বেসামাল প্রেম ২৮

0
2327

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৮
কারো ঘনঘন উষ্ণ নিশ্বাস বক্ষপটে ধারালো হয়ে বিঁধছে। আচমকা দৃষ্টিজোড়া মেলে তাকাল মাহের। দেখতে পেল রোজকার মতোই অত্যাশ্চর্যকর দৃশ্যটা। তন্দ্রাচ্ছন্ন সূচনার সুশ্রী মুখটা দেখে নিত্যদিনের মতোই বিরবির করে আওড়াল,
-” আমার একেকটা দিনের সূচনা ঘটে আপনার এই নিষ্পাপ মুখটা দেখে। আমার আকাশ ভরা মেঘের ঘনঘটায় আপনি আমার এক টুকরো রোদের আলো।”

অধর কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে তার৷ প্রতি রাতে দু’জন যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ঘুমালেও সকালটা আজকের মতোনই অমায়িক সুন্দর হয়। অপলকে তাকিয়ে সূচনার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখায় মগ্ন মাহের। তার এই মগ্নতায় বাঁধ সাধল সেলফোনের রিংটোন। নাম্বার দেখে কেটে দিল সে। মৃদুস্বরে ডাকল সূচনাকে। কারণ হৈমীর বইপত্র নিয়ে সকাল সকালই সূচনাকে শেখ বাড়ি যেতে হবে। সেখানে ঝিনুক আর পনির অপেক্ষায় থাকবে তার জন্য। হামিদা বাড়িতে নেই, সে আছে টিশার দেখভাল করার জন্য হসপিটালে। এরপর হয়তো টিশার বাচ্চাটার জন্য টিশার বাসায়ও থাকবে দীর্ঘদিন। একদিকে ভালোই হলো, এই সময়টায় টিশাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। হৈমীর শোকটাও কাটিয়ে ওঠতে পারবে। মাহেরের এত চিন্তার মাঝে আরো একটি চিন্তা যোগ হয়েছে। তা হলো তার মা এবং সূচনার বাচ্চার প্রতি গভীর ভালোবাসা। গতরাতে বাড়ি ফেরা নিয়ে সূচনা কী মন খারাপটাই না করল! এক প্রকার জোর করেই আনা হয়েছে তাকে। নেহাতই মেয়েটা শান্ত মনের, বুঝদার। তাই রাগ করেনি, মন খারাপ করলেও তা দীর্ঘ করেনি। একবার তার ইচ্ছে করেছিল বলতে,
-” মন খারাপ করবেন না সূচনা। একদিন আমাদেরও এমন বাচ্চা হবে। তাকে সব সময় আপনার কাছে রাখবেন। আমি বাঁধা দেব না, কেউ বাঁধা দেবে না৷ কারণ তার ওপর আপনার অধিকার সর্বোচ্চ। ”

কিন্তু বলেনি। হাজার হোক মেয়ে মানুষের মন। এদের রক্তে, মাংসে মা, মা অনুভূতি লুকিয়ে আছে। দেখা গেল এ কথা শুনে এখনি বাচ্চা কনসিভ করতে চাইবে। প্রেমের বীজ অলরেডি হৃদয়ে বপণ করে দিয়েছে৷ এবার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করার পালা। এসবে মাহেরের বাঁধা নেই, নেই জড়তা। সে নিজেও সূচনাকে পূর্ণরূপে নিজের করে চায়। তবে এই চাওয়া পূর্ণ করার আগে সূচনার স্বপ্ন পূরণ করতে চায়৷ তার যে স্বপ্ন নিজের পায়ে দাঁড়ানো। নিজের আলাদা একটি পরিচয় গড়ে তোলার। তাই সে স্বামী হিসেবে পাশে থেকে, সাপোর্ট করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করতে চায় নিজের স্ত্রীকে। যেন আজ থেকে বিশ বছর, বা ত্রিশ বছর পর মেয়েটা নিজের সফলতা নিয়ে গল্প করার সময় অর্ধাঙ্গের দিকে একটিবার ফিরে তাকায়। বুকে মাথা গুঁজে তৃপ্তি সহকারে বলে,
-” আপনি আমার সাহস, আপনি আমার শক্তি। ”

জীবদ্দশায় যদি পৃথিবী থেকে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। তবুও যেন প্রিয়তমা তাকে একটি বার স্মরণ করে, যে স্মরণ থাকবে শ্রদ্ধা, এক সমুদ্র ভালোবাসা।
_______
সকাল আটটা। ঘুম ভেঙে চোখ কচলে ওঠে বসল রুদ্র। এদিক ওদিক তাকিয়ে ডানপাশে তাকাতেই ঘুম ছেড়ে গেল তার। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গুনগুন করে গান গাইছে হৈমী। পাশাপাশি মেকআপ বক্স বের করে সাজগোজও করছে। সাতসকালে মানুষ বই খাতা নিয়ে বসে, টুকটাক কাজ থাকলে করে, ব্রেকফাস্টে কী খাবে তাই নিয়ে চিন্তা করে, সে অনুযায়ী রান্নাবান্নাও করে। আর এই মেয়ে মেক-আপ বক্স নিয়ে বসেছে! চোখ, মুখ শক্ত করে নিল সে। গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল,
-” এত সাজগোজের মানে কী? ”

হৈমীর মন কাল রাত থেকেই বেশ ফুরফুরে। রুদ্র সরাসরি তাকে সুন্দরী না বললেও ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে। এতেই সে ফিদা হয়ে গেছে। বুঝে গেছে রুদ্রর চোখে সে আগুন সুন্দরী। শাবনূরের চেয়ে সুন্দরী মানে তো আগুন সুন্দরীই। সাথে এও বুঝেছে রুদ্র তাকে পছন্দ করে, ভালোও বাসে। সব মিলিয়ে সে খুব খুশি। সেই খুশিকে কেন্দ্র করেই সকাল সকাল একটু সাজতে বসেছে। যাতে ঘুম ভাঙতেই রুদ্র তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। সে মুগ্ধতায় মুখ ফস্কে প্রপোজও করে দেয়,
-” হৈমী আই লাভ ইউ। ”

রুদ্রর প্রশ্ন শুনে উৎসুক হয়ে তার দিকে তাকাল সে। চঞ্চলিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-” আমাকে কেমন লাগছে? ”

-” খুব বাজে! ”

কাঠ কাঠ জবাব রুদ্রর। জবাব শুনে চোখ বড়ো করে মুখটা গুমড়া করে ফেলল সে। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
-” এত কষ্ট করল সাজলাম। আর আপনি বাজে বললেন? সাজগোজের কী বুঝেন আপনি? আমাকে সুন্দরই লাগছে। দাঁড়ান আমি আদ্রিতা আপু আর আবির ভাইয়াকে দেখিয়ে আসি। ”

চট করে ওঠে পাশের ঘরে যেতে উদ্যত হলো হৈমী। রুদ্র তড়াক করে ওর হাত টেনে ধরল। ব্যস্ত গলায় বলল,
-” অ্যাই ওঘরে যাবে না। ”

-” আমি যাবই। ”

ত্যাড়ামি করল হৈমী। রুদ্রও দ্বিগুণ ত্যাড়ামি দেখিয়ে শক্ত করে হাত চেপে ধরল। টেনে বসাল বিছানায়। মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
-” দেখো এই সব নাটক বন্ধ করো। একটু সিরিয়াস হও, আমি কিন্তু ধৈর্য্যশীল পুরুষ নই। মেরে একদম হাড়গোড় ভেঙে দেব। ”

আঁতকে ওঠল হৈমী। ঢং করে কেঁদে দিয়ে বলল,
-” আপনি আমাকে আবার মারবেন? আমি এখানে থাকব না, এক্ষুনি দিয়ে আসুন আমাকে। আপনার জন্য আমি আমার মা, ভাইকে কষ্ট দিয়েছি আর আপনিই কিনা আমার হাড় ভাঙার পরিকল্পনা করছেন! আমি এখানে থাকব না, আমি আম্মুর কাছে যাব। ”

-” চুপপ! একদম চুপপ। মাথাটা ধরিয়ে ফেলছ আর একটা কথা বললে হাত, পা, মুখ বেঁধে ফেলে রাখব। বেয়াদব মেয়ে! বাড়ি যাওয়ার কথা ভুলে যাও। ঝিনুক আজ তোমার বইপত্র নিয়ে আসবে। সংসার করবে আর পড়াশোনা করবে ব্যস। ”

কাচুমাচু হয়ে বসে রইল হৈমী। রুদ্র ধমকি-ধামকি দিয়ে ওঠে ফ্রেশ হয়ে এলো। দেখল হৈমী বসে আছে, চোখ দু’টো টলমল করছে তার। সত্যি বলতে সিরিয়াস ধমক খেয়ে এবার তার মা, ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে। তারা তাকে কখনো এমন করে ধমক দেয়নি। তার মুখোভঙ্গি দেখে রুদ্র বলল,
-” মেয়ে হয়ে জন্মেছ অথচ কিছুই পারো না। বিছানা গোছাতে জানো না, রুম ঝাড় দিতে পারো না, রান্না করতে পারো না, খেতে পর্যন্ত পারো না! শুধু পারো বকবক করতে। শুনেছি পড়াশোনায়ও কাঁচা। শুধু কথায় পাকা, অ্যাই শোনো তোমাকে যদি মানুষ না বানাতে পারি আমিও রুদ্র না। ”

তীব্র অপমানে গাল ফুলে ওঠল হৈমীর৷ থমথমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-” আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন! ”

-” নো, যা সত্যি তাই বলছি। ”

কাভার্ড থেকে টিশার্ট বের করতে করতে বলল রুদ্র। হৈমী নাক ফুলিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। টিশার্ট পরতে পরতে রুদ্র আবার জিজ্ঞেস করল,
-” কয়েক মাস পরই তো পরীক্ষা, সেদিকে মন আছে? মন আছে সাজগোজ, আর হাঁসের মতো পকপক করাতে ”

মেজাজ খারাপ হলো হৈমীর। বিছানা থেকে নেমে এসে রুদ্রর সামনে দাঁড়াল। তর্জনী উঁচিয়ে বলল,
-” মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। আমার পড়াশোনা আমি ইচ্ছে হলে করব, আমার মুখ আমি হাজারটা কথা বলব। ”

চোয়াল শক্ত করে হাত বাড়িয়ে রুদ্র তার তর্জনি চেপে ধরল। কিছুটা ব্যথা সহকারেই ধরল। হৈমী ” আহ ” করে ওঠতেই বলল,
-” বেয়াদবি নট এলাউ। যা বলেছি তাই শুনবে। বোঝাপড়া করব পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার পর! ”

ঢোক গিলল হৈমী। রুদ্র এবার হাতটা নরম করল। সে বলল,
-” আপনাকে কে বলেছে আমি পড়াশোনায় খারাপ? শুনুন, বিসিএসে আসা প্রশ্নের উত্তরও আমি জানি। ”

ভ্রু বাঁকিয়ে রুদ্র বলল,
-” তাই? ”

মনে মনে হৈমী বলল,
-” এই রে বেশি বলে ফেললাম নাকি! ”

-” বিশ্বে কয়টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল? ”

-” দুইটি, দুইটি। ”

-” প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কবে হয়েছে জানো?”

-” দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের আগে। ”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রুদ্র। চোখ, মুখের আকৃতি কিছুটা বিকৃতি করে পুনরায় প্রশ্ন করল,
-” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবে হয়েছে?

উল্লসিত কণ্ঠে হৈমী উত্তর দিল,
-” প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে। ”

উত্তরটা দিয়ে মনে মনে বলল,
-” সাল ভুলে গেছি তাই বলে আমি খারাপ স্টুডেন্ট নই। লজিক দেখিয়ে ঠিক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি। ”

দাঁতে দাঁত চেপে রুদ্র বলল,
-” বাহ তোমাকে তো স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ারে এওয়ার্ড দেয়া উচিৎ। আর এ মুহূর্তে তোমাকে আমার মিউজিয়ামে রেখে আসা উচিৎ। ”

কথাটা বলেই হেঁচকা টানে ছোট্ট শরীরটা নিজের বক্ষে এনে ফেলল। তার বুকপটে কপাল ঠেকল হৈমীর। গম্ভীর মুখটায় মাথা তুলে তাকাল সে। রুদ্র স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দৃঢ় চোখে তাকিয়ে রইল। কয়েক পল চুপ থাকার পর বলল,
-” সত্যিই নির্বোধ একটা! ব্যাপার না সোজা বানিয়ে ফেলব। ”
________
কফি বানানোয় পারদর্শী থাকায়, হৈমীকে দিয়ে তিন কাপ কফি বানালো রুদ্র। এরপর কল করল আবিরের ফোনে। আবির ফোন রিসিভ করতেই সে বলল,
-” কী রে আজ ওঠবি না? ”

-” এই তো বন্ধু ওঠতেছি। ”

ফোন কেটেই বেরিয়ে এলো আবির। সোফায় বসা ছিল রুদ্র। তাকে দেখে তৃপ্তিময় হেসে এগিয়ে এসে পাশেই বসল। রুদ্র কফি খেতে ইশারা করলে আবির কফির মগ হাতে নিয়ে বলল,
-” ভাই আমি অনেক ভাগ্যবান পুরুষ। প্রেম থাকাকালীন কত ঝগরা করেছি, কত কষ্ট দিয়েছি। অথচ মেয়েটা আমাকে কাল সেরা উপহারটাই দিল। আমি ওকে আর বিন্দুমাত্র কষ্টও দিব না। ও যা বলবে তাই শুনব। জানিস কেমন ফিল হচ্ছে? এই মেয়েটা যদি এখন আমাকে বিষপান করতেও বলে আমি তাই করে ফেলব! ”

বাঁকা হাসল রুদ্র। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে আবির আবারো বলল,
-” আমি সত্যি ভাগ্যবানরে ওর মতো বউ পেয়ে। ”

রান্নাঘর থেকে হৈমী বেরোতেই আবিরের এই কথা শুনে চোখ পিটপিট করে এগিয়ে এলো। আবিরকে বলল,
-” শুধু আপনি একা একাই ভাগ্যবান না ভাইয়া উনিও ভাগ্যবান তাই আমার মতো বউ পেয়েছে। আপনি ভালো মানুষ তাই স্বীকার করলেন, কিন্তু উনি মোটেই ভালো মানুষ নন এজন্য স্বীকার করবে না। ”

রুদ্র চোখ গরম করে তাকাল। কথার আগা মাথা না বুঝে এই মেয়েটা ফোঁড়ন কাটতে এলো। মান, সম্মান আর রাখবে না দেখছি! হৈমীর কথা শুনে আবির মিটিমিটি হাসতে লাগল। তার খুব বলতে ইচ্ছে করল,
-” ওর মুখে ভাগ্যবান শুনতে চাইলে তোমাকে যে অনেক সেক্রিফাইস করতে হবে বোন। ”

কিন্তু বলল না। রুদ্র বিষয়টা পছন্দ করবে না। তাছাড়া হৈমী তার ছোটো বোনের চেয়েও ছোটো। তাই ওর সঙ্গে এসব মজা করতেও বিবেকে বাঁধে।

রুদ্রর গরম চাহনি দেখে হৈমী বলল,
-” দেখেছেন কীভাবে তাকাচ্ছে? আপনি কখনো আপুর দিকে এভাবে তাকান? ”

আপুর কথা স্মরণ হতেই খেয়াল করল সে উপস্থিত নেই। তাই বলল,
-” এমা আপু কোথায়? কফি তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমি দিয়ে আসি কেমন? ”

কফির মগ নিয়ে আদ্রিতার কাছে গেল হৈমী। আবির খিলখিল করে হাসতে লাগল। বলল,
-” বন্ধু তুমি সব সময় এত হট থাইকো না। তোমার বাচ্চা বউ সইতে পারবে না। ”

রুদ্র চোখ কটমট করে তাকাল। আবির বলল,
-” দোস্ত, তোর মুখে ভাগ্যবান শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে রইলাম। শুধু আমি না আমাদের ছোট্ট মিষ্টি ভাবিটাও বসে আছে। ”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here