#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – ২৭
বিকেলের দিকে একদম হঠাৎ করে উচ্ছ্বাস হোটেল থেকে উধাও হয়ে গেছে। কুসুমকে বলেও যায় নি কিছু। ফোন তুলছে না। একপ্রকার যোগাযোগ করা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। কুসুম চিন্তায় অস্থির আপাতত। সে বারবার ফোন করেই যাচ্ছে। অথচ পাষাণ লোক কুসুমের ফোন তোলার প্রয়োজন বোধ করছে না।
কুসুমের চিন্তার অবসান ঘটিয়ে রাত প্রায় নয়টায় উচ্ছ্বাস রুমে এল। কুসুম উচ্ছ্বাসকে দেখে রেগেমেগে তেড়ে এলো। উচ্ছ্বাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ বিকেল থেকে কোথায় ছিলেন? ‘
উচ্ছ্বাস কুসুমকে এতটা রেগে যেতে দেখে কিছুটা ভরকাল। খানিক দমে গিয়ে উত্তর দিল,
‘ আশেপাশেই বেড়িয়ে ছিলাম। চিন্তায় ছিলে? ‘
‘ না, খুব মজায় ছিলাম। আমাকে বলে গেলেন না কেন? ফোনও তুলেন নি। ‘
উচ্ছ্বাস দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করল। কুসুমের কয়েকটা মিসডকল দেখে বেচারা আহাম্মক হয়ে গেছে। আড়চোখে কুসুমকে একবার দেখে নিয়ে বলল,
‘ সাইলেন্ট ছিল। ‘
কুসুম কি আর বলবে। চুপ করে সরে বিছানায় বসল। উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ সেখানেই দাড়িয়ে থাকল। খানিক পর এগিয়ে এল। কুসুমের পাশে বিছানায় বসল। কুসুম সরে গেল। উচ্ছ্বাস আরো একটু গা ঘেঁষে বসল। এবারেও কুসুম সরে যেতে চাইলে উচ্ছ্বাস হাত বাড়িয়ে কুসুমের কোমর আকড়ে ধরে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে বসিয়ে রাখল। কুসুম কথা বলল না, সরেও গেল না। চুপচাপ বসে আছে। উচ্ছ্বাস খানিক পর কুসুমের কানের কাছে ফিসফিস করে শুধাল,
‘ সারপ্রাইজ রেডি করার জন্যে বেরিয়ে ছিলাম। সমুদ্র দেখতে এসে বউকে সারপ্রাইজ দেয় না কোন নরাধম? তাড়াহুড়োয় ফোন কখন সাইলেন্ট হয়েছি বলতে পারিনি। সরি। ‘
কুসুম এতেই যে গলে গেল। মৃদু হেসে পরপরই মুখ শক্ত করে থাকল। উচ্ছ্বাস তবুও বুঝতে পারল, কিছুটা কাজ হয়েছে। তাই সে উঠে দাঁড়াল। সোফার উপর রাখা দুটো প্যাকেট হাতে নিয়ে কুসুমের দিকে এগিয়ে দিল। কুসুম মাথা তুলে তাকাল। উচ্ছ্বাস বলল,
‘ রাগ কমেছে? কমলে প্লিজ দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। এত কষ্ট করে করা সারপ্রাইজ নষ্ট করো না প্লিজ, বুকে লাগবে। ‘
কুসুম এতটা কাতর কণ্ঠ শুনে নেতিয়ে গেল। চুপ করে উঠে দাঁড়াল। শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। উচ্ছ্বাস নিজেও রুমে তৈরি হয়ে নিল। ঘড়ি দেখে নিল কয়েকবার। তারপর বাথরুমে টোকা দিয়ে বলল,
‘ কুসুম, হয়েছে তোমার? ‘
কুসুম উত্তর দিল,’ আর অল্প সময়। ‘
উচ্ছ্বাস আরো একবার ঘড়ি দেখল। তারপর রুম জুড়ে পায়চারি করতে লাগল। কুসুম বের হল গুনেগুনে আধা ঘন্টা পর। উচ্ছ্বাস তখন সোফায় বসে মোবাইল দেখছে। কুসুম বের হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। আরেকটা প্যাকেট থেকে গয়নার বাক্স বের করল। ছোট একটা সাদা রঙের ডায়মন্ডের নোজপিন, দুটো ছোট আকারের কানের দুল, আর একটা চিকন চেইন। কুসুম নোজপিন পরবে, তবে উচ্ছ্বাস এসে আটকে দিল। হাত বাড়িয়ে কুসুমের হাত থেকে নোজপিন নিজের হাতে নিল। কুসুম দেখল সব। উচ্ছ্বাস নিজ হাতে কুসুমকে নোজপিন পরিয়ে দিল। পরানোর সময় কিছু কথা আওড়াল,
‘ ডায়মন্ড এর নোজপিনটা কিনেছিলাম বিদেশে থাকতে। পার্টটাইম জব করার টাকা জমিয়ে জমিয়ে কেনা। নিজের টাকায় তখন এই ছোট নোজপিনটাই এফোর্ড করতে পেরেছিলাম। এটা কেনার সময় একটা কথা ভেবেছিলাম। ‘
কুসুম মন্ত্রমুগ্ধের মত প্রশ্ন করল, ‘ কি ভেবেছিলেন? ‘
উচ্ছ্বাস হালকা হাসল। উত্তর দিল, ‘ বিয়ে করা বউ খুব ছোট ছিল। হঠাৎ বিয়ে হবার কারণে প্রেমে পড়তে পারিনি। বউকে ভালো করে উপলব্ধি করার আগেই বিদেশে পাড়ি। তাই এই নোজপিনটা কেনার সময় ভেবেছিলাম যেদিন আমি আমার বউয়ের প্রেমে পরব, সেদিন তাকে উপহার স্বরূপ নিজের প্রথম কষ্ট করে উপার্জন করা টাকায় এই ডায়মন্ডের নোজপিন দেব। শুধু উপহার দেব না, নিজ হাতে তাকে পরিয়েও দেব। ভাবনাটা খুব দ্রুতই সত্যি হয়ে গেল, তাইনা?’
কুসুম মাথা নত করে সামান্য হাসল। উচ্ছ্বাসের এই কথাগুলো তার কি ভীষন ভালো লেগেছে সেটা সে নিজে মুখে বলতে পারবে না। উচ্ছ্বাস বাকি গয়নাগুলো কুসুমকে নিজে পরিয়ে দিয়ে আয়নার মুখোমুখি করাল। কুসুম মাথা নত করে দাড়িয়ে আছে। মুখে লজ্জার আভা। উচ্ছ্বাস আয়নায় কুসুমের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। পরপর সম্মোহনের ন্যায় বলল,
‘ তুমি খুব বেশি সুন্দর, কুসুম। তোমাকে যেভাবেই দেখি সেভাবেই আমার মারাত্মক সুন্দর লাগে। কেন বলো তো? ভালোবাসি তাই বলেই কি? ‘
কুসুম আয়নায় নিজের দিকে তাকাল। শ্যামলা গায়ের বরণের নারীকে উচ্ছ্বাস এতটা মুগ্ধ চোখে দেখছে, সুন্দর বলছে। এতেই কুসুমের খুশিতে পরান উড়ে যায় যায়। কুসুম হাসল।
___________________________________
সমুদ্রের পাড়ে এসে কুসুমের চোখ ছানাবড়া। অত্যধিক খুশিতে কুসুম মুখে হাত চেপে ধরে ঠায় নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে। উচ্ছ্বাস পাশে দাড়িয়ে কুসুমের খুশি দেখছে। রাতের আকাশের নিচে সমুদ্র মোটেও কালো দেখাচ্ছে না। বরং চারদিক কেমন আলোয় পূর্ণ। অসংখ্য ফানুস উড়ছে আকাশে। মনে হচ্ছে দিনের আলোয় সমুদ্রের পানি ঝলমল করে উঠছে। কুসুম দৌড়ে এগিয়ে গেল কিছুটা। পরপরই অবাক হয়ে দাড়িয়ে গেল। আরো একটু দৌড়াল, আবার দাড়াল। কুসুম থামল। সমুদ্রের পানিতে কুসুমের পা ডুবে। উচ্ছ্বাস নিজেও কুসুমের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। একসময় উচ্ছ্বাস জিজ্ঞেস করল, ‘ ভালো লাগছে? ‘
কুসুম খুশিতে চিৎকার করে বলল, ‘ এমন ভালো লাগা আমি কখনোই পাইনি। উফ, চারপাশ কি সুন্দর দেখাচ্ছে। কিভাবে করলেন এসব? এত এত ফানুস, এত এত আলো। উফ!কি করেছেন এসব? ‘
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হেসে ফেলল। সে খুব একটা বেশি কিছু করেনি। শুধু ফানুস উড়িয়েছে। এতেই কুসুম খুশিতে কেঁদে দেবার উপক্রম। যারা এত ছোট ছোট বিষয়ে খুশিতে পাগল হয়ে যায়, এদেরকে বারবার ছোট ছোট আনন্দের বিষয়গুলো দেখিয়ে খুশি করতে মন চায়। উচ্ছ্বাস পেছনে থেকে কুসুমকে জড়িয়ে ধরল। কুসুমের কানের কাছে মুখ এনে বলল,
‘ কুসুম, নিজ হাতে ফানুস উড়াবে? ‘
কুসুম ঘাড় কাত করে পাশ ফিরে তাকাল। উচ্ছ্বাসের থুতনি কুসুমের ঘাড়ে। উচ্ছ্বাসের এটুকু স্পর্শে কুসুম আপাতত নেতিয়ে। কুসুম মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
অতঃপর কুসুম-উচ্ছ্বাস আগুন জ্বালিয়ে ফানুস উড়ালো। একটা দুটো অসংখ্য। ফানুস উড়ানোর সময় উচ্ছ্বাস কুসুমের চোখের দিকে চেয়ে এতদিন জমানো অনুভূতি স্বীকার করে বসে,’ভালোবাসি কুসুম। ‘
প্রতিবার ফানুস উড়ানোর বেলায় একই স্বীকারোক্তি, একই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ।
কুসুম এসব পাগলামি দেখে লজ্জায় নত হচ্ছে, আবার শব্দ করে হেসে হেসে উঠছে। শেষ ফানুস উড়ানোর সময় উচ্ছ্বাস আবারও একই কথা উচ্চারণ করবে তার আগে কুসুম উচ্ছ্বাসের মুখ চেপে ধরল।
লজ্জায় জমে গিয়েও নিজে থেকে উচ্চারণ করল,
‘ ভালোবাসি, ডাক্তার সাহেব। ‘
কুসুমের এটুকু কথা উচ্ছ্বাসকে তাক লাগিয়ে দিল। মেয়েরাও বুঝি এতটা কাউকে ভালোবাসতে পারে? কুসুমের ভালোবাসার পরিমাপ করতে গেলে উচ্ছ্বাসের জনম লেগে যাবে যে। উচ্ছ্বাস হাসল। আচমকা জড়িয়ে ধরল কুসুমকে। কুসুম উচ্ছ্বাসের ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয়। উচ্ছ্বাস অনুভব করে কুসুম কাদঁছে। কাঁদুক না। ভালোবাসার সুখে এটুকু তো কাঁদতেই হয়।
______________________
হোটেল রুমে এসে কুসুম আরো এক দফা অবাক হয়েছে। বাসর ঘরের ন্যায় আবারও সাজানো হয়েছে। লাভ শেপের বিছানায় গোলাপের পাঁপড়ির ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা বিছানার আশেপাশে। লজ্জায় এবার কুসুমের মুখ জ্বলছে, ভারী হয়ে আসছে। কুসুম আশপাশ দেখে নিয়ে বলল,
‘ এসব কখন করেছেন? ‘
উচ্ছ্বাস উত্তর দিল, ‘ আমরা বেরুনোর পর করিয়েছি। ‘
কুসুম আর কিছুই বলল না। এমনিতেও এই ভালোবাসার অনুভূতি ওকে শেষ করে দিচ্ছিল। এখন আবার বাসর! লজ্জায় কুসুম মরে যাচ্ছে না কেন? ইশ! কুসুম পালাতে চাইল। এদিক ওদিক চেয়ে বলল,
‘ আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। ‘
কুসুম বাথরুমের দিকে চলে যাবে তার আগেই উচ্ছ্বাস কুসুমের হাত টেনে ধরল। কুসুমকে টেনে নিজের বুকে উপর মিশিয়ে নিয়ে বলল,
‘ আজকে আর বাথরুমে রাত কাটাতে দিচ্ছি না। আজকে আমরা স্বপ্নের রাত কাটাব। ‘
উচ্ছ্বাস ডান চোখ আলগোছে বুজে চোখ টিপে দিল। কুসুমের দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন। ভাঙা স্বরে বলল,
‘ ফ-ফ্রেশ হ-হব না? ‘
উচ্ছ্বাস কুসুমকে পাজকোলে তুলে নিল। বিছানার দিকে যেতে যেতে বলল, ‘ ফ্রেশ হবে তো। কাল সকালে আমরা দুজন একসঙ্গে ফ্রেশ হব। আমি ফ্রেশ করিয়ে দেব তোমায়। ডোন্ট ওরি মিসেস উচ্ছ্বাস। ‘
কুসুমের গলায় কথা আটকে আটকে আসছে। লজ্জায় কি করবে ঠাহর করতে পারছে না। আনমনে উচ্ছ্বাসের বুকের দিকে চেয়ে আছে। উচ্ছ্বাস কুসুমকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই কুসুম উঠে চলে যেতে চাইল। উচ্ছ্বাস আটকে ধরল কুসুমের শাড়ির আঁচল। কুসুম থমকে গেল। উচ্ছ্বাস লজ্জায় অবনত কুসুমের দিকে চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে শাড়ির আঁচল নিজের হাতে পেচিয়ে নিয়ে খুলে ফেলল সম্পূর্ন আঁচল। কুসুম লজ্জায় পাশ ফিরে দ্রুত মুখ লুকাল উচ্ছ্বাসের বুকে। উচ্ছ্বাসের ঠোঁটে এক পৃথিবী জয় করা হাসি লেগে রইল।
#চলবে
#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – ২৮
‘ কুসুম? ঘুম থেকে উঠবে না আজ? ‘
কুসুম উচ্ছ্বাসের কথা শুনল। শুনেও উঠল না। বরং কম্বল দিয়ে মাথা অব্দি ঢেকে ফেলল। উচ্ছ্বাস হেসে উঠল। ঝরঝরে, প্রাণোচ্ছ্বল হাসি কুসুমের কানে প্রবেশ করলে কুসুম অবাক হয়ে শুনল। উচ্ছ্বাস ভীষন পারফেক্ট একজন, ঝরঝরে হাসি, ছাড়াছাড়া কথা, লম্বাটে, বলিষ্ট দেহ। এমন ছেলে কার না স্বপ্নের পুরুষ হয়ে উঠে! উচ্ছ্বাসের পাশে কি কুসুমকে মানাত? উহু! তবুও উচ্ছ্বাস আর কাউকে না, কুসুমকে ভালোবাসে। এই কথা ভাবলে কুসুমের সুখে আকাশে উড়তে ইচ্ছে করে। উচ্ছ্বাস আরো একবার ডাকল কুসুমকে। কুসুম উঠল না। চোখ মুখ খিঁচে শুয়ে রইল। উচ্ছ্বাস এবার জোর করে কুসুমের মাথা থেকে কম্বল সরিয়ে বলল,
‘ বিছানার লেগে থেকে লাভ নেই। উঠো দ্রুত। ফ্রেশ হয়ে নিচে যাব আমরা। দুপুরের খাবার খেয়ে বের হতে হবে আমাদের। ভুলে গেছো? ‘
কুসুমের মনে পরল, আজকে তাদের বাড়ি ফিরে যাবার কথা। আরো কদিন থাকত তারা। তবে উচ্ছ্বাসের জরুরি কল এসেছে। দ্রুত ঢাকা পৌঁছাতে বলা হয়েছে তাকে। কুসুম উঠে বসল। কপালের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এলোমেলো চুল কানের পেছনে গুঁজে ইতি-ওতি তাকাল। মিনমিন করে বলল,
‘ আ-আপনি এ-এখানে থাকবেন? এই র-রুমে? ‘
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ তো কোথায় যাব? ‘
‘ না, মানে…’
উচ্ছ্বাস এবার টিপ্পনী কেটে বলল, ‘ তুমি কি লজ্জা পাচ্ছ? আরে আমিই তো। আমাকে চেনো না? আমার আম্মা এবং তোমার পরিবারের সম্মতিতে আমাদের তিন কবুল পড়ে ফাতেমী মোহরে বিয়ে হয়েছে। আর গতকাল আমাদের এতদিনের পেন্ডিং বাসরও হয়ে গেছে। অথচ তুমি আমাকে চেনো না? আমার সামনে লজ্জা পাচ্ছ? আমি তোমার হাসবেন্ড! তোমার না..’
বাকি কথা সম্পন্ন করতে পারল না উচ্ছ্বাস। কুসুম দ্রুত এসে উচ্ছ্বাসের মুখ চেপে ধরল। অসহায় কণ্ঠে বলল,
‘ দোহাই লাগে আপনি চুপ করেন। দয়া করে আর লজ্জা দিবেন না। আমি লজ্জায় মারা যাচ্ছি। ‘
উচ্ছ্বাস কুসুমের চেপে রাখা হাতে চুমু বসাল। কুসুম উচ্ছ্বাসের মুখ ছেড়ে দিল। উচ্ছ্বাস আর জ্বালালো না কুসুমকে। বরং মৃদু কণ্ঠে বলল,
‘ ব্যথা হচ্ছে? ‘
কুসুম উত্তর দিল না। উচ্ছ্বাস উত্তরের অপেক্ষাও করল না। উঠে গিয়ে একটু আগে কিনে আনা দুটো ঔষধ কুসুমের হাতে দিল। কুসুম জিজ্ঞেস করল,
‘ কিসের ঔষধ? ‘
উচ্ছ্বাস বলল, ‘ একটা ব্যথার। আরেকটা…’
উচ্ছ্বাস থেমে গেল। কুসুম ভ্রু কুঁচকে উচ্ছ্বাসের দিকে চেয়ে আছে। উচ্ছ্বাস একটু থেমে নিভু স্বরে বলল, ‘ দুটোই ইম্পর্ট্যান্ট মেডিসিন। তোমার জন্যে ভালো। খেয়ে নাও দ্রুত। ‘
কুসুমের এতকিছু ভাবার সময় নেই। শরীরের ব্যথায় পিষে যাচ্ছে সে। গা ব্যথায় টনটন করছে। কুসুম উচ্ছ্বাসের হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে দুটো ঔষধ চুপচাপ খেয়ে ফেলল। উচ্ছ্বাসকে এবার স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলতে দেখা গেল।
____________________________
রাতের দিকে বাড়িতে প্রবেশ করল কুসুম-উচ্ছ্বাস। রাত থেকেই উচ্ছ্বাসের বোনেরা কুসুমের আগেপিছে ঘুরছে। কুসুম প্রথমে বুঝতে না পারলেও, এখন বুঝতে পেরেছে এদের উদ্দেশ্য মূলত কি! তাতেই কুসুম মুখে কুলুপ এঁটে যে বসেছে, বসেছেই। কাউকে কিছু বলছে না। রাতের খাবারের পর এবার কুসুমকে টেনে নিয়ে শিউলি রুমে গেল। বাকি বোনেরাও একে একে কুসুমকে ঘিরে বসল। শিউলি জিজ্ঞেস করল,
‘ ভাবি, কিছু তো বলো। আমাদেরও তো শিখতে হবে, মানুষ হানিমুনে গিয়ে কি করে? অ্যাই ওয়ান্ট টু নো। ‘
কুসুম কাঁচুমাঁচু করে বলল, ‘ বিয়ে হলে এমনি শিখবে। আগে শেখার কি দরকার? তাছাড়া আজকাল ইউটিউবে সব ড্রামা, মুভিজে শেখায় এসব। ওখান থেকে দেখে শিখে নাও। কিন্তু এখন আমার না প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। যাই আমি, ঠিকাছে? তোমরা গল্প করো। ‘
কুসুম কোনরকম সেখান থেকে পালিয়ে এলো। রুমে প্রবেশ করলে উচ্ছ্বাকে কোথাও দেখা গেল না। কুসুম দরজায় খিল আটকে বারান্দায় গেল। ঐযে উচ্ছ্বাস বসে আছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। এলোমেলো চুল কপালে পরে আছে। ঘুমঘুম চোখ, ক্লান্তিতে অবসন্ন চেহারা। কুসুমের হৃদস্পন্দন একটুর জন্য বন্ধ হয়ে পরপরই দ্রুত চলতে শুরু করল। একটা মানুষের আর কতভাবে প্রেমে পরবে কুসুম? এই প্রেম, ভালোবাসার অন্ত কোথায়? কুসুমের মনে হয়, সারা পৃথিবীর ভালোবাসা এক করেও তাদের এই ভালোবাসার পরিমাপ করতে পারবে না। কুসুম দৌঁড়ে এগিয়ে গেল।
উচ্ছ্বাসের কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে ফেললে উচ্ছ্বাস খানিক বিরক্ত হয়। বলে, ‘ গুরুত্বপূর্ন ক্লাস করছি, কুসুম। প্লিজ ল্যাপটপ দাও। ‘
কুসুম ল্যাপটপ দিল না। বরং এগিয়ে এসে উচ্ছ্বাসের কোলে চড়ে বসল। উচ্ছ্বাস চমকে উঠল। কুসুম আজকাল ভীষন চঞ্চল হয়ে গেছে। সারাক্ষণ উচ্ছ্বাসের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। নতুন নতুন ভালোবাসা অনুভব করলে এমনই হয়, উচ্ছ্বাস বুঝে। তার যে এসব মন্দ লাগে এমন নয়। বাহ্যিক ভাবে স্বাভাবিক থাকলেও, ভেতর ভেতর অস্থির বোধ হয়। কুসুমকে নিজের বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলতে মন চায়। ইচ্ছে করে কুসুমকে সারাক্ষণ চোখের সামনে বসিয়ে রেখে ইচ্ছেমত দেখতে।
উচ্ছ্বাসের ধ্যান ভেঙে যায় কুসুমের কথা শুনে,
‘আপনি এত সুন্দর কেন, বলেন তো? আপনাকে দেখলেই আমার বুকের ভেতর কাঁপে। এই যে, এখনো কাঁপছে। এমন কেন হয়? আগে কেন হয়নি, এখন কেন হচ্ছে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ‘
কুসুমের এমন অদ্ভুত কথা শুনে উচ্ছ্বাসের ভ্রু কুঁচকে গেল। পরপপর সে কুসুমের কোমরে আলতো করে হাত রাখল। কুসুমকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,
‘ ভালোবাসো যে, তাই। ‘
‘ ভালো কি শুধু আমিই বাসি? আপনি বাসেন না? তাহলে শুধু এই অস্থির বোধ আমি কেন অনুভব করি? আপনি কেন না?
‘ কে বলেছে আমার হয়না? আমি বলেছি? ‘
‘ হয় যে সেটাও তো বলেন নি। আমি আগে বলেছি। ‘
উচ্ছ্বাস উত্তর দিল না। বরং কুসুমের হাত নিজের বুকে আলগোছে রেখে বলল,
‘ মন দিয়ে অনুভব করো। কিছু বুঝতে পারছ? ‘
কুসুম কপাল কুঁচকে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করল।
পরপরই অবাক হয়ে বলল, ‘ আপনার হৃদ স্পন্দন খুব দ্রুত চলছে। ‘
‘হ্যাঁ, হচ্ছে। কারণ এটাই স্বাভাবিক। আমরা যাকে ভালোবাসি, সে আশেপাশে থাকলে আমাদের হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়। আমরা আবেগে উত্তেজিত হয়ে যাই বলেই এটা ঘটে। এটা হার্টের একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ‘
কুসুমের মনটা ভরে গেল খুশিতে। উচ্ছ্বাসের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইল। একপর্যায়ে উচ্ছ্বাস কুসুমের কোমরে হাত জড়িয়ে মিষ্টি স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি বলেছিলে, আমি সুন্দর? ‘
কুসুম সম্মোহনের ন্যায় আদুরে কণ্ঠে বলল,
‘ ভয়াবহ সুন্দর। ‘
উচ্ছাস হাসল। আঙ্গুল দিয়ে কুসুমের নাক টেনে বলল,
‘ তাহলে তুমিও এই সুন্দরের সুন্দর বৌ। বৌপ্রিয়া আমার! ‘
#চলবে