বৃষ্টি_ভেজা_গোলাপ #পর্ব_২৪

0
1109

#বৃষ্টি_ভেজা_গোলাপ
#পর্ব_২৪
#নবনী_নীলা

বাতাসের প্রকট শব্দে রুহির ঘুম ভাঙলো। আবছা নীল রঙের পর্দাগুলো বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। ঘুম ঘুম চোখটা খুলতেই নিজের ঘাড়ে কারোর নিঃশ্বাসের তাপ অনুভব করলো রুহি। সেই তাপেই শরীরে শীতল শিহরণ বয়ে যাচ্ছে তার। রুহি আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে নিয়ে তাকাতেই দেখলো আহান তার খুব কাছে এসে ঘুমিয়ে আছে। এইজন্যই একসাথে ঘুমাতে তার এতো ভয় লাগে। কিন্তু আজকের দৃশ্যটা অন্যরকম আহানের হাতের দিকে তাকিয়ে রুহি ভ্রু কুটি করে ফেললো।হয়েছে কি এই কুম্ভকর্ণের? রুহির ওড়নার প্রান্তভাগ হাতে পেঁচিয়ে সেটা শক্ত করে ধরে শুয়ে আছে আহান। এ আবার কেমন জ্বালা! এবার সে উঠবে কিভাবে? ওড়নাটা ছাড়া সে যেতেও পারবে না আবার ওড়না রেখেও যেতে পারবে না। আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেছে তো! এমন হাতে কাউকে ওড়না পেঁচিয়ে ঘুমাতে সে বাপের জন্মে দেখেনি। এই ওড়নাটা সরিয়ে নিলেই কুম্ভকর্ণটা উঠে পরবে। রুহি তাও হাল ছাড়লো না। ওড়নাটা তো সে নিয়েই ছাড়বে। সব সময় কি সব এনার ইচ্ছে মতোন হবে নাকি?
রুহি খুব সাবধানে ওড়নার পেচটা খোলার চেষ্টা করছে। অসভ্য লোকটা এমন ভাবে পেচিয়েছে যে খুলতে গিয়ে রুহির ঘাম ছুটে যাচ্ছে। রুহি কিছুক্ষণ পর পর আহানের দিকে নজর রাখছে। উঠলে আবার কি না কি বলে বসে।
রুহি যেই শেষের পেঁচটা খুলতে যাবে ওমনি আহানের ঘুম ভেঙে গেলো। আহান ঘুম ঘুম চোখটা খুলতেই দেখলো রুহি বসে বসে কি জানি করছে তার হাতে। আহান হাই তুলতে তুলতে সেই হাত দিয়েই রুহির হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। রুহি একদম খেয়াল করেনি যে আহানের ঘুম ভেঙে গেছে তাই হটাৎ এমন কাছে টেনে আনতেই বুকের ভিতরটার ধুক ধুক বেড়ে গেলো চারগুণ।

আহান ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে রুহির দিকে,এই চাহিনিতেই ভয় লাগছে রুহির। এভাবে হেরে যায় যাবে না সে, রুহি নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল,” আমার ওড়নাটা ছাড়ুন। একদম সকাল সকাল অসভ্যতা করবেন না।”

আহান রুহির কোমড় জড়িয়ে ওকে বিছানার সাথে মিশিয়ে দিয়ে দুই হাত বিছানার সাথে শক্ত করে ধরলো। হটাৎ এমন কাজে রুহির চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো, বুকের ভিতরটা তোলপাড় চলছে। এই লোকটা দেখছি যখন যা ইচ্ছে তা করে বসে।
আহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” তাহলে অসভ্যতাটা ঠিক কখন করবো? দুপুরে করবো না রাতে। তুমি কখন চাও?”

আহানের উত্তরে রুহি পুরো তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে রইলো। এ জীবনে আহান রহমানের কাছ থেকে তাকে এমন কথাও শুনতে হবে তার জানা ছিলো না। রুহি লজ্জা মিশ্রিত গলায় বললো,” আপনার লজ্জা বলতে কিছু নেই? পাশের ঘরে আপনারা গার্লফ্রেন্ড, আপনি কিনা নিলজ্জের মতন আমাকে এসব বলেছেন। কাল রাতে আবার….” বলতে গিয়েও থেমে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো রুহি।

” কাল রাতে কি করেছি আমি? থেমে গেলে কেনো বোলো? কে আমার গার্লফ্রেন্ড? কতবার বললে তুমি বুঝবে বলতো?আর তার থেকেও বড় কথা লিগ্যালি তুমি আমার ওয়াইফ সো ম্যাডাম আমার অধিকার আছে আপনার উপর। সে নেহাৎ আমি ভদ্রতা বজায় রাখেছি।”, খুব কাছে এসে বললো আহান।

” এটা আপনার ভদ্রতার নমুনা? বাপরে! আপনার অভদ্রতা দেখে না আমি কোমায় চলে যায়। আপনার বউয়ের কপালে দুঃখই আছে।”, মুখ বাকিয়ে বললো রুহি। পরক্ষনেই মনে পড়লো সে নিজেই এখন এই কুম্ভকর্ণটার রুহি। মনে পরতেই ঠোঁট কামড়ে চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললো।

আহান এক টানে হাতে পেচানো রুহির ওড়নাটা টেনে রুহির উপর থেকে সরিয়ে ফেলতেই রুহি হকচকিয়ে উঠলো। আহান ওড়নাটা একপাশে ফেলে দিয়ে রুহির দুপাশে হাত রেখে ঝুকে এলো। রুহির আত্তা কেপে উঠছে,কিছু করে বসবে না তো? এই লোকটা। এর উপর কোনো ভরসা নেই।আহান রুহির উপর থেকে নিচে দেখতেই রুহি হাত দুটো বুকের সামনে রেখে দৃষ্টি সরিয়ে কাপা কাপা গলায় বলল,” কি করছেন আপনি!”
বাতাসেই আজ অন্যরকম নেশা। রুহির ভয় হতে লাগলো। আহান বাকা হাসি দিয়ে বলল,” আসলেই তোমার কপালে দুঃখ আছে। আমাকে যে এভাবে ভুগাচ্ছো তার পানিশমেন্ট তো তুমি শীগ্রই পাবে। চিন্তা করো না।”বলেই আহান রুহির উপর থেকে সরে এলো।

রুহির যেনো প্রাণ ফিরে এলো। এই লোকটা মাঝে মাঝে এমন সব কাজ করে যে পুরো অগোছালো হয়ে যায় রুহি। রুহি চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে।

________
আহানের অফিসের যাবার সাথে সাথে সামিরাও বেরিয়ে পড়ে। রুহি বাসায় একা, তার কিছুই ভাল্লাগে না। উফফ কি অসহ্য লাগছে তার। রুহি বারান্দাটায় সময় কাটালো, টিভি দেখলো। খুবই বিরক্ত লাগছে। তারপর মাঝে মাঝে আহানের বলা কিছু কথা মনে পড়তেই মাথা ঝাকিয়ে সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। দুপুরের পর আবার সামিরা হাজির হলো। হাতে করে অনেক কিছু নিয়ে। রুহি দরজা খুলে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,” এসব কি?”

সামিরা ব্যাগগুলো সোফায় রেখে বললো,” আহানকে সারপ্রাইজ দিবো।আমি তো আজ রাতে চলে যাচ্ছি। তাই সন্ধায় আমরা একটু একসাথে টাইম স্পেন্ড করবো ভাবছি। ওকে সারপ্রাইজ দিবো বুঝলে।”

রুহির কেনো জানি প্রচন্ড রাগ হলো। একসাথে টাইম স্পেন করবে মানে কি? রুহি থমথমে গলায় বললো,” তুমি ভুলে যাচ্ছো আমি তার ওয়াইফ।” রুহির চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। এই মেয়েটাকে সে আর সহ্যই করতে পারছে না। শাকচুন্নি কোথাগার!
এই মেয়েটা পিছেই পরে আছে আহানের আর সেই বিশাল ভদ্র ছেলে কিছুই বলছে না।

সামিরা জোড়ে হেসে উঠলো। রুহির মেজাজ আরো বিগড়ে গেলো। সামিরা হাসি থামিয়ে বললো,” রুহি, সত্যি তুমি অনেক ভালো অভিনয় করো। মানতেই হচ্ছে। তবে আমার সামনে আর অভিনয় করতে হবে না তোমায়।আমি জানি তোমাদের এগ্রিমেন্টের কথা।”এতটুকু শুনেই থমকে গেলো রুহি। এগ্রিমেন্টের কথা তো সে ভুলেই বসেছিলো। মুহুর্তে সবটা কেমন ধোঁয়াশা লাগছে রুহির কাছে। সামিরাকে আহান বলেছে এসব!

সামিরা আরো বললো,” এতোদিন আহান লুকিয়ে গেছে ও ভেবেছিলো আমাকে সারপ্রাইজ দিবে কিন্তু আমি অনেক হার্ট ছিলাম তাই পরে সবটা খুলে বলে। তোমাদের এগ্রিমেন্ট শেষ হলেই আমরা বিয়ে করছি।” কথাটা শুনে রুহির পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেল। তাহলে কি ওরা আসলেই একটা রিলেশনে আছে!
আহান এই মেয়েটাকেও কি তার মতন কাছে টেনে নিবে। খাবার বানিয়ে দিবে, মাথার কাছে বসে থাকবে? ভেবেই রুহির বুকের ভিতরে একটা ঝড় বইছে। এসব সে কি ভাবছে? নাকি কি সে আহানের প্রতি দূর্বল হয়ে পরেছে। রুহির চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু জল জমলো।

রুহিকে দমিয়ে দিতেই সামিরা এই মিথ্যে কথাগুলো বললো। রুহির এমন একটা কথা শুনে অবশ্যই আহান থেকে দুরে সরে যাবে। এটাই সে চায়। তাহলেই আহানকে পাবে সে।
ঘা টা আরেকটু বাড়িয়ে দিতে সামিরা বললো,”রুহি তোমার মতন এতো ভালো মেয়ে পাওয়া যায় না যে চুক্তিতে কারোর সাথে থাকতে রাজি হয়। তুমি সত্যিই অনেক সাহসী।”

গরম তেলে যেনো এক ফোঁটা পানির ছিটে। এই অপমানটা রুহি নিতে পারলো না। এমন কিছু যে তাকে শুনতে হবে জীবনে সে ভাবতেও পারেনি।
এই অপমানটা কি তার প্রাপ্য ছিল?
রুহির কাছে এখন সবটাই ধোঁয়াশা। অনেক কষ্টে চোখের পানি ধরে রাখছে সে। তাহলে তাকে শুধু প্রয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে আর এইসব মিথ্যে। সেদিনের নিরবকে ওভাবে মারাটাও কি মিথ্যে আর সেই কথাগুলো। রুহির সবকিছু এলোমেলো লাগছে। আহান কেনো তাহলে তার এতো কাছে আসতো? রুহি কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। তারই বা কেনো এতো খারাপ লাগছে। রুহি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বেরিয়ে গেলো ফ্ল্যাট থেকে। কোথায় যাবে তার জানা নেই তবে এইখানে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। রুহি বেরিয়ে যেতেই চোখ দিয়ে অভিমানের বৃষ্টি নামতে লাগলো। রুহি ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিতে লাগলো। অচেনা এক পথে হাঁটতে লাগলো সে। আজ আকাশটার ও মন খারাপ হয়েছে। সেও কাদতে শুরু করেছে। সেই বৃষ্টির বিন্দু গুলো রুহির অভিমানের ফোঁটাগুলো মুছে দিচ্ছে।

__________
আহান সন্ধায় বাসায় ফিরলো। বাসায় ফিরতেই সমিরা আহানের চোখ হাত দিয়ে ধরতেই আহান প্রচন্ড বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,” সামিরা জাস্ট স্টপ দিস। উ আর গোয়িং টু ফার,স্টেয় ইন ইউর লিমিট, আদার ওয়াইজ আই ওন্ট এলাও দিস।” বোলেই চোখ থেকে সামিরার হাত সরিয়ে ফেললো আহান। তারপর রুহিকে খুজতে লাগলো। আহানের মেজাজ ভীষন খারাপ কারণ বিকেল থেকে রুহিকে ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু রুহি ফোন ধরছে না।
আহান হাত সরাতেই সামিরা আহানের সামনে এসে দাড়ালো তারপর গোলার পাশে হাত জড়িয়ে বললো,” তুই এতো রেগে থাকিস কেনো? একটু মিষ্টি করে কথা বলতে পারিস না?”

” রুহি কোথায়?”, চারপাশটা দেখে সোজা প্রশ্নটা করলো আহান। সামিরা এতোক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলো তবে আহান রুহি রুহি করায় সামিরা রেগে গেলো।

” এতো রুহি রুহি করিস কেনো? আমার সামনে অভিনয় করা লাগাবে না আমি জানি তুই শুধু সাত মাস ঐ মেয়েটার সাথে থাকবি।”, আহানের কাছে এসে বলতেই আহান এক ঝটকায় সরিয়ে ফেললো সামিরার হাত।
তারপর কোমরে হাত দিয়ে দাতে দাত চিপে চোয়াল শক্ত করে বললো,” তুই আমায় জিনিস পত্র ঘেটেছিস? অ্যাম আই রাইট?” আহান সোজা রুহিকে খুজতে গেষ্ট রুমে গেলো রুহি নেই। দেখেই আহানের বুঝতে বাকি রইলো না সামিরা কোনো না কোনো প্যাচ লাগিয়েছে।
আহানের চোখে রক্ত উঠে লাল হয়ে গেছে রাগে। নিজেকে শান্ত করে বললো,” রুহি কোথায়? বাসায় নেই কেনো? বাসায় থাকলে অবশ্যই সাড়া পাওয়া যেতো। কি বলেছিস তুই ওকে?” আহান নিজেকে শান্ত করতে চেয়েও পারলো না কথা বার্তায় রাগের পরিমাণ আন্দাজ করতেই সামিরা ভয়ে বললো সে কিছু বলেনি। আহানের রাগ তার দেখা আছে।

” কিছু জানিস না তুই?”, ধমকের সুরে বললো আহান। সামিরা আতকে উঠলো আহানের ধমকে।

” তোকে একটা কথা বলে দিচ্ছি শুনে রাখ রুহির যদি কিছু হয়। আই স্বয়ার আমি তোর লাইফটা হেল বানিয়ে দিবো। অ্যান্ড আই মিন ইট।”, জোরালো ভাবে বলতেই সামিরা শেষ চেষ্টায় বললো,”সাত মাস পর তো ছেড়েই দিবি ওকে। তাহলে কিসের এতো…।”বলতেই আহান কড়া গলায় বলল,”মাইন্ড উর ল্যাঙ্গুয়েজ। রুহিকে আমি এ জীবনে ছাড়ছি না। কথাটা পরিষ্কার ভাবে শুনে রাখ। সি ইজ মাইন। ….[ থেমে আবার বললো]…. আর একটা কথা ফিরে এসে যেনো তোকে আমি এখানে না দেখি।”বলেই হন হনিয়ে বেড়িয়ে গাড়ী নিয়ে রুহিকে খুজতে বেড়িয়ে পড়লো আহান।

[ #চলবে]

{Don’t be a silent reader}?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here