#বেনেবউ
#পর্ব_১৮
#তানজিলা_খাতুন_তানু
নিভ্র স্পষ্ট ইপ্সিতার চোখে অন্যকিছু দেখতে পারছে, যেটা আগে কখনো দেখেনি। ইপ্সিতার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে নিভ্র বলল,
– ‘বাই এনি চান্স তুমি কি আমাকে চাও!’
নিভ্রের কথা শোনা মাত্রই ইপ্সিতা অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। ওর এমন কাজে নিভ্রের বুঝতে অসুবিধা হলো না, ওর আন্দাজটাই সঠিক। তাই দুষ্টুমি করে বলল,
– ‘তাহলে অপেক্ষা কেন বউ। চলো বাসর করি।’
– ‘ধ্যাত আপনিও না।’
ইপ্সিতা নিভ্রের বুকে মুখ লুকায়, নিভ্র আলতো হাসল। অবশেষে তার বেনেবউ তার কাছে ধরা দিয়েছে, ওর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে।
**
ইপ্সিতার ঘুম ভাঙতে দেখল নিভ্রের খোলা বুকের উপরে শুয়ে আছে। ইপ্সিতা হাসল, মানুষটি একান্তই ওর। নিজের। দুজনের মাঝে নেই আর কোনো দূরত্ব, সবকিছু ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। নতুন একটা সকাল, নতুন ভাবে পথ চলার শুরু। সমাপ্তিটা যেন সুখেরই হয়।
ইপ্সিতা গোসল করে রান্নাঘরে চলে গেল। নিভ্রকে বিরক্ত করার ইচ্ছা হলো না। বউমাকে সকাল সকাল গোসল করতে দেখে নিভ্রের মা মুখ টিপে হাসলেন, অবশেষে ছেলে মেয়ে দুটোর মিল হলো। এতেই শান্তি।
ইপ্সিতা রান্না শেষ করে নিভ্রকে ডাকতে গেল। তিনি তখনো ম’রার মতো ঘুম যাচ্ছেন, ইপ্সিতার মাথাতে শয়তানি বুদ্ধি আসলো। নিভ্রের পাশে বসে নিজের মাথার চুল নিয়ে ওর নাকে দিতে লাগল, তারপর….
– ‘হাচ্ছি….
ইপ্সিতা খিলখিলিয়ে উঠে, ঘুমের মধ্যে এইরকম হওয়াতে নিভ্রের মেজাজ আকাশ ছোঁয়া কিন্তু প্রিয়তমার খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ কর্নপাত হতেই সমস্ত রাগ কপূরের মতো উড়ে গেল। মুগ্ধ হলো সামনে বসে থাকা রূপবতীকে দেখে, খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ নিভ্রের বুকে ঝড় তুলে দিয়েছে। এলোমেলো শাড়ি, ভেজা চুল নিভ্রকে আবারো প্রেমে পড়তে বাধ্য করছে। মেয়েটা চুম্বকের মতো টানছে, নিভ্র আবারো মাতাল হয়ে উঠছে।
নিভ্রকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ইপ্সিতা হাসি থামিয়ে উঠে যেতে যায় কিন্তু তার আগেই নিভ্র ওকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে অধর আঁকড়ে ধরে। প্রথমে নিজেকে সামলে রাখলেও নিভ্রের ভালোবাসার পরশ উপেক্ষা করতে পারে না, নিজেও তাল মেলাতে থাকে।
দুজনেই হাঁপাচ্ছে। ইপ্সিতা হাঁপানোর মাঝেই রাগ নিয়ে বলল,
– ‘সকাল সকাল দিলেন তো নষ্ট করে।’
– ‘কি করবো জান, তোমার এই রূপ আমাকে মাতাল করে তুলছে। ইচ্ছা করছে তোমাকে আদর করি।’
– ‘থাক আর কিছু করতে হবে না। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।’
– ‘একটা কিস দাও যাবো।’
– ‘পারবো না।’
ইপ্সিতা বারান্দায় চলে যায়। নিভ্র উঠে ইপ্সিতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– ‘আমার বউটাকে রাগ করলে দারুন লাগে, ইচ্ছা করে খেয়ে ফেলি।’
ইপ্সিতা কিছু বলতে যাবে তার আগেই টিয়াপাখিটা বেনেবউ বেনেবউ বলে চেঁচিয়ে উঠল। ইপ্সিতা হতবাক!
– ‘পাখিটা বেনেবউ বলছে কাকে?’
– ‘তোমাকে।’
– ‘শিখল কিভাবে?’
– ‘আমি শিখিয়েছি।’
– ‘কিন্তু এই টুকু সময়ের মধ্যে কিভাবে?’
– ‘টিয়াটাকে আগেই কিনেছিলাম। বেনে বউ পাখিটার খোঁজ পাচ্ছিলাম না বলে আনিনি। আর ওটাকে বেনেবউ বলা শিখিয়েছিলাম ভেবেছিলাম কালকে তোমাকে বলে চমকে দেবে কিন্তু শয়তান পাখি কালকে বলেনি আজকে বলছে।’
ইপ্সিতা নিভ্রের বাচ্চামো দেখে হাসল। মানুষটি এতটা ভালো কেন? ইপ্সিতার জীবনের সবকিছু জানার পরেও এতটা যত্ন করে আগলে রেখেছে, যেটা কজনই বা পারে!
– ‘বউ তুমি থাকো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
সারাটাদিন নিভ্র সকলের সাথে আড্ডা দেয়। আজকে মনটা ভিষন ভালো। ইপ্সিতার মা বাবাও আজকে ছিলেন, সকলেই খুশি।
– ‘হ্যালো নিভ্র।’
– ‘জ্বি স্যার বলুন।’
– ‘অফিসারের সাথে কথা হয়েছে। অপরা’ধীদেরকে এরে’স্ট করা হয়েছে।’
– ‘এটা তো খুব ভালো খবর।’
– ‘হ্যা তবে এই ঘটনার সাথে আরো একজন জড়িত ছিল।’
– ‘কে?’
– ‘রিয়া।’ (গতপর্বে ভুলবশত রিয়ার জায়গায় রুহি লেখা হয়ে গিয়েছিল। তার জন্য দুঃখিত)
নিভ্র চমকে উঠল। রিয়া এইরকম কিছু করতে পারে আগেই সন্দেহ ছিল কিন্তু এতটা নিচে নামবে সেটা ভাবতে পারেনি।।
– ‘স্যার রিয়ার সবোর্চ্চ শা’স্তির ব্যবস্থা করুন।’
– ‘অবশ্যই। তুমি টেনশান করো না, আমি সবটা দেখছি। আর আগামীকাল তোমার ওয়াইফকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসো।’
– ‘কিন্তু স্যার।’
– ‘এটা আমার অনুরোধ নয় আদেশ।’
– ‘ওকে স্যার।’
নিভ্র ফোনটা রেখে ইপ্সিতাকে ডাক দিলো,
– ‘ইপ্সিতা, এই ইপ্সিতা।’
– ‘জ্বি বলুন।’
– ‘কালকে তোমাকে আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।’
– ‘কোথায়?’
– ‘আমার স্যারের বাড়িতে। স্যার যেতে বলেছে।’
ইপ্সিতা কিছু একটা ভেবে বলল,
– ‘আচ্ছা সমস্যা নেই।’
পরেরদিন,
ওদেরকে লাঞ্চ টাইমের আগেই যেতে বলেছে। ইপ্সিতা শাশুড়ি মায়ের জন্য রান্না করে রেডি হয়ে নিল। নিভ্রের মায়ের জোরাজুরিতে একটা লাল শাড়ি পড়তে হয়েছে। লাল শাড়ি তার সাথে হালকা সাজ, পুরোই নতুন বউ লাগছে।
– ‘কি সুন্দর লাগছে আমার মেয়েটাকে।’ (নিভ্রের মা)
নিভ্র হাতের ঘড়ি পড়তে পড়তে ইপ্সিতাকে তাড়া লাগাতে এসে থমকে গেল। নিভ্রের মা ছেলের বেহাল অবস্থা থেকে মুচকি হেসে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। নিভ্র সম্মোহনের মতো ব্যবহার করছে, ধীর পায়ে ইপ্সিতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যেন ইপ্সিতা ওকে সম্মোহন করেছে।
– ‘কি হলো আপনি এইভাবে এগিয়ে আসছেন কেন?’
নিভ্র কিছু না বলে এগিয়ে যেতে থাকে, ইপ্সিতার অধর স্পর্শ করবে তার আগেই ইপ্সিতার হাত দিয়ে নিজের ঠোঁট জোড়া ধরে বলল,
– ‘এইরকম করলে কিন্তু আমি আপনার সাথে কিছুতেই যাব না।’
নিভ্র নড়েচড়ে দাঁড়ায়। না ইপ্সিতাকে ক্ষে’পিয়ে তুললে হবে না।
– ‘চলো দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
– ‘দেরিটা কে করাল?’
– ‘চলো।’
দুজন বেড়িয়ে পড়ল নিভ্রের স্যারের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ইপ্সিতা নিভ্রের বাইকের পেছনে বসে আছে, আঁকড়ে ধরে আছে নিভ্রকে। আগেও নিভ্রের বাইকে উঠলেও এতটা ক্লোজড হয়ে বসেনি।
– ‘এই পথ যদি না শেষ হতো ,তাহলে কেমন হতো বলো তো।’ (রোমান্টিক মুডে)
– ‘বাইকের সব তেল শেষ হয়ে গিয়ে হাঁটতে হতো।’
নিভ্র মুখ গোমড়া করে নেয়। ইপ্সিতা ওর গোটা রোমান্টিক মুডটাই নষ্ট করে দিয়েছে, রাগ হচ্ছে ভীষন তাই কথা না বলে চুপচাপ বাইক চালাতে লাগল।
বাইকটা একটা বিলাসবহুল বাড়ির সামনে থামে। নিভ্রের স্যার অনেক ধনী ব্যক্তি, অনেকগুলো কোম্পানি তার। ইপ্সিতা আর নিভ্রকে দেখা মাত্রই স্যার তার স্ত্রীকে ডাক দিলেন,
– ‘সুমা ওহ সুমা দেখে যাও কারা এসেছে।’
একজন ভদ্রমহিলা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে আসলেন। মহিলাটি খুব সাধারন সাজেই আছে, তাই নিভ্র আর ইপ্সিতার ঠিক ধরতে পারল না মহিলাটি কে?
– ‘কি হয়েছে এত চেঁচামেচি করছ কেন?’
– ‘দ্যাখো কে এসেছে। নিভ্র আর ওর ওয়াইফ।’
মহিলাটির চোখ খুশিতে চকচক করে উঠল। খুশি মনে বলল,
– ‘তোমাদের কথা কত শুনেছি ওনার মুখে। তোমাদের দেখার আমার অনেক ইচ্ছা ছিল ফাইনালি সেটা পূরন হলো।’
– ‘আরে আগে ওদেরকে বসতে দাও তারপরে না হয় ওদের সাথে কথা বলবে।’
নিভ্র আর ইপ্সিতা বসলো। তারপরে স্যার মহিলাটার সাথে পরিচিত হলেন,
– ‘উনি আমার স্ত্রী সুমা।’
ওরা একটু অবাক হলো, এত ধনী পরিবারের বউ হয়েও ওনার সাজ একদম সাধারন পরিবারের বউদের মতো কেন? আর ব্যবহারও কতটা অমায়িক।
– ‘মিসেস রায়হান আপনাকে দেখার অনেক ইচ্ছা ছিল আমার।’
মিসেস রায়হান বলাতে ইপ্সিতার একটু ইতস্তত হচ্ছিল তাই বলল,
– ‘স্যার আমি আপনার মেয়ের বয়সী তাই আমাকে নাম ধরেই ডাকতে পারেন।’
স্যারের মুখে হাসি ফুটে উঠল, উনার ওহ মিসেস রায়হান ডাকতে কিরকম একটা লাগছিল কিন্তু তবূও ভদ্রতার খাতিরে বললেন।
– ‘তাহলে তো কোনো কথাই নেই। নিভ্র আজকে থেকে আমি তোমার শশুর।’
নিভ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বুঝতে না পেরে বলল,
– ‘মানে?’
– ‘আরে তোমার ওয়াইফ বলল সে আমার মেয়ের মতো। ওহ যদি আমার মেয়ে হয় তাহলে আমি তো তোমার শশুর তাই না।’
নিভ্র হেসে ফেলল, স্যার মানুষটাই এমন। সহজেই সকলকে আপন করে নেন। সারাটা দিন ওরা খুব আনন্দ করে, সুমা নিজের হাতে সমস্ত রান্না করে নিজের হাতে পরিবেশন করেছে ওদেরকে।
খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষে, আড্ডা দিতে বসেছে।
– ‘তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগছে নিশ্চয়, আমাদের এই বিলাসবহুল বাড়িতে একটাও কাজের মানুষ নেই কেন!’
– ‘না মানে আসলে… (ইতস্তত করে)
– ‘এইটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তোমাদেরকে একটা গল্প বলি চলো…
#চলবে…