#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩৭
গোধূলি বিকেল। পশ্চিমাকাশে গাঢ় কমলা বর্ণের সূর্যটা নিভু নিভু৷ ফুরিয়ে গেল আস্ত একটা দিন। নেমে এলো সন্ধ্যা। ঠিক যেভাবে রাত ফুরিয়ে ভোরের আগমন ঘটে। সেভাবেই দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামল। জানান দিল রাত্রির আগমনী বার্তা। দিন ফুরায়, রাত ফুরায়, ফুরিয়ে যায় এ জগতের মানুষগুলোও। এ বেলা নবজাতকের জন্ম হচ্ছে তো ও বেলা কোনো না কোনো প্রবীণ, প্রবীণার মৃত্যু হচ্ছে। ফুরিয়ে যাচ্ছে এ পৃথিবীর আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা, হেসে খেলে জীবন পারি দেওয়া মানুষগুলো। এ জগতের সবকিছুই ফুরিয়ে যায়। জড়ো বস্তু থেকে শুরু করে জীব সব কিছুরই অন্তিমকাল রয়েছে। সবই যদি ক্ষণস্থায়ী হয় তবে এ পৃথিবীতে দীর্ঘস্থায়ী কি কিছুই নেই? আছে কী? ভালোবাসা নামক অনুভূতিময় কোনো শব্দ? বুকের বা পাশে ডানহাতটা চেপে ধরল মাহের৷ সেখানে ধিকিধিকি শব্দ হচ্ছে। এক ঘুমন্ত সুশ্রী মুখের তপ্ত নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে তার কাঁধে। শিহরণ জাগাচ্ছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেকেণ্ড কয়েকের মাঝেই গন্তব্যে এসে পৌঁছাল তারা। কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকা সূচনাকে ডাকল কয়েকবার৷ ক্লান্ত দেহে নরম চোখে তাকাল সূচনা। মাথা তুলে হাই তুলতে তুলতে সরে বসল। মাহের আলতো হেসে বলল,
– ” নামতে হবে, পৌঁছে গেছি। ”
বাক্যটি কর্ণগোচর হতেই সূচনার সকল অবসাদ নিমিষেই দূর হয়ে গেল। চোখের পলক পড়ল ঘনঘন। আশপাশে নজর বুলিয়ে সন্তর্পণে এক ঢোক গিলল। ফের মাহেরের পানে তাকিয়ে নরম সুরে বলল,
-” অনেকদিন পর লং জার্নি করেছি তো তাই কিছুটা দুর্বল ফিল করছি, সে থেকেই এমন ঘুমিয়ে গেছি। ”
মৃদুভাবে হাসল মাহের৷ গাড়ি থেকে নামার পূর্বক্ষণে বলল,
-” রিলাক্স চার, আপনার দ্বারা চার, পাঁচটা খু'”ন হয়ে যায়নি। এভাবে অপরাধ বোধে ভুগবেন না। ইট’স ওকে। একটা লং জার্নি, আপনার মাথা আমার কাঁধে, আপনার ঘুমন্ত সুশ্রী মুখে আমার চোখ, ব্যাপারটা দারুণ ছিল আ’ম এনজয়িং। ”
মাহের বেরিয়ে রুদ্রকে কল করল। সূচনা কিছুক্ষণ লজ্জা মিশ্রিত মুখে বসে রইল। শ্বাস-প্রশ্বাস চলল ঘনঘন৷ নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে দু’মিনিটের মাথায় নামল সে। সঙ্গে সঙ্গেই মুখোমুখি হলো রুদ্রর। সে কিছু বলার পূর্বেই, বোনের দুর্বল মুখশ্রীতে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রুদ্র বলল,
-” বেশি খারাপ লাগছে মনে হয় চল চল রেস্ট নিবি। ”
________
অনেকদিন পর ভাইকে কাছে পেয়ে আহ্লাদে ভেসে গেল হৈমী৷ সারাটাক্ষণ খুশিতে গদগদ হয়ে রইল। মুখ থেকে হাসি সরে না, কথা ফুরোয় না। কোনোরকমে রুদ্র শুধু সন্ধ্যায় নাস্তাটুকু করাতে পেরেছিল। নাস্তা করে সূচনা শুয়ে আছে, মাহের হৈমীর সঙ্গে গল্পে মগ্ন। এক পর্যায়ে মাথা ধরে গেল সূচনার। টের পেয়ে হৈমীকে মাহের বলল,
-” হৈমী মা যে যে জিনিস পাঠিয়েছে দেখেছ? ”
উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে হৈমী বলল,
-” ইস, দেখাই হয়নি। ওগুলো আমাদের ঘরে রাখা। আমি গিয়ে দেখি? পরে আবার আসব। ”
মাহের সম্মতি দিলে হৈমী ছুটে বেরিয়ে গেল। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে সূচনার কাছে এসে বসল মাহের। জিজ্ঞেস করল,
-” অনেক বেশি খারাপ লাগছে ? ”
মাথা যন্ত্রণায় কান্না পেয়ে গেল সূচনার। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে ওঠে বসল সে। বলল,
-” হৈমী চলে গেছে? ওকে একটু বলবেন আমার চুলে বিলি কেটে তেল দিয়ে দিতে। আসলে যখনই ব্যথা হতো দাদিন এভাবে তেল দিয়ে দিত। এতে বেশ আরাম লাগে। ”
রুগ্ন মুখটা দেখে বড্ড মায়া হলো মাহেরের। বলল,
-” আমিই পারব। তেল কোথায় বলুন দিয়ে দিচ্ছি। ”
দুই হাঁটু আড়াআড়ি ভাঁজ করে মাহেরের সামনে বসল সূচনা৷ ছোট্ট একটি বাটিতে তেল ঢেলে পাশে রাখল। মাহের তার পেছনে বসে বেশ যত্ন নিয়ে চুলে বিলি কেটে তেল লাগাতে শুরু করল। আরাম পেয়ে চোখ বুজল সূচনা। দুচোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অজস্র নোনাপানি। মাথা যন্ত্রণা নাকি সৌভাগ্য এই নোনাপানির উৎস কী জানা নেই তার। শুধু জানে বড়ো সুখ সুখ লাগছে। এত শান্তি পৃথিবীর আর কোথাও বোধহয় নেই। এমন একটা অনুভূতি হচ্ছে। কী নরম, কী মিষ্টি এই অনুভূতি! যে অনুভূতিতে সিক্ত হয়ে অন্তঃকোণে বয়ে গেল শীতল স্রোত। এই ভাগ্য এতকাল কোথায় লুকিয়ে ছিল তার?
রুমের দরজা খোলা। রুদ্র এসেছিল সূচনাকে জিজ্ঞেস করতে সকালবেলা কী খাবে তারা? বোন, বোন জামাইয়ের যত্নের কোনো প্রকার ত্রুটিই সে রাখতে চায় না৷ মা নেই, বাবা নেই তো কী হয়েছে সে একাই যথেষ্ট। কিন্তু এটুকু জিজ্ঞেস না করেই ফিরে গেল নিজের রুমে। দু-চোখ ভরে দেখা বোনের সুখে কিঞ্চিৎ বাঁধা দিতেও মন সায় দিল না। প্রাণভরে শুধু চায় এই সুখটা অটুট থাকুক। যতকাল এ পৃথিবীতে তার বোনের অস্তিত্ব থাকবে ঠিক ততকাল।
টুকটুক করে মায়ের পাঠানো জিনিসগুলো বের করছিল হৈমী। রুদ্র বিছানায় বসে ভাবছে কিছু অথচ তাকিয়ে আছে হৈমীর পানে। হৈমী নিজের মতো করে সব বের করে দেখে জিনিসপত্র গুছিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিল। বিশটার মতো বড়োই বার্মিজ আচার শুধু বিছানার সাইট টেবিলের ড্রয়ারে রাখল। দু’টো নিজের কাছে রেখে একটি ছিঁড়ে খেতে খেতে রুম ছাড়তে উদ্যত হলো। অমনি কাঠখোট্টা স্বরে রুদ্র বলল,
-” কোথায় যাচ্ছ? ”
চঞ্চল পা আচমকা থামিয়ে, আচার খেতে খেতে ঘাড় ঘুরিয়ে হৈমী বলল,
-” বুঝেন না কোথায় যাচ্ছি, জিজ্ঞেস করার কী আছে ? ”
ভেঙচিয়ে কথাটা শেষ করল সে। বিরক্ত মুখে রুদ্র বলল,
-” এদিকে এসো। ”
মৃদু পায় এসে হৈমী দাঁড়াল তার সামনে। সে জিজ্ঞেস করল,
-” এখন ওদের কাছে যেও না। লং জার্নি করেছে রেস্ট করুক। গল্প করার জন্য অনেক সময় পাবে কাল থেকে। ”
কথাটা যুক্তিসঙ্গত। তাই মান্য করল হৈমী। সিদ্ধান্ত নিল বেলকনিতে গিয়ে আয়েশ করে বার্মিজ খাবে পাশাপাশি রাতের আকাশ দেখবে, তারা গুনবে, শহরে বিল্ডিং দেখবে। তবুও এই নুন হীন পান্তা ভাতের সামনে বসে থাকবে না। তার সিদ্ধান্তটি বেশিক্ষণ স্থির রইল না। রুদ্রের প্রশ্নে সিদ্ধান্ত পালিয়ে বিভ্রান্ততে পরিণত হলো।
-” কী খাচ্ছ এটা? ”
-” আপনি এটা চেনেন না? ”
বার্মিজের প্যাকেট একটু এগিয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল হৈমী৷ রুদ্র নাক ছিটকে বলল,
-” দেখে তো তেমন ইম্পরট্যান্ট কিছু মনে হচ্ছে না যে চিনতেই হবে। বা চেনা বাধ্যতামূলক। ”
তীব্র অপমানে গাল ভার হয়ে গেল হৈমীর। তেজ দেখিয়ে বলল,
-” এটা বার্মিজ, বড়ই দিয়ে বানায়। একটার দাম দুইটাকা করে। অনেক টেস্টি… আমি আর টিশা একসঙ্গে থাকলেই এটা খাই। কী যে মজা। এটা কীভাবে খেলে সবচেয়ে বেশি মজা লাগে জানেন? পানিতে ভিজিয়ে। বুঝতে পারলেন না তাইনা, আচ্ছা বোঝাচ্ছি, এটার ভিতর হালকা পানি দিয়ে মাখোমাখো করেও খাওয়া যায়। আবার বাটিতে কয়েকটা প্যাকেটের আচার ঢেলে পানি দিয়ে একটু লবণ, মরিচ গুঁড়ো দিলেও জোশ লাগে। ”
হৈমীর জিভে জল চলে এলো। রুদ্র চোখ, মুখ অস্বাভাবিক কুঁচকে তাকিয়ে রইল। কর্কশ কণ্ঠে বলল,
-” অস্বাস্থ্যকর খাবার এটা। ”
মেজাজ খারাপ করে হৈমী বলল,
-” ধূর ব্যাটা! স্বাস্থ্য, অস্বাস্থ্য বুঝি না। জিভে যা অমৃত লাগে তাই খাই। ”
মুহুর্তেই জিভে কামড় পড়ল তার। রুদ্রর ভরাট মুখে তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বার্মিজের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
-” একবার টেস্ট করেই দেখুন ছাড়তে চাইবেন না। ”
তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠল রুদ্র। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” এসব বাজে খাবার আমি খাই না। তোমাকেও নিষেধ করছি এসব খাবে না। এগুলো খেলে অসুখ হবে। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে হবে। ”
মুখ ভেঙিয়ে হৈমী বলল,
-” দেখুন এটা আমার খুব প্রিয়। এটা আমি ছাড়তে পারব না৷ প্রয়োজনে আপনাকে ছেড়ে দিব! ”
কথাটা বলেই দু পা পিছিয়ে গেল হৈমী। রুদ্র ঘাড় বাম দিক ডান দিক বাঁকিয়ে তার দিকে গাঢ় চোখে তাকাল। বলল,
-” পিছিয়ে গেলে যে কথাটা বলে ভয় লাগল? ”
-” না মানে ইইয়ে। ”
বাঁকা হেসে চুলগুলো দু’হাতে ব্যাকব্রাশ করে নিল রুদ্র। কয়েক কদম এগিয়ে হৈমীর কাছে চলে গেল। শান্ত কণ্ঠে বলল,
-” লিসেন, বার্মিজ খাও, ঘাস, পাতা, শামুক, নর্দমার কীট যা পারো খাও। শুধু নিজে সুস্থ থাকো, ওজন বাড়াও। তোমার এই চুয়াল্লিশ কেজি ওজন আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। ”
ভ্রু কুঁচকে গেল হৈমীর। সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বলল,
-” আমার ওজনের সঙ্গে আপনার ঘুমের কী সম্পর্ক?”
-” জানি না। ”
বলেই সরে দাঁড়াল রুদ্র। হৈমী বার্মিজ খেতে শুরু করল আবারো৷ রুদ্র হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে বিরবির করে কিছু একটা বলল। যা দেখে হৈমী বলল,
-” বকার হলে উঁচু গলায় বকুন, নিচু গলায় বকে বাহাদুরির কিছু নেই। ”
চরম বিরক্ত হয়ে চট করে হৈমীর বাহু চেপে ধরল রুদ্র। হাত থেকে বার্মিজ ফেলে দিয়ে ধমকে বলল,
-” ফ্রিজে জুস আছে, ফল আছে কেটে খাও। এটা বাদ। ”
চোখ কটমট করে হৈমী বলল,
-” আমার বার্মিজ! ফেলে দিলেন! আপনি একটা অসহ্য। আপনি বড্ড বাড়াবাড়ি করছেন। কী শুরু করেছেন? আমার ওজন কি খুব কম নাকি আপনার ওজন অনেক বেশি। আপনি একটা মটু! নিজের লজ্জা ঢাকতে আমার সাথে ভেজাল করছেন৷ নিজের হাতির শরীরের দিকে নজর না দিয়ে আমার বিড়ালে শরীরে কুনজর দিচ্ছেন, হাতি বানাতে চাচ্ছেন আমাকে। কী ভেবেছেন আমি চালাকি বুঝি না? সব বুঝি আমি, হাড়ে হাড়ে বুঝি। এসব করে করে আমাকে হাতির মতো মোটা বানাবেন। যাতে কোনো ছেলে আমাকে দেখে পছন্দ না করে। আমার রূপ, সৌন্দর্য স্বাস্থ্যের নিচে চাপা ফেলতে চাচ্ছেন।
সব বুঝি সব। ”
হৈমীর কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও ক্রোধকে বেশি প্রাধান্য দিল রুদ্র। চটে যাওয়া মেজাজে বলল,
-” ওকে ফাইন, এই লিরলিরে শরীরে তুমি কতটুকু সহ্য করতে পারো তাই দেখব। ”
বড়ো বড়ো চোখ করে হৈমী বলল,
-” মানে! ”
বাঁকা হেসে রুদ্র বলল,
-” সংসার, পড়াশোনা, স্বামী সোহাগ সব সামলাতে হলে শারীরিক, মানসিক সবদিক থেকে সবল থাকতে হয় ডার্লিং। দুর্বল লোকদের এসব সহ্য হয় না। ”
-” আপনি আমাকে দুর্বল বলে অপমান করছেন? ”
আচমকা হৈমীর খুব কাছে এসে দাঁড়াল রুদ্র। কানের কাছে ঠোঁট ছুঁয়ে ফিসফিস কণ্ঠে বলল,
-” কতটা সবল তা তো দেখেই ছাড়ব। ”
চলবে..