বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ২২

0
757

#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২২)

“কি ব্যপার! ঘুমাও নি কেন?”

“ঘুম আসছিল না।”

“কেন? ঘুমের আবার কি হলো?”

“রাগ হয়েছে।”

“তা রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করলে না?”

“না। রাগ ভাঙাতে গেলে সে বলবে ঢং করতে এসেছি।”

“মাঝে মাঝে ছোট খাটো ঢং মন্দ নয়।”

বাক্যটি শুনতে পেয়েই উঠে এল উষশী। সঙ্গে সঙ্গে অভিরাজের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,”এত নিষ্ঠুর কেন আপনি?”

“নিষ্ঠুর কেমন করে হলাম?”

“বললাম ঘুম আসছে না। তাও কাছে টেনে আদর করলেন না।”

“সবসময় আদর করা যায় না বাবা। একটা সীমাবদ্ধতা থাকে।”

“না,না আমার জন্য কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। আমি অভিরাজের,আর অভিরাজ আমার। এর বাইরে আর কোনো সত্য নেই।”

মেয়েটির এই কথায় হেসে ফেলল অভিরাজ। ধীরে ধীরে বাদামি রঙা চুল গুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে শুধাল,”বিয়ে করতে হবে না?”

“হবে। চলেন এখনি বিয়ে করে ফেলি।”

বাচ্চাদের মতো আচরণ হয়ে এল কিশোরীর। অভিরাজ একটু শক্ত গুমোট করল মুখশ্রী।
“সবে পনের বছর বয়স তোমার। আঠারো হওয়ার জন্য আরো দুই আড়াই বছর সময় লাগবে। কোনো ভুল নয় রেইন।”

মন খারাপ করে ফেলল মেয়েটি। অভি ওকে টেনে পাশে বসাল। মন ভালো করার প্রয়াসে গালে গাল স্পর্শ করাল।
“এই তো আদর করে দিলাম। এবার ঘুমিয়ে পড়।”

উষশী ঘুমিয়ে পড়ল। তবে অভিরাজের হাতটা শক্ত করে চেপে রাখল। ওর কান্ডে না হেসে পারল না অভিরাজ। তার গলাটা এক অন্যরকম অনুভূতিতে শুকিয়ে এসেছে। এত কাছে এসেও পারছে না সর্বোচ্চ ভালোবাসায় সিক্ত হতে। প্রতিটা প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার হৃদয়ের গলিতেই সুপ্ত বাসনা লুকিয়ে থাকে। শুধু সঠিক সময় আর পরিস্থিতির কারণে ব্যক্ত হয় না। আর যারা সীমাবদ্ধতা ধরে রাখতে পারে তাদের প্রেমই হয় শুদ্ধ।

ছোঁয়া’র বিদায় হয়ে গেছে অনেকটা সময়। বাড়ির আনাচে কানাচে লোকজন। লাবণ্য’র বান্ধবী’রাও এসেছে। সেই জন্যেই অভিরাজের রুমে ঘুমিয়েছে উষশী। মেয়েটা একটু অন্যরকম। সবার সাথে সহজে মিশতে পারে না। উষশী’র ঘুম গভীর হতেই উঠে এল অভিরাজ। দরজা লক করে বেরিয়ে পড়ল ট্রেরেসের উদ্দেশ্যে। সেখানে আজ ঈশানের আধিপত্য। ছেলেটা বার বার করে বলে দিয়েছে কেউ যেন এখানে না আসে। তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে সবাই। তবে অভিরাজ সর্বদাই বিপরীত। সে এল। তার সঙ্গ পেয়ে ঈশানের মোটেও খারাপ লাগল না। সে যত্ন নিয়ে গ্লাস সাজাচ্ছে। অন্য সব প্রেমিকদের মতো মদ খেয়ে সিগারে বুক পুড়িয়ে নিজের কষ্ট জানান দিচ্ছে না ঈশান। সে নীরবে বুকের ভেতর কষ্ট পুষে রাখছে। তার এই অস্বচ্ছ ব্যথাটা অভিরাজের চোখে পড়েছে। সে গ্লাসে সফট ড্রিঙ্কস ঢেলে নিয়ে বলল,”ছোঁয়াকে পছন্দ করিস সেটা আগে কেন বলিস নি?”

এ প্রশ্নের জবাব মিলল না। অভিরাজ আরো একটা গ্লাসে সফট ড্রিঙ্কস নিয়ে নিল। ছোঁয়ার বিয়ে কিছু সময় পূর্বে এই সব তাকে জানিয়েছে উষশী। কিন্তু তখন কিছু করার ছিল না। অবশ্য আগে জানালেই বা কি হতো?

আকাশের চাঁদ থালার মত বিশাল। সম্ভবত পূর্ণিমা আজ। ছোঁয়া’র সংসারকে মন প্রাণ ভরে দোয়া করছে স্বয়ং চাঁদ ও। আর এদিকে হিংসেয় জ্বলে যাচ্ছে ঈশানের বুক। সে বড়ো অতৃপ্ত, কাঠ হয়ে যাওয়া কণ্ঠে বিদ্রুপ মাখা হাসিতে হেসে উঠল।
“চাঁদ ও আমায় অবহেলা করে।”

ঈশান এক নয়নে আকাশের পানে তাকিয়ে রইল। চাঁদ কে ঘিরে আছে হাজার হাজার ছোট ছোট আলো। যা তারা নামেই পরিচিত। চাঁদের অহংকার ঈশানকে তেতিয়ে দিল। তার মুখ থেকে হিস হিস শব্দ বেরিয়ে পড়ল।
“সবাই হারামি। কেউ স্বার্থহীন না। সবাই স্বার্থপর।”

মাতাল না হয়েও মাতলামি শুরু হলো ঈশানের। এই সময়টা অভি চুপ করে রইল। তার চিত্ত থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরোচ্ছে কেবল। একটা ব্যথা তর তর করে পা থেকে উঠে গিয়ে মস্তিষ্ক অবধি অবশ করে নিচ্ছে। ভাইকে সান্ত্বনা দেবার মতো শব্দ নেই তার বিশাল শব্দভান্ডারে।

এত কিছুর মাঝে সাতটা দিন পেরিয়ে গেছে। নানান ঝামেলা কিংবা স্ব ইচ্ছেতেই উষশী’র বাড়ির লোকের খোঁজ বন্ধ ছিল। বিমানবন্দর থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে উষশী’র মা সাব্রিয়া পল স্লোভেনিয়ায় ফিরে যান নি। এ কথাটা উষশীকে জানানো হলো। মেয়েটি বেশ মনমড়া হয়ে গেল। অভি’র ও ভালো লাগছিল না। তার উচিৎ ছিল আরো আগে থেকে জোর দেওয়া। সেদিনই উষশীদের লোকাল গার্জেনের বাড়িতে যাওয়া হলো। সেখানে গিয়েও হতাশ হতে হলো। কাউকেই খুঁজে পাওয়া গেল না। এত হতাশার মাঝে উষশী যেন ভেঙে পড়ছিল। এদিকে ঈশানের অবস্থাও খারাপ হচ্ছিল। মাঝে ঠিক হলো গ্রামের বাড়িতে যাবে। সেখানে অভিরাজের চাচাতো দাদা দাদি রয়েছেন। ওনারাই ওদের বংশের সব থেকে বয়স্ক সদস্য। বেশ কিছু বছর ধরে যাওয়ার কথা থাকলেও যাওয়া হচ্ছিল না। ছোঁয়া’র বিয়েতে এসে খুব করে বলে গেছেন। সকলের হাতে কিছু সময় থাকাতে এবার যাওয়াটা নিশ্চিত হয়ে গেল। উষশী কখনো গ্রামে যায় নি। তার উত্তেজনা বেশ। অভি’র রুমের কাছে ঘুরঘুর করছিল। তবে লাবণ্য’র সাথে কি যেন কথা বলছে। তাই সে আর এল না। ইরার রুমে এসে বসে রইল। গোসল শেষে উষশীকে দেখে বলল ইরা।
“আরে, তুমি কখন এলে?”

“একটু আগেই এসেছি।”

“ভালো করেছ। এমনিতে তো আসোই না।”

“ইরাপু গ্রাম কেমন হয়?”

“গ্রাম দেখো নি কখনো?”

“না।”

“গেলেই দেখতে পারবা। আগে বলে দিলে তো স্পয়লার হয়ে যাবে।”

ইরা চুল মুছে নিয়ে উষশী’র পাশে বসল। তাদের মাঝে কিছু সময় আলাপ হলো। এর মাঝেই ফোন এল ইরার। মেয়েটি ব্যস্ত হতেই বেরিয়ে পড়ল উষশী। অভিরাজের ঘর ফাঁকা। মন খারাপ নেমে এল কিশোরীর। যে চলে যেতে নিলেই পেছন থেকে আগলে নিল শক্ত পোক্ত হাতটা।
“সকাল থেকে দেখা নাই। ঘরেও পাচ্ছি না। সারাক্ষণ কোথায় থাকেন আপনি?”

“এসেছিলাম তো।”

“কখন?”

“একটু আগেই। যখন লাবণ্যপুর সাথে কথা বলছিলেন।”

“ভেতরে আসো নি কেন?”

“এমনি।”

“ঠিক আছে। বসো একটু।”

উষশী বসল না। সে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। এর মাঝেই কিছু জিনিস পত্র গুছিয়ে ফেলল অভিরাজ। একটু পর পর মেয়েটিকে দেখে চলেছে। মেয়েটির সুন্দর মুখশ্রীতে আজ একটু বেশিই খুশি দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মেঘ সরিয়ে সূর্য উঠেছে।

ক্লোজেট থেকে এক গাদা শপিং ব্যাগ বের করল অভিরাজ। সব গুলো খুলে দেখছে উষশী। এখানে অনেক রকমারি জামা কাপড়। তবে এ ধরণের জামা পরে না সে।
“গ্রামে গিয়ে এসব পরবে।”

“আগের জামা গুলো?”

“ওগুলো গ্রামে পরার দরকার নেই।”

“কেন নেই?”

“অন্য চোখে দেখবে মানুষ। শহরে যতটা সহজে শর্ট ড্রেপআপ মেনে নেওয়া হয় গ্রামে ততটাই আলোচনা হয়। এটা আসলে একেক জায়গায় একেক কালচার।”

“ঠিক আছে।”

উষশী দেখল এক পাশে আরো কিছু ব্যাগ। সেগুলো ও খুলল সে। এগুলো অভিরাজের জামা কাপড়। সব গুলো টি শার্ট দেখল সে। অভি ফোন হাতে নিয়ে বসেছে। হুট করেই মেয়েটি একটা টি শার্ট পরে ফেলল। তারপর অভিরাজের সামনে এসে দাঁড়াল। সব দিক দিয়েই ভীষণ ঢিলেঢালা হয়েছে। তাকে দেখতে এলিয়েন লাগছে।
“ভালো লাগছে না?”

“এলিয়েনের মতো দেখাচ্ছে।”

“পঁচা মানুষ।”

“রাগ করলে?”

“হুম। রাগ ভাঙান এবার।”

“কিভাবে ভাঙাব?”

“এভাবে।” বলেই গালে চুমু খেল উষশী। এত দ্রুত ঘটে গেল বিষয়টা অভি বুঝতে পারল না। হেসে উঠল সে। উষশী একে একে সব গুলো টি শার্ট পরে দেখাল। অভি’র ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। সে মেয়েটিকে শক্ত হাতে আলিঙ্গন করল। একদম বুকের সাথে মিশিয়ে বলল,”এখন তো আমার ঘুম হারাম হয়ে যাবে রেইন।”

“কেন,কেন?”

“এই যে টি শার্ট গুলো থেকে তোমার শরীরের মিষ্টি সুবাস আসবে। আমি তো এখনি পাগল হয়ে যাচ্ছি।”

মুখ টিপে হাসল উষশী। অভিরাজের বুকে থেকেই তার মসৃণ গালে হাত বুলাতে লাগল। ছেলেটার গলার কাছটা ভীষণ সুন্দর। চোখ লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। অভিকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগল সে। একটা সময় পর বলল,
“এত সুন্দর কেন আপনি?”

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here