ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব ২+৩

0
1518

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-০২+৩

আমার আকুল মনের আবেদন শুনতে পেলো না রাফি ভাই। ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখলাম রুদ্র মূর্তি নিয়ে সে এগিয়ে আসছে। আব্বার কাছে এসে থেমে গেল। বাহিরে আবছা অন্ধকার। আব্বা তাকে চিনতে পারলেন না। তিনি উচুঁ স্বরে বললেন,

‘কেডা রে?’

‘আমি রাফি। জাকির হোসেনের ছেলে।’

আমি ছোট খাটো বিস্ফোরণের অপেক্ষায় রইলাম। আব্বা কি রেগে যাবে? রাফি ভাইকে বিশ্রী কিছু বলবে? কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আব্বা হেসে উঠলেন। আন্তরিকতার হাসি। রাফি ভাই কে নিয়ে হঠাৎ ভীষন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। চেঁচিয়ে সেজো আপাকে ডাকতে লাগলেন।

‘এই ময়না, চেয়ার আনতো। বাবাজীকে বইতে দে।’

সেজো আপা বের হলো না। আব্বা এবার আমাকে ধমকে বলে উঠলেন,

‘হুনস না? কথা কানে যায় না! বাবাজী রে বইতে দে।’

গালে হাত রেখেই নড়লাম আমি। রুমে ঢুকে হন্যে হয়ে চেয়ার খুঁজলাম। চেয়ার নেই। ভালো চেয়ার মাত্র একটা আছে। সেটা নতুন মায়ের ঘরে। বাধ্য হয়ে পায়া ভাঙ্গা চেয়ারটা নিয়ে বের হলাম। রাফি ভাই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে চেয়ার এগিয়ে দিতে ছোট্ট করে সে বললো,

‘বসবো না আমি।’

আব্বা জোর করলো বসার জন্য। তবুও সে বসলো না। তার দৃষ্টি ঘুরেফিরে আমার গালের উপর ন্যস্ত হলো। আব্বা একসময় জিজ্ঞেস করলেন,

‘বাবাজী কি মনে কইরা?’

‘চাচী তেলের কথা বললো। তেল নাই নাকি। এইজন্যে মোড়ের দোকান থেকে এনে দিলাম।’

‘ও। আমারে কইবো না? আমি তো বাজারে গেছিলাম।’

‘আমি আসছি!’

কেরোসিনের বোতলটা চেয়ারের উপর রেখে রাফি ভাই ঘুরে দাঁড়ালো। আব্বা বাঁধা দিয়ে ঝটপট বললেন,

‘বাবাজী দাঁড়াও এট্টু। একখান জিনিস দেবো।’

আব্বা হেঁটে উত্তরের ঘরের দিকে গেলেন। চিন্তা হলো আমার। আব্বা কি দিবে রাফি ভাই কে! চিন্তারত অবস্থায় আচমকা মুখে আলো জ্বলে উঠলো। চোখের পাতায় পড়তে বন্ধ করে নিলাম। রাফি ভাই ফোনের লাইট দিয়ে গাল দেখল। নরম সুরে বললো,

‘ব্যথা পেয়েছিস খুব? রাতে কিছু লাগিয়ে নিস!’

রাফি ভাইয়ের বাম হাতটা গাল স্পর্শ করলো আমার। কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলাম। পরক্ষণে ভয় পেয়ে দূরে সরে গেলাম। রাফি ভাইয়ের ভয়ডর নেই? বাড়ি ভর্তি মানুষ! আব্বা ফিরছে। তার হাতে বক্সের মতো কিছু একটা। সেটা তিনি রাফি ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

‘এইডা তোমার আব্বা রে দিও।’

রাফি ভাই মাথা নেড়ে হাঁটা ধরলো। আর পেছন ফিরে তাকালো না। আমি আগের জায়গাতে জমে রইলাম। একটা মানুষ আমাকে পাথর বানিয়ে কি নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে গেলো!

ঘোর কাটলো আমার। আব্বা আবার চেঁচাচ্ছে। সেজো আপা এখনো বের হয়নি। আপার প্রচন্ড জিদ। রান্নার জন্য তখন হয়তো আপাকে ডেকেছে। আপাকে না পেয়ে আমাকে। আমি ছিলাম না বলে মারলো। এটা নতুন নয়। আব্বা আগে থেকেই আমাদের গায়ে হাত তুলে। একবার তো পুতুলকে তুলে আছাড় দিয়েছিল। ছোট্ট পুতুল! আমাদের বাবা নামক মানুষটা ভারী নিষ্ঠুর।

আব্বা আবার সেজো আপাকে ডাকছে। সেজো আপার কাজ গুছানো। চমৎকার। রান্নার হাতে যেনো জাদু আছে। আব্বা হয়তো চাচ্ছে আজ তার নতুন অতিথির জন্য আপার হাতে ঝোল করতে। কিন্তু আপা বের হলো না। তার বদলে বের হয়ে এলো বড়ো আপা। আব্বা মাছ এনেছে। মুখের টনটনে ব্যাথা নিয়ে আমি রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। বড়ো আপাকে সাহায্য করতে হবে।

__________

এরপর দুদিন কেটে গেছে। বাড়ির অবস্থা ভয়াবহ। মা এখন পর্যন্ত মুখে কিছু তুলেনি। বড়ো আপা আর সেজো আপা কোনো রকমে দুটো দানা খেয়ে বেঁচে আছে। মাকে কিছুতেই খাওয়ানো যাচ্ছে না। পুতুলকেও কাছে নিচ্ছে না। মায়ের শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে। শরীর আরো দূর্বল হয়ে গেছে। তবুও মুখে খাবার তুলছে না।

বড়ো আপা শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে এসেছে মাসখানেক হলো। বর ভালো না। সারাক্ষণ মারধর করে। ঠিকমতো খেতে দেয় না। পেটে বাচ্চা আসার পর আরো ক্ষেপেছে। সর্বদা চড়, লাথি! আপা সহ্য করতে না পেরে চলে এসেছে। আর খোঁজ নিচ্ছে না তারা। এত দুঃখ সহ্য করা যায়?
পৃথিবীর সব দুঃখ উপরওয়ালা আমাদের দিয়েছে যেনো!

বিকেলের দিকে আব্বা গোছগাছ শুরু করলো। কথা বলতে ইচ্ছে করে না তার সাথে। তবুও কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম,

‘আব্বা কোথায় যাবে তুমি?’

আব্বা সদুত্তর দিলো না। নতুন মা এই দুদিন কোনো কথা বলেনি। চুপচাপ থেকেছে। আব্বার ঘর থেকে বের হয়নি। খাবারও আব্বা ঘরে দিয়ে এসেছে। কানাঘুষায় শোনা যাচ্ছে, নতুন মা নাকি যাত্রাপালা করতো। সেখানে আব্বার সাথে পরিচয়। পরে নাকি আব্বাকে বিয়ে করে পালিয়ে এসেছে।

আব্বার বয়স বাড়েনি। দেখলে অল্প বয়সের মনে হয়। প্রথম দেখায় কেউ বিশ্বাস করবে না এত বড় বড় মেয়ে আছে। আমার নতুন মায়েরও বোধ হয় বিভ্রম হয়েছে। বুঝতে পারেনি।

সন্ধার পর পর আব্বা বের হলো। নতুন মাকে সাথে নিয়ে। একদম পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে। আব্বাকে দেখে কেন জানি আমার কষ্ট হলো। ভীষণ কষ্ট হলো। মনে হলো, আব্বাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলছি। আব্বা কি আর কোনোদিন আসবে না? নিজের অজান্তে আমার চোখের কোণ ভিজে উঠলো।

আব্বা যাওয়ার পর পরই মা রুম থেকে বের হলো। টানা ৪ দিন পর বাহির হলো মা। আব্বা যাওয়ার আগে মায়ের রুমে ঢুকেছিল। তাদের মধ্যে কি কথা হয়েছে জানি না। কিন্তু আমি তাকিয়ে দেখলাম মা একদম স্বাভাবিক। আমার কাছে এসে লাজুক স্বরে বললেন,

‘জুঁই ভাত আছে? ভাত দে তো। খিদা পাইছে খুব।’

আমার চোখের জল গাল স্পর্শ করলো। দৌঁড়ে রান্নাঘরে গিয়ে ভাত বেড়ে আনলাম। মা বারান্দায় বসে খেলো। পেটপুরে। খাওয়া শেষ করে পুতুলকে কোলে নিল। ওর সাথে দু চারটে ছেলেমানুষী কথার আদান প্রদান করলো। আমার কি যে ভালো লাগলো!

________

সেজো আপা আজ আমার পাশে শুয়েছে।মা পুতুলকে নিয়ে বড়ো আপার সাথে ঘুমিয়েছে। সমস্ত বাড়ি সুনসান। নিরব! সেজো আপা চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। আপা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? আমার কিছুতেই ঘুম আসছে না। কদিন হলো স্কুলে যাওয়া হয়নি। লোকের কথার ভয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখা হয়নি। ঘরবন্দী সময় কাটছে অনেকটা! সেজন্যে রাফি ভাইয়ের সাক্ষাৎ মেলেনি। সেই যে সেদিন রাতের অন্ধকারে দেখেছিলাম। আর চোখে পড়েনি। ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিলাম আমি। মানুষটা ঐ তো একটু দূরে রয়েছে। হাত বাড়ালেই স্পর্শ করা যাবে যেন! তবুও কত দূরে! একবার চোখের দেখা মেলে না।

‘জুঁই, নড়চড় করবি না। লাথি দিয়ে ফালায় দিবো কিন্তু!’

মুহূর্তে আমি স্ট্যাচুর মতো হয়ে গেলাম। আপাকে দিয়ে ভরসা নেই। সত্যি সত্যি লাথি দিতে পারে। একবার শীতের রাতে কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে দুজনার। লাথি দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিয়েছিল। আপার প্রচন্ড রাগ। আপাকে দুলাভাই সামলাবে কি করে?

‘আপা! ঘুমিয়ে পড়েছ?’

ক্ষীণ গলায় ডাক দিলাম আপাকে। আপা শুনলো না। এবার হালকা করে বাহু তে ধাক্কা দিলাম। আপা বিরক্তি নিয়ে বললো,

‘বল!’

‘এই বিয়েতে তোমার মত নেই?’

‘বিয়েটা হবে না রে জুঁই। তোর মনে হয় আব্বার এতবড় ঘটনার পর ওরা আমায় বাড়ির বউ করবে? করবে না। ওরা নামী-দামী পরিবার। এলাকায় নাম প্রচুর। আমদের মত এমন পরিবার থেকে মেয়ে কেন নিবে?’

আপার বিয়ে ঠিক হয়েছে পাশের গ্রামে। ছেলে একটু বখাটে টাইপের। তবুও বাপের প্রচুর অর্থ। বাপ মেম্বার। সেজো আপা আগুন সুন্দরী। ছেলেটা রাস্তায় আপাকে দেখেছিল। কিছুদিন উত্যক্ত করেছে। তারপর বিয়ের প্রস্তাব এনেছে। আব্বা এক কথায় রাজি হয়ে গেছে। আর কিছুদিন পর বিয়ে। কিন্তু কয়েক দিন হলো তারা খোঁজ নিচ্ছে না। কোনো প্রকার যোগাযোগ করছে না। আপার বিয়েটা কি ভেঙ্গে যাবে? বিয়ে ভেঙ্গে গেলে মা প্রচুর কষ্ট পাবে।

অন্ধকারে আপার দিকে তাকালাম। মুখ দেখা না গেলেও বুঝলাম আপা কাদঁছে। কেনো কাদঁছে? আপা তো এই বিয়েতে খুশি ছিল না। আব্বা এক প্রকার জোর করে বিয়ে দিচ্ছিল। বিয়ে না হলেই তো ভালো। আপা তাহলে কষ্ট কেন পাচ্ছে? আপা কি কাউকে ভালোবাসে?

আচমকা প্রশ্ন টা মাথায় এলো আমার। জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থেমে গেলাম। আপার মন ভালো না। অন্য সময় জিজ্ঞেস করবো। কাত ঘুরে চোখ বন্ধ করলাম আমি। বন্ধ দু চোখের পাতা পাশের বাড়ির ছেলেকে নিয়ে স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেলো।

__________

জানালার বাইরে কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে। আবছা ভাবে কানে আসছে। কিন্তু চোখ মেলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু পুরুষ কন্ঠটা চির পরিচিত মনে হচ্ছে। হঠাৎ ধপ করে চোখ খুললাম। জানালার ওপাশে রাফি ভাই। রাফি ভাই এতরাতে কার সাথে কথা বলছে? আমার বাঁ পাশের বিছানা খালি। সেজো আপা নেই। অন্ধকারে দেখলাম আপা পায়ের দিকের জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। জড়োসড়ো হয়ে। ফিসফিস করে রাফি ভাইয়ের সাথে কি যেনো বলছে! বুকের ভেতর তীব্র জ্বলুনি শুরু হলো আমার। এই অন্ধকার রাতে ভয়ংকর এক সত্য আবিষ্কার করলাম।

(চলবে)
#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব – ০৩

অন্ধকারে দেখলাম আপা পায়ের কাছের জানালায় দাঁড়িয়ে। জড়োসড়ো হয়ে! ফিসফিস করে রাফি ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। বুকের ভেতর জ্বলুনি শুরু হলো আমার। এই অন্ধকার রাতে ভয়ঙ্কর এক সত্য আবিষ্কার করলাম। রাফি ভাই আর সেজো আপা একে অপরকে ভালোবাসে। এতদিন কেন বুঝতে পারিনি আমি? নিজেকে বড্ড বোকা মনে হলো। চোখের সামনে ভেসে উঠল পুরোনো দিনগুলো। সত্যি তো! রাফি ভাইয়ের দৃষ্টি সবসময় সেজো আপার দিকে ছিল। অথচ তার প্রেমে আমি এতটা অন্ধ ছিলাম যে কিচ্ছুটি বুঝতে পারিনি।

সেজো আপা আর রাফি ভাই সমবয়সী। ছোটবেলায় একসাথে পড়াশুনা করেছে। তাদের সাথে আরো একজন ছিল। আমার মেজো আপা। আমার আরেকজন ভালোবাসার মানুষ। আপার কথা মনে পড়তে কষ্ট আরো বেড়ে গেল। মেজো আপা আর সেজো আপা জমজ ছিল। মেজো আপার জন্মের মিনিট বিশেক পর নাকি সেজো আপার জন্ম। আব্বার মুখে এসব কথা শোনা। মেজো আপা আর সেজো আপা সমানে সমানে বড়ো হচ্ছিল। বাড়িতে তখন হৈ হুল্লোর লেগে থাকতো। তারা প্রাইমারি স্কুল পাশ করেছে তখন। মায়ের কথামত আব্বা দুই বোনকে হাই স্কুলে পাঠাল। তখন আমার বয়স নয় কি দশ। এক বৃষ্টির দিনে মেজো আপা একা স্কুল থেকে ফিরছিল। পথে কি হলো জানি না। পরদিন আপাকে দূরের এক ধানক্ষেতে মৃত পাওয়া গেলো। তখন ছোট ছিলাম বলে বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখন বুঝি আপার সাথে কি হয়েছিল। আপা আমার এক বুক দুঃখ নিয়ে দুনিয়া ছেড়েছিল। তার সেই দুঃখের কিছু অংশ আমাদের পরিবারে অভিশাপ হয়ে নামে। আমরা আর ভালো থাকতে পারিনি। দুই দন্ড সুখে থাকতে পারিনি।

মেজো আপার ঘটনার পর আব্বা সেজো আপাকে আর স্কুলে পাঠায়নি। কিন্তু আপা রাফি ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ রেখে গেছে। ভীষণ কষ্ট হতে লাগলো আমার। দেহের ভেতর ক্রমাগত সূচ ফুটছে। বুক ফুঁড়ে কান্না বের হতে চাইলো। আমার পনেরো-ষোলো বছরের জীবনে এত দুঃখ পাইনি যেন। কি যে কষ্ট হতে লাগলো! কিন্তু এখন তো কান্না করা যাবে না। আপাকে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না। হাতের আঙ্গুল কামড়ে মরার মতো পরে রইলাম আমি।

জানালা বন্ধ হওয়ার আগ মুহূর্তে রাফি ভাই কি যেন বললো। সেজো আপা চাপা সুরে হেসে উঠলো। আহা! বাচ্চাদের মতো কি প্রাণবন্ত হাসি। এতো এতো দুঃখ, মলিনতার ছাপ পড়েনি সে হাসিতে। কান পেতে শুনলাম সে হাসি। শেষ কবে আপাকে হাসতে দেখেছিলাম ভুলে গেছি। আপার হাসি কি সুন্দর! আচ্ছা, রাফি ভাই কি আপার হাসির প্রেমে পড়েছিল?

সেজো আপা এসে পাশে শুয়ে পড়েছে। আমি ঘুমের ভান ধরে পরে আছি। কিছুক্ষণ পর আপা ডান হাতটা আমার পেটের উপর রাখলো। আপা এখনো চাপা সুরে হাসছে। তার সেই হাসিতে ক্ষণে ক্ষণে শরীর দুলে উঠছে। খুব দ্রুত আপা ঘুমিয়ে পড়ল। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে। তার এপাশে আমার সদ্য ভাঙ্গা হৃদয়ের দেহটা পড়ে রইলো!

________

পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি একমাত্র আমার আব্বা ছিল। আব্বার একার আয়ে কোনো রকমে দিন চলতো। আব্বা চলে যাওয়ার পর সংসারে ধ্বস নেমে এলো অল্প দিনেই। পুতুলের দুধ কেনার টাকা নেই। ঘরে চাল কেনার টাকা নেই। দু চারজনের কাছে ধার চাইতে গিয়ে শূন্য হাতে ফিরতে হলো মাকে। উল্টো যারা টাকা পেতো তারা রোজ আসা শুরু করলো। একটুখানি বাড়ি! সেটাও ছাড়ার হুমকি ধামকি দেওয়া শুরু করলো। মা অসহায় ভাবে তার বাবার বাড়িতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। মায়ের দিকের, না বাবার দিকের! এই দুর্দিনে কোনো দিকের আত্মীয় স্বজন পেলাম না। আগে থেকেই কোনো আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ ছিল না। আব্বার ঘটনার পর সবাই আরো মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। এমনি এক দুঃখের দিনে একটা কাগজ এলো। দেখলাম ডিভোর্স পেপার। বড় আপার স্বামী ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে। সাথে আরো জানতে পারলাম, ইতোমধ্যে সে আরেকটা বিয়েও করে ফেলেছে।

সেজো আপার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে দিন দুই হলো। সে খবর মা হজম করে নিয়েছিল। কিন্তু বড় আপার এত বড় দুঃসংবাদ মা মানতে পারলেন না। উঠোনে গড়াগড়ি করে কাঁদলেন। তাকে সঙ্গ দিলো বড়ো আপা। আপার পেট উচুঁ হয়ে গেছে। গর্ভের সন্তান দিন কে দিন বেড়ে উঠছে। বড় হচ্ছে। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আসার জন্য তার সে কি তোড়জোড়!

মায়ের কান্না দেখলে সবাই কাঁদে। বড় আপা কাঁদে, আমি কাঁদি, পুতুল কাঁদে। এমনকি আকাশ-বাতাস, প্রকৃতি কাঁদে। শুধু কাঁদে না সেজো আপা। আমার সেজো আপা খুবই কঠিন। দুঃখ পায় না, কষ্ট পায় না, ব্যথা পায় না যেন! অনুভূতিহীন পাথরের মতো আচরণ করে সবসময়। এই পাথরসম মন নিয়ে আপা রাফি ভাইকে ভালোবাসলো কি করে? নাকি সব অনুভূতি রাফি ভাইকে দিয়ে আপা এমন নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে!

ঘরের এক কোণে বসে অশ্রু নির্গত করছিলাম আমি। সেজো আপা পুতুলের হাত ধরে ঘরে এলো। বাহিরের উঠোনে মা আর বড়ো আপার কান্না তখনও থামেনি। সেজ আপা কাছে এসে পুতুলকে এগিয়ে দিল। বলল,

‘পুতুলের কান্না থামা তো।’

দ্রুত চোখ মুছে ফেললাম আমি। কাছে টেনে নিলাম পুতুলকে। আপার বের হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু আপা বের হলো না। আমাকে অবাক করে দিয়ে পাশে বসে পড়লো। গা ঘেঁষা স্বভাব নেই আপার। একা থাকতে পছন্দ করে সবসময়। সেজন্য বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কিছু বলবে আপা?’

‘জুঁই, তোকে যদি দুটো অপশন বলা হয়। সবচেয়ে সহজ মৃত্যু অথবা এই কঠিনতর জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা। কোনটা পছন্দ করবি?’

‘বেচেঁ থাকা আপা। বেচেঁ থাকা কঠিন নয়। বেচেঁ থাকা সবচেয়ে সুন্দর আর সহজ পথ।’

আপা হাসলো। কেমন অদ্ভুত সে হাসি। ক্ষনিকের জন্য গা শিউরে উঠলো আমার। আপা বললো,

‘বেচেঁ থাকা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। তুই বেচেঁ আছিস মানে তোকে অবশ্যই দুঃখ সইতে হবে। জ্বালা যন্ত্রণা অনুভব করতে হবে। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ এবং সুন্দর মুহূর্ত হচ্ছে প্রেমে পড়া। তুই যখন কাউকে ভালোবাসবি বা প্রেমে পড়বি, তখন বেঁচে থাকার মতো কঠিন কাজ সহজসাধ্য হয়ে পড়বে। জীবনে যত কষ্ট থাকুক না কেনো উপলব্ধি করতে পারবি না!’

প্রবল দুঃখ বোধে মন ছেয়ে গেলো আমার। আমি জানি প্রেমে পড়ার মতো সুন্দর মুহূর্ত পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। সারাদিন যত কষ্ট পেতাম, গালিগালাজ শুনতাম। দিনশেষে রাফি ভাইয়ের মুখটা এক নজর দেখলে মন ফুরফুরে হয়ে যেত। এ ধরায় শ্বাস নেওয়া সার্থক মনে হতো।

‘তবে জানিস জুঁই?’

আপার দিকে তাকালাম আমি। আপার মুখটা অন্ধকার মনে হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আপা বললো,

‘আমি আগে এমনটা ভাবতাম বুঝলি! কিন্তু আরো বড়ো হওয়ার পর বুঝলাম, প্রেম, ভালোবাসা সব আপেক্ষিক। শুধুমাত্র দুঃখটা চিরস্থায়ী। কষ্টটা চিরস্থায়ী। তুই যতদিন বেঁচে থাকবি, এগুলো তোর পিছু ছাড়বে না। বেচেঁ থাকা সত্যি কঠিন। তোর মনে আছে? ছোটবেলায় আমি কতবার পুকুর পাড়ের নারকেল গাছে উঠার চেষ্টা করেছি! কখনো পারিনি। অসাধ্য মনে হতো। এখন বেচেঁ থাকা আমার কাছে নারকেল গাছে উঠার মতো কঠিন মনে হচ্ছে!’

‘তবুও বেঁচে থাকা সুন্দর।’

বিড়বিড় করে বললাম আমি। আপা শুনতে পেলো না হয়তো। এলোমেলো ভাবে পা ফেলে বের হয়ে গেলো।

__________

মা আজ মাংস রান্না করেছে। পাতিল ভর্তি করে ভাত রান্না করেছে। আমার সবগুলো বোনকে পাশে বসিয়ে পেট পুড়ে খাইয়েছে। একবার নিচু স্বরে টাকার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম মাকে। ঠিকমতো উত্তর দিতে পারেনি মা। শুধু বলেছে, জমানো ছিল!

খাওয়া শেষ করে ঘরে বসেছিলাম। মা গ্লাস ভর্তি দুধ নিয়ে এলো। ছোটবেলায় পর্যাপ্ত দুধ খেতে পারিনি। সেজন্য দুধের প্রতি আমার আলাদা আকর্ষণ। উৎফুল্ল হয়ে গ্লাস ছিনিয়ে নিলাম। চুমুক দেওয়ার আগ মুহূর্তে সংবিৎ ফিরলো। গ্লাস হাতে রেখে বললাম,

‘এতো দুধ আমি খাবো মা?’

‘হ। তুই খাবি! একসের দুধ জ্বাল দিছি। খাইয়া ফেল সব।’

‘পুতুলের হবে তো?’

‘হইবো। তুই খা!’

‘আমি উঠোনে বসে খাই।’

মা প্রথম দিকে বাঁধা দিলো। পরমুহুর্তে কি মনে হতে বললো,

‘যাহ! উঠানে বইসা খা।’

আমি ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। মা হয়তো ভয় পাচ্ছে আমি দুধ ফেলে দিবো কিনা! পাগল নাকি! দুধ ফেলার জিনিস? দুধ আমার কতটা প্রিয়। প্রিয় জিনিস ফেলতে আছে? না, নেই!

আকাশে আজ মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। তার রূপালী আলোয় ভেসে যাচ্ছে সমস্ত গ্রাম। গাছের পাতা ঝকঝক করছে। বাইরে হিমশীতল বাতাস। বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠল। আমি চাঁদের আলোয় পা রেখে পুকুর পাড়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। পুকুর পাড় পরিষ্কার। চাঁদের আলোয় চারিদিক দিনের মত আলোকিত। হালকা ঘাসের উপর বসে পড়লাম আমি। প্রায় রাতে এখানে বসে থাকা হয়। রাফি ভাইয়ের সত্য উদঘাটনের পর আসা হয়নি। আজ আসতে প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে গেল। পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়লো।

তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। স্কুল থেকে ফেরার পথে এক দুপুর বেলা ঝড় উঠে এলো। ঝড় এসে দিনকে রাত বানিয়ে দিল মুহূর্তে! প্রকৃতিতে বেপরোয়া ভাব। বৃষ্টি পড়ছিল তুমুল বেগে। সেই ভয়াবহ ঝড়ের দুপুর বেলা দেখা হলো রাফি ভাইয়ের সাথে। সে-ও স্কুল থেকে ফিরছিল। আমাকে দেখে দ্রুত এগিয়ে এলো। আধভেজা বইগুলো নিজের কাঁধব্যাগে নিয়ে নিল। তারপর আমার হাত ধরে দিলো ছুট! সেই ঝড়ের দিনে আবারো তাকে মন দিয়ে ফেললাম।

জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এই একটা মানুষকে আমি চিনি। আমার সমস্ত চিন্তা জুড়ে শুধু একজন ছিল! যার আমার হওয়ার কথা নয়। এর চেয়ে কষ্টের কিছু আছে?

বিড়ালের ডাকে ঘোর কাটলো আমার। সাদা রঙের বিড়ালটা গা ঘেঁষছে। গলার স্বর রিনরিনে। ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে ওকে। কয়েক বার চিন্তা করে দুধের গ্লাসটা ওর মুখের কাছে দিলাম। পেট কানায় কানায় পরিপূর্ণ আমার। ওর হয়তো সারাদিন খাওয়া হয়নি। খুদার জ্বালা জানা আছে আমার। বিড়ালটা চুকচুক করে খাওয়া শুরু করেছে। এক ফাঁকে মুখ উচুঁ করে আমার দিকে তাকালো। চাঁদের আলোতে ওর কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টি দেখতে পেলাম।

এরপর কতক্ষণ কেটে গেছে ধারণা নেই। রাফি ভাইদের রান্নাঘরের আলো বন্ধ হতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বিড়ালের খাওয়া শেষ। মুখ ভার করে বসে রয়েছে। আমি খালি গ্লাস হাতে নিয়ে ঘরে আসলাম। ঘর থেকে মায়ের গোঙানির আওয়াজ আসছে। বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো আমার। হাতের গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে মায়ের কাছে গেলাম। মায়ের মুখ দিয়ে ফ্যানা বের হচ্ছে। মা কেমন মোচড়ামুচড়ি করছে। মুখ দিয়ে গোঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। দেখে বুঝতে পারছি মায়ের ভীষন কষ্ট হচ্ছে। মাকে জড়িয়ে আমি চিৎকার করে উঠলাম।

‘মা কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন? মা কথা বলো! মা?’

মা কথা বললো না। কয়েক মিনিটের মধ্যে মা নিস্তেজ হয়ে এলো। শরীর টান টান হয়ে গেলো। মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে না। হাত পা কাঁপছে আমার। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বড় আপাকে ডাকলাম। সেজো আপাকে ডাকলাম। কেউ এলো না। এতক্ষণে খেয়ালে এলো আমার। ঘরের এদিক ওদিক আপারা অগোছালো ভাবে শুয়ে আছে। বড় আপার বুকের ওড়না ঠিক নেই। অথচ আপা কখনো মাথার কাপড় ফেলতো না। দৌঁড়ে আপার কাছে গেলাম। মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে ডাকলাম। আপা শুনলো না। সেজো আপাকে ডাকলাম। আপা প্রতিত্তর করলো না। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে দেখলাম, পুতুল বিছানায় শুয়ে আছে। পাশে দুধের বাটি পড়ে আছে। চামচটা পুতুলের হাতে আঁকড়ে ধরা এখনো। ঠোঁটের কোণে ফ্যানার স্তূপ নিয়ে ও চিরনিদ্রায় চোখ বন্ধ করেছে।

এক চিৎকার দিয়ে আমি উঠোনে পড়লাম। দিন দুনিয়া ঘুরছে। মস্তিষ্ক নিশ্চল হয়ে গেছে। হৃদপিন্ডে কি যেনো খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। তার প্রতি ঠোঁকরে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। শ্বাস আটকে আসতে চাইছে বার বার। চোখ বন্ধ করার আগ মুহূর্তে দেখলাম, আশপাশের সবাই বাড়িতে ঢুকছে। তাদের সবার সামনে রাফি ভাইয়ের চিন্তিত মুখ দেখা গেল। চোখ আপনা-আপনি স্মিত হয়ে এলো! আমি অস্পষ্ট সুরে বিড়বিড় করলাম,

‘আমার ভালবাসার মানুষগুলো তীব্র অভিমান নিয়ে দুনিয়া ছেড়ে গেলো। তোমরা কেউ দেখলে না। কেউ নাহ!’

(চলবে)

!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here