#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| শেষাংশ ০১ ||
—“নির্ঝর তোর চাচ্চুকে নিয়ে ইমিডিয়েটলি জামিন আঙ্কেলের বাড়িতে নিয়ে আয় আমিও সেখানেই যাচ্ছি। যে করেই হোক আজই এই ইমরান আর আমিরের ব্যবস্থা নিতে হবে।”
—“ওকে বস! তুই যা আমিও আসছি।”
—“ওকে।” বলেই নিহান ফোন কেটে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো।
নিহানের পাশেই বসে আছে নাফিহা।
নাফিহা সব জেনেছে, কী করে তার বাবাকে অপহরণ করে এতদিন বন্দি করে রেখেছিলো।
সাথে এও জেনেছে ইমরানের ছেলে আমিরের তার উপর কুনজর ছিলো।
জামিন রহমান এখন মোটামুটি সুস্থ, তাই নিহান আর দেরী করতে চাইছে না।
ইনু আর মিনু পেছন সিটে দৌড়াদৌড়ি আর ধস্তাধস্তির উপরে আছে।
নাফিহা ধমক দিলেই দুটো একদম চুপ মেরে বসে থাকবে।
তার কিছু সময় পর আবার খামচাখামচি শুরু।
পুরো রাস্তায় দুটোকে ধমকাতে ধমকাতে নাফিহা ক্লান্ত।
কে বলবে এরা জামাই-বউ!
অবশেষে দুজনেই নাফিহার বাড়িতে এসে গাড়ি থামালো।
নাফিহা গাড়ি থেকে নেমে ইনু, মিনুকে একটা ঝুঁড়িতে নিয়ে ভেতরে চলে আসলো।
জিনিয়া তো ইনু আর মিনুকে দেখে বেশ খুশি হলো।
নাফিহার হাত থেকে ঝুঁড়িটা নিয়ে সে নিজের ঘরে চলে গেলো।
নাফিহা আর নিহান চলে গেলো জামিন রহমানের রুমে।
ঘরে রনিয়া রহমান এবং জামিন রহমান গল্প করছে।
নিহান আর নাফিহাকে দেখে দুজনেই চমকে উঠলো।
—“আরে আরে হঠাৎ জামাইবাবা, নাফি তোরা! কোনো সমস্যা হয়নি তো?” চিন্তিত সুরে বললো রনিয়া রহমান।
—“না মা তেমন কিছু না। আমরা এসেছি বাবার অপহরণের পিছে কে আছে সেই বিষয়ে প্রশ্ন করতে।”
নিহানের কথায় রনিয়া রহমান, জামিন রহমান উভয়েরই মুখ কালো হয়ে গেলো।
রনিয়া রহমান এতদিন পর স্বামীকে পেয়ে সেসব বিষয় একদম ভুলে বসেছিলো।
ভাগ্যিস মনে করালো ওরা।
রনিয়া রহমান এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জামিন রহমানের দিকে তাকালেন।
জামিন রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
—“হ্যাঁ বলবো। আজ সব বলবো! অনেক হয়েছে লুকোচুরি খেলা আর সম্ভব না।”
বলেই জামিন রহমান থামলেন।
জামিন রহমান থামতেই নির্ঝর তার চাচ্চুকে নিয়ে হাজির।
উনি লাঠি ঘুরাতে ঘুরাতে মাথা থেকে পুলিশের ক্যাপটি খুলতে খুলতে বলে,
—“আমি কী বেশি দেরী করে ফেললাম?”
জামিন রহমান নির্বাক হয়ে অফিসারের দিকে তাকালো।
পুলিশ কেন তার বাসায় আসলো তা-ই তার বোধগম্য হচ্ছে না।
নিহান জামিন রহমানের বিস্ময় বুঝতে পেরে হেসে বলে,
—“চিন্তিত হবেন না বাবা আমি-ই ওনাকে এনেছি। উনি আপনার সকল ঘটনা শুনবে এবং রেকর্ড করবে। তারপরের কাজ আমি সারছি। আর চাচ্চু, আপনি সোফায় গিয়ে বসেন!”
অফিসার সম্মতি জানিয়ে সোফায় বললো আর তার পাশে নিহান।
নাফিহা একটা চেয়ার এনে দিতে নির্ঝর সেটায় বসলো।
নাফিহা চেয়ার দিয়ে মায়ের পাশে বিছানার কোণে বসলো।
অফিসার রেকর্ডার চালু করে বললো শুরু করতে।
জামিন রহমান কিছুটা সময় নিয়ে বলা শুরু করলেন,
—“আমি একজন সরকারি সিক্রেট এজেন্সি ছিলাম। তার মাঝে রেলমন্ত্রীর সাথে আমার বেশ ভাব হয়। উনি আমাকে কোনো কাজ দিলেই আমি তা করতাম। একসময় খুবই গোপনে জানতে পারলাম ইমরান একজন নারী পাঁচারকারি। অনেক সহজ-সরল গ্রামের মেয়েকে চাকরি দিবে বলে শহরে নিয়ে আসতো, তারপর সেই মেয়েদের উপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার করে ভারতে পাঁচার করতো। বিষয়টা আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি। তাই এক সহকারীর সাহায্য নিয়ে ইমরানের নেক্সট টার্গেট মানে সেই গ্রামে গিয়ে ছদ্মবেশে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। সে ঠিকই আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে গ্রামে চলে আসলো। তখন আমি নিজে প্লান করি এই ইমরানের বিরুদ্ধে সকল প্রমাণ জোগার করার জন্য। সেই ছদ্মবেশ নিয়েই ইমরানের সাথে বিভিন্ন অযুহাতে ওর এই বিজনেস পার্টনার হয়ে গেলাম। আস্তে আস্তে সে তার সকল কুকর্ম ফাঁস করতে থাকে আর আমিও সেগুলো প্রমাণ হিসেবে নিখুঁতভাবে এক গোপন জায়গায় রেখে দেই। একসময় সহ্য করতে না পেরে নিজের আসল পরিচয়ে ইমরানের কাছে গিয়ে হুমকি দেই, যদি সে এসব আবারও করে তাহলে তার ব্যবস্থা আমি নিজে করবো কারণ আমার কাছে যথেষ্ট প্রমাণ ছিলো। ”
বলেই জামিন রহমান থামলো।
সকলে উৎসুক হয়েই ওনার দিকে তাকিয়ে আছে।
জামিন সাহেব লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার বলা শুরু করে,
—“আমার হুমকিতে তার এই পাঁচার কারবার কয়েকমাস বন্ধ রেখেছিলো। সরকারের নানান কাজে আমাকে সবসময়ই এদিক সেদিক ছুটতে হতো তা ইমরান বেশ ভালো করেই জানে। তো তিনি একদিন বললো যে অন্য দেশে কয়েক বছরের একটা মিশন আছে আমাকে সেখানে যেতে হবে। আমার মনে প্রথমে প্রশ্ন উঠেছিলো, সরকার ছেড়ে ইমরান কেন তাকে এই কথা বলবে? পরে সরকারের আদেশ ভেবে আমিও ছুটে গেলাম সেই ভিন্ন দেশে। হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সেদিনই করেছিলাম। সেখানে গিয়ে বুঝলাম ইমরানের এটা একটা ফন্দি ছিলো, আমাকে তার রাস্তা থেকে সরানোর। সেখান থেকে এও জানলাম ইমরান শুধু নারী পাঁচারকারী নয়, একজন মাদক ব্যবসায়ীও! সেদিন আমি আর বসে থাকতে না পেরে ছয় বছরের জায়গায় ৪ বছরের মাথায়ই আমি দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু দেশে ফিরলেও পরিবারের মুখ দেখতে পারলাম না। ইমরান প্লান করে আমাকে কিডন্যাপ করে। প্রতিদিন নানানভাবে অত্যাচার করতো। ১ মাসে এই অত্যাচার থেকে বাঁচতে পারতাম বিশ দিন। কারণ সে চেয়েছিলো যেন আমি বেঁচে থাকি। আমি যদি মরে যাই তাহলে তার সব প্রুভগুলো খুইয়ে ফেলবে। অত্যাচার করতে করতে আমার এমন অবস্থা করেছে তবুও আমি মুখ খুলিনি, কোথায় রেখেছি তার প্রমাণগুলো। এগুলোর জন্য ইমরান যেমন আমার চিকিৎসা দিতো তেমনই অত্যাচার করতো। এমনও দিন গেছে ৩-৪দিন না খেয়ে অজ্ঞান অবস্থায় পরে ছিলাম!”
বলেই জামিন রহমান দুই আঙ্গুল দিয়ে নিজের চোখের কোনা মুছলো।
রনিয়া রহমান আঁচলে মুখ বুজে নিশব্দে কাঁদছে আর নাফিহার চোখ দিয়ে আঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পরছে।
কতো কষ্ট দিয়েছে মানুষটাকে এতগুলো বছর।
—“যখন কোনোকিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না তখন আমাকে সিরিঞ্জের মাধ্যমে জোর করে ড্রাগস দেয়া হতো। এইযে আমার হাতের এই দাগগুলোই তার প্রমাণ!”
বলেই জামিন রহমান নিজের হাতগুলো সামনে এগিয়ে দেখালো।
উজ্জ্বল শ্যাম হাতদুটোতে সুঁইয়ের দাগগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
নির্ঝর তৎক্ষনাৎ তার কাঁধে থাকা ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে হাতের দাগগুলোর ছবি তুলে নিলো।
—“এতো এতো অত্যাচারের পরেও আজ আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ আছি। কারণ, এই ইমরান যতো অত্যাচার করেছে ততোই আমাকে চিকিৎসা দিয়েছে। নয়তো এই এতোদিনের ড্রাগস নেয়া নিয়ে আমার উপর ভয়ংকর প্রভাব ফেলতো। যাহোক আসল কথায় আসি, এভাবে এতোগুলো বছর অত্যাচার করে এসেছে কিন্তু ২ বছর আগে ইমরানের সাথে আরও একজন যোগ হলো ইমরানের ছেলে “আমির”! এই আমির বাবার চেয়েও বড় ধূর্তিবাজ। কতো মেয়েকে ধর্ষণ করেছে তার হিসাব নেই। আমার কাছে প্রমাণ ছিলো না কিন্তু এই আমির আমারকাছে এসে তাদের অন্তরঙ্গের মুহূর্তগুলোর ছবি দেখাতো। রাগে, কষ্টে, ঘৃণায় চোখ বন্ধ করে রাখলেও আমির জোর করে চোখ খুলিয়ে সেসব দেখাতো। বিশ্বাস করেন অফিসার সাহেব এইসব দৃশ্য দেখার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো ছিলো। যখন দেখলো কোনো কিছুতেই আমি দুর্বল হচ্ছি না তখন আমিরের নজর গেলো আমার বড় মেয়ের দিকে। সে আমাকে প্রতিজ্ঞা করেছে আমার সামনেই আমার মেয়েকে সে….”
বলেই হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো জামিন রহমান।
কোন মেয়ের বাবা এসব কথা সহ্য করতে পারবে!
এদিকে এসব শুনে নিহানের পুরো মুখমন্ডল লাল হয়ে গিয়েছে। হাত দু’টো মুঠিবদ্ধ করে নিজের দমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই সে সফল হচ্ছে না।
নাফিহার কাঁদতে কাঁদতে নিহানের দিকে চোখ যেতেই দেখলো নিহান ভয়ংকর রেগে আছে।
নিহানের এমন রূপ দেখে অজানা ভয়ে নাফিহার গা শিউরে উঠলো!
জামিন সাহেব নিজেকে সামলে আবার বলা শুরু করে,
—“সেদিন আল্লাহ্’র দরবারে বারংবার মিনতি করেছি যাতে আল্লাহ্ আমার মেয়েটাকে এই অমানুষটার হাত থেকে বাঁচায়। আল্লাহ হয়তো আমার কথা শুনেছিলেন, তাই হয়তো আমার নাফিহা মা বেঁচে যায় ওই শয়তান অমানুষটার হাত থেকে!”
নাফিহা আবার নিহানের দিকে তাকালো।
সেদিন যদি নিহান এসে তাকে না বাঁচাতো কতো ভয়ংকর ঘটনা যে ঘটে যেত তা নাফিহা কল্পনা করতে পারছে না।
—“বড় মেয়েটার বিয়ে হয়েছে শুনে আমির ভয়ংকর রেগে আমার উপর অত্যাচার চালায়। আমার সামনেই সে অন্য মেয়ের সাথে….। তখন ড্রাগসের ডোজ ছিলো বিধায় আমি অজ্ঞান অবস্থায় পরে ছিলাম তাই ওই নির্মম ঘটনা দেখার হাত থেকে বেঁচে গেছিলাম। এরকম নিয়মিত ড্রাগস দিতে দিতে অবস্থা খারাপের দিকে পৌঁছে যায়। ইমরান তার ছেলেকে শান্ত করে আবারও আমার চিকিৎসা করান। চিকিৎসা করিয়ে একটু ভালো হতেই একদিনে দুই সিরিঞ্জ ড্রাগস দিয়ে আমাকে রাস্তায় ছেড়ে দেয়। যার ফলে আমি পাগলের মতো এদিক সেদিন ঢলে ষলে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। এতো যুদ্ধের পরে আমি আজ এখানে আমার পরিবারের মাঝে উপস্থিত আছি। আল্লাহর দরবারে লাখো শুকুরিয়া জ্ঞাপন করছি উনি আমাকে সেই অন্ধকার থেকে বের করেছে।
অফিসার সাহেব, আমার কাছে এইটুকু ঘটনাই আছে। আর বাদবাকি প্রুভ সুরক্ষিত স্থানে আছে আমি আপনাকে দিবো। তবে আমিরের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ আমার কাছে নেই।”
বলেই মাথা নিচু করে ফেললো জামিন রহমান।
সবাই নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে জামিন রহমানের দিকে।
একটা মানুষ কতোটা ধৈর্যশীল হতে পারে, সেটা জামিন রহমানকে না দেখলে বোঝা যাবে না।
অফিসার রেকর্ডার অফ করতেই নিহান নির্ঝরকে নিয়ে বাহিরে এসে বললো,
—” যেগুলো ইমপর্টেন্ট কথা সেগুলো রেকর্ডারে রাখবি আর যেগুলো অপ্রয়োজনীয় সেসব লাইন বা কথা ডিলিট দিবি। আমি আসছি তুই বাদবাকি ক্যা করার কর!”
বলেই নিহান চলে যেতে নিচ্ছিলো নির্ঝর পিছু ডেকে তাকে থামালো!
—“তুই কোথায় যাচ্ছিস?”
—“আমিরের ব্যবস্থা করতে। ভেবেছিলাম দু-একদিন বন্দি রেখে পুলিশের হাতে ধরায় দিবো। কিন্তু এই জানোয়ারের কাজে-কর্মে এর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।”
বলেই নিহান হনহন করে বেরিয়ে গেলো।
পরেরদিন প্রতিটি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ,
“মিনিস্টার ইমরান সাহেবের একমাত্র ছেলে আমিরকে কেউ টুকরো টুকরো করে পুরো বডির পার্ট বাই পার্ট বিভিন্ন স্থানে ফেলা হয়েছে।
পুলিশ এখনো আমিরের শরীরের বিভিন্ন পার্ট খুঁজে পায়নি।
তদন্ত চলছে ব্যাপকভাবে। ”
এই একটা নিউজই পুরো দেশবাসীকে ভয়ংকরভাবে কাঁপিয়ে তুললো।
চলবে!!!
বিঃদ্রঃ রিচেক দেয়ার সময় হয়ে উঠেনি তাই ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।