বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৩৭

0
638

#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩৭)

লাবণ্য যেন সবটা গুলিয়ে ফেলেছে। ওর ভেতরটা এখনো শান্ত হতে পারছে না। পাঁচ বছর আগের উষশী আর এই উষশী যেন আলাদা গ্রহের প্রাণী। অন্যদিকে শান্ত ধীর স্থির অভিরাজ। বত্রিশ বছরেও নিজ সৌন্দর্যের এক চুল কমতে দেয় নি ছেলেটা। তার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইল লাবণ্য। ভীষণ মায়া হলো ওর। উষশী যাওয়ার পর অভি’র ভে ঙে পড়া মুহূর্তের কথা স্মরণ হলো। তারপর থেকে প্রতি সেকেন্ড সে চেয়েছে উষশী ফিরে আসুক। অভি ভালো থাকুক। ছেলেটার ভালো থাকার মাঝেই যেন নিজের সব খুঁজেছে। অথচ তেমন কিছু ঘটে নি। সময় যেতে থাকল। অভি’র সুস্থতার কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। কয়েক বছরেও যখন কিছুই ঠিক হচ্ছিল না তখন ও ভেবেছিল অভি’র পাশে সর্বদা থেকে যাবে। একটা সময় পর ঠিকই ভালোবাসা হবে। একত্রিশ বছর বয়সে এসেও অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবে নি মেয়েটি। আজ যখন হঠাৎ উষশীকে নজরে এল তখন সবটা যেন বদলে গেল। তবু তার মনে কষ্ট ছিল না। শুধু ছিল একটা ধাক্কা। অভি’র ভালো থাকাটা সব চেয়ে গুরুত্ব ওর নিকট। কিন্তু সব যেন বদলে যাচ্ছে।
“উষশী’র সাথে আগে দেখা হয়েছিল তোর?”

“হুম।”

“কবে?”

“প্রথমবার বারে, দ্বিতীয় বার একটা পার্কে আর তৃতীয় বার ও বারে।”

“কেন জানাস নি?”

“কি জানাতাম?”

এ প্রশ্নে মৌনতা ভেসে উঠল লাবণ্য’র মুখে। অভি একটু পাশ ঘুরে বলল,”ব্যথা পেয়েছিস?”

“একটু।”

“সরি লাবণ্য।”

“তুই কেন সরি বলছিস?”

“উষশী তোকে ওভাবে…”

“সরি তো ওর হওয়া উচিত। তুই কেন বলছিস?”

লাবণ্য’র প্রশ্নটা আসলেই যুক্তিসম্মত। মেয়েটির প্রশ্নের বিপরীতে জবাব নেই অভিরাজের নিকট। একটা সময় পর লাবণ্য বলল,”খুব ভালোবাসিস ওকে?”

“বিনা কারণে উষশী আমায় খু ন করলেও ওর প্রতি আমার ভালোবাসাটা কমবে না লাবণ্য।”

ঈশান শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ছেলেটার ভেতর কখনোই শান্তি পায় না। ওর জীবনের রূপ যেন বহু পূর্বেই বদলে গিয়েছে। ফোনের অপর পাশে থাকা ছোঁয়া ভীষণ ক্লান্ত।
“অভি ভাইয়াই ঠিক। আমাদের দুজনের মায়া বাড়ানোটা অনুচিত ঈশান ভাইয়া।”

“তুই কেন আগে বললি না,আমায় পছন্দ করিস? অলকের সাথে তোর সম্পর্কটার কোনো মানে নেই। জোর করে সম্পর্ক করেছে শ য় তা ন টা।”

“সেসব কথা রাখো। এখন থেকে আমরা আর কথা বলব না। কখনোই না। বুঝেছ?”

“হুম।”

দুজনেই নীরব হয়ে রইল। এক মাস আগে ছোঁয়া নিজের ভেতরের সত্য ব্যক্ত করেছিল। তবে মেয়েটির সীমাবদ্ধতার রেখাটা যেন এখনো একটা রহস্য। তবু সব রেখে ঈশান নিজেকে পরিবর্তন করা শুরু করে। যেখানে অলক আর ছোঁয়ার সম্পর্কের কোনো মানে নেই সেখানে নিজের জন্য একটা ভালোবাসার নীড় তৈরি করতে থাকে। অথচ একদমই অনুচিত ছিল সেটা।
“ছোঁয়া।”

“হুম?”

“আমরা আর কখনো কথা বলব না তাই না?”

“হুম।”

“দেখা হলেও না?”

“না।”

“আচ্ছা।”

“হুম।”

“শোন।”

“বলো শুনছি।”

“অনেক বেশি ভালোবাসি তোকে। সুখী হ, আর কখনো আমাদের যোগাযোগ হবে না। কখনো দেখা হবে না। কখনো কথা হবে না।”

ছোঁয়া কিছু বলার পূর্বেই ঈশান কল কেটে দিল। অথচ যদি কলটা না কাটত তবে শুনতে পেত ছোঁয়া’র আর্তনাদ। চিৎকার করে বলা ‘আমি তোমায় কখনো ভুলতে পারব না ঈশান ভাইয়া। আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা তুমি।’

অভিরাজ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নিশ্বাস ফেলল। তারপর কল করল অলকের নাম্বারে। একটা রিং বাজতেই রিসিভ হলো। ছেলেটা যেন ওর কলেরই অপেক্ষায় ছিল।
“ঈশান আর ছোঁয়া আর কখনো যোগাযোগ করবে না।”

“থ্যাংক ইউ ভাইয়া।”

“যদি বিয়ের আগে এসব জানতে পারতাম তবে ছোঁয়া’র সাথে কখনোই তোমার বিয়েটা হত না। আমার বোন ভীষণ বোকা। নতুবা নিজের কথাটা আগে চিন্তা করত। যাক গে সেসব কথা। ছোঁয়াকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে ঈশানের দুঃখ ভুলিয়ে দিও। গত পাঁচ বছরে যা পারো নি তা পাঁচ মাসে করতে পারবে সেই আশা আমি রাখি না। তবে হ্যাঁ মনে রেখো তোমার জন্য আমার বোনের চোখ থেকে এক বিন্দু জল গড়ালে তোমার বাড়িতে সেদিন ই ওর শেষ দিন হবে।”

“মনে থাকবে ভাইয়া। আমি মানছি সম্পর্কটা জোর করে করা তবে ভালোবাসাটা মিথ্যে নয়। ছোঁয়া’র হৃদয়ে আমি না থাকলেও আমার হৃদয়ে ছোঁয়া আজীবন থেকে যাবে।”

হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ল অভিরাজ। তার এত অপরাধবোধ হচ্ছে। সে কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারছে না। চারপাশ থেকে সমস্ত চাপ যেন ক্রমশ আ ঘা ত করে চলেছে। পারিবারিক ঝামেলা গুলো আসলেই সইবার মতো নয়।

লাবণ্য দেখল অভি একের পর এক কফি শেষ করছে। ছেলেটা নিজেকে কাজে ডুবিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এখন প্রায় শেষ রাত। লাবণ্য নিজেও পুরোটা রাত ঘুমায় নি। ছেলেটার শারীরিক স্বাস্থ্য এভাবে অবনতি’র দিকে যাবে। ওপাশে থাকা ডাক্তার নাফিস বলে উঠল।
“মিস্টার অভিরাজ এখনো জেগে?”

“জি। ওর বিষয়টা তো আগেই বলেছিলাম।”

“হুম। উষশী মেয়েটার প্রতি এক অন্যরকম ভালোবাসা ওনার।”

“সেটাই। হুট করেই সেই মেয়েটার সাথে দেখা হয়ে গেল।”

“তাহলে তো ভালো।”

“ভালো নয়।”

“কেন?”

“কারণ মেয়েটা বদলে গেছে। অভি না ওকে ভুলতে পারছে আর না ছাড়তে পারছে।”

“হুম বুঝলাম। তাই ওনি নিজেকে কাজে ডুবিয়ে রেখেছেন, রাইট?”

“একদম।”

লাবণ্য উষ্ণ শ্বাস ফেলল। ডাক্তার নাফিস দীর্ঘদিন ধরে অভিরাজের চিকিৎসা করছে। সেই সাথে লাবণ্য’র কলিগ। অভি’র বিষয়ে নাফিসকে সবটা জানিয়ে কল রাখল লাবণ্য।
“আসব?”

“কবে থেকে অনুমতি নিচ্ছিস?”

“না ভাবলাম যদি কিছু মনে করিস।”

“লাবণ্য। ব্যাপারটা অদ্ভুত হয়ে গেল না?”

“কেন?”

“তুই আমার সব থেকে কাছের বন্ধু। যখন তখন ঘরে আসতে পারিস।”

“হুম।”

অভি কাজ রেখে লাবণ্য’র নিকট এসে দাঁড়াল। মেয়েটা বড়ো ভালো। অভি’র হৃদয়ে ওর জন্য সর্বদা ভালোবাসা কাজ করে। এক বন্ধুর ভালোবাসা।
“উষশী’র কথা গুলো মাথায় রাখিস না।”

“রাখি নি।”

“তাহলে ঘুমাস নি যে?”

“তুই ও তো ঘুমাস নি।”

“আমার তো কাজ ছিল।”

“আমার ও ছিল।”

“সেটা কি? আমার সমস্ত খোঁজ খবর ডাক্তার নাফিস কে দেওয়া?”

কথাটাতে অন্যরকম ইঙ্গিত ছিল। লাবণ্য একটু অবাক হলো বটে। তারপরই সামলে নিয়ে বলল,”তোর সব খবর ওনাকে দিতে হয়। কারণ তোর বিষয় ওনিই দেখেন।”

“জানি তো।”

অভিরাজ আরাম করে বসল। কাহিল হয়ে গিয়েছে তার শরীর। বত্রিশ বছর তো কম সময় নয়। তার উপর একের পর এক ঝামেলা। নিজের যত্ন নেওয়া হয় না। ক্লান্ত অভিকে দেখে লাবণ্য আর সময় নষ্ট করল না। লাইট অফ করে দিয়ে চলে গেল। মেয়েটি চলে যেতেই একটা গরম দীর্ঘশ্বাস ফেলল অভিরাজ। লাবণ্য ওর জীবনে এমন এক সত্য যে সত্যের কোনো নাম হয় না। এ সত্য কেবল অনুভব করা যায়।

এত ভোরে প্রাণীটার সাথে দেখা হয়ে যাবে তা কখনোই ভাবে নি অভিরাজ। কোকো তার ভারী শরীরটা নিয়ে হেঁটে চলেছে। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে ছোট্ট সেই বিড়াল ছানা। সময় কত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়।
“কোকো।”

প্রাণীটাকে কোলে নিয়ে আদর করল অভিরাজ। তারপর এদিকে সেদিক তাকিয়ে বলল,”তোর বন্ধু কোথায়?”

মিউ মিউ করল কোকো। সে কি বোঝাতে চাইছে জানা নেই। তবে কিছু যে বলতে চায় সেটা বোঝা যাচ্ছে। অভিরাজ কোকো কে কোলে নিয়েই চারপাশ ঘুরল। কিন্তু কোনো মানুষ নজর এল না। একটু দূরে আসতেই কোকো লাফাতে শুরু করল। কোল থেকে নেমে একটা সুন্দর বাড়ির কাছে এসে অভিরাজের উদ্দেশ্যে মিউ মিউ ডাকল। অভি কি মনে করে যেন ভেতরে প্রবেশ করল। বাড়িটা ভীষণ সুন্দর আর পরিপাটি। কোকো তার প্যান্ট ধরে টানাটানি শুরু করেছে। প্রাণীটিকে কোলে নিতে গেলেই ছুটে পালাল। তার পিছু নিয়ে আসতেই দেখা মিলল লাস্যময়ী যুবতী উষশী’র। মেয়েটির শ্বেত রঙা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। তার বাদামি চুল গুলো কাঁধের কাছে এসে লুটপাট করছে। তবে কি বিশ বছর বয়সী যুবতী উষশী আরো একবার অভিরাজের মন কেড়ে নিল?

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here