ভালবাসা রং পাল্টায় না পর্ব ৫

0
321

#ভালবাসা_রং_পাল্টায়_না(৫)
ভীষন রকমের নির্লিপ্তভাবে চেয়ে রইল রুমকি। কিন্তু এই নির্লিপ্ততা তানজিদের মাঝে কোন পরিবর্তন আনতে পারল না। সে আজ যে উদ্দ্যেশ্যে এসেছে সফল হয়ে যাবে। পেছন ফিরে দেখল রুবানা দাঁড়িয়ে আছে। রুবানাকে চলে যেতে বলেই রুমকির উদ্দ্যেশ্যে বলল
-আমি জানতাম তুমি এমন নির্লিপ্ত থাকবে। ভাব এমন করছ যেন আমার আসা না আসায় তোমার কিছু যায় আসে না।
রুমকি অবাক হয়ে যায় তানজীদ আসলে কি করতে বা বলতে চাইছে। ছোটবেলা থেকে রুমকির রুমে এভাবে চলে আসা তানজীদের জন্য কোনো ব্যাপার নয়। আর নানান সময় সে রুমকির সাথে কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি একবার রুমকির হাতে চড়ও খেয়েছে। কিন্তু আজকের এই তানজীদ আর সেদিনের সেই তানজীদের মাঝে যেন বিস্তর ফারাক। আর এই তানজীদকে মানা করার সাধ্য যেন আজ রুমকির নেই। তাই চুপচাপ শুনে যেতে লাগল কথাগুলো।
তানজীদ বলে যেতে লাগল
-একটা ছেলে যখন থেকে ভালোবাসা নামে যে একটা জিনিস আছে সেটা বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই একটা মেয়েকে ভালোবাসে। ঘরঘর খেলার সময় বউ হিসেবে যে মেয়েটি তার সাথে খেলা করত বাস্তব জীবনে নিজের পাশে সে মেয়েটিকে চাইতে লাগল। মেয়েটি তার বয়সে বড় কি ছোট কিছুই মাথায় এলো না। এটা কি ভীষণ দোষের কিছু?
এই বলে কিছুক্ষণ রুমকির দিকে চেয়ে রইল। কিন্তু রুমকি যেন আজ পণ করেছে সে কিছু বলবে না। অবশ্য তানজীদ রুমকি কিছু বলবে সে আশাও করছে না। নিজের মতো করে আবার বলে যেতে লাগল
-মেয়েটি ব্যাপারটা জানার পর ভীষণ রকমের ভৎর্সনা করল। বাসায়ও কি করে যেন জানতে পেরে গিয়ে বাবা তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল। প্রচণ্ড রকমের অভিমানে ছেলেটি সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েটির সামনে আর যাবে না। কিন্তু চলে যাবার দিন যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল ছেলেটি নিজের মাঝে আর স্থির থাকতে পারে না। মেয়েটির সাথে দেখা করার জন্য চলে যায়। কিন্তু মেয়েটি এবারও তাকে ফিরিয়ে দেয়। প্রচন্ড অভিমানে ছেলেটি আর মেয়েটির সাথে দেখা করেনি। একতরফা ভালোবাসাকে দাফন করে দেয় মনের মাঝে। হঠাৎ অনেক বছর পর কাকতালীয়ভাবে মেয়েটির সাথে আবার দেখা হয় ছেলেটির। এবার ছেলেটি মেয়েটির চোখে এক অদ্ভুত অনুরাগ দেখতে পেল। ছেলেটির আর বুঝতে বাকি নেই মুখে কিছু না বললেও মেয়েটিও তাকে ভালোবাসে। এটা জানার পর ছেলেটি সিদ্ধান্ত নেয় সে আর পিছু হটবে না। তার ভালোবাসা সে যেমন করেই হোক আদায় করে নিবে।
এইটুকু বলে রুমকির দিকে তাকিয়ে থাকে। রুমকি ঠিক আগের মতোই নির্বিকার। তানজীদ ভীষণ অবাক হয় একটা মানুষ এমন নির্লিপ্ত থাকে কি করে। আর এদিকে রুমকি ভীষণ অবাক হয় এই ভেবে এই ছেলে কি করে তার মনের অবস্থা বুঝে ফেলল? এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়। তানজীদ বুঝতে পারছিল রুমকি আজ আর কিছু বলবে না তাকে, তাই বিদায় নিয়ে চলে গেল।
দুইদিন পর রুবানা হঠাৎ রুমকিকে ডেকে তার মোবাইলে কথা বলতে দিল। অপর দিকে অবশ্যই তানজীদ ছিল। এবার রুমকি বাধ্য কথা বলতে। যদিও বেশীরভাগ কথা তানজীদ বলছিল। তানজীদ ভীষণ করে দেখা করতে চাইছে। তিনদিন পর চলে যাবে। যাবার আগে একবার রুমকির সাথে দেখা করতে চায়। রুমকি অবশ্য হা না কিছুই বলেনি।
এদিকে রুবানা রুমকির উপর ভীষণ ক্ষ্যাপা। সে মনে আশেপাশেই কোথাও ওত পেতে ছিল। কথা শেষ হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে চোটপাট শুরু করল
-এসব কি? ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস কেন? এবার খুল্লাম খুল্লা কর। অনেক দিন তো হলো আর কত? আর আমার ফোনে এভাবে কল দিয়ে ফোন এঙ্গেজ করে রাখা যাবে না। নিজের ফোন নাম্বারটা দে।
-তুই কি আড়ি পেতে কথা শুনছিলি?
-শোন আড়ি পাতার দরকার আছে? আমার মোবাইলের ভয়েচ রেকর্ড অপশন অন করে দিলেই তো হয়ে যায়, তাই না?
রুমকি বোকার মতো বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। এ দেখে রুবানা বলে
-এমন করে তাকাতে হবে না আমি তানজীদকে তোর নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি।
এরপর শুরু হয় তানজীদের পাগলামি। এই পাগলামির কাছে হার মেনে অবশেষে রুমকি দেখা করার জন্য রাজি হয়।
………….
আর আটদশ জন দেখা করার জন্য বেছে নেয় কোন রেস্তোরেন্ট, পার্ক কিংবা শপিং মল। কিন্তু এই ছেলেটি কেমন অদ্ভুত। সে দেখা করার জন্য বেছে নিয়েছে একটা নার্সারী। রুমকি ভীষণ অবাক হয়। তানজীদ একটু ক্ষ্যাপাটে আছে এটা জানে কিন্তু তাই বলে এতোটা!
যাই হোক রুবানাকে ঝাড়ি দিতে দিতেই সে দেখা করতে যাচ্ছে। রুবানা কিছু বলে না কেবল মুচকি হাসে। সে জানে রুমকির এই ঝাড়ির পেছেনেও আহ্লাদ লুকিয়ে আছে। তানজীদ আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল রুমকির জন্য। রুমকিকে দেখেই দৌড়ে এলো।
রুমকির কেমন যেন একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কেন এলো বুঝতে পারছে না। আবার তানজীদের জোরাজোরিতে না এসেও পারছিল না। সব জেনে এসেছে তার মানে এটা দাঁড়ায় সে তানজীদের আহবানে সাড়া দিচ্ছে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করল তানজীদ। এই ছেলের অদ্ভুত এক ক্ষমতা, কিছু বলতে হয় না। সবকিছু কি করে যেন বুঝে যায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই যেন নিজের গল্প করছে। বাবার বদলী, নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, মজার ঘটনা ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ করে বলে বসল
-তোমার তো অনার্স শেষ। মাস্টার্স শেষ হতে আর বছর দেড়েক এরপর পরিকল্পনা কি?
-কি আর! জবের জন্য ট্রাই করব।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে উঠল
-আর বিয়ে?
-ভাবিনি এখনো।
আবারো বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা। হঠাৎ কণ্ঠস্বর কেমন যেন ভারী শোনাল তানজীদের
-আমাকে দুবছর সময় দিবে? দুবছর পর আমি ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জয়েন করতে পারব। তখন বাসায় প্রস্তাব পাঠাব। প্লিজ।
রুমকি কি বলবে? নিজের মাঝেই কেমন যেন ভাঙ্গা গড়া টের পাচ্ছিল। অনেক কষ্টে বলল
-জানিনা।
-এ কেমন কথা তুমি জান না? আচ্ছা ঠিক আছে। দুবছর লাগবে না, আমি পরশু চলে যাচ্ছি শীপে। একবছরে ছুটিছাটা কেমন পাই জানি না। তবে যদি আসতে পারি তখন অথবা একবছর পর এলে তখন তোমার বাসায় প্রস্তাব পাঠাব। তুমি এক বছরই ধরে নাও। এই একটা বছর আমার জন্য অপেক্ষা কর প্লিজ।
রমকি কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কি এক ঘোরের মধ্যে আছে নিজেও বলতে পারবে না। কেবল মুখ থেকে গোঙানির মতো ‘হু’ বের হলো। তানজীদ যেন এই এক ‘হু’র মাঝেই সব উত্তর পেয়ে গেল। তার এখন বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ।
সবাই তাদের বিশেষ দিনটাকে স্মরনীয় করে রাখার জন্য নানান কর্মকান্ড করে থাকে। তানজীদও এর ব্যাতিক্রম নয়। কিন্তু তার কার্যকলাপ অন্যদের চাইতে একটু আলাদা। নার্সারী থেকে একটা কদম ফুল আর একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ কিনে নার্সারীর প্রবেশদ্বারের দুইপাশে লাগিয়ে দিল।
রুমকি ভীষণ অবাক হলো তানজীদের এমন কাজে। রুমকির বিস্ময় বুঝতে পেরেই বলল
-বর্ষার দিনে কদম গাছটা যখন ফুলে ফুলে ভরে যাবে তখন তোমার সাথে এসে এই কদম গাছের নীচে এসে বসে থাকব।
-কৃষ্ণচুড়া কেন লাগিয়েছ তাহলে?
-তোমার লাল রঙ প্রিয় তাই।
-আমিতো কখনো তোমাকে বলিনি আমার লাল রং পছন্দ।
-সবকিছু বলতে হবে কেন? যে মেয়েটা অনেকগুলো রঙের মাঝে বেছে বেছে কেবল লাল রংয়ের জিনিসটাই নেয়, তাতে যতই খুঁত থাকুক না কেন তাহলে তার পছন্দের রঙ লাল না হয়ে কি হবে?
রুমকি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তানজীদের দিকে। এই ছেলেটা তাকে এতো ভালোবাসে! ভীষণ আফসোস হচ্ছে তার কেন এতোগুলো দিন পর তাদের দেখা হলো। তানজীদ আবার বলল
-কৃষ্ণচূড়া গাছটি লাগানোর আরেকটা কারন আছে। তুমি ভালো করে ভেবে দেখ নার্সারিটা ঠিক আমার বাসার কাছাকাছি। তুমি যখন বিয়ের পর বাসা থেকে বের হবে এই নার্সারিটার সামনে দিয়েই যেতে হবে। সিজনে রাস্তার উপর বিছিয়ে থাকা ফুলগুলো মাড়িয়ে যখন এই পথ দিয়ে যাবে তখন ভাববে আমি ভালোবেসে লাল গালিচা বিছিয়ে রেখেছি তোমার জন্য।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here