বেনেবউ পর্ব ৪

0
693

#বেনেবউ
#পর্ব_৪ (ইপ্সিতার বি’ষা’ক্ত অতীত)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

নিভ্র কিছু বলার আগেই ছেলেটার গালে একটা থাপ্পর পড়ল। থাপ্পরটা ইপ্সিতাই দিয়েছে, ছেলেটা একটা মেয়ের হাতে থাপ্পর খাওয়া মেনে নিতে পারল না। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
– ‘তোর এতো বড়ো সাহস আমার এলাকায় এসে আমাকেই থাপ্পর মারিস।’

ইপ্সিতা কে আঘাত করার জন্য হাতটা তুলতেই, ইপ্সিতা হাতটাকে ধরে নিয়ে বলল,

– ‘আমার সাহসটা অনেক বেশিই। আর এটা তোর এলাকা নয় আমার ওহ এলাকা, ভালো করে মুখের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ চিনে যাবি।’

ছেলেটা ইপ্সিতার মুখের দিকে ভালোভাবে তাকাতেই চমকে উঠল।

– ‘ইপ্সিতা!’
– ‘হ্যাঁ ইপ্সিতা, তবে আগের সেই সহজ সরল মেয়েটা ভেবে ভুল করিস না, কেমন।’

কথাটা বলে ইপ্সিতা হাতটাকে ঝাড়ি দিয়ে ফেলে দিলো। ছেলেটা ইপ্সিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘কাজটা ঠিক করলি না। চল..

ছেলেগুলো চলে গেল। নিভ্র অবাক হয়ে ইপ্সিতার বাঘিনী রূপ দেখতে ব্যস্ত। গলার স্বরটা স্বাভাবিক করে বলল,

– ‘ছেলেগুলোর সাথে এইভাবে কথা বললেন ভয় লাগলো না।’

ইপ্সিতা পাশে তাকাল, নিভ্রকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
– ‘না।’
– ‘তাহলে তো বলতেই হয় আপনি খুব সাহসী।’

ইপ্সিতা তাচ্ছিল্যের হাসল। এই সাহসটা ২বছর আগে থাকলে নিজের কতবড়ো ক্ষতিটা হয়তো হতো না। নিভ্র আরো কিছু জিজ্ঞাসা করবে তার আগেই ইপ্সিতার গাড়ি চলে আসে আর ওহ চলে যায়।

– ‘যা চলে গেল,দূর।’

দুইজন দুদিকে চলে গেল। নিভ্র নিজের অফিসে যাবে আর ইপ্সিতা নিজের স্বপ্নপূরনের উদ্দেশ্যে।

ইপ্সিতা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গেটের বাইরে সিকিউরিটি গার্ড দিচ্ছে, ইপ্সিতা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘মিসেস অহনা আহমেদ এই বাড়িতে থাকেন?’
– ‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?’
– ‘ওনার সাথে আমার একটু দরকার ছিল, আমি কি ওনার সাথে দেখা করতে পারি?’
– ‘আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি ম্যামকে জিজ্ঞেস করে জানাচ্ছি।’
– ‘আচ্ছা।’
– ‘আপনার নামটা কি যেন?’
– ‘ইপ্সিতা চৌধুরী।’

সিকিউরিটি গার্ড ফোনে কথা বলে ইপ্সিতাক বলল,
– ‘আপনি যান।’

অনুমতি পেয়ে ইপ্সিতা বাড়ির দরজায় কলিং বেল বাজালো। একজন মহিলা দরজা খুললেন, সম্ভবত এই বাড়ির কাজের লোক।

– ‘ম্যাম আছেন?’
– ‘হ্যাঁ আপনি ভেতরে আসুন।’

ইপ্সিতা বাড়ির ভেতরে আসলো, সাজানো গোছানো পরিপাটি বাড়ি। মহিলাটি ইপ্সিতাকে বসতে দিয়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর একজন মহিলা আসলো, দেখলে বোঝার উপায় নেই ওনার আসল বয়স।

– ‘তুমিই কি ইপ্সিতা।’
– ‘জ্বি ম্যাম।’
– ‘তা আমার সাথে কি দরকার তোমার?’
– ‘আসলে ম্যাম আপনার কাছে আমার একটা হেল্প চাই।’
– ‘কি হেল্প?’ (কৌতুহল কন্ঠে)
– ‘ম্যাম আপনার কথা আমি অনেক শুনেছি, তাই আপনার কাছে এসেছি।’
– ‘সব বুঝলাম কিন্তু কি হেল্প সেটা তো বলো।’
– ‘একজন ধ’র্ষ’ককে শাস্তি দিতে চাই।’
– ‘সেটা ভালো কথা, তবে আমার সাথে সেই মেয়েটার কথা বলিয়ে দাও আমি আমার মতো চেষ্টা করবো।’
– ‘মেয়েটি আপনার সামনে বসে আছে।’
– ‘মানে?’
– ‘ধ’র্ষি’তা মেয়েটি আমি নিজেই।’

মিসেস অহনা আহমেদ চমকে উঠলেন, সামনের মেয়েটিকে দেখে একবারের জন্যও ভাবিনি মেয়েটি ধ’র্ষি’তা।

– ‘জানি ম্যাম হয়তো আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু এটাই সত্যি, ২বছর আগে আমি একজনের রে’পড হয়।’
– ‘সম্পূন ঘটনাটি আমাকে খুলে বলো।’
– ‘হুম।’

২বছর আগে,

তখন আমি অর্নাস ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। পড়াশোনায় বরাবরই খুবই ভালো, তবে খুব একটা চালাক চতুর নয়। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়াতে একটু বেশিই আদরের। সবকিছু ভালোই চলছিল আমি নিজের পড়াশোনা, ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে এক ছেলের সাথে ধাক্কা লাগে, ভদ্রতার খাতিরে ছেলেটিকে – ‘সরি।’ বলে চলে আসি। কিন্তু ছেলেটি আমার রূপে পাগল হয়ে যায়। দিন আগাতে লাগল, ছেলেটি আমাকে ফলো করতে শুরু করে। সব বুঝেও ইগনোর করার চেষ্টা করতাম। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে,

– ‘ইপ্সিতা দাঁড়াও তোমার সাথে আমার কথা আছে।’
– ‘কি কথা?’
– ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
– ‘সরি আমি আপনার প্রোপজাল এক্সসেপ্ট করতে পারলাম না।’

রিতেশকে রিজেক্ট করে চলে আসি। তখন আমার কাছে প্রেম ভালোবাসা এইসবের কোনো জায়গা ছিল না, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এইটাই সবসময়ে মাথাতে ঘুরতো।

দিন দিন রিতেশের পাগলামী বাড়তে থাকে, চিঠি দেওয়া, ফুল দেওয়া বারবার রাস্তা আটকে ভালোবাসি বলা চলতেই থাকে। একদিন সবকিছুর লিমিট ক্রস করে যায়, রিতেশ সকলের সামনে আমার হাত টেনে ধরে। সকলের সামনে এইরকম করাটা আমি নিতে পারে না, রাগে থাপ্পর মেরে দিই রিতেশকে। আর সেটাই আমার জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল ছিল।

আমার করা অপমান আর থাপ্পর রিতেশকে পাগল বানিয়ে দেয়, একপ্রকারের উম্লাদের মতো হয়ে যায়, নেশা পর্যন্ত করা শুরু করে। একদিন কলেজ থেকে একাই বাড়ি ফিরছিলাম, একটা গাড়ি পথ আটকায়। গাড়ি থেকে রিতেশকে নামতে দেখে ভয়ে বুক কেঁপে উঠে,

– ‘কি হলো পথ আটকে দাঁড়ালেন কেন?’
– ‘তোমাকে চাই।’
– ‘দেখুন আমার পথ ছাড়ুন আমাকে যেতে দিন।’
– ‘তুমি আমার সাথে যাবে।’

রিতেশ আমার হাত ধরে টানতে থাকে। ক্রমাগত নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি কিন্তু একজন ছেলের সাথে কিছুতেই পেরে উঠছি না তবুও আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি। আমার ছটফটানি দেখে রিতেশ মুখে রোমাল চেপে ধরে আর আমি সেন্সলেস হয়ে যায়।

জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে একটা বিছানায় দেখতে পাই, প্রচন্ড ভয়ে পেয়ে যায়। মাথা ভারি হয়ে আছে, কোনো রকমে উঠে বসে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করি কিন্তু পারি না।

– ‘কি আছেন এইখানে? আমাকে হেল্প করুন হেল্প।’

আমার কন্ঠস্বর শুনে রিতেশ ঘরে আসে, ওকে দেখে আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়।

– ‘আপনি আমাকে কোথায় এনেছেন? আমি ছেড়ে দিন আমি বাড়ি যাবো।’
– ‘তুমি কোথাও যাবে না, আমার কাছেই থাকবে।’
– ‘হ্যাঁ থাকবো না, কিন্তু এখন আমাকে যেতে দিন নাহলে বাড়িতে চিন্তা করবে তো।’

রিতেশ মাতালের মতো ঠলছে আমি ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম ওহ নিজের মধ্যে নেই তাই চেষ্টা করছিলাম বোঝানোর। কিন্তু রিতেশ আমার কোনো কথাতে কান না দিয়ে আমাকে স্পর্শ করতে শুরু করে। আমার গোটা শরীরে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকি ফলে রিতেশের শরীরে আঘাত লাগে।

– ‘ছাড়ুন আমাকে। ছেড়ে দিন।’

রিতেশকে কোনোরকমে ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের হতে যাবো তার আগেই রিতেশ আমাকে টেনে বিছানায় ফেলে দেয়। বারবার বারন করা সত্ত্বেও সেদিন রিতেশ আমার কোনো কথাই শোনেনি, আমার সর্বস্ব শে’ষ করে দেয়।

**

ইপ্সিতার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি ঝড়ছে। মিসেস আহমেদের চোখেও পানি, তিনি ভাবতেই পারেনি এইটুকু একটা মেয়ের উপর দিয়ে এইরকম একটা জিনিস বয়ে গেছে।

– ‘মা তুমি কেঁদোনা। আমি তোমাকে সাহায্য করবো।’

মিসেস আহমেদ ইপ্সিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। ইপ্সিতা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে, সেই ভয়ানক দিনের কথা চাইলেও ভূলে থাকতে পারে না। মনে পড়লেই নিজেকে শে’ষ করে দিতে মন চাই কিন্তু পারে না।

ইপ্সিতাকে শান্ত করে জিজ্ঞেস করে,

– ‘ছেলেটার বিরুদ্ধে কোনো কে’স করোনি?’
– ‘না।’
– ‘কিন্তু কেন?’
– ‘সেইদিন আমি ফিরে আসার আগেই গোটা এলাকায় আমার ধ’র্ষি’তা হবার খবর ছড়িয়ে পড়ে। বাবা জানতেন মানুষগুলো আমাকে বাঁ’চতে দেবে না, তাই সেইরাতেই আমাদের নিয়ে শহর ছাড়েন।’
– ‘এইটাই তো ভূল করেছো, তখন কেসটা করলে বিষয়টা সহজ হতো। কিন্তু এখন এতদিন পর কিভাবে!’
– ‘ম্যাম প্লিজ আমি অনেক আশা নিয়ে এসেছি। এমনকি আপনার সাথে দেখা করার জন্যই আমি আবারো এই বীরভূমে ফিরে এসেছি।’
– ‘সবটা বুঝতে পারছি‌। কিন্তু দুইবছর আগের ঘটনা, সমস্ত প্রমান বিলু’প্ত হয়ে গেছে।’

ইপ্সিতা হতাশ হলো, তাহলে কি সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।

– ‘চিন্তা করো না, আমি দেখছি কি করা যায়।’
– ‘ম্যাম আমার আর একটা রিকুয়েস্ট আছে।’
– ‘কি বলো?’
– ‘ম্যাম আমি আপনার সাথে কাজ করতে চাই। আমার মতো আরো অনেক অসহায় মেয়েদের সাহায্য করতে চাই, প্লিজ ম্যাম আমাকে একটা সুযোগ দিন।’
– ‘ঠিক আছে।’
– ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’

ইপ্সিতা মিসেস আহমেদকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। মিসেস আহমেদ ইপ্সিতার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– ‘ফুলের মতো মেয়েটার যে স’র্ব’নাশ করেছে, তার চরম শা’স্তি হওয়া উচিৎ।’

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here