বৌপ্রিয়া পর্ব ৯ + ১০

0
795

#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৯|

তীব্র গরমে ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত কুসুম। ক্লান্তি যেন মাথায় চড়ে বসেছে। গা অত্যন্ত ম্যাজম্যাজ করছে। কুসুম দু কাঁধে দু বেনুনি দুলিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসে। সঙ্গে কুসুমের বান্ধুবি সেঁজুতি। কুসুম সেঁজুতির সঙ্গে আসন্ন পরীক্ষা নিয়ে কথা বলতে বলতে বাসার দিকে এগুচ্ছিল। হঠাৎ কুসুমকে পেছন থেকে ডাক দেয় শুভ। কুসুম ভ্রু কুঁচকে শুভর দিকে তাকায়। শুভ কুসুমের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। বেশ কদিন ধরে সে কুসুমের পেছনে পরে আছে। কুসুমের সঙ্গে প্রেম করাই যেন গর ধর্ম হয়ে গেছে। কুসুমকে চিঠিপত্র, ফুল এসব দিয়ে ভুলানোর চেষ্টাও করা হয়েছে কয়েকবার। তবে কুসুম বরাবরই তাকে এড়িয়ে গেছে। কুসুম এবারেও এড়িয়ে যেতে চাইল। তবে শুভ ততক্ষণে কুসুমের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেঁজুতি শুভকে একপল দেখে কুসুমের কানে কানে বলল,

‘ যখন বিরিয়ানির মধ্যে এলাচি কা*মড়ে পরে, তখন আমরা কি করি কুমকুম? ‘

কুসুম বোকার মত ফিসফিস করে বলে, ‘ কি? ‘

সেঁজুতি বিরক্ত হল। ধাম করে কুসুমের মাথায় ভয়াবহ চাপড় দিয়ে বলল, ‘ গাধার বাচ্চা। আমরা এলাচি ছুঁড়ে ফেলে দেই। এটাও জানিস না? ‘

কুসুম মাথায় হাত ঘষে বিড়বিড় করে, ‘ হ্যাঁ,তাইতো। ‘

সেঁজুতি আবারও ফিসফিস করে বলে, ‘ এবার দেখ এই অশুভকে কি করি আমি। চোখ মেলে থাকবি। পলক ফেলবি না। এখন মজাদার নাটক হবে। খলনায়িকা হব আমি। জাস্ট সি। ‘

কুসুম সত্য সত্য চোখে মেলে বড়বড় চোখে সেঁজুতির কাজ দেখে যায়। শুভ এগিয়ে আসতে চায় কুসুমের দিকে। সেঁজুতি পথ আটকে দাড়ায়। শুভ কাতর কণ্ঠে বলে,

‘ দেখ সুজি, কুসুমের সঙ্গে আমার অনেক দরকারি কথা আছে। সরে দাঁড়া। ‘

সেঁজুতি তার স্কুল ইউনিফর্ম এর কলার ঝাঁকায়। দম্ভ নিয়ে বলে,

‘ কুমকুম এখন ব্যস্ত। পরে কথা বলবে। ফুট এখন। ‘

শুভ তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে। সেঁজুতিকে পাশ কাটিয়ে কুসুমের দিকে চেয়ে বলে, ‘ আই লাভ ইউ কুসুম। দেখ, তোর জন্যে আমি আমার হাত কে*টে ফেলেছি। এই দেখ, দেখ। হাতে এখনো র*ক্তের দাগ আছে। ‘

শুভ তার স্কুল ড্রেসের হাতা উঠিয়ে বাম হাতের কব্জি কুসুমকে দেখায়। কুসুম আঁ*তকে উঠে। সত্য সত্য কা*টা শুভর হাত। ব্যান্ডেজের উপর র*ক্তের দাগ। কুসুমকে কথা বলতে না দিয়েই সেঁজুতি বলে,

‘ এটা ছাগলের র*ক্ত। বোকা পাইসিস আমাদের? ‘

শুভ এবার যেন আরো অসহায় হয়ে পরে। গতকাল রাতে সে বুক ভর্তি সাহস সঞ্চয় করে চোখ বুজে কব্জিতে ছু*রি দিয়ে এক টান দিয়েছে। ফিনকি দিয়ে র*ক্তও পরেছে। ব্য*থায় এখনো কব্জি জায়গাটা টনটন করছে। আর তারা বলে কি না, এটা ছাগলের রক্ত? এত ব্যথা তাহলে কার জন্যে সহ্য করল শুভ? পা*ষাণ মেয়ে। শুভ ছলছল চোখে বলে,

‘ এটা আমারই র*ক্ত। আমি সত্যি বলছি। বিশ্বাস না হলে আমার মায়েরে জিজ্ঞেস করতে পারিস। ‘

সেঁজুতি ধমকে উঠে, ‘ আরে রাখ ব্যাটা তোর আবেগের কথা। কুসুম তোর সঙ্গে প্রেম করতে পারবে না। কুসুমের হাত পা বাঁধা। ‘

শুভ অবাক হয়ে কুসুমের হাতের দিকে চায়। বোকার মত বলে,

‘ হাত পা তো খোলাই আছে। ‘

সেঁজুতি এবার যেন রেগে যায়। কটমট করে বলে,

‘ ওই ব্যাটা বে*য়াক্কলের বাচ্চা। কুসুমের হাত পা বাঁধা মানে সেই বাঁধা না। সম্পর্কের দড়ি দিয়ে বাঁধা। সোজা বাংলায় কুসুমের বিয়ে হয়ে গেছে। তোর মত পুচকু ছেলের জন্যে কুসুম বসে থাকবে নাকি? তার বিয়ে হয়েছে ডাক্তার বাবুর সাথে। বুঝসস? এখন ফুটে যা। কুইক। ‘

শুভর মাথা যেন চক্কর দিয়ে উঠে। কুসুম দাঁত দিয়ে ঠোঁট কেটে আহম্মকের মত দাঁড়িয়ে থাকে। সে এই বিয়ের কথা এতদিন লুকিয়ে এসেছে। কাউকে জানতে দেয়নি। আর আজ এই মুখ পাতলা সুজির বাচ্চা শুভকে জানিয়ে দিয়েছে। এখন সবাই জেনে যেতে মাত্র কয়েক মিনিট। কুসুম সেঁজুতির পিঠে ঘু*ষি দিয়ে বলে,

‘ সুজির বাচ্চা, সব ফাঁস করছিস কেন? ‘

সেঁজুতি হাত দিয়ে ইশারা করে কুসুমকে চুপ থাকতে বলে। শুভ সেঁজুতির কথা বিশ্বাস করে না। মাথা কাত করে কুসুমকে জিজ্ঞেস করে, ‘ সত্যি কুসুম? তোমার বিয়ে হয়ে গেছে? ‘

কুসুম কি আর বলবে? মিথ্যা তো আর বলতে পারবে না। তাই অগ্যতা কুসুম মাথা হেলায়, ‘ হ্যাঁ। ‘

শুভর বুকে যেন কেউ খা*মচি দিয়ে ধরে রাখে। সে টালমাটাল কণ্ঠে বলে, ‘ কবে হয়েছে বিয়ে? ‘

কুসুম মিনমিন করে উত্তর দেয়, ‘ এক সপ্তাহ আগে। ‘

শুভ বলে,’ এত ছোট বয়সে বিয়ে করে ফেললে? পরে যদি এই বিয়ে নিয়ে আফসোস কর? ‘

কুসুমের বুক ধড়ফড় করে উঠে। কুসুম কথা বলে না। হাঁসফাঁস করে অন্যদিকে চেয়ে বসে। শুভ আর কি বলবে? কুসুমের দিকে একপল অসহায় চোখে চেয়েও চলে আসে সেখান থেকে। সেঁজুতি এবার কুসুমের দিকে চেয়ে দম্ভ করে বলে,

‘ কেমন দিলাম, কুমকুম? ‘

কুসুম কথা বলে না। চুপচাপ হাটা শুরু করে। সেঁজুতি পথ পেরিয়ে আচমকা বলে,

‘ এই কুমকুম, কাল না তোর জন্মদিন গেল? ডাক্তার বাবু কি দিল গিফট? ‘

কুসুম বেজায় মন খারাপ করে। জন্মদিন উপলক্ষে কুসুম আর কিছুই চায়নি। শুধু চেয়েছিল, উচ্ছ্বাস ভাই একবার কল করবে। জন্মদিনের শুভেচ্ছা না জানাক, একবার ‘ ভালো আছো, কুসুম? ‘
জিজ্ঞেস করবে! না, সে কিছুই করেনি। না একটা ফোনকল, না একটা শুভেচ্ছা বার্তা, আর নাইবা কোনো গিফট। সে তো বিদেশ যাবার পর একবারও কুসুমের খোঁজ নেয়নি। হয়তো এত এত বিদেশি নারীর কারণে কুসুমের মত ছোট্ট নারীকে ভুলেই বসেছে। কে জানে তার মনে কি চলছে? সেঁজুতি কুসুমের কথা বলার অপেক্ষা করে না। বরং নিজের মত করেই বলতে থাকে,

‘ জানিস, সজীব আমাকে আমার লাস্ট জন্মদিনে একটা ইয়া বড় টেডি বিয়ার গিফট করেছে। পুতুলটা কি মোলায়েম জানিস? হাত দিলেই যেন হাত দেবে যায়। আমি তো রোজ এটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই। ‘

কুসুমের মন এবার আরো খারাপ হতে শুরু করে। এই বিয়ে সে কেন করল? কেন বয়সের আনন্দ বোঝার আগেই বিয়ে নামক জঞ্জালে জড়িয়ে পরল? মা কেন কুসুমকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে এতবড় দায়িত্ত্ব কাঁধে চাপিয়ে দিল? সবাই কেন কুসুমকে বোঝার চেষ্টা করল না? সবাই সবার মত চলছে। অথচ কুসুমের মনের তুফান কেউ বুঝতে চাইল না। কেউই না। এমনকি উচ্ছ্বাস ভাইও না।
_______________________
সারাপথ কুসুম কান্না আটকে বসে থাকলেও বাসায় এসেই আর কান্না দমাতে পারেনি। রান্নাঘরে মায়ের কাছে এসেই মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। সাহেদা মেয়ের আচমকা কান্না দেখে হতভম্ব হয়ে যান। চুলোর আগুন দ্রুত নিভিয়ে মেয়ের দিকে ফেরেন। কুসুমের ঘামে ভেজা কান্নামাখা মুখ বড্ড আদুরে লাগছে। সাহেদা মেয়ের মাথা দুহাতে তুলে কণ্ঠে আদর ঢেলে বলেন,

‘ কুসুম, কাঁদছিস কেন মা? স্কুলে কেউ কিছু বলেছে? কি হয়েছে? মাকে বল। ‘

কুসুম মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বুকের সঙ্গে মিশে যায়। কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দেয়,

‘ আমাকে এত ছোট বয়সে কেন বিয়ে দিলে মা? আমার এই বিয়ে ভালো লাগছে না। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না, মা। কিচ্ছু না। ‘

সাহেদা আঁতকে উঠেন মেয়ের কথায়। বিয়ের অল্পদিনেই মেয়ে এসব কি বলছে? উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কি ঝামেলা হয়েছে? সাহেদার মা’সুলভ বুকের ভেতরটা কেউ যেন খা*মচে ধরে রাখে। মেয়ের কান্নায় ভয় জমে যায় মনের ভেতর। তবে কি বোনের কথায় অল্প বয়সে মেয়ে বিয়ে দিয়ে ভুল কিছু করে বসলেন তিনি?

#চলবে

#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব- |১০|

মন ব্য/থার অনুভূতিটা বড্ড বি/শ্রী। শরীরের ব্য/থার ঔষধ আছে, লোকের সহানুভূতি আছে। মনের ব্য/থার কি কোনো ঔষধ আছে? এই যে কুসুমের মন ভালো না। বিরহের কাতর মনে কিছুই ভালো লাগছে না। এতদিন উড়ন্ত পাখির মত মেয়েটা হঠাৎ করে উড়তে ভুলে গেল। ডানা ঝাপটে নীড় খুঁজে পেল না। ডানার উপর ভর করল রাজ্যের নীল-কালো ব্য/থা। ব্য/থার ভারে কুসুমের মন নেতিয়ে পরছে। আজ প্রায় দু মাস ধরে উচ্ছ্বাস ভাইয়ের দেখা নেই। কথা নেই, আলোচনা নেই। জন্মদিনের দিন কুসুম আর কিইবা চেয়েছে তার থেকে। সামান্য একটা শুভেচ্ছা। সেটাও সে দেয়নি। এমন একটা পা/ষাণ মানুষকে কুসুম কিভাবে দুবার চিন্তা না করে বিয়ে করে ফেলল। সে কথা চিন্তা করলে কুসুমের বড্ড আফসোস হয়। কুসুম বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সাধের ক্যাকটাস গাছে পানি দিয়ে দোলনায় এসে বসে। দোলনা পা দিয়ে মৃদু দুলিয়ে নড়েচড়ে উঠে। উষা কুসুমকে ঘরে না পেয়ে বারান্দায় আসে। বিবশ নয়নে কুসুমকে বসে থাকতে দেখে উষা এসে কুসুমের পাশে বসে। উষা বসায় দোলনা নিছক নড়ে উঠে। কুসুম তাকায়। তার চোখে রাজ্যের অভিমান। বোনের প্রতি অভিমান, ভাইয়ের প্রতি অভিমান, অভিনটা মায়ের প্রতিও। উষা কিছুক্ষণ সবকিছু দেখে। তারপর বলে,

‘মন খারাপ?’

কুসুম মুখ ঘুরায়। ক্যাকটাস গাছের দিকে চেয়ে মাথা দুলিয়ে নিভে যাওয়া স্বরে বলে, ‘জানিনা। ভালো লাগছে না কিছু।’

উষা কুসুমের উরুতে হাত রাখে। কুসুমের চোখ ভাসাভাসা। যেন টোকা দিয়েই টলমলে চোখ থেকে জল গড়াবে। উষা বলে, ‘উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কথা বলবি?’

কুসুম চমকে তাকায়। পরপরই মাথা নেড়ে বলে, ‘না, ইচ্ছে নেই।’

উষা মৃদু হাসে। বলে

‘কেন নেই? তোর বর হয়। বরের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে নেই?’

কুসুম এবার পূর্ন দৃষ্টিতে উষার দিকে তাকায়। অভিমান জড়ানো কণ্ঠে বলে,

‘ বর? কে বর? ওই মানুষটা আমার কিছুই লাগে না আপা। সবার বয়ফ্রেন্ড জন্মদিনে কত সুন্দর সুন্দর উপহার দেয়। রোজ রাতে কথা বলে। ঘুরতে নিয়ে যায়। আমি এসব দেখি না? আমার কি মন চায় না ওদের মত হতে? আমি তার কাছে কি চাইলাম? রোজ কথা না বলুক। আমার জন্মদিনে একটা শুভেচ্ছা জানালে কি ক্ষতি হয়ে যেত আপা। তুমিই বলো। এটা কি আমি খুব বেশি চেয়েছিলাম। জীবনে প্রেম কি বুঝার আগেই তোমরা ধরে বিয়ে দিয়ে দিলে। এখন আমার এই বিয়ে সহ্য হচ্ছে না। এখন বললে কি তোমরা আবার বিয়ে ভেঙে দেবে? দেবে না তো! সবকিছু এখন আমাকেই সহ্য করতে হবে। ‘

কুসুম কথা বলতে বলতে কেঁদে উঠে। ভাসাভাসা চোখ থেকে জল গড়িয়ে গালে এসে বসে। টসটসে জলে গাল মাখামাখি। শ্যামলা গায়ে জলের ফোঁটা যেন চোখে হারাচ্ছে। উষা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর অবুঝ কুসুমকে বুঝায়,

‘ তোদের বিয়েটা হুট করে হয়েছে, কুসুম। না তুই উচ্ছ্বাসকে ভালো করে জানতে পেরেছিস না উচ্ছ্বাস তোকে জানতে পেরেছে। আমার মনে হয়, উচ্ছ্বাস তোর জন্ম তারিখের কথা জানেই না। তুই কি কখনো ওকে বলেছিস নিজের জন্ম তারিখের কথা? ‘

কুসুম মাথা নাড়ে। উষা বলে,

‘ না বললে ও কোথা থেকে জানবে, কুসুম? সে তো সবজান্তা নয়, তাইনা? আমার মনে হয় উচ্ছ্বাস আজ তোকে কল করবে। ফুপু দেখলাম উচ্ছ্বাসের মায়ের সঙ্গে রেগে কথা বলছে। উচ্ছ্বাস ঠিক জেনে যাবে তোর রাগের কথা। বিয়ে নিয়ে তোর অভিযোগের কথা। তাছাড়া, তোকেও বুঝতে হবে। উচ্ছ্বাস বিদেশে ঘুরতে যায়নি। পড়তে গেছে। বিদেশের পড়া অনেক কঠিন, কুসুম। বাংলাদেশের ছেলে হয়ে উচ্ছ্বাস সেখানে ফুল স্কলারশিপ পেয়েছে। নিশ্চয়ই এমনি এমনি পায়নি। কষ্ট করেছে দেখেই পেয়েছে। এখন কোর্স পাশ করতে হলে তার থেকেও বেশি কষ্ট করতে হবে। তুই কি একবার নিজে থেকে জানতে চেয়েছিস, সে কেমন আছে? কিভাবে সব ম্যানেজ করছে? বউ হিসেবে এটা কি তোর দায়িত্ত্ব ছিল না? ‘

কুসুম উষার এতসব কথা শুনে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। কোনটা ঠিক, কি বেঠিক সেটা নিয়ে চিন্তিত হয়। উচ্ছ্বাস ভাইয়ের প্রতি এতদিন খামোকা অভিযোগ পুষে রেখে হঠাৎ করেই নিজের কাছে বড্ড খারাপ লাগা শুরু হয়। উষা আপা তো ঠিকই বলেছে। উচ্ছ্বাস ভাই বিদেশে পড়তে গেছেন, নিশ্চয়ই কুসুমের সঙ্গে রাতের পর রাত প্রেমালাপ করতে নয়। কুসুম কেন সেটা বুঝতে পারেনি? নিজেও একবার তার খোঁজ নেয়নি। কেন নেয়নি? কুসুমের উচিত ছিল, উচ্ছ্বাস ভাইকে একবার অন্তত কল করে খোঁজ নেওয়া। উষা কুসুমকে চিন্তিত দেখে বুঝে, উষার কথা নিয়ে কুসুম ভাবছে। উষা কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়। তারপর বলে,

‘ যা হবার হয়ে গেছে। এখন এসব নিয়ে চিন্তা করিস না। আয়, ভাত বাড়ছি। ভাত খাবি। ‘

কুসুম উঠে না জায়গা থেকে। বলে,

‘ আমি এখন খাব না, আপা। তুমি ভাত তরকারি টেবিলে ঢেকে রাখো। পরে খেয়ে নেব। ‘

উষা আর কথা বাড়ায় না। চলে যায় বারান্দা থেকে। কুসুম তখনও বসে আছে দোলনার মধ্যখানে। চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ ক্যাকটাস গাছের উপর বসে থাকা কীটের দিকে।
________________________
উষার কথামত ঠিক রাতের বেলা উচ্ছ্বাসের কল এলো। কুসুম তখন টেবিলে বসে খাতায় কিসব আঁকিবুঁকি করছে। উষা ফোন নিয়ে এল কুসুমের কাছে। কুসুম উষাকে দেখেই খাতা লুকিয়ে ফেলল। পড়া বাদ দিয়ে এসব হাবিজাবি আঁকতে দেখলে উষা আপা ভীষন বকবে। কুসুম মাথা তুলে বলল, ‘কিছু বলবে আপা?’

উষা মৃদু হেসে ফোন এগিয়ে দিল। বলল,

‘উচ্ছ্বাস কথা বলতে চায় তোর সাথে। হোয়াটসসঅ্যাপের কল লিস্টের প্রথম নাম্বারটাই তোর বরের। কল দিয়ে কথা বল। গুড লাক।’

ফোন কুসুমের হাতে ধরিয়ে দিয়েই উষা চলে গেল। হয়ত কুসুম-উচ্ছ্বাসকে প্রাইভেসি দিয়ে গেল। ফোন দেখেই কুসুমের হাত কাঁপতে শুরু করেছে। কি কল করবে উচ্ছ্বাস ভাইকে? তার নাম শুনেই কুসুমের দম বন্ধ হয়ে আসছে। কি সব য/ন্ত্রণা! অনুভূতির য/ন্ত্রণা! সহ্য করা যায় না, শুধু বুকে পুষে যেতে হয় অবিরাম।
কুসুম কল লিস্ট বের করল। প্রথমেই একটা বিদেশি নম্বর। নম্বরের পাশে একটা ছবি। কুসুম ছবিটা বড় করল। উচ্ছ্বাস ভাইয়ের একটা হুডি পড়া ছবি। পা থেকে মাথা অব্দি শীতের কাপড় দিয়ে ঢাকা। হুডির নিচে কুসুমের পছন্দ করা সেই ম্যারুন রঙের শার্ট। চোখে রোদচশমা। কি সুন্দরই না লাগছে উচ্ছ্বাস ভাইকে। চোখ ফেরাতে পারছে না কুসুম। এত সুন্দর একটা বিবাহিত ছেলে বিদেশে গিয়ে টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ যদি পছন্দ করে ফেলে তাহলে? কুসুমের কি হবে? উচ্ছ্বাস ভাইয়ের সামান্য বিরহ সহ্য হয়না কুসুমের। আর সে একবারে চলে গেলে কুসুম পাগল হয়ে যাবে। কুসুম যখন উচ্ছ্বাসের ছবি দু চোখ ভরে দেখতে মগ্ন, তখন উচ্ছ্বাসের কল এল। চমকে উঠে কুসুমের হাত কেঁপে উঠে ফোন পরে যেতে লাগলে কুসুম দ্রুত ফোন ধরে নেয়। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে তারপর কল ধরে।

ওপাশ থেকে উচ্ছ্বাস বলে, ‘হ্যালো।’

কুসুম কথা বলে না। কতদিন পর তার কন্ঠ শুনল কুসুম! শুনলে শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। কুসুমকে চুপ থাকতে দেখে উচ্ছ্বাস আবার বলে, ‘হ্যালো, কুসুম?’

কুসুম আর কথা না বলে থাকতে পারে না। আস্তে করে বলে,

‘কেমন আছেন?’

উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়, ‘ যেমন থাকার তেমনি আছি। কদিন ভীষন চাপ গেছে পড়াশোনার। প্রথম এলাম তো। সবকিছু সামলাতেই দিন গেছে। তাই তোমার খোঁজ নিতে পারিনি। তুমি কেমন আছো? ‘

‘যেমন রেখে গেছেন, তেমনি আছি।’

উচ্ছ্বাস হেসে উঠে বলে, ‘ আমাকে কপি করছ? দ্যটস গুড। ‘

কুসুম লজ্জা পেয়ে বলল, ‘ আপনাকে কেন কপি করব? আমি আমার কথা বললাম শুধু। ‘

‘আচ্ছা, কেউ কারো কপি করেনি। এবার ঠিকাছে? আচ্ছা, শুনলাম তোমার নাকি গতকাল জন্মদিন গেছে? আমি রাগ করলাম কুসুম। তোমার জন্মদিনের কথা আমাকে জানাতে পারতে! আম্মার থেকে জানতে হল নিজের বউয়ের জন্মদিনের কথা। কি লজ্জাটাই না পেলাম আমি, কুসুম। এটা ঠিক করো নি তুমি।’

কুসুম কি বলবে? তার দোষের কারণে উচ্ছ্বাস ভাই লজ্জা পেল? রাগ উঠছে নিজের উপর। কুসুম বলল, ‘আমার মনে ছিল না।’

উচ্ছ্বাস এবার নিভে যাওয়া স্বরে বলল,

‘আমি তোমায় রোজ কল করি না দেখে, তুমি কি আমার উপর রে/গে আছো কুসুম?’

কুসুম উত্তর দিল, ‘দুপুরে রে/গে ছিলাম। বিকেলের দিকেই রা/গ চলে গেছে।’

উচ্ছ্বাস শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর বলল,

‘ বিশ্বাস করো কুসুম, আমি খুবই ব্যস্ত থাকি। সারাদিন চলে যায় মেডিকেলে। রাতে বাসায় এসে আবার নিজের পড়া থাকে। তাছাড়া রান্নাবান্না সব নিজেই করতে হয়। আগে কফি আম্মা নাহলে শিউলি করে দিত। এখন কফিটাও নিজের করতে হয়। সবকিছু একা হাতে সামলে আমি আজকাল খুব ক্লান্ত বোধ করি। মাঝেমধ্যে মনে হয়, দেশে থাকাই বোধহয় বেশি ভালো ছিল। ‘

উচ্ছ্বাসের কথা বলা দেখে কুসুমের খুব খারাপ লাগে। মানুষটা সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে। আর তাকে নিয়ে কিনা কুসুম এতবড় ছেলেমানুষী করে বসল? অ/পরা/ধবোধে বুকের ভেতরটা পু/ড়ে যাচ্ছে কুসুমের। কুসুম বলল,

‘তাহলে বিদেশে থাকছেন কেন? দেশে চলে আসুন। এখানে চাকরি করবেন। ডাক্তারদের চাকরির অভাব হয়না।’

উচ্ছ্বাস হেসে বলে, ‘ পাগল নাকি? কত কাঠখড় পুড়িয়ে বিদেশ এলাম একটা ডিগ্রীর জন্যে। ডিগ্রী না ছাড়া আজকাল ডাক্তারদের দাম নেই রে বাবা। মাসে দিনমজুরদের মত ইনকাম করতে হবে। এটায় ঘর চলবে না। ‘

‘না চলুক। আপনাদের সম্পদ তো কম নেই। এসব কে খাবে?’

‘হোক সম্পদ। আমার নিজের তো কিছু নেই। এসব আমার বাবার। আমার নিজের একটা পরিচয় দরকার, কুসুম। এটাই জন্যেই আমার এত কষ্ট করা। তুমি আর তিনটা বছর অপেক্ষা করো। মন দিয়ে পড়াশোনা করো। তোমার ১৮ বছর হোক। সংসার করার উপযোগী হয়ে উঠো। তারপর আমি দেশে এসে আবার খুব ধুমধাম করে বিয়ে করব। এখন একটু কষ্ট করে নাও, ঠিকাছে?’

কুসুম লজ্জা পেয়ে গেল উচ্ছ্বাস ভাইয়ের কথায়। উচ্ছ্বাস ভাই কি ভাবলেন? কুসুম মরিয়া হয়ে যাচ্ছে তাকে বিয়ে করতে! ইশ! লজ্জা, লজ্জা। লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে কুসুমের। কুসুম লজ্জায় আধখান হয়ে বললে,

‘আমি আর বিয়ে করব না।’

উচ্ছ্বাস সশব্দে হেসে উঠে বলে,

‘এক বরকে দুইবার বিয়ে করবে, কুসুম। কি সৌভাগ্য তোমার।’

কুসুম লজ্জা পেয়ে এবার আকাশে উড়ে যেতে লাগল। এক হাতে মুখ ঢেকে বলল, ‘কোনো সৌভাগ্য না। দুর্ভাগ্য সব। রাখছি। আল্লাহ হাফেজ।’

কথা বলেই কুসুম রেখে দিল। কল কাটার আগে শুনতে পেল, উচ্ছ্বাস ভাইয়ের অট্টহাসির একটু ঝলক। এতেই কুসুমের মন মেজাজ কেমন শীতল হয়ে গেল। কান ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। লজ্জায় বুকের ভেতরটা মু/চড়ে যেতে লাগল। ইশ!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here