। বিকজ, আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ সো মাচ।”

আনন্দে কান্না আসলো আমার। নিজের অজান্তেই অশ্রু ঝরছে। গলার স্বর আটকে আছে। সে আমার হাত টেনে নিয়ে অনামিকা আঙুলে রিংটা পরিয়ে দিয়ে সেটাতে চুমু খেলো। উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছাকাছি এসে হাতদুটো তার হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, ” এই হাত জোড়ার মালিক আজ থেকে আমি। এই যে আমার ভালোবাসার চিহ্ন! আপাতত এটা দিয়ে আমার ভালোবাসার মানুষটাকে সিলমোহর লাগিয়ে অধিকারে নিয়ে নিলাম। খুব শীঘ্রই এই পুরো মানুষটাকে পরিপূর্ণরূপে আমার করে নিবো। একান্ত আমার। ”

তার ঘোরলাগা কন্ঠে আমিও যেন ঘোরে চলে গেলাম। হাত-পা কাঁপছে আমার। এই মুহূর্তের অনুভূতিগুলো সত্যিই অন্যরকম। ভালোবাসার মানুষটি যখন নিজের ভালোবাসাটা প্রকাশ করে তখন বুঝি এমন হয়! সে ততক্ষণে আমার হাত টেনে নিয়ে কেক কাটতে বসিয়ে দিল এবং কেক কেটে নিজেও খেয়ে নিল। পাশ থেকে গোলাপটা নিয়ে সেটা আমার মুখে ছোঁয়ালো। মৃদুস্বরে বললো, ” আরও একটা গিফট বাকী আছে। সেটার জন্য চোখ বন্ধ করতে হবে। ”

আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। তা দেখে সে বললো, ” চোখ বন্ধ করতে বলেছি। চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছিস কেন?”

আমি লাজুক হেসে বললাম, ” আমার জন্মদিনের সেরা গিফট পেয়ে গেছি। আর কোনো গিফট লাগবে না আমার।”

” কিন্তু আমার দেওয়া লাগবে। জলদি চোখ বন্ধ কর।”

চোখ বন্ধ করলাম তার কথায়। একটুপর অনুভব করলাম খুব কাছ থেকে তাকে। তার নিঃশ্বাস ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। চট করে চোখ খুলে ফেললাম। তার হাতদুটো আমার মুখে রাখা৷ এই মুহূর্তে সে কী করতে চায়ছে তা বুঝতে পারছি। ঠোঁট কাপছে, বুক ধুকপুক করছে আমার। নিজের অজান্তেই চোখ বন্ধ হলো৷ সে আলতো করে ঠোঁট বসালো আমার ঠোঁটে। আমার হাতদুটো আপনাআপনি তাকে জড়িয়ে নিলো। এক অন্যরকম, অসহ্যরকম অনুভূতির সাথে পরিচিত হলাম। লজ্জায় চোখ খোলার সাহস পেলাম না। কোমর জড়িয়ে আমার কপালের সাথে তার কপাল ঠেকালো। এভাবে ঘোরের মধ্যে কতক্ষণ ছিলাম জানি না। ধ্যান ভাঙলো তার কথায়।

” এইবার বল তো সেরা গিফট কোনটা? প্রথমেরটা নাকি একটু আগেরটা?”

লজ্জায় আরেকটা রাঙা হলাম। সে বুকে টেনে নিয়ে আমার লজ্জিত মুখটা লুকানোর সুযোগ করে দিলো। তার বুকে মাথা রেখে প্রচন্ড শান্তি অনুভব করলাম। সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে।
.
.
সকালে নাস্তা করতে বসে পড়লাম বিপদে। হাতের রিংটা দেখে পিউ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” এটা কোত্থেকে এলো? কাল রাতেও তো এটা ছিলো না।”

আমি স্বাভাবিকভাবে বললাম, ” আজ দিয়েছি। সেদিন ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে নিয়েছিলাম। ”

ছোট চাচী হাত টেনে নিয়ে দেখে বললো, ” বাহ্! সুন্দর তো। ডায়মন্ডের মনে হচ্ছে।”

আমি হাত টেনে নিয়ে তড়িঘড়ি করে বললাম, ” কী বলো এসব! পঞ্চাশ টাকা দিয়ে নিয়েছি ফুটপাতের দোকান থেকে। ”

বলেই নিঠুল ভাইয়ের দিকে তাকালাম। নিশ্চিন্তে খাচ্ছে সে৷ পিউর মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে বিশ্বাস করে নি।নিঠুল ভাইয়ের কথায় তার সন্দেহ আরো গাঢ় হলো বোধহয়।

নিঠুল ভাই বললো, ” কোনো ছেলেপুলে দেয় নি তো!”

কপট রাগ দেখালাম আমি। এমনিতেই তার জন্য ঝামেলায় পড়েছি। সে আবার উল্টাপাল্টা বলে ঝামেলা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। কেউ বুঝতে পারলে একবার তাহলে আমার আস্ত থাকবে না, মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। পিউ বললো, ” আমিও একটা নিবো। কোত্থেকে নিয়েছিস দেখিয়ে দিস তো!”

রুমে গিয়ে আবারও ধরলো পিউ। গতরাতে ছাদ থেকে আসার পর দেখলাম পিউ ঘুমিয়ে। সে নাকি আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি অতো সময় ছাদে কী করছিলাম এসব জিজ্ঞেস করছে। একটা বলে এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু পিউ তো পিউ। তার কথা আমি নাকি প্রেমে পড়েছি। রুমে তার জন্য পারছি না বলে ছাদে সুযোগ পেয়ে নিরিবিলিতে কারো কথা ভাবতে গিয়েছি।
.
.
আজকাল আম্মুও সন্দেহ করা শুরু করে দিয়েছে। সেদিন রিংটা দেখে আম্মুও জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। আজকে নিঠুল ভাইদের ডিপার্টমেন্ট থেকে কয়েকজন মিলে ট্যুরে যাচ্ছে। তাদের সাথে আমি আর পিউও যাচ্ছি। কয়েকদিন আগে ডিপার্টমেন্ট থেকে ট্যুরে গিয়েছিল। এতো করে বলার পরও সেখানে আম্মু যেতে দেয় নি। খুব মন খারাপ করেছিলাম৷ নিঠুল ভাইকে সুপারিশের জন্য বললে সে বলে তাদের সাথে নিয়ে যাবে।
সকাল সাতটা। তাড়াহুড়ো করে তৈরি হচ্ছিলাম। নিঠুল ভাই আসবে নিতে। পথে পিউকেও তুলে নিবে। নিঠুল ভাই এলো পনেরো বিশ মিনিটের মধ্যে। সে এলে আম্মু তাকে নিয়ে আমার রুমে ঢুকলো। ঢুকেই আমার মোবাইলটা নিলো। তারপর আমাকে বললো রুম থেকে যেতে। কিছুই বুঝলাম না আমি। জিজ্ঞেস করতেই ধমকে পাঠিয়ে দিলো। রুম থেকে বেরিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম আম্মুর এমন ব্যবহারের কারণ কী! রুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম নিঠুল ভাইয়ের হাতে আমার মোবাইল। সে কিছু করছে আমার মোবাইলে। তারপর আবার আম্মুর হাতে মোবাইলটা দিয়ে বলে, ” এমন কিছু নেই মোবাইলে।”

আম্মু চিন্তিত হয়ে বললো, ” তাহলে ও সবসময় মোবাইলের দিকে তাকিয়ে হাসে কেন? শুধু তাই নয়। সারাদিন দেখি একা একা হাসে পাগলের মতো, আর কী যেন ভাবে। ওর হাবভাব আমার ভালো ঠেকছে না। ওকে একটু দেখিস তুই।”

আম্মুর কথার মাঝে নিঠুল ভাইকে ঠোঁট টিপে হাসি এড়াতে দেখলাম। ব্যাটা মজা পাচ্ছে। হেসে আম্মুকে বললো, ” আচ্ছা, আমি দেখবো। তুমি চিন্তা করো না।”

পথে আমাকে বললো, ” তুই নাকি সারাদিন পাগলের মতো হাসিস! অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবিস! প্রেমিকের কথা ভাবিস নিশ্চয়ই! তার কথা ভেবে লজ্জা পেয়ে মিটিমিটি হাসিস তাই না!”

” আমার আর কাজ নেই তার কথা ভেবে ভেবে হাসবো! আমি তো এমনিই হাসি।”

” এমনি তো পাগলে হাসে। প্রেমিকের কথা ভাবতে ভাবতে আবার পাগল হয়ে যাস নি তো! কোনো পাগলিকে তোর প্রেমিক বিয়ে করবে না বলে দিচ্ছি।”

” তুমি বলার কে! সে করবে বিয়ে। এই দেখো, সিলমোহর লাগিয়ে আমাকে তার করে নিয়েছে,” হাতের রিংটা দেখিয়ে বললাম তাকে। সে হেসে আমার হাতটা তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়।

প্রায় দুপুর বারোটার দিকে কাপ্তাইয়ের নেভি ক্যাম্পে পৌঁছালাম। গাড়ি থেকে নেমে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলাম। লেক প্যাডাইস পিকনিক স্পটের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। চারপাশে গাছপালা সহ অসংখ্য পাহাড়। হিমেল বাতাসে পরিবেশটা উপভোগ করার মতো। সবুজ ঘাসের উপর ধুপ করে বসে পড়লাম। পিউ রুপম ভাইয়ার সাথে কথা বলছে। রুপম ভাইয়ার দিক থেকে প্রেমের সাড়া না পেলেও দুজনে কথাবার্তা চালিয়ে যায় সহজেই। নিঠুল ভাইকে ফ্রেন্ডরা ডাকছে ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। রুপম ভাইয়া, পিউ এসে বসে। রুপম ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো, ” কেমন লাগছে, রোজা? পরিবেশটা সুন্দর না?”

আমি হেসে বললাম, ” অনেক সুন্দর। ভীষণ ভালো লাগছে আমার।”

পিউ উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে রুপম ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ” কায়াকিং করতে যাবো না? ”

” এখন না। খাওয়াদাওয়ার পরে।”

” অনেক মজা হবে। রোজা তোরও যেতে হবে।”

” কোনোদিনও না। আমার পানিতে ভয় করে।”

” যাহ! এটাই তো মজার। যেতে হবে তোর।”

আমি কিছু বললাম না। দেখলাম নিঠুল ভাই আর মিষ্টি আপু আসছে। চকোলেট কালারের চেক শার্টে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে নিঠুল ভাইকে। গলায় ঝুলানো ক্যামেরাটা এক হাতে ধরে সেটাতেই দৃষ্টি রেখে হেঁটে আসছে। পিউ দের আড়ালে নিজের মোবাইলে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম তার। ছবিগুলো দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। তার পাশে মিষ্টি আপুও উঠেছে। দুজনকে একসাথে চোখে লাগছে খুব। নিঠুল ভাই আমার পাশে বসে বললো, ” এসেই বসে গেছিস! খবরদার ঘাসে শুয়ে আবার ঘুমিয়ে যাস না। তোর তো আবার যেখানে সেখানে ঘুমানোর অভ্যাস।”

অন্যরা হেসে উঠলে লজ্জা পেলাম আমি। সাথে রাগও হলো। নিঠুল ভাই আমার আর পিউর অনেকগুলো ছবি তুললো তার ক্যামেরায়। নিঠুল ভাই তার সাথে কাপল পিক তুলার কথা বললে তুলতে দিই নি। পিউর নজরে পড়লে সন্দেহ করবে। তাও শুনলো না সে। রুপম ভাইয়াকে দিয়ে ছবি উঠালো দুজনের। দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই জড়ো হয়ে নাচ গান হলো। কায়াকিং করতে যাওয়ার সময় জোর করলেও গেলাম না আমি। পিউ রেগে বললো, ” তুই না গেলে আমি আর ফিরে আসবো না দেখিস!”

আমি হেসে বললাম, ” ঠিক আছে। আমি ফুপিকে জানিয়ে দিবো।”

নিঠুল ভাই জানে পানিতে আমার ফোবিয়া আছে। তাই সে বললো, ” পিউ তুই যা রুপমের সাথে। ও থাক এখানে। রুপম, ওকে দেখিস।”

” তুই যাবি না? ” রুপম ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো।

” না। ওর সাথে আছি আমি। ”

রুপম ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে চলে গেলো। আমি নিঠুল ভাইয়কে জিজ্ঞেস করলাম, ” ভাইয়া হাসলো কেন ওভাবে?”

নিঠুল ভাই হেসে বললো, ” আমি কীভাবে জানবো? জিজ্ঞেস করিস নি কেন? ”

” রুপম ভাইয়া কী জানে আমাদের কথা?”

” আমাদের কী কথা? ” নিঠুল ভাই ভ্রু-কুচকে জিজ্ঞেস করলো।

” কিছু না। তুমি যাও নি কায়াকিং করতে? মিষ্টি আপু তো অনেকবার ডাকলো।”

” মিষ্টি ডাকলেই মিষ্টির পেছনে পিঁপড়ের মতো সুড়সুড় করে চলে যেতে হবে নাকি!” বলে সে ঘাসের উপর শুয়ে পড়লো।

” লেকের পাড়ে চলো না! ওদের দেখি!”

” বোটে না চড়লে যাওয়ার দরকার নেই,” কথাটা বলে সে আমার হাতটা টেনে নিলো। চমকে তার দিকে তাকালাম আমি। সে আপনমনে আমার হাত নিয়ে খেলছে। আমি হাত নিয়ে নিলে সে আমার দিকে রেগে তাকালো। তারপর আবারও হাত টেনে নিয়ে চুমু খেয়ে তার বুকের ওপর রাখলো। চোখ বন্ধ করে উচ্চারণ করলো, “শান্তি।”

লজ্জায় রাঙা হলাম আমি। সেই রাতের পর থেকে তার সামনাসামনি হলেই লজ্জা লাগে, অন্যরকম অনুভূতি হয়। আর সে! হঠাৎ হঠাৎ রেগে গিয়ে ধমকা ধমকি করে ভয় পাইয়ে দেয়, আবার হঠাৎ হঠাৎ অদ্ভুত কর্মকাণ্ডে লজ্জা পাইয়ে দেয়। একটু পর দেখলাম মিষ্টি আপু ফিরে এসেছে। তাকে দেখে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম৷ কিন্তু সে হাতটা বুক থেকে সরালেও হাত ছাড়লো না। মিষ্টি আপুর চোখদুটো আমাদের হাতের দিকেই নিবদ্ধ। নিঠুল ভাইয়ের সেদিকে ধ্যান নেই। সে জিজ্ঞেস করলো, “চলে এলে যে! কায়কিং করো নি?”

” উহুম। দুজন দুজন হয়ে গেছে। তাই যাই নি। তুমি চলো না আমার সাথে! ”
নিঠুল ভাই চট করে উঠে বসলো। লেকের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। নিঠুল ভাই আর মিষ্টি আপু কায়াকিং করছে। অন্যরা ততক্ষণে নেমে এসেছে। আরও বেশ কিছুক্ষণ পর রুপম ভাই এসে পিউর হাত আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ” রোজা, এই পাগলটাকে ধরো তো! সে আজ বোটে থাকার পায়তারা করছে।”

পিউ রেগে বললো, ” আমি আবার যাবো। একা একা কায়াকিং করবো।”

বলতো বলতে সে আবারও সেদিকে চললো। ততক্ষণে নিঠুল ভাইরা ও চলে এসেছে। সবার উচ্ছ্বাস দেখে আমারও ইচ্ছে করছে বোটে চড়তে। কিন্তু সাহস করতে পারলাম না। নিঠুল ভাই হয়তো বুঝতে পেরেছে। সে এসে আমার হাত ধরে বললো, ” চল আমার সাথে। ”

” না, না। আমি জীবনেও না।” ভয়ে ভয়ে বললাম আমি।

” আমি আছি না! কিচ্ছু হবে না। চল।”

ভরসা পেলাম তার কথায়। পিউ লাফিয়ে উঠে বললো, ” আমিও যাবো। ভাইয়া, তোমার বন্ধুকে বলো আমাকে আবার নিয়ে যেতে নিজ দায়িত্বে।”

রুপম ভাইয়া হাত তুলে বললো, ” আমি আর নেই এর সাথে। নিঠুল তুই ওকে নিয়ে যা নিজ দায়িত্বে আবার নামিয়েও নিস নিজ দায়িত্বে।”

পিউ অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিল। নিঠুল ভাই পিউকে নিচু স্বরে বললো, ” পিউ তুই উঠে বস। দেখবি সুড়সুড় করে সেও চলে আসবে।”

বোটে পা রাখতেই ভয়ে আঁতকে উঠলাম আমি। আমার মনে হচ্ছিল তখনই উল্টে পড়ে যাবো। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম নেমে যাবো। নিঠুল ভাই টেনে আমাকে বসিয়ে দেয়। তবে অন্যদের মতো দুজন দু’দিকে নয়। তার সামনেই বসালো। তাও আমি নেমে যেতে চাইলাম। সে আমার মাথাটা তার বুকের সাথে চেপে ধরে বললো, ” এভাবেই থাক চুপচাপ। কিচ্ছু হবে না। ”

প্রথমে একটু একটু ভয় লাগলেও পরে বেশ উপভোগ করলাম।

” ভয় লাগছে? ” কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো নিঠুল ভাই। আমি মুচকি হেসে এদিক ওদিক মাথা নাড়ালাম। পাশের বোট থেকে পিউ পানি ছুড়ে বললো, ” এবার কোথায় পালালো ভয়!”

যেহেতু আমার ভয় ছিলো তাই পিউ আমাদের দুজনকে এভাবে দেখে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে।

আসার সময় মিষ্টি আপু আমাকে একা ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ” নিঠুলের সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন?”

অন্যদিনের তুলনায় আজকে সে আমার সাথে খুব কমই কথা বলেছে। আমি নিশ্চিত সে নিঠুল ভাইকে ভালোবাসে। সেও হয়তো বুঝতে পেরেছে আমার আর নিঠুল ভাইয়ের সম্পর্কটা কেমন।

” কেমন মানে? বুঝলাম না আপু।”

” না মানে তোমাদের মাঝে কী বিশেষ কোনো সম্পর্ক আছে নাকি এমনিতেই.. ”

” কই না তো আপু৷ ” এড়িয়ে গেলাম আমি।

সে বিশ্বাস করে নি আমার কথা। অন্যদিনের তুলনায় আজকে সে আমার সাথে খুব কমই কথা বলেছে। আমি নিশ্চিত সে নিঠুল ভাইকে ভালোবাসে। সেও হয়তো বুঝতে পেরেছে আমার আর নিঠুল ভাইয়ের সম্পর্কটা কেমন।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here