গল্পঃ #ভয় ( ৩য় পর্ব )
টের পেলাম আজ সত্যি আমার পিরিয়ড শুরু হয়েছে এবং ঘাবড়ে গেলাম এই কথা অভ্রকে কিকরে বলবো। ও জানে আমার পিরিয়ড শেষ এবং এখন যদি এই কথা বলি ও নিশ্চিত ভুল বুঝবে আমায়।
অভ্র ভাববে এভাবে তাকে দূরে সরিয়ে রাখার নিশ্চই কোনো কারণ আছে। হয়তো ভাববে আমি ওর প্রতি অখুশি নয়তো ভিন্ন কিছু।
আমি মোবাইলের ফ্লাস জ্বালাবো এমন সময় অভ্র আমার হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো– একদম না, প্রকৃতি ইশারায় জানিয়ে দিচ্ছে এবার আমাদের একান্তে কাছে আসার সময় অথচ তুমি বুঝছো না।
আমার মাথায় আরও একটা বিষয় ঘুরছে, সেটা হলো হারিকেনটা ছিল টেবিলের মাঝ বরাবর সেখান থেকে একেবারে টেবিলের বাইরে এসে পড়লো কীভাবে? যদি কাত হয়েও পড়ে তাহলেও পড়ে থাকার কথা টেবিলের ওপরেই। বিষয়টি সত্যি রহস্যময়।
আজ প্রথমবার অভ্র বলেই ফেললো– আচ্ছা তোমার কি কোনো কারণে আমার ওপর রাগ আছে? অথবা মনে কোনো লুকোনো কষ্ট?
আমি থতমত খেয়ে বললাম– অভ্র রাগ তো দূর, তোমার প্রতি আমার যে সীমাহীন ভালোবাসা সেখানে তিল পরিমাণ অভিযোগের অবকাশ নেই।
: তাহলে দূরে সরে থাকছো যে!
: হুম, পরিক্ষা নিচ্ছি আমার বরের।
: কিসের পরিক্ষা নিচ্ছ বউ?
: ধৈর্যের পরিক্ষা, আমার বর কতদিন ধৈর্য ধরে থাকতে পারে সেই পরিক্ষা।
: তাহলে এই পরিক্ষায় আমি ফেল করতে চাই বউ।
: হা হা হা, এতটা অধৈর্য হলে তো চলবেনা বর সাহেব। সংসার জীবনের ভিত্তি হলো এই ধৈর্য। দুজনের ধৈর্য যত বেশি সংসারের স্থায়িত্ব এবং সুখশান্তি তত বেশী।
: ধৈর্য নাহয় পরে ধরবো, আগে বউকে ধরি।
কথা শেষ করেই অভ্র আমাকে জড়িয়ে ধরতেই বাইরে ধুপ করে কিছু একটা পড়ার শব্দ হলো। অভ্র আমাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কি হতে পারে।
আমি বললাম– হয়তো বাতাসে শুকনো নারকেল পড়েছে গাছ থেকে অভ্র।
অভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো– চোরও হতে পারে, এরকম ওয়েদার শুধু জামাই বউয়ের জন্যই নয়। চোরদের জন্যও চুপচাপ কাজ শেরে সটকে পড়ার সময় বুঝলে? যাই বাইরে গিয়ে দেখি।
এরকম পরিস্থিতিতে কিছুতেই অভ্রকে বাইরে যেতে দেয়া যাবেনা।
আমি উঠে দাড়িয়ে অভ্রর হাত ধরে টেনে খাটে শোয়ালাম।
পাতলা কম্বল টেনে আমাদের গায়ে জড়িয়ে অভ্রর বুকে মাথা রেখে বললাম– এরকম ওয়েদারে বউয়ের পাশে শুয়ে থাকতে হয় মিস্টার জামাই।
অভ্র ইচ্ছে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো– শুধু শুয়ে থাকা আর পেটে ক্ষুধা নিয়ে বিরিয়ানির প্লেটের সামনে বসে থাকা ভীষণ বেদনার বিষয় যে বউ।
অভ্রর কথা শুনে না হেসে আর থাকতে পারলাম না আমি। হেসে হেসে বললাম– বিরিয়ানি খেয়ে ফেললেই তো হয়ে গেল, মাঝেমধ্যে অপেক্ষা করা কিন্তু মধুর, অপেক্ষার পরে পেলে তখন তৃপ্তি বেশি।
অভ্র মজা করে বললো– আর তৃপ্তি! এরকম হবে জানলে আবেগের বশে বিয়ে না করে বিবেকের বশে চিরকুমার থেকে যেতাম।
অভ্র আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো, আমি ধীরে ধীরে অভ্রকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালবেলা উঠে জলদি করে ফ্রেশ হয়ে অভ্রর জন্য নাস্তা রেডি করলাম। একটা নামকরা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবে ও।
নাস্তা শেষে রেডি হয়ে সবসময়ের মতো কোথাও যাবার আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে মিষ্টি হেসে ভালোবাসি বউ বলে অভ্র বেড়িয়ে গেল।
আমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রান্নার কাজে মনোযোগী হলাম, অভ্রর আসতে হয়তো দুপুর হয়ে যাবে।
রান্নাঘর থেকে বাইরে বের হতেই অবাক হয়ে গেলাম। পুকুর পাড়ের কাছে সেই রক্তজবার বাগানের পাশে অনড় হয়ে দাড়িয়ে রক্তজবার বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে একটা সাত আট বছরের বাচ্চা মেয়ে।
– এই যে শুনছো?– আমি বললাম।
মেয়েটি ঠিক সেভাবেই অনড়ভাবে দাড়িয়ে তাকিয়ে আছে।
আমি মেয়েটির কাছাকাছি এগিয়ে যেতেই বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে এসে বাজপাখির মতো ছোবল মেরে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে এক মহিলা বললো– কতবার বলেছি তোকে এবাড়িতে ভুলেও ঢুকবিনা।
মহিলা সম্ভবত মেয়েটির মা।
মহিলা আবারও বললো– কেন এসেছিস এখানে?
বাচ্চাটি মুখ ভার করে বললো– উনি ডেকেছে আমাকে ফুল দেবে বলে।
মহিলা বিরক্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে তারপর আমাকে দেখিয়ে বাচ্চাকে বললো– কে ইনি ডেকেছেন?
বাচ্চা মেয়েটা না সূচক মাথা নেড়ে আঙ্গুল দিয়ে রক্তজবার বাগানের দিকে ইশারা করে বললো– ঐখানে সাদা কাপড় পরা এক দাদু ছিল, সে আমাকে ডেকেছে।
মেয়েটির কথা শেষ হতে না হতে আমার এবং মেয়েটির মায়ের চোখ রক্তজবার বাগান তন্নতন্ন করে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। কিন্তু কৈ, কোথাও কেউ নেই।
আমার বুকের ভেতরটা কেমন ধড়াম করে উঠলো।
বাচ্চারা তো মিথ্যা বলেনা সহজে। তাহলে কি সাদা কাপড় পড়া সে কোনো অশুভ শক্তি ছিল?!
মেয়েটিকে তার মা– আর কোনদিন ভুলেও যেন এবাড়িতে আসতে না দেখি– বলে চলে যেতে যেতে আমাকে বললো– ভাবী আপনিও একটু সাবধানে থাকবেন, বাড়িটা আমার কেমন যেন অদ্ভুত লাগে।
আমি ঘুরে দাড়িয়ে ঘরে যাবার উদ্দেশ্যে দুপা বাড়াতেই পেছনের রক্তজবা গাছগুলো কেমন ঝরঝর করে হেলে-দুলে উঠলো। আমি চমকে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম সব স্বাভাবিক।
ইশ চুলোয় তরকারি চাপিয়ে এসেছি আবার পুড়ে যায়নি তো! দৌড়ে রান্নাঘরে এসে দেখি যা ভেবেছি তাই। পুড়ে গেছে।
মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে।
বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়তে দেরী হলোনা মোটে।
ঘুম ভাঙলো অভ্রর ডাকে, চোখ খুলে দেখি হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে জনাব। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই এগিয়ে এসে আমাকে পাজাকোলা করে কোলে তুলে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বললো– জবটা অবশেষে পেয়ে গেলাম বউ, এবার আমি আমার বউটাকে মনের মতো করে সাজিয়ে নিতে পারবো।
আনন্দে আমার চোখের কোণে জল টলমল করে উঠলো অভ্রর আনন্দ দেখে, এটাই বোধহয় ভালোবাসা, এটাই প্রেমের প্রতিচ্ছবি।
আমাকে কোল থেকে নামিয়ে অভ্র বললো– জলদি করে রেডি হও আজ আমরা বাইরে ঘুরবো ফিরবো এবং বাইরেই খাবো।
অভ্রর সাথে পালিয়ে আসার পরে থেকে বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। বাবা তো এখনও রেগে আছেন। মায়ের সাথেই যা দুচার কথা হয়। অভ্রর চাকরিটা হয়েছে এই খুশির খবর কারো সাথে শেয়ার করার আগপর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছিনা যে।
মাকে ভিডিও কল করলাম, মা রিসিভ করতেই দেখলাম বাবা মায়ের কাছ থেকে সরে গেল। তারমানে বাবা মা পাশাপাশি বসা ছিল।
মাকে বললাম– মা পালানোর মতো অপরাধ করে হলেও তো ভালোবাসার মানুষটাকে আজীবনের জন্য নিজের করে পেয়েছি বলো, ভালোবাসার জন্য এটুকু অপরাধ হয়তো জায়েজ আছে। ভালোবাসার মানুষটাকে পেয়েছি এবার তোমরা মেনে নিলেই তো আমি চির সুখী। তোমরা তো সবসময় আমার সুখই চাইতে মা।
আমার কথা শুনে মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো– তাই বলে পালিয়ে যাবি? বাবার সামনে সাহস করে বললেই হতো অভ্রকেই চাই। বাবা তো তোর, জম নয় যে মেরে ফেলতো।
– মা, বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে ঐ কথাটুকু বলার সাহস মেয়েদের হয়না বলেই তো পালিয়ে যাবার মতো অপরাধ করে ফেলে।
– বুঝলাম, কিন্তু তোর চোখের নিচে কালি পড়েছে যে, শরীর ঠিক আছে তো তোর?
– হ্যা মা আমি একদম ঠিক আছি, শুধু তোমাদের কাছে যেতে পারছিনা বলে কষ্ট হয়। ওমা– আব্বার রাগ কি কমবেনা?
– কে জানে! তোর বাপের যে রাগ।
– বাংলা সিনেমার মতো বাবু নিয়ে গিয়ে আব্বার হাতে তুলে দিলেই নাতির মুখ দেখে রাগ পানি হয়ে যাবে দেইখো মা।
– হা হা হা, তুই এখনও সেই পাগলী মেয়ে রয়ে গেলি।
– মা, অভ্রর খুব ভালো একটা চাকরি হয়েছে।
– আলহামদুলিল্লাহ খুশীর সংবাদ। ভালো থাকিস তোরা, সাবধানে থাকিস। এখন রাখি পরে আবার কথা হবে।
কল কেটে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি অভ্র নীল শাড়িটা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। শাড়িটা আমার হাতে দিয়ে বললো– আজকে এটা পরে নীলপরি হয়ে যাও আমার মায়াপরি। তুমি রেডি হও তারপর আমরা বের হবো।
অভ্র গিয়ে খাটে বসলো।
আমি শাড়ি চুড়ি পরে চোখে কাঁজল আঁকতে আঁকতে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বললাম– এবার কিন্তু আমরা এই বাসা চেঞ্জ করে অন্য কোথাও বাসা ভাড়া নিবো যত দ্রুত সম্ভব।
অভ্র আমার দিয়ে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো– ওসব বাদ আগে বউটার ওপর আরও আরও ক্রাশ খেয়ে নেই। নীল শাড়ীতে তোমায় অপূর্ব লাগছে নীলপরি।
– বেশি বেশি বলছো কিন্তু – বলে আবার আয়নায় তাকাতেই বুকের ভেতর কলিজাটা যেন উল্টে গেল আমার, শরীরের লোম কাটা দিয়ে উঠলো। ভয়ে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এ কি দেখলাম আমি…
চলবে…
লেখিকাঃ সাদিয়া ইসলাম কেয়া।