#বৃষ্টি_ভেজা_গোলাপ
#পর্ব_২১
#নবনী_নীলা
“দিদা কি চাইছে সেটা জানতে চাও?”, বলে গাড়ির গ্লাসগুলো হাত বাড়িয়ে বাটন চেপে বন্ধ করে দিলো আহান। আহানের কণ্ঠ শুনে চোখ খুললো রুহি। আহান এখনো তার খুব কাছে আছে। রুহি এলোমেলো দৃষ্টিতে আশে পাশে তাকিয়ে গাড়ির গ্লাস গুলো আটকানো দেখে একটু ঘাবড়ে গেলো তারওপর আহান তার এতো কাছে। আহান হাত বাড়িয়ে সিট বেল্টটা নিয়ে রুহিকে পরিয়ে দিলো। রুহির কেমন অদ্ভুত এক অনুভুতি হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিলো রুহি। আহান সিট বেল্ট লাগিয়ে রুহির কানের কাছে মুখ আনতেই রুহির বুকের ভিতরটা কেপে উঠলো। আহানের নিঃশ্বাস তার গলায় আছড়ে পড়ছে, শরীরে শিহরন বইছে। রুহি চোখ বন্ধ করে ফেললো।
আহান কানের কাছে এসে বললো,” তুমি বাচ্চা মেয়ে তুমি বুঝবে না।”
কথাটা কর্নগচর হতেই রুহি চোখ বড় বড় করে আহানের দিকে তাকালো। দুজনের মধ্যকার দুরত্ব একে বারে কমে গেলো। রেগে গেল রুহি। তার বয়স বিশ আর তাকে কিনা বলছে বাচ্চা মেয়ে।
” আমি বাচ্চা মেয়ে? আমাকে কোনদিক দিয়ে আপনার বাচ্চা মনে হয়।”, রুহির কথায় আহান রুহিকে উপর থেকে নিচে দেখতে লাগলো। তারপর নিজের সিটে ফিরে গিয়ে বললো,” বাচ্চা না হলে এই কথার মানে বোকারাও বোঝে। এখন হয় তুমি বোকা না হয় বাচ্চা।”
রুহি আড় চোখে আহানের দিকে তাকালো। লোকটা সুযোগ পেলে অপমান করতে ছাড়ে না। মুখ ফুলিয়ে রুহি দিদার কথাগুলো ভালো ভাবে আরেকবার ভাবলো। আবদার করেছে কিছু একটার, আবার শেষে যাওয়ার সময় বললো সুখবর যেনো পায়। কিসের সুখবর? নতুন বাড়ি, গাড়ির নাকি? আচ্ছা তাহলে আবদারটা আহানকে করেছে নাকি আমাকে? ধুর ছাই মাথায় কিছুই কিছুই আসছে না। আমি কি আসলেই বোকা নাকি? আচ্ছা নুড়িকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়। রুহি নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে নুড়িকে ম্যাসেজ পাঠাতে নিয়ে আবার ফোন রেখে দিলো। নুড়িটাও একটা বেয়াদব পরে দেখা যাবে হাসাহাসি করবে তাকে নিয়ে।
রুহি নিজেই ভাবতে লাগলো। কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ি ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়লো। আহানের গাড়ির পাশে একটা অ্যাম্বুলেন্স দাড়ানো। রাস্তায় জামের কারনে তারাও আটকে পড়েছে। অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে থাকা আত্মীয়রা বাহিরে ছুটছে সাহায্যের জন্যে। গাড়ির গ্লাসটা লাগানো থাকায় রুহি কিছু বুঝতেও পারছে না। রুহি কৌতহল বশত গাড়ির গ্লাসটা খুলতেই চারপাশের গাড়ির হর্ন আসতে লাগলো। আহান সিটে মাথা হেলিয়ে ছিলো শব্দে মাথা তুললো। মাথা তুলে ভ্রু কুঁচকে রুহির দিকে তাকালো। তারপর বিরক্তি সুরে বললো,” রুহি গ্লাসটা বন্ধ করো। কি দেখছো বাহিরে।”
রুহি চিন্তিত মুখে বললো,” ঐ অ্যাম্বুলেন্সে একজন প্রেগন্যান্ট মহিলা আছে। ওনার হাজব্যান্ড তখন থেকে ছোটাছুটি করে যাচ্ছে। এই ট্রাফিক পুলিশগুলো একটু সাহায্য করছে না। বেচারীর চিৎকার শোনা যাচ্ছে। ”
আহান মাথা তুলে অ্যাম্বুলেন্সটার দিকে তাকালো। তারপর বললো,” তুমি কিভাবে জানো রোগী প্রেগন্যান্ট?”
” আরে একটু আগে লোকটা যেতে যেতে ফোন বললো। এই জ্যামটা কখন ছাড়বে। উফফ কি হবে এবার?”, খুব চিন্তিত হয়ে বললো রুহি।
আহান নিজের সিট বেল্ট খুললো তারপর গাড়ি থেকে নেমে গেলো। আহানকে হটাৎ এভাবে নেমে যেতে দেখে রুহি অবাক হয়ে বললো,” আরে আমাকে একা রেখে কোথায় যাচ্ছেন? আমিও যাবো।”বলে নিজের পাশের দরজাটা খুলতে গিয়ে রুহির মেজাজ বিগড়ে গেল কারণ আহান দরজা লক করে দিয়েছে। আহান রুহির জানালার পাশে এসে দাড়িয়ে, জানালার কাচটা হাতে থাকা বাটনটা দিয়ে অর্ধেক তুলে দিয়ে বলল,” তুমি বসো এখনে আমি আসছি।”
রুহি আর কিছু বলার আগেই আহান ছুটে সেই লোকটার কাছে গেলো। রুহির রাগ হচ্ছে আহানের উপরে কিন্তু রাগটা ঠিক এতোটা না। আহান এভাবে ছুটে ওদের সাহায্য করতে এগিয়ে যাবে রুহি ভাবেনি। আহান এতো ভালো একটা মানুষ সেটা রুহির জানা ছিলো না আবার বদমাইশ ও আছে নিজে গেলো সাহায্য করতে আর তাকে কিনা খাচার মতন গাড়ীতে ভরে দিয়ে গেলো। রুহির তো মনে হয় আহান ইচ্ছে করে তার সাথে এমন করে। রুহি গাড়ির জানালার ফাকে চোখ দিয়ে বাহিরে দেখছে। আহান আর ওই লোকের কোনো খবর নেই আশে পাশে আরো মানুষ জমা হয়ে গেছে। সামনে একটা গাড়ির দুটো টায়ার ফুটো হওয়ায় এই সমস্যা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর আহান আর ওই লোকটাকে একজনকে সাথে নিয়ে আসতে দেখা গেলো। কিছুক্ষণ সেখানে দাড়িয়ে থেকে আহান রুহির পাশে এসে দাড়ালো। রুহি গাড়ীর কাচটায় হাত দিয়ে শব্দ করে বললো,” খুলুন। আমি বের হবো। এখানে ভাল্লাগছে না আমার।”
আহান পকেট থেকে কি টা বের করে গাড়ির কাচটা নিচে নামালো। রুহি দুই হাত বের করে আহানের হাত ধরে টেনে কাছে নিয়ে এলো। আহান এক হাত গাড়িতে রেখে ঝুকে দাড়ালো।
” আমিও বের হবো।”, রেগে বলল রুহি।
” একদম না একটুপর রাস্তা ফাঁকা হয়ে যাবে সামনের গাড়িটা সরানোর ব্যাবস্থা হচ্ছে।”, কড়া ভাবে না করে বললো আহান।
” আপনি নিজে যে বাহিরে আছেন। নিজের বেলায় সব ঠিক।”, মুখ বাকিয়ে বললো আহান।
” তুমি তো ঠিক করে হাঁটতেও পারো না। তোমায় বাহিরে এনে আমি বিপদে পরি, না?”, আহানের কথা শুনে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো রুহি। কথাই বলবে না সে।
আস্তে আস্তে জ্যাম কমতে শুরু করেছে। আহন এগিয়ে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে থাকা লোকটার সাথে কথা নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। আহান গাড়িতে বসার সাথে সাথে ছোটো বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে হেসে ফেললো। রুহি চমকে উঠে বাইরে উকি দিয়ে দেখার চেষ্টায় আছে। বাচ্চা অ্যাম্বুলেন্সে হয়ে গেছে। তারমানে আহানের সাথে তখন ডক্টর ছিলো। বাপরে এই খোলা রাস্তায় ডক্টর পর্যন্ত জোগাড় করে ফেলেছে। যাই হক রুহির ভেবেই অবাক লাগছে এই মুহুর্তে পৃথিবীতে নতুন এক প্রাণ নিঃশ্বাস নিলো। রুহির মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে আছে। আহানের কাছে সেই হাসি টুকু অনেক বড় পাওয়া। রুহির দৃষ্টি বাহিরে আটকে আছে। এর মাঝে সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চার বাবা গাড়ীর পাশে আসলো। পাশে আসতেই আহান জানালা দিয়ে গলা বের করে বললো,” মা আর বেবী সুস্থ আছে তো?”
লোকটা এগিয়ে এসে কান্নাছল চোখে এক গাল হাসি নিয়ে হা সূচক মাথা নাড়ল। ওনার হাসি মুখটা দেখেই মন ভালো হয়ে গেছে রুহির। উনি এগিয়ে এসে আহানের হাত ধরে বললো,” আপনি যদি পাশের হাসপাতাল থেকে ডক্টরকে না আনতেন তাহলে হয়তো এই দিনটা আমার জীবনে সুখের দিন না হয়ে হয়তো সবচেয়ে কষ্টের দিন হতো। আমি আপনার কাছে সারাজীবন কেনা হয়ে থাকলাম।”
আহান লোকটাকে তাড়া দিয়ে বললো,”আরে এটা কোনো ব্যাপারই না। আপনি যান, ওদের আপনাকে প্রয়োজন।”
লোকটা রুহির দিকে একবার তাকালো তারপর যেতে যেতে বললো,” জলদি আপনার জীবনেও এমন একটা সুখবর আসুক।”
এতক্ষন রুহি একগাল হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিল। হটাৎ সুখবর কথাটা শুনে রুহির মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো দিদাও কি এই সুখবরের কথা বলেছে। ভেবেই রুহির মুখ হা হয়ে গেলো, নিজের পেটের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর তার উপর হাত দিয়ে একটা ঢোক গিললো। আহান রুহির এভাবে নিজের পেটের উপর হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে ঘাড় কাত করে তাকালো। রুহির সাথে আহানের চোখে চোখ পরতেই রুহির গাল দুটো লাল হয়ে গেল। রুহি পেট থেকে হাত সরিয়ে এলোমেলো দৃষ্টিতে সামনে তাকালো। মনে হচ্ছে আত্মাটা বেরিয়ে আসবে। আহান গাড়ির ইস্টেয়ারিংয়ে হাত রেখে নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসছে। লজ্জা পেলে এই মেয়েটাকে এতো মিষ্টি লাগে কেনো?
__________
আহানের গাড়ী একটা বিশাল অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাড়ালো। রুহির চেহারায় এখনো লজ্জা মাখা ভাবটা রয়েই গেছে। ব্যাপারটা এমন কিছু দাড়াবে রুহির চিন্তার বাহিরে ছিলো তার ওপর সে আবার আবদার পূরণে কি ইচ্ছুক ছিলো। মারাত্মক লজ্জায় পরেছে সে। সে যে এতো বলদ সেটা তার জানা ছিলো না। আহান গাড়ি থেকে নেমে রুহির পাশে এসে রুহির দরজাটা খুললো। গাড়ির দরজা খোলায় রুহির হুশ ফিরল। দ্বিতীয়বারের মতন তাকে লজ্জায় পড়তে হলো। মাথা নিচু করে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে দাড়ালো। তারপর আহানের পিছু পিছু হাটতে লাগলো। আহান গাড়ির চাবিটা কেয়ারটেকারের হাতে দিয়ে দিলো গাড়ি গ্যারেজে রেখে আসার জন্য। আহান লিফটে উঠে দাড়ালো, রুহি একেবারে মুখে তালা মেরে তার পাশে দাড়িয়ে আছে।
লিফট অষ্টম ফ্লোরে পৌছে দরজা খুললো। এবারও রুহি আহানের পিছু পিছু আসছে। আহান ফ্ল্যাটে ঢুকে রুহিকে দেখিয়ে দিচ্ছিলো কোনদিকে কিচেন। রুহি কোনদিকে তাকাচ্ছে না। সে নিজের রুমের অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছে। আহান গেস্ট রুম কোনটা দেখতেই রূহি বলে উঠলো,” আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে। বাকিটা আমি কালকে দেখে নিবো।”বলে রুহি গেস্ট রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। আহান কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত পেলো না। রুহি দরজা লাগিয়ে লজ্জায় হাত দিয়ে মুখ লুকিয়ে ফেললো।
#চলবে