#বৃষ্টি_ক্লান্ত_শহরে
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৩
কাব্যের কথায় শুভ্রতার কান্নার বেগ যেন আরও বেড়ে গেল। কাব্য ফুস করে একটা নিশ্বাস নিয়ে দুই হাত ধরে টেনে তুলল শুভ্রতাকে। নিজের দুইহাতের মাঝে শুভ্রতার মুখটা আবদ্ধ করে আলতো করে ওর চোখে নোনা জল মুছিয়ে দিয়ে বলল
-“দেখ শুভ্রতা তুমি যতো ভেঙে পরবে মানুষ তোমাকে আরও ভাঙতে চাইবে। মানুষ তোমার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে তোমাকে আঘাত করবে। নিজেকে শক্ত করে শত্রুকে মোকাবেলা করতে পারলেই জীবন সুন্দর। বাস্তবতা অনেক কঠিন শুভ্রতা।”
কাব্য শুভ্রতার দুই হাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে বলল
-“আমি প্রমিস করছি আমি এখন থেকে তোমার পাশে থাকবো। তুমি আমাকে নিজের ফ্রেন্ড ভাবতে পারো।”
হুট করেই শুভ্রতা কাব্যকে জড়িয়ে ধরে ফোপাতে লাগল। কাব্য এতে অবাক হয় নি। কাব্য আলতো হাতে শুভ্রতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
খানিকক্ষণ পর কাব্য ধীর কন্ঠে বলল
-“চলো শুভ্রতা কিছু খেয়ে নেও।”
শুভ্রতা কান্নাভেজা কন্ঠে বলল
-“না আমার ক্ষুধা নেই। আপনি খেয়ে আসুন।”
কাব্য কিছু বলতে নিবে তার আগেই দরজায় টোকা পরলো। আশা বেগমের কন্ঠ শুনে কাব্য উঠে গেল দরজা খুলতে।
আশা বেগম খাবার প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। গম্ভীর কন্ঠে কাব্যকে বলল
-“যা গিয়ে খেয়ে নে। সবাই তোর অপেক্ষা করছে। আমি ওকে দেখে নিচ্ছি।”
কাব্য বাধ্য ছেলের মতো চলে গেল। আশা বেগম ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করে দেখলো শুভ্রতা থ মেরে বসে আছে বেডের উপর। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনি খাবারটা বেড সাইট টেবিলে রেখে বসলো শুভ্রতার সামনে বরাবর। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন
-“তুমি যদি এখন না খাও তাহলে কিন্তু তোমার বাবা কষ্ট পাবেন। বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নেও কোনো কথা আমি শুনতে চাই না।”
শুভ্রতা কিছু বলল না চুপ করে বসে রইল। আশা বেগম ভাত মাখিয়ে শুভ্রতার মুখের সামনে ধরলো। শুভ্রতা টলমল চোখে তাকালো আশা বেগমের দিকে। আশা বেগমের গম্ভীর মুখের আড়ালে যে মমতাময়ী মায়ের রূপ আছে তা বুঝতে দেড়ি হলোনা শুভ্রতার।
আশা বেগম জোর করে শুভ্রতার মুখ ধরে খাইয়ে দিলো। শুভ্রতা কিছু বলতে গেলেই আশা বেগমের ধমকানি খেয়ে দমে গেল। খাওয়ানো শেষে আশা বেগম বের হয়ে যেতেই কাব্যকে দরজায় দেখে বলল
-“ধমকাধমকি করিস না।”
মায়ের কথা শুনে হাসলো কাব্য। কাব্যকে হাসতে দেখে আশা বেগম ভ্রু কুচকে বললেন
-“এখানে হাসার কি হলো।”
কাব্য ফুস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল
-“নিজে এতক্ষণ যে ধমকাধমকি করলে তাতে কিছু হলো না আবার আমাকে বলছো।”
আশা বেগম মুখ ঘুরিয়ে বলল
-“ওটা আলাদা কথা। আমি ধমকাধমকি না করলে ও খাবারটা খাইতো না। পরে অসুস্থ হলে কি হতো। আমাকেই তো তোর বাবা দেখতে বলতো।”
কথাগুলো বলেই গটগট পায়ে চলে গেলেন আশা বেগম। কাব্য মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
কাব্য লাইট অফ করতেই শুভ্রতা বেড থেকে উঠে যেতে নিলেই কাব্য ওর হাত ধরে আটকিয়ে বলল
-“সোফায় যেতে হবে না তোমার।”
শুভ্রতা গুটিসুটি মেরে বেডের বাম সাইডে শুয়ে পরলো। কাব্য ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে বেডে ডান সাইডে আধ শোয়া হয়ে শুভ্রতার মাথায় হাত রাখলো।
শুভ্রতা রিনরিনে কন্ঠে বলল
-“আপনি ঘুমান আমার জন্য চিন্তা করতে হবেনা। আমি ঠিক আছি।”
কাব্য গম্ভীর কন্ঠে বলল
-“তোমার এত কথা বলতে হবেনা চুপচাপ ঘুমাও।”
শুভ্রতা আর কিছু বলল না। চোখ বন্ধ করে রইলো। কিছুতেই ঘুম আসছে না শুভ্রতার। শুভ্রতা কাব্যের দিকে ফিরে দেখলো কাব্য সিলিংএর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শুভ্রতা রিনরিনে কন্ঠে বলল
-“আপনি কি জানেন আমাদের হুট করে কেন বিয়ে হলো!”
কাব্য ভ্রুকুচকে তাকালো শুভ্রতার দিকে। শুভ্রতা সিলিং এর দিকে সোজা হয়ে সেদিকে তাকিয়ে বলল
-“শুনুন তাহলে, আমি যখন কলেজে উঠি তখন থেকেই কাহিনী শুরু। আমাদের এলাকার এমপির ছেলে তীব্র। বড় লোকের অবাধ্য সন্তান বলা চলে। সে কলেজের সামনে মেয়েদের টিজ করে বেড়াতো। ছেলেটা খারাপের সেরা বললেই চলে। যতো খারাপ কাজ ছিলো সব কাজই সে করতো। সে যাইহোক ওর দৃষ্টি আমার উপর পড়ে। সে আমাকে খারাপ কথা ও ইঙ্গিত করায় আমি ওকে একটা থাপ্পড় মারি। এটা নিয়ে ও একদম ক্ষেপে উঠে। বাসায় এসে হুমকি দিয়ে যায়। বাবাকে ডেকে আমাকে বিয়ে করার কথা বলে। আমার বাবা জানতেন ও কেন বিয়ে করতে চাইছে। ওর আগেও দুটো বউ ছিল। যাদের বিয়ের পর সে খুন করে। কিন্তু এই কথা সবাই জানে কিন্তু ক্ষমতার কাছে আর কি। সে যাইহোক আমার বাবা যখন ওর প্রস্তাবে রাজি হয় তখন হুমকি দেয় আমাকে তুলে নিয়ে যাবে। পরে আমাদের বাসায় টাকা গহনা সব দেয়। বাবা সবকিছু ফিরিয়ে দেয়। ওইদিন রাতে বাবা আমাকে আপনার হাতে তুলে দেয়। উনি বলেন আমাকে না পেয়ে ওরা দমে যাবে। কিন্তু…”
কথাগুলো গলায় যেন দলা পাকিয়ে আসছে শুভ্রতার। কাব্য বুঝতে পেরে কাত হয়ে শুভ্রতার দিকে হলো। ধীর কন্ঠে বলে উঠলো
-“আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর। তুমি চিন্তা করো না ওর শাস্তি আল্লাহ নিজের হাতে দিবেন। তুমি শুধু আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। দেখবে ওর শাস্তি ও পাবে। ইহকালে না পাক পরকালে তো পাবেই পাবে। আল্লাহর উপর ছেড়ে দেও।”
শুভ্রতা পরপর কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কাব্য শুভ্রতার মাথার হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। কথাগুলো কাব্যকে বলে একটু হালকা লাগছে শুভ্রতা। চোখ বুজে এলো তার। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল সে।
ড্রিম লাইটের মৃদু আলোতে স্নিগ্ধ লাগছে শুভ্রতাকে। ঘুমন্ত শুভ্রতার মুখে যেন চোখ আটকে গেল কাব্যের। কান্নাকাটি করায় চোখ মুখ ফুলে গেছে। তাতে যেন আরও সুন্দর লাগছে। এর আগে উপন্যাস গল্পে মেয়েদের ঘুমন্ত চেহারার সৌন্দর্যের বিবরণ দেখেছে আজ নিজের চোখে দেখছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মেয়েটাকে যেন এক অসম্ভব মোহনীয় নারী লাগছে। কাব্য শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছে টেরও পায়নি সে।
———————————
সকালে মিষ্টি রোদ শুভ্রতার চোখমুখে আছড়ে পরতেই ঘুম ভেঙে গেল ওর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। হুড়মুড়িয়ে উঠলো সে। এতক্ষণে কাব্যরা চলে গেছে। বেড সাইড টেবিলে একটা চিঠি দেখে ভ্রু কুচকালো শুভ্রতা। শুভ্রতা চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখলো চিঠিতে লেখা
“আজ থেকে না হয় আমাদের সম্পর্কের একটা নাম দেই। বন্ধুত্ব নামক সম্পর্কটা না স্থাপন করি।”
শুভ্রতা মুচকি হাসলো। সে এখন থেকে শক্ত হবে কাব্যের কথাগুলো মনে গেঁথে গেছে তার। সে যদি ভেঙে পরে তাহলে তার বাবা ভালো থাকবেন না।
শুভ্রতা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে চলে গেল বসার রুমে। আশা বেগম চশমা চোখে এটে খাতা দেখছেন। শুভ্রতা গিয়ে পাশের সোফায় বসে বলল
-“শাশুড়ি কি করছেন!”
আশা বেগম তল চোখে একবার তাকিয়ে বলল
-“খাতা দেখছি পরীক্ষার।”
শুভ্রতা গালে হাত দিয়ে বলল
-“একটু দয়া মায়া করে খাতাগুলো দেখেন শাশুড়ি।”
আশা বেগম ভ্রুকুচকে তাকালো শুভ্রতার দিকে। শুভ্রতা বলল
-“মেলা কষ্ট করে ওরা পড়াশোনা করে।”
আশা বেগম বললেন
-“তোমাকে আমি আমার কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবো। যাও রেডি হয়ে আসো।”
শুভ্রতা ঝট করে উঠে বলল
-“না না আমার বিয়ে হয়ে গেছে এখন আবার কেন পড়াশোনা করবো শাশুড়ি। আমার পড়াশোনা ভালো লাগে না। ওটা ছাড়া আর যা বলবেন তাই শুনবো।”
আশা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বললেন
-“তা হবেনা। রেডি হয়ে এসো। তোমাকে পড়াশোনা শেষ করতে হবে। আমি কাব্যকেও বলে দিবো ঢাকার কম্পানির দায়িত্ব ম্যানেজারকে বুঝিয়ে দিয়ে এখানেই থাকতে। পরে তোমার পড়াশোনা শেষে না হয় তোমাকে নিয়ে যাবে।”
শুভ্রতা কিছু একটা ভেবে আশা বেগমের পাশে গিয়ে বসে বলল
-“না পড়লে কি হয় শাশুড়ি। আমি আপনার সেবা যত্ন করবো। সংসার মন দিয়ে করবোনি। আমাকে ছেড়ে দিন শাশুড়ি।”
আশা বেগম কঠোর কন্ঠে বললেন
-“আমি কিছু মানছিনা। আমাদের বাসায় সবাই উচ্চশিক্ষিত। তোমাকেও পড়তে হবে। আমাদের বাসায় সার্ভেন্ট আছে কাজ করার জন্য। তোমাকে এখনি সংসারে মন দিতে হবেনা। যখন সময় হবে তখন আমি নিজেই তোমাকে সব দায়িত্ব দিবো। আর আমার সামনে এতো বাহানা চলবেনা। এখন গিয়ে রেডি হয়ে এসো। ও ভালো কথা টেবিলে খাবার আছে খেয়ে নেও ভালো মেয়ের মতো। দেড়ি হয়ে যাচ্ছে আমার যাও।”
শুভ্রতা আর কিছু বলতে পারলো। বিরবির করতে করতে চলে গেল খাবার টেবিলে।
আশা বেগম হাসলেন শুভ্রতার কাজে। মেয়েটা যে মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে এতে শান্তি মিলছে তার।
শুভ্রতা বকবক করতে করতে খাবার টেবিলে বসেছে দেখে কাকলি ভ্রু কুচকে তাকালো শুভ্রতার দিকে। শুভ্রতা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলল
-“আল্লাহ গো কি শাশুড়ি দিলা গো। আমার পড়াশোনা নিয়ে লাগছে গো। আমার কপালটাই খারাপ কই ভাবলাম বিয়ে হয়ে গেছে আর পড়াশোনা করতে হবেনা।”
কাকলি খেতে খেতে বলল
-“এখনো তো আম্মুকে চেনোনি। তোমাকে যখন পড়াতে বসাবে তখন বুঝবে। আমাদের কলেজের সিনিয়র টিচার আম্মু। সবাই জমের মতো ভয় করে।”
শুভ্রতা চোখ বড় বড় করে তাকালো কাকলির দিকে। অবাক কন্ঠে বলল
-“কি বলছো উনি আমাকে পড়াতেও বসাবেন।”
কাকলি বলল
-“হুম এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে নেও তাছাড়া আম্মু আবার বকবে।”
#চলবে
( আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। রিয়েক্ট-কমেন্ট করবেন ধন্যবাদ।💛)