#বেনেবউ
#পর্ব_২
#তানজিলা_খাতুন_তানু
ছাদে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে ইপ্সিতা পেছনে ফিরে তাকিয়ে, একজন অচেনা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি নিজের মাথার কাপড় ঠিক করে বলল,
– ‘আপনি কে? আর আমাদের বাড়ির ছাদে কি করেন?’
প্রশ্নটা নিভ্রের বুঝতে কিছুটা সময় লাগল,
– ‘আপনাদের বাড়ি মানে?’
– ‘আমাদের বাড়ি মানে আমাদের। কিন্তু আপনি কে?
– ‘আমি এই বাড়ির দোতলায় ভাড়া থাকি।’
– ‘বাবা দোতলাটা ভাড়া দিয়েছে! কই আমি তো কিছু জানি না।’
– ‘আপনিই কি তাহলে বাড়িওয়ালার মেয়ে।’
– ‘হুমম। আচ্ছা আমি আসছি।’
ইপ্সিতা কোনোরকমে ওখান থেকে পালিয়ে গেল। নিভ্রের মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিতে লাগল, আচ্ছা মা যে মেয়েটার কথা বলছিল এটাই কি সে? প্রশ্নটা মনে আসলেও উত্তরটাতে মন সায় দিতে চাইল না, মেয়েটার বোন বা দিদিও তো হতে পারে মেয়েটি।
নিভ্র ছাদ থেকে নেমে নিজের ঘরে চলে গেল। বারবার মেয়েটার মুখটা ভেসে উঠছে, সরল চাহনি নিভ্রকে কিছুতেই শান্ত থাকতে দিচ্ছে না।
ইপ্সিতা নীচে এসে মাকে জিজ্ঞেস করল,
– ‘মা ওহ মা।’
– ‘কি হয়েছে, এত চেঁচামেচি করছিস কেন?’
– ‘মা আমাদের দোতলাটা ভাড়া দিয়েছো?’
– ‘কই আমি তো কিছু জানি না, তোর বাবাটে জিজ্ঞেস কর বলতে পারবে।’
– ‘ওহ।’
– ‘আচ্ছা তুই বল তো এইভাবে চেঁচামেচি করে এইটা জানতে চাইছিলিস কেন? কিছু কি হয়েছে?’
– ‘আসলে ছাদে একটা ছেলের সাথে দেখা হলো, সে বলল সে নাকি দোতলায় ভাড়া থাকে।’
– ‘আচ্ছা তুই এইসব বাদ দে, অনেক জার্নি করে এসেছিস রেস্ট নে।’
– ‘হুম।’
সন্ধ্যা হবার কিছুক্ষণ পরেই কয়েকজন ভদ্রমহিলা ইপ্সিতার বাড়িতে আসেন। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ইপ্সিতার মা ইরা চৌধুরী মহিলাগুলোকে ভেতরে বসতে বললেন।
– ‘কি গো ইরা এতবছর পর এইখানে ফিরে আসলে।’
– ‘কি করবো দিদি নিজের বাড়ি থেকে আর কতকাল দূরে থাকব।’
– ‘সেটাই তো, মেয়ের জন্য আর কত ত্যাগ করবেন।’
– ‘বলছি কি ইরা, মেয়েটার বিয়ে নিয়ে কি কিছু ভাবলেন।’
ইপ্সিতার মা কেঁপে উঠল, বিয়ের দিনের ঘটনা মনে পড়তেই অন্তর কেঁপে উঠছে।
– ‘আমার এক দূরসম্পর্কের ভাই আছে, যদিও আগে বিয়ে হয়েছিল কিন্তু একেবারে সোনার টুকরো।’
– ‘দিদি মাফ করবেন। আমি আমার মেয়ের বিয়ে এখুনি দেব না।’
– ‘ভালো ছেলে তাই বলছিলাম।’
– ‘দিদি আপনাদের অন্যকিছু কথা থাকলে বলতে পারেন। বিয়ে নিয়ে কিছু বলবেন না দয়া করে।’
– ‘তাহলে আসি।’
মহিলাগুলো নিজেদের মধ্যে কিসব বলাবলি করতে করতে চলে গেল। ইপ্সিতার মা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, মেয়ে ধ’র্ষি’তা বলে এইভাবে জলে ফেলে দিতে পারবেন না, ভদ্রমহিলা যার কথা বলছেন তার ইপ্সিতার বয়সী দুটো ছেলে মেয়ে আছে। সে মেয়ের বয়সী মেয়েকে বিয়ে করতে চাই কিভাবে, সেটাই বুঝতে পারলেন না উনি।
মুহিদ চৌধুরী বাড়িতে আসতেই ইপ্সিতা ওনাকে প্রশ্ন করল,
– ‘বাবা তুমি নাকি দোতলাটা ভাড়া দিয়েছো?’
– ‘হ্যাঁ রে।’
– ‘কিন্তু কেন বাবা, আমাদের কি কোনো অভাব আছে?’
– ‘নারে মা সেইজন্য না, আসলে আমরা থাকতাম না বাড়িটা ফাঁকাই থাকত সেইজন্য দিয়েছি।’
– ‘ভালো করেছো।’
ইপ্সিতা রাগ দেখিয়ে চলে যায়। মুহিদ চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, সেই ঘটনার পর থেকে মেয়েটা কিরকম একটা বদমেজাজি হয়ে উঠেছে। উপরওয়ালা ভালো জানেন কবে মেয়েটা আবারো স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
নিভ্রের মন এখনো অশান্ত হয়ে আছে, ইপ্সিতার পরিচয় জানার জন্য ছটফট করে চলেছে।
– ‘বাবু তোকে কি বলেছিলাম তোর মনে আছে?’
– ‘কি?’
– ‘অন্য বাড়ি দেখার কথা।’
– ‘মা আমরা এই বাড়িতেই থাকব, আর এইখান থেকে আমার অফিসটা কাছে হয়।’
নিভ্রের মা নয়না নিভ্রকে ভালোভাবে বোঝাতে থাকেন উনি কিছুতেই এই বাড়িতে থাকবেন না কিন্তু নিভ্র নাছোড়বান্দা এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না।
কলিং বেল বেজে উঠতে মা ছেলের তর্কাতর্কি থেমে যায়। নিভ্রের মা বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দেখলেন, একজন সুন্দরী মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। মহিলাটি কে সেটা উনি বুঝলেন না, তবুও সৌজন্যের খাতিরে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– ‘দিদি আপনি কে?’
– ‘আমি নীচে তলায় থাকি, এই বাড়িটা আমাদেরই।’
কথাটা শোনা মাত্রই নিভ্রের মায়ের মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেল। বাড়িটা ওনাদের মানে ওনার মেয়েই তো ধ’র্ষি’তা। ওনার সাথে কথা বলতে নিভ্রের মায়ের কিরকম একটা অস্বস্তি বোধ হতে লাগল, তবুও মুখের উপরে কিছু বলতে না পেরে ভদ্রতার খাতিরে ভেতরে আসতে বললেন।
ইপ্সিতার মা নিভ্রের মায়ের ব্যবহারে খুবই খুশি হয়েছেন সেটা মুখের হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ইপ্সিতার মা দ্বিমত প্রকাশ না করে ভেতরে প্রবেশ করলেন, একই বাড়িতে যখন থাকবেন তখন একটু বোঝাপড়া থাকলে সুবিধাই হবে। তবে নিভ্রের মা বিষয়টিতে একটু চটলেন, বিরবির করে বলল,
– ‘কি বেহায়ারে, বললাম আর চলে আসলো।’
দুজনের মধ্যে আলাপ শুরু হলো, নিভ্রের মা নিভ্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ আর ইপ্সিতার মা হাসিমুখে সবটা শুনছেন।
– ‘দিদি আপনার বাড়িতে কে কে আছে?’
– ‘আমরা স্বামী স্ত্রী আর এক মেয়ে।’
ইপ্সিতার মায়ের জন্য নিভ্রের মায়ের একটু মায়া হলো, এক মেয়ে আবার সে ধ’র্ষি’তা। তাই মেয়েটার টপিক বাদ নিয়ে অন্য কথা বলতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক স্থাপন হয়ে যায়।
২টো দিন কেটে যায়।
ইপ্সিতা ছাদটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলেছে, নিভ্রের মুখোমুখি হতে চাই না। আর এইদিকে নিভ্র ইপ্সিতাকে দেখার জন্য আকুল হয়ে আছে, একপলকের একটু দেখাই বেনেবউ ওর মনে দাগ কেটেছে কিছুতেই মন থেকে দূরে সরাতে পারছে না। নিভ্রের মা ও বাড়ি ছাড়া নিয়ে কিছুই জোরাজুরি করেনি এতে নিভ্র কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছে।
ইপ্সিতা খাবার খাওয়ার জন্য টেবিলে এসে বসতেই ইপ্সিতার মা বলল,
– ‘ইপ্সিতা মা একটা কাজ করে দিবি।’
– ‘কি কাজ?’
– ‘এই টিফিনটা একটু উপরে দিয়ে আসবি।’
ইপ্সিতার ভ্রু কুঁচকে যায়।
– ‘কি আছে এতে?’
– ‘একটু পায়েস আছে, নয়না ভাবির ছেলেটা খেতে খুব পছন্দ করে।’
– ‘বাবাহ এই ২দিনে এতকিছু জেনে গেলে?’
– ‘যা না মা দিয়ে আয় না।’
– ‘দূর ভালো লাগে না।’
ইপ্সিতা রাগে গজগজ করতে করতে দোতলার দিকে পা বাড়াল। কলিং বেল বাজানোর পরেও দরজা খুলছে না, ইপ্সিতার রাগ হলো। শেষবারের মতো কলিং বেল বাজিয়ে চলে যেতে যাবে তখনি দরজা খোলার শব্দে ইপ্সিতা ঘুরে তাকালো,
একজন ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দিলেন।
– ‘আন্টি মা এইটা পাঠালো।’
– ‘মা মানে?’
– ‘আমি নীচের তলায় থাকি।’
– ‘ভেতরে আসো মা।’
ইপ্সিতা ভেতরে ঢুকে নয়না রায়হানের হাতে টিফিনটা দিলো। নয়না মুচকি হেসে টিফিনটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন, ইপ্সিতা একা দাঁড়িয়ে কি করবে তাই বলল,
– ‘আন্টি আমি কি আপনার সাথে আসতে পারি?’
– ‘হ্যাঁ অবশ্যই।’
নয়না টিফিন গুলো খালি করছে আর ইপ্সিতা দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
– ‘কি নাম তোমার?’
– ‘ইপ্সিতা।’
– ‘ভারি মিষ্টি নাম তো। মাঝে মধ্যে তো আসতে পারো মায়ের সাথে, একটু গল্প করি একসাথে।’
– ‘আন্টি আপনি তো কখনোই আমাদের বাড়িতে যাননি, একদিন আসবেন আড্ডা দেব জমিয়ে।’
ওইটুকু সময়ের মধ্যে দুজন অনেক কথাই বলে ফেলল। নিভ্রের মা নয়নার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে বাড়িওয়ালার মেয়ের পরিচয়, আচ্ছা ওআনর যদি খেয়াল থাকত তাহলেও কি ইপ্সিতার সাথে এতটা মিশে যেতে পারতেন?
#চলবে…