ভাবীর সংসার
৪র্থ পর্ব
সাঈদ সকালে উঠে হাঁটাহাঁটি করছেন বারান্দায়, চেহারায় বেশ চিন্তার ছাপ। পলি দুই বার দেখেও কথা বলে নি। কারণ ভাইজান তাদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা বলেন না।
এবার সাঈদ পলিকে দেখে বললেন, এই পলি এদিকে আয়।
– জি ভাইজান।
– কি যে যন্ত্রণায় পড়লাম, আমি! তুই বুদ্ধি দেয়।
– ভাইজান, আপনি যা ভালো মনে করেন, করবেন। আমি কি বলবো?
– আচ্ছা, যা, তুই রুমে যা।
– চা দিব ভাইজান।
– না।
সাঈদ অফিসে যাওয়ার পরে, শ্বশুর চেম্বারে ডাকলেন,
– আসসালামু আলাইকুম।
– জামাই, জাহান কেমন আছে?
– ভালো আছে।
– ওকে সপ্তাহ খানেকের জন্য আমার বাসায়, দিও। এখন তো তার বিশ্রামের প্রয়োজন।
– জি।
– আর, এর পরে তোমার শ্বাশুড়ি সকাল-বিকাল দেখে আসবে। যেহেতু মেয়েটা অসুস্থ।
– জি, আব্বা।
– সব কিছুতে জি জি বলবেনা, তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, মাঝে মাঝে প্রসংগে কথা বলবে।
– জি বলবো।
সাঈদ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, কারণ এতো দিন বউয়ের সাথে, শ্বশুর বাড়ী থাকা, বেশ ঝামেলার। এটা থেকে মুক্তি পেয়ে বেশ আনন্দ লাগছে তার।
বিকেল বেলা সাঈদ বউকে বুঝিয়ে বললো সব, এবং তার বাবা ও কি বলেছেন সেটাও বললো।
তখন শারমিন, বললো তাহলে আমি এখন আর যাবো না। তুমি থাকবেনা কেন? সব আমি বুঝি। তোমার মতো মানুষের বিয়ের কোন যোগ্যতা নেই, নিজের বউয়ের যত্ন নিতে পারো না। আলাদা কেয়ার নিতে সমস্যা! নিবেই বা কেমনে ঘরভর্তি মানুষ। আমার কি কোন প্রাইভেসি আছে এই বাসায়? আমার আব্বা আমাকে বুঝলেন না, কি দেখে যে তোমার সাথে বিয়ে দিলেন! সেটাই মেলাতে পারিনা। এখন আবার নিজের মেমেকে বাসায় যেতে বারণ করছেন।
– জাহান।
– প্লিজ, চুপ থাকো। একদম কথা বলবেনা।
তখন কলিং বেল বেজে উঠেছে, সাঈদ বললো জাহান প্লিজ, একটু চুপ করবে, দেখি কে আসছে!
– আমি কাউকে ভয় পাইনা, চুপ কেন করবো?
পলি ভাইয়ের রুমে এসে বললো, ভাইজান খালুজান এসেছেন, ভাবীর আব্বা। বসার ঘরে বসেছেন।
– যা, আমরা আসছি।
জাহান, আব্বা এসেছেন, চলো।
– তুমি যাও, আমি আসছি।
– চলো…
– বললাম তো আসছি।
বাবার সাথে অনেক মান-অভিমান পরে, তিনি বললেন মা, তুমি একটা ঘরের বড় বউ, তুমি তোমার সংসার ছেড়ে গেলে চলবে? তোমার আম্মা এখন থেকে সকালে আসবেন সাঈদ আসার পরে যাবেন, তুমি আর মন খারাপ করে থাকবেনা।
শারমিনের মন কিছুটা শান্ত হলো, বাবার কথার অবাধ্য সে হয় না, কিন্তু অভিমান ভিতরে রয়ে গেল।
একসপ্তাহ বাবার বাড়ী থাকার প্ল্যান বাদ দিল শারমিন, মা প্রতিদিন আসবেন, তাতেই সে অনেকটা সন্তুষ্ট।
এখন প্রতিদিন সাহিদা খানম সকাল দশটার দিকে, মেয়ের বাসায় চলে আসেন। এবং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়ের পছন্দের রান্না বুয়া কে করতে বলেন। শারমিনের এখন রান্নার কোন চিন্তা নেই।
সাহিদা বেগম সাঈদ কে বললেন, আমার আজ তোমার সাথে কিছু আলাপ আছে। তাই আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকলাম বাবা।
– জি আম্মা বলুন।
– পলি খুব ভালো মেয়ে। ওর জন্য আমার কাছে, বিয়ের একটা আলাপ আছে।
– আম্মা, এখন বিয়ে দেওয়ায় মতো আমার অবস্থা নাই।
– আরে, তুমি শুধু খাইয়ে দিবে, প্রয়োজনে ছেলে পক্ষ সেই টাকাও দিবে।
– এই শ্যামলা মেয়েটাকে কে এমন করে নিবে।
– আরে, নিবে। আমাদের পাশের বাসার যে, মির্জা সাহেব আছেন, ওনার ছেলে মির্জা ইমদাদের জন্য প্রস্তাব এসেছে আমার কাছে
– ওরা কত্ত বড় লোক। এই লাইনের সব কটি বাস তাদের। তারা কেন?
– আহা! এতো কেন কেন করো কেন? আমি ওদের আজ রাত আট্টায় চায়ের দাওয়াত দিয়েছি। তোমার আপত্তি আছে?
– না, না। কিন্তু…
– আর কিন্তু না।আমি পলির সাথে কথা বলছি।
– জি।
পলির রুমে গিয়ে সাহিদা বললেন, এই পলি তুমি তো রাজ কপাল নিয়ে জন্মেছ দেখছি।
– কি যে বলেন খালাম্মা।
– মির্জা ইমদাদের জন্য তোনাকে পছন্দ করেছে। আমার কাছে প্রস্তাব এসেছে। আজই দেখতে আসবে।
– উনি কে? আর এখন বিয়ে?
– আরে, কপালে হাত দেও, তিনবার।
– খালাম্মা, এখন ভাইজান এই অবস্থায় নেই….
– কোন কথা নেই, তুমি জাহানের একটা শাড়ি পরে রেডি হও। ছেলে রাজপুত্র, বাইশ টা বাসের মালিক। কি নেই ছেলের। তুমি রেডি হও, যাতে তোমাকে পছন্দ করে।
কলি বার বার বলছে, পলিপা ভাবীর মা তোর বিয়ের জন্য এমন করছে কেন?
– জানিনা রে!
– যদি মির্জা বাড়ীতে বিয়ে হয়, তবে খুব ভালো হবে। কারণ ওদের তিন তলা সাদা বাড়িটি কি সুন্দর লাগে। খোদাই করে লিখা, “মির্জা বাড়ী”
– চুপ থাক।
– তুমি লজ্জা মরে যাচ্ছ কেন?
– তুই চুপ থাক বললাম।
– আচ্ছা চুপ।
পলি বার বার চিন্তা করে কিছুই মেলাতে পারছেনা, তার চেহারা মিষ্টি, কিন্তু গায়ের রঙ চাপা। সুন্দরী কিংবা রুপবতী না হলেও সে মায়াবতী। তবে কেন তাকে? আর যদি হয়, তাহলে কি সত্যি তার সংসার হবে? তার ভাই-বোন গুলিকে কি, সে দেখতে পারবে! এই কয়েক মিনিটে কত কিছু ভাবছে পলি। এই সংসারের মানুষ টা কি তার আপন হবে!
ঠিক আট্টায় সত্যি সত্যি মির্জা বাড়ীর তিন সদস্য তাদের বাসায় আসলেন,পাঁচ কেজি মিষ্টি নিয়ে। মির্জা ইমদাদের মা, মিসেস জেবা সিদ্দিকা, খুবই সুন্দর পরিপাটি হয়ে এসেছেন। গা ভর্তি গহনা চিক চিক করছে, স্যুট পরে বসেছেন মির্জা ইমদাদ, শ্যমলা হলেও বেশ মায়াবী চেহারা। পাত্রের বাবা মির্জা সাহেব সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পরে আছেন। পলি চারদিক দেখছে আর ভাবছে! এটা সত্যি?
মিসেস জেবা সিদ্দিকা, পলিকে বললেন, ভারী মিষ্টি মেয়ে তুমি। আমি সাহিদা ভাবীর সাথে সব আলাপ করেছি মা, তুমি ইমদাদের সাথে কথা বলো, আমি আজ আংটি পরিয়ে দিয়ে যাবো।
পলির বুক ধড়ফড় করছে, কিন্তু ইমদাদ সাহেব খুব সুন্দর করে কথা বলছেন। পলি মুগ্ধ হয়ে শুনছে।
হঠাৎ ইমদাদ সাহেব বললেন, মিস পলি আমার বউ ঈশিতা খুব ভালো মেয়ে, এতো রুপবতী মেয়ে, আমি খুব কম দেখেছি। কিন্তু আল্লাহ সবাইকে সব দেন না,একটা কিছু কমতিতে রাখেন। তার সেই কম জিনিস টা হলো, সে মা হতে পারছেনা। আমার বয়স চল্লিশ প্লাস হয়েছে, আমি আমার বাবার একমাত্র ছেলে। তাই আমি দ্বিতীয় বিবাহের জন্য চিন্তা করেছি। আমি দশ বছরেও বাবা ডাক শুনতে পারিনি। আপনি কি আমাকে একটা বাবু দিবেন? আমি আপনার কোন কিছুর অপূর্ণতা রাখবো না। সাহিদা আন্টি বলছেন আপনার পরিবারে সমস্যা, আমি আপনার দুই ভাইকে জব দিয়ে দিব। তারা ভালো করে চলতে পারবে। শুধু আপনি আমাকে বাবা ডাক শোনাবেন।
পলির যেন হঠাৎ করে সব হ য ব র ল লাগছে। কি বলছে এই লোক, সে এতোই খারাপ যে, একুশ বছর বয়েসে সে, একজন বিবাহিত পুরুষ কে বিয়ে করবে, শুধু সন্তান জন্মদানের জন্য! তার ভাইজান তার পরিবার তার জন্য টাকার জন্য এমন বিয়ের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেল!
পলি কি উত্তর দিবে, বুঝতে একদম পারছেনা। শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ কি ভিজে যাচ্ছে কি না তাও যেন টের পাচ্ছেনা পলি…..
চলবে….
আন্নামা চৌধুরী।