#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩০)
অভিরাজের বদল চোখে পড়ার মতো। কেউ ভাবতেই পারে না আদৌ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে ছেলেটা। পাঁচটা বছর লাগল স্বাভাবিক হতে! এখন সে সাধারণ ভাবে সব দেখা শোনা করছে। অভিরাজের বাবা আসাদ সিনহা’র দু চোখ টলমল করে উঠল। এতদিন পর বুকের ভেতরটা হালকা মনে হচ্ছে। লাবণ্য বেশ সময় নিয়ে খাবারের আয়োজন করেছে। সকাল থেকে একা হাতে রান্না করেছে। অনেক দিন পর বাড়ির সকলে একসাথে হয়েছে। ঈশান ফোনের মধ্যে ডুবে আছে। তার স্বভাবের বদল ঘটেছে অনেক দিন হলো। অভিরাজের খাবারটা লাবণ্যই সাজিয়ে দিল। সকলকে খাবার দিয়ে বসল লাবণ্যও। প্লেটে মাছ নিয়ে বসে আছে মেয়েটি। সেটা লক্ষ্য হতেই মৃদু হাসল অভিরাজ। অতীতের মতোই মাছ বেছে দিয়ে লাবণ্য’র প্লেটে তুলে দিল। আমিনা’র ভেতরটা সুখে ভরে উঠেছে। লাবণ্য’র চোখ একটুখানি সুখেই কেমন চিকচিক করছে। খাবারের টেবিলে একটি কথাও হচ্ছিল না। অভিরাজই বলল,”ডেনমার্কে আবারো আমাদের কোম্পানি’র ব্রাঞ্চ ওপেন করতে চাচ্ছি। তোমাদের কি মতামত?”
ছেলের কণ্ঠটা শুনতে পেয়ে ঘোরের মধ্যে চলে গেলেন আসাদ সিনহা। আমিনা স্বামীর বাহুতে স্পর্শ করলেন।
“অভি কিছু বলেছে।”
“হুম। কি বলছিলে তুমি?”
“আমাদের বিজনেসের প্রফিটের বড়ো অংশ আসত ডেনমার্কের ব্রাঞ্চ থেকে। সেখানে সকল সুবিধা রয়েছে। ক্লাইন্টরা ও যথেষ্ট কো অপারেটিভ। মাঝে আমাদের নাম খারাপ হলেও আমার ধারণা একটু চেষ্টা করলেই সবটা ঠিক করা পসিবল।”
আসাদ একটু ভেবে বললেন,”দেশের ব্রাঞ্চ গুলোও বর্তমানে বেশ সফলতা পাচ্ছে।”
“শুধু দেশের উপর নির্ভর হলে চলবে না আব্বু।”
“তুমি যদি দায়িত্ব নিয়ে সবটা শুরু করো। আমার কোনো অসুবিধা নেই। তোমার চাচ্চুও নিশ্চয়ই দ্বিমত করবে না।”
আতিফ সিনহাও ভাইয়ের কথায় সায় দিলেন। অভিরাজের খাবার খাওয়া প্রায় শেষ। সে হাত ধুয়ে নিল। আমিনা এসে ছেলের হাত মুছিয়ে দিলেন।
“এতটাও বাচ্চা নই মা।”
“মায়ের কাছে সন্তান’রা সর্বদা বাচ্চাই থাকে বাবা।”
আমিনা’র ব্যথাটা বুঝতে পারল অভিরাজ। বহুদিন পর মা কে শক্ত করে আলিঙ্গন করল সে। এতেই যেন আমিনা’র দুটি নয়ন নোনা জলে সিক্ত হয়ে গেল। অবেশেষে সব কিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে!
অতীত
অভিরাজের ঘরে এসে বসেছে উষশী। ছেলেটা গোসল করতে গিয়েছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। মেয়েটি এবার অধৈর্য হয়ে পড়ল।
“হলো আপনার?”
“এই তো হয়ে গেছে।”
কথা শেষ হতেই বেরিয়ে এল অভিরাজ। তার সিক্ত চুল গুলো কপালে লেপ্টে আছে। উষশী একটু উঁচু হয়ে সেটা ঠিক করে দিল। সুযোগ নিতে ভুল করল না অভিরাজও। মেয়েটির কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিল। ওর উন্মুক্ত বুকের জল বিন্দু ভিজিয়ে দিল শ্বেত রঙা মেয়েটিকে।
“ইস, ভিজিয়ে দিলেন তো।”
“একটু আধটু ভিজলে কিছু হবে না। চেঞ্জ করে নিও।”
“সবাই কি ভাববে।”
“কি ভাববে?”
“আপনার ঘর থেকে ফিরেই আমি জামা বদলে নিলাম। বুঝতে পারেন বিষয়টা কতটা লজ্জার?”
“অত লজ্জা পেতে হবে না মিস। আপনি ড্রেস চেঞ্জ করে নিবেন। আধ ভেজা কাপড়ে থেকে জ্বর বাঁধানোর কোনো প্রয়োজন নেই।”
“আপনি যে কি করেন!”
“তুমিই কাছে এসেছ।”
“আমার ইনটেনশন ওমন ছিল না।”
“বাট আমার ছিল।”
“শ য় তা ন লোক।”
উষশী দূরে সরে এল। অভিরাজ তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে নিচ্ছে। সামনে থাকা বড়ো মিররে উষশী’র মুখটা দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা মুখ গোমড়া করে রেখেছে। ওর মন ভালো করার জন্যেই এগিয়ে এল অভিরাজ। পায়ের কাছটায় বসে বলল,”অভিমান ভাঙানোর জন্য কি করতে হবে?”
“চুমু খেতে হবে।”
বাক্যের সমাপ্তিতেই চুমু খেল অভিরাজ। এতটা দ্রুত ঘটে গেল বিষয়টা ধরতেও পারলা না উষশী। পুনরায় ওমন কিছু ঘটার পূর্বেই ছোট্ট পেঁজা তুলোর ন্যায় উষশী পালিয়ে গেল। এতেই যেন মিউ মিউ করে ডেকে উঠল কোকো। প্রাণীটা যেন অভিরাজের কাছে উষশী’র পালিয়ে যাওয়া ব্যক্ত করতে চাইছে। উষশী পালিয়ে গিয়েছিল। তবে অভিরাজ পিছু আসে নি বিধায় ফের এসেছে। এখন সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে।
“কোকো, এদিকে আয়।”
কোকো যেতে নিলেই খপ করে ধরে ফেলল অভিরাজ। উষশী হাবুলের মতো তাকিয়ে। শক্ত পোক্ত দেহের অভিরাজ তাকে না দেখার মতো করে বলল,”চল রে কোকো। তোকে নিয়ে আজ বিশ্ব ভ্রমণ করে আসি।”
ঈশান আর উষশীকে একসাথে নিয়ে বেশ বাজে মন্তব্য ছড়িয়েছে নিয়াজী বাড়ির ছোট ছেলে নকিব নিয়াজী। গতদিনই এসব কানে এসেছে অভিরাজের। বিষয়টা প্রথম থেকেই তার মস্তিষ্কে তাড়া করছিল। সারাটা রাত ঘুম হয় নি। উষশী’কে নিয়ে একটা বাজে কথা সহ্য হয় না ওর। সেখানে অত গুলো মিথ্যে রটানো তো কখনোই সহ্য হওয়ার কথা না। সেই জন্যেই তিক্ত মেজাজে দুপুরে বের হয়েছে। নকিবের দিন আসলেই খারাপ। নতুবা পথিমধ্যেই কেন অভিরাজের সাথে দেখা হবে? অভিরাজ কে ছোট থেকেই ভয় পেলেও সময়ের স্রোতে আজ তার সাহস বেড়েছে। সেটাও পরিমাণে একটু নয়। অভিরাজ নিজেকে সংযত করতে চাইলেও নকিবের তিক্ত হাসিটা সহ্য হলো না। পর পর লাথি মা র ল পিঠ বরাবর। আ ঘা তে লুটিয়ে পড়ল নকিব। তার সাথে থাকা ছেলেটা ছুটে গিয়ে উঠাল ওকে। নকিবারের শরীর মাটিতে মেখে গিয়েছে। তাকে অদ্ভুত প্রাণী মনে হচ্ছে।
“আ ঘা তটা কেন করেছি সেটা বোধকরি মনে থাকবে।”
“কাজটা ঠিক করলি না অভিরাজ সিনহা।”
“কোন কাজ ঠিক আর ভুল সেটা আমি বুঝে নিব। তবে আমার ভাই আর উষশী’কে নিয়ে আর একটা বাজে মন্তব্য করলে তোর জ্বিভ ছিঁড়ে নিব।”
“সত্যি বললেই তো তোদের সমস্যা হয়। ঐটুকু একটা ভোলা ভালা মেয়েকে নিয়ে দুই ভাই ফুর্তি করে বেড়াচ্ছিস লজ্জা হয় না?”
আত্মসম্মানে প্রচন্ড আ ঘা ত লাগল অভিরাজের। সে নিজের রাগটাকে একটুও সামলাতে পারল না। কোকো তার পাশেই ছিল। অভিরাজের মুখের ভঙ্গিমা দেখে সে মিউ মিউ করছে। নকিবের উস্কানিমূলক কথাবার্তা আসলেই সহ্য হলো না ছেলেটার। নিজের শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে উন্মাদের মতো আ ঘা ত করতে লাগল। ইতোমধ্যেই লোকজন জড়ো হয়ে গিয়েছে। কোথা থেকে যেন ছুটে এসেছে উষশীও। তার পাশে রয়েছে কোকো। প্রাণীটা বার বার ডেকে চলেছে। অভিকে এতটা বেপরোয়া হতে দেখে উষশী বের ভরকে গেল। তার মন মস্তিষ্ক চলছে না ঠিক। মাথাটা কেমন ভন ভন করতে লাগল। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হতে শুরু করেছে। জ্ঞান শূন্য হওয়ার পূর্বে “অভিরাজ” নামটি উচ্চারণ করল মেয়েটি।
এক সন্ধ্যা ম রা র মতো ঘুমিয়েছে উষশী। ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল সে। কোকো যখন তার কাছে ছুটে এল তখনি বেরিয়ে পড়েছিল। পথে অভিকে ওমন বেপরোয়া হতে দেখে বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল সব ধ্বংস হতে শুরু করেছে। ঘুম ভাঙতেই লাবণ্য বলল,” উঠো না। রেস্ট নাও। আমি অভিকে ডেকে দিচ্ছি।”
লাবণ্য যেন ইদানীং উষশী’র মন পড়তে পারছে। চোখের দৃষ্টিতেই কেমন বুঝে গেল। অভি এল একটু বাদে। হাতে স্যুপের বাটি। মুখের ভঙ্গিমা বেশ গম্ভীর। ছেলেটার এমন রূপ এর আগে দেখে নি কিশোরী। তাই একটু কেমন অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব রাগ করেছে। স্যুপের বাটি থেকে স্যুপ তুলে খাওয়াল অভিরাজ। এই সময়ে উষশী একটা কথাও বলে নি। বলে নি অভিরাজ ও। দুজন যেন মৌনতার সাথে মিতালি গড়েছে। ছেলেটা যখন উঠে যাচ্ছে তখনি শার্টের হাতা টেনে ধরল উষশী। কিশোরী’র ভেজা কণ্ঠ।
“রেগে আছেন?”
“না।”
“কণ্ঠটা এমন লাগছে কেন?”
“এমনি।”
“বুঝেছি।”
“কি?”
“রেগে আছেন।”
উষ্ণ শ্বাস ফেলল অভিরাজ। মেয়েটার সাথে রাগ করাও যায় না। কিশোরী মাথা নিচু করে রইল। খারাপ লাগছে। অভি তার খুব নিকটে এসে দাঁড়াল। দুজন দুজনার শ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
“ওখানে গিয়েছিলে কেন?”
“আপনি ওকে ওভাবে মারছিলেন কেন?”
“কারণ ও একটা…”
অত্যন্ত বাজে শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়েও করল না অভিরাজ। বরং নিজেকে সামলে নিয়ে উষশী’র নরম তুলতুলে হাতটা মুঠো বন্দী করল। পর পর শ্বাস নিয়ে বলল,”ভয় পেয়েছিলে খুব?”
“হুম।”
“কিছু হয় নি। এত ছোট্ট জিনিসে ভয় পাবে না কেমন?”
“আচ্ছা।”
“এখন তাহলে রেস্ট নাও।”
“আপনি পাশে থাকবেন প্লিজ?”
অভিরাজ যেতে নিয়েও থেমে রইল। যদিও হাজার খানেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু মন সে তো কোনো সীমাবদ্ধতা মানতে চাইছে না। কিশোরী’র সুন্দর মিষ্টি কণ্ঠের আকুলতা বেশ তাগাদা দিচ্ছে। সত্যিই থেকে গেল ছেলেটা। যতক্ষণ না গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল তার ছোট্ট তুলতুলে ব্যক্তিগত বৃষ্টি।
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
|