বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ২৫

0
679

#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২৫)

বাদামি রঙের চুলে কিছু নাম না জানা সাদা ফুল। গলায় ছোট্ট একটা মালা। হাতে চিকন ব্রেসলেট। তার বরফ সাদা মুখে হাল্কা প্রসাধনী’র ছোঁয়া। শরীরে জড়ানো বাঙালি পোশাক। পুরোদস্তুর বাঙালি মেয়ে,বউ হয়ে উঠেছে উষশী। অভি বেশ তাড়াহুড়া করছিল। মেয়েটির এমন রূপ দেখে তার পথ চলা বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ অস্বস্তি অনুভব করছে কিশোরী। একে একে তার উপর দৃষ্টি পড়ল সবার। রত্না মিটিমিটি হাসছে।
“ওকে কেমন দেখাচ্ছে? ভীষণ সুন্দর না? শাড়িতে একদম বাঙালি হয়ে উঠেছে।”

কিশোরী’র প্রশংসা করতে কেউ ই দ্বিধা করল না। অভিরাজ কিছু সময় পর বলল,”লেট হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত চলো সবাই।”

উষশী গল্প করছে। তাকে বেশ খুশি দেখাচ্ছে। লুকিং গ্লাসে মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে। এতেই যেন দৃষ্টিবদল হয়ে পড়ল। ওর অবস্থা দেখে ঈশান বলেই ফেলল,”ব্রো আমি ড্রাইভ করি। না হলে সবাইকে ভোগে যেতে হবে।”

“বে য়া দব! বড়ো ভাই এর সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”

ঈশান ফের হাসল। অভিরাজ নিজেকে শক্ত করে গাড়ি চালনায় মনোযোগ দিচ্ছে। মেলার ভেতরে সবাই যখন যাচ্ছিল তখন অভি হাত আটকে দিল উষশী’র। মেয়েটি ছটফট করতে করতে শুধাল,”হাত ধরে রাখলেন কেন? ওরা তো চলে যাচ্ছে।”

“চলে যাওয়ার জন্যেই আটকে রেখেছি।”

“আমি কিভাবে ঘুরব?”

“ঘুরবে না।”

“মানে!”

“আমার সাথে যাবে।”

“আরে,আমি গ্রামের মেলা দেখি নি কখনো। আমি যাব।”

“সেটা হচ্ছে না মিস।”

অভিরাজের আলিঙ্গনে উষ্ণতা পেল উষশী। একটু নরম হয়ে এল তার কণ্ঠটা।
“মেলা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল।”

“সন্ধ্যায় মেলা ঘুরাব। এখন আমরা আলাদা টাইম স্পেন্ড করব। এখানে আসার পর তোমাকে কাছে পাওয়া বড়ো দুষ্কর হয়ে উঠেছে রেইন। তুমি কি একটুও মনে করো না আমায়?”

উষশী এ প্রশ্নের উত্তর দিল না। তবে সে মনে করেছে। প্রতি বেলা প্রতিক্ষণ মানুষটাকে মনে করেছে সে। একটা শুনশান রাস্তায় এসে দাঁড়াল ওরা। এখানটা ঘন জঙ্গল বলা চলে। চারপাশ জুড়ে বিশাল রেইনট্রি গাছ। সেগুলো যেন কথা বলছে। নিস্তব্ধ পরিবেশে ওদের শ্বাস গুলো কেমন ভয়ঙ্কর সুর তুলেছে। কিছুটা ভীত হয়ে গেল উষশী। অভিরাজের কোমর চেপে ধরে রইল। ওর ভয় দূর করতে শক্ত করে ধরে রইল অভিরাজও। তারা যে পথ ধরে চলছে সাধারণত এ পথে কেউ আসে না। এই রাস্তাটা বেশ পুরনো। জঙ্গলের পথে বিধায় চলাচল নেই। উষশী কেমন চুপ করে গেছে। ওর এই নীরবতায় চারপাশ যেন কাঁদছে।
“ভয় পাচ্ছ?”

“হুম।”

“বোকা মেয়ে। ভয়ের কিছু আছে এখানে? তাছাড়া যে মেয়েটা রাতের আঁধারে শহরের রাস্তায় একা থাকার মতো সিদ্ধান্ত নেয় সেই মেয়ে দিনের বেলায় ভয় পায়!”

“তখন তো অন্যরকম ছিল সব।”

“কি রকম ছিল?”

“পিছুটান ছিল না। শুধু মনে হয়েছিল মম কে পেলেই হবে।”

“আর এখন?”

“এখন তুমি আছ। প্রচন্ড ভয় করে আমার। যদি তোমায় হারিয়ে ফেলি।”

উষশী’র কণ্ঠে তুমি ডাকটা বড়ো মধুর শোনাল। মৃদু হাসল অভিরাজ। তারপর নিচু হয়ে শুধাল,”ভালোবাসো?”

“জানি না। তবে আপনার সঙ্গ আমায় আনন্দ দেয়। আপনিই তো বলেছেন আমরা সম্পর্কে আছি।”

একটা মিশ্র অনুভূতি পেল অভিরাজ। উষশী অন্যদের থেকে খুব আলাদা। সে বাঙালি মেয়েদের মতো সহজে ভালোবাসা বুঝতে পারে না। প্রকাশ ও করতে পারে না। তার পরিবেশ ভিন্ন। এত ভিন্নতার মাঝেও কোথাও একটা সুখ খুঁজে বেড়ায় অভিরাজ। মনে হয় তুলোর মতো দেখতে মেয়েটি তার খুব আপন। তাকে ছাড়া এ জীবন কাটানো অসম্ভব।

নদীর ধারে চলে এসেছে ওরা। সেখানে দু একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে। আকাশে তেমন রোদ নেই। মনে হচ্ছে একটু বাদেই বৃষ্টি হবে। এই সময়ে গ্রামের সকলের মন খারাপ হয়ে গেলেও উষশী ভীষণ আনন্দিত। ওর কাছে বৃষ্টি মানেই ভালো লাগা। বৃষ্টি মানেই অন্য এক অনুভূতি। ঠোঁটের কোণের দীঘল হাসির দিকে তাকিয়ে মাঝিকে ডেকে নিল অভিরাজ। মাঝি আকাশের অবস্থা দেখে বলল,”মামা এহন তো যাওন যাইব না। যে বৃষ্টি আইতেছে।”

“আমরা বেশিদূর যাব না মামা।”

“টাকা কিন্তু বাড়ায় দেওন লাগবে।”

“সেটা নিয়ে ভাববেন না।”

মাঝি নৌকা তীরে নিয়ে এল। উষশী একটু ভয় পাচ্ছে। ছোট্ট পাতলা নৌকা ক্ষণে ক্ষণে দোল খাচ্ছে।
“হাত ধরে থাকো।”

উষশী হাত ধরে রইল। অভিরাজের শক্ত পোক্ত বড়ো হাতটার মাঝে ওর নরম তুলতুলে ছোট্ট হাত গলে গেল। মৃদু বাতাসে শীতল হয়ে এল শরীর। খানিক বাদেই উষশী অনুভব করল শীত লাগছে না। বরং কোথা থেকে যেন উষ্ণতা এসে জড়িয়ে নিচ্ছে। অভিরাজের মুখটা একদম ঘাড়ে মিশে আছে। নড়লেই কেমন একটা শিরশির অনুভূতি হয়।
“চুপ করে বসে থাকো। নড়লেই পড়ে যাবে।”

“এত কাছে আপনি!”

“কেন ভালো লাগছে না?”

“লাগছে তো।”

“তাহলে?”

“বুকের ভেতর কেমন লাগছে।”

“কেমন?”

“জানি না। এক মিশ্র অনুভূতি। না ছাড়তে পারব আর না এভাবে থাকতে পারব।”

অভিরাজ হাসল। সে হাসি’র শব্দ কেবল উষশী’র কানেই পৌছাল। একটা সুন্দর পরিবেশ। চারপাশে বিশাল বিশাল ঝাউ গাছ। আরেকটু বাদেই আকাশ চমকাতে লাগল। সে শব্দে কেঁপে উঠল উষশী। তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিল অভিরাজ। হাল্কা নরম বাতাসে ভেসে আসছে মন ভালো করা সুর। একটা উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ায় কিশোরী। বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় শরীর। শাড়ি লেপ্টে যায় শরীরে। উষশী’র কোমল উদর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অভিরাজ তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে। প্রিয়তমার সৌন্দর্যের এক বিন্দু ভাগ দিবে না কাউকে। সবটাই শুধু তার।

বৃষ্টির জন্য মেলার ছোট ছোট দোকান গুলোর বাইরে ভীড় কমে গিয়েছে। সবাই জড়সড় হয়ে আশ্রয় নিয়েছে চারপাশে। ওমন সময় রত্না’র কণ্ঠ বেজে উঠল।
“বিরক্তি, এই সময়েই কেন বৃষ্টি নামতে হলো!”

“ঘোরাঘুরির বারোটা বেজে গেল।”

“হুম। কখন থামবে কে জানে। রাতের যাত্রাটা বুঝি দেখতেই পাব না।”

“থেমে যাবে। এত চিন্তা করো না।”

“হুম।”

ইরা আর রত্নার কথা গুলো শুনতে শুনতে হঠাৎ করেই অভিরাজ আর উষশী’র কথা স্মরণ হলো লাবণ্য’র। এরা তো সাথে নেই। আলাদা ঘুরছে নিশ্চয়ই। লাবণ্য চারপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছে।
“কি দেখিস আপু?”

ঈশান ওদের সাথেই আছে। তবে বড়ো চুপচাপ ছিল। হঠাৎ লাবণ্যকে প্রশ্ন করায় সকলেই নজর দিল।
“কিছু না।”

“তোরা কি আরো ঘুরবি?”

“হ্যাঁ।”

“আমি তাহলে চলে যাচ্ছি। ভালো লাগছে না।”

“কেন?”

রত্নার প্রশ্নে ঘুরে তাকাল ঈশান। একটু শ্বাস ফেলে বলল,”এই বৃষ্টির মাঝে থেকে কি করব?”

“রাতে যাত্রা আছে তো। তাছাড়া আরেকটুপর ই বৃষ্টি থেমে যাবে। থেকে গেলে কি হয়?”

রত্নার সাথে সাথে ইরা ও জোরাজুরি করতে লাগল। ঈশানের ভালো লাগছে না। তবু থাকতে হলো তাকে।

কাক ভেজা হয়ে ফিরল উষশী,অভিরাজ। এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আকাশ এখনো অশান্ত হয়ে আছে। আজ বৃষ্টি থামবে বলে মনে হচ্ছে না। লাবণ্য অনেক সময় ধরেই কল করছিল। গাড়িতে এসে ফোনের স্ক্রিনে মিস কল দেখতে পেল অভিরাজ।
“কোথায় তোরা?”

“মেলার বাইরে আছি।”

“ভেতরে আসছিস না কেন?”

“এই বৃষ্টিতে কি করব? তাছাড়া যাত্রাপালা ও ক্যানসেল হয়ে গেছে। আর উষশী,আমি দুজনেই নদীতে নৌকা নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। বৃষ্টিতে ভিজে অবস্থা বেশ খারাপ। এখন আর মেলায় যাব না। সোজা ফিরে যাচ্ছি।”

এই অবধিই কথা হলো ওদের। লাবণ্য’র এত খারাপ লাগল। উষশী আর অভিরাজের ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত চোখে ভাসছে। নৌকায়, বৃষ্টিতে ঠিক কতটা কাছাকাছি ছিল তারা সেটাই কল্পণায় আসছে। বুকের ভেতরের রিক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমশ। যন্ত্রণায় পুরো শরীর পু ড়ে যাচ্ছে। দু চোখ গভীর লাল। বৃষ্টির মধ্যেই দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ল সে। বৃষ্টির জলে দু চোখের নোনা জল মিশে যেতে লাগল। যেন কষ্ট লুকানোর নিদারুণ প্রয়াস।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here