বিষাদময়_প্রহর পর্ব ২৪

0
837

#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ২৪ ||

নিহান জুতার ফিতা বাঁধছে আর আড়চোখে ইনুর দিকে তাকাচ্ছে।
নিহানের থেকে বেশ কিছুটা দূরে বসে লেজ নাড়ছে ইনু।
ইনুকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ খুশিমনেই আছে সে।
নিহানের জুতোর ফিতা লাগানো শেষ হতেই উঠে দাঁড়ালো।
নিহান নিজের হুডির কলারটা ঠিক কলার ঠিক করতে করতে বললো,

—“তোকে নিয়ে যাচ্ছি তবে হ্যাঁ, ভুলেও আজ আমার বিয়েতে ব্যাগড়া দিবি না! দিলে তোরে ডোবায় ফেলে আসবো মনে রাখিস।”

ইনু বোকার মতো তাকিয়ে রইলো নিহানের দিকে।
ইনুর ভাবভঙ্গিতে নিহান বুঝলো তার কথার আগামাথাও ইনু বুঝতে পারেনি।

—“মিঁয়াও!”

—“আমি তোর মালকিন না যে তোর এই এক ওয়ার্ডে দুনিয়াটা বুঝে ফেলবো। এখন চল তোর লাইন করিয়ে আসি।”

বলেই নিহান রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
নিহানের পিছে পিছে ইনু ছুটছে।
নিচে নামতেই নিহানের মা নিহানকে দেখতে পেলো।

—“কীরে নিহান! এই সাত-সকালে কই যাচ্ছিস?”

মায়ের কথায় নিহান থেমে গেলো।
নিহান তার পায়ের কাছে থাকা ইনুকে দেখিয়ে বললো,

—“নবাবজাদার সেটিং করাতে যাচ্ছি। এর জ্বালায় তোমার আদরের হবু বউমা থাকতেই পারছে না।”

—“ওমা বলিস কী?”

—“হ্যাঁ! তাইতো এরে সঙ্গে নিয়ে বাগানে যাচ্ছি জগিং করতে।”

—“ওহ আচ্ছা তাহলে যা। আমি ওইদিকটা গিয়ে দেখি লোকজন কাজ কতোদূর এগোলো।”

—“আচ্ছা যাও।”

নিহানের মা চলে যেতেই নিহানও ইনুকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
এবার নিহান আগে নয় ইনু আগে।
ইনুর পিছে এবার নিহান ছুটছে।
হুট করে ইনু দৌড় লাগালো।
ইনুকে দৌড় দিতে দেখে নিহানও ইনুর পিছে ছুটলো।
ইনু ছুটতে ছুটতে এক জায়গায় এসে দাঁড়ালো।
নিহান ইনুর কাছে এসে দুই হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাতে লাগলো।
হাঁপাতে হাঁপাতে ইনুর দিকে তাকাতেই দেখলো ইনু একটা বক্স খোলার চেষ্টা করছে।
নিহান ভ্রু কুচকে ইনুকে সরিয়ে নিজেই বক্সটা খুললো।
বক্সটি খুলে নিজেই হতবাক হয়ে গেলো।
একটা কিউট ফুটফুটে বিড়াল সেটার ভেতরে।
কিন্তু বিড়ালটিকে বেশ ফ্যাকাসে লাগছে, অনবরত কাঁপছে বিড়ালটা।
নিহান বিড়ালটাকে হাতে নিতেই দেখলো বিড়ালের গায়ের কিছু জায়গায় কাটা-ছেঁড়ার দাগ। কিছু কিছু ক্ষত দিয়ে রক্তও বের হচ্ছে।

—“ও মাই গড! ওর তো চিকিৎসা প্রয়োজন।”

—“মিঁয়াও!” নিহান ইনুর দিকে তাকালো।
ইনু বিড়ালটার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
নিহান কি যেন একটা ভাবলো।
তার ভাবা শেষ হতেই বললো,

—“ইনু আমার সাথে চল। ওরে প্যাট হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।”

বলেই বিড়ালটাকে নিজের জড়িয়ে গাড়ির গ্যারেজের দিকে ছুটলো।
নিহানকে যেতে দেখে ইনুও নিহানের পিছু নিলো।

২ ঘন্টা হয়ে গেলো বউ সেঁজে কমিউনিটি সেন্টারে বসে আছি এদিকে নিহান ভাইয়ের খবর নেই।
সকলের চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ।
এদিকে আমি ওনাকে ফোনের উপর ফোন দিয়েই চলেছি বারংবার সুইচড অফ বলছে।
মা আমার পাশে বসে আমাকে সামলাচ্ছে, ওদিকে আন্টিরও অবস্থা খারাপ চিন্তা করতে করতে।
আন্টির কাছে শুনেছি উনি সেই ভোর ৭টায় ইনুকে নিয়ে জগিং এ বেরিয়েছিলেন আর এখন তো বিকাল ৪টা বাজে।
গেলেন কোথায় উনি?
চিন্তায় মাথা ধরে গেলো আমার।
আদ্রান ভাইয়া এবং হিদের বিয়েটা ১ ঘন্টা আগেই সম্পূর্ণ হয়েছে।
তারা এখন পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ আর আমাদের বেলাতেই যতো ঝড়-তুফান।
জানি না আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের কপালে কী রেখেছেন!
কিন্তু আমি চাই আমার যা-ই হোক আমার নেতাসাহেবকে যেন উনি সুস্থ রাখেন, ভালো রাখেন।

আন্টি রীতিমতো কান্নাকাটি লাগিয়ে রেখেছে তাই উপায় না পেয়ে নিবিড় ভাইয়াসহ নিহান ভাইয়ার বন্ধুরাও নিহান ভাইয়াকে খুঁজতে বের হলো।
এক এক কর্ণারে চুপচাপ মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছি।
ভেতরের আমিটা যে কতো ভয়ংকরভাবে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি সেটা একমাত্র আমি এবং আমার মাবুদ ভালো জানেন।
দম আটকে আসছে আমার, কী এমন হলো যে নিহান ভাইয়া হুট করে উধাও হয়ে গেলো।

কাজি একজায়গায় বসে ছিলেন।
হঠাৎ তার ফোনে কল আসলো।
তিনি কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ওনাকে কিসব যেন বলা হলো।
উনি সব শুনে সম্মতি জানিয়ে ফোন কেটে দেয় এবং নাফিহাকে ডাকিয়ে বিয়ে পড়ানো শুরু করে।
নাফিহা কিছুই বুঝতে পারছে না, বর ছাড়া কী করে তার বিয়ে হবে?

কিছুক্ষণ বাদে নিহান সকলকে অবাক করে দিয়ে তার বিয়ের শেরওয়ানি পরে কমিউনিটি সেন্টারে প্রবেশ করলো।
নিহানের পিছে আসছে নিবিড়সহ নিহানের বন্ধুরা।
নিহানকে দেখতেই নাফিহার চোখের কোণা বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পরলো।
সেই মুহূর্তে নাফিহা তার মায়ের হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের গাউন দুই হাত দিয়ে ধরে উঁচু করে দৌড় দিলো নিহানের কাছে।
সকলের সামনেই নিহানকে গিয়ে ঝাপটে ধরলো এবং ডুকরে কেঁদে উঠলো!
নাফিহার খেয়াল নেই যে আশেপাশে কয়েকশো মানুষজন আছেদ আর তাদের দেখছে।
নিহান নাফিহাকে নিজের সাথে জড়িয়ে বারবার নাফিহাকে সামলানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
নাফিহা কাঁদতে কাঁদতে বলে,

—“আপনি খুব পঁচা নেতাসাহেব! এভাবে আমায় একা ফেলে কোথায় চলে গেছিলেন? জানেন কতটা দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম। ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছেন আপনি! আপনার আমাকে কষ্ট দিতে বেশ ভালো লাগে তাইনা? ভুলে গেছিলেন যে আজ আপনার বিয়ে, আপনার এই বউটা টুকটুকে বউ সেঁজে আপনারই অপেক্ষায় আছে! সব ভুলে কোথায় গিয়েছিলেন আপনি!!”

—“জানপাখি! এভাবে কেঁদো না প্লিজ। দুঃখিত একটু বেশিই দেরী করে ফেলেছি। আর ফোনটার চার্জ ছিলো না। কাল রাতে চার্জ দিবো করে মনেই ছিলো না, তোমার সাথেই তো সারারাত কথা বললাম তাই না বলো? আর কেঁদো না লক্ষ্যিটি! আমি এতো এসেছি তাই না? চোখ মুছো নয়তো পুরো পেত্নির মতো লাগবে দেখতে।”

নিহানের শেষের কথায় নাফিহা কান্নার মাঝেই হেসে ফেললো।
সকলে মুগ্ধ নয়নে তাদের ভালোবাসা দেখছে।
লাভ বার্ড ওরা যাকে বলে ম্যাড ফর ইচ আদার।
সিফাত চৌধুরী কিঞ্চিৎ পরিমাণ হেসে নিহানের মাকে বললো,

—“আগেই বুঝেছিলাম এই দুটোর মাঝে কিছু একটা চলছে। নাহলে আমার ছেলে বিয়ের জন্য এমন পাগলামি করতো না।”

—“যখন বুঝলা আমাকে বলোনি কেন?”

—“কী মনে করে যেন বলিনি।”

বলেই মুচকি হাসলো সিফাত চৌধুরী আর মিসেস চৌধুরী ভেংচি কাটলো।
অবশেষে সকল নিয়ম মেনে নাফিহা এবং নিহানের বিয়ে সম্পূর্ণ হলো।
বিয়ে হতেই উপস্থিত সকলেই “আলহামদুলিল্লাহ” বলে উঠলো।
নিহান আড়চোখে নাফিহাকে দেখে মুখ টিপে হাসলো।
নিহান যা ভেবেছিলো তার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে আজ তার নাফিপাখিকে।
কিন্তু কেঁদে-কেটে মুখটা ফ্যাকাশে করে ফেলেছে।
হঠাৎ নিহানের মনে প্রশ্ন জাগলো নাফিহা খেয়েছে তো?
নাফিহাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলো তার সন্দেহ-ই ঠিক।
ফটোগ্রাফাররা এগিয়ে আসতেই নিহান তাদের থামিয়ে বললো,

—“আপনারা অপেক্ষা করুন আমরা খেয়ে আসছি।”

বলেই নাফিহার হাত ধরে টেনে স্টেজ থেকে নামলো।
নাফিহা চোখ বড় বড় করে নিহানের দিকে তাকালো।
উপস্থিত সকলেই এই দৃশ্য দেখছে আর মুখ টিপে হাসছে।
কয়েকজন ফটোগ্রাফার কয়েকটা ছবিও তুলেছে।
নিহান নাফিহাকে নইয়ে খাবারের টেবিলের সামনে আসলো।
নিহান নাফিহার হআত ছেড়ে একটা চেয়ার টেনে নাফিহাকে বসতে ইশারা করলো।
নাফিহা প্রশ্ন না করে মাথা নিচু করে বসে পরলো।
নাফিহার পাশে বসলো নিহান, প্লেট উল্টোতে উল্টোতেই কাজিনরা, নিবিড় আর জিনিয়া এসেও হাজির হলো।
ওরা আগেই খেয়ে ফেলেছে তবুও ওরা একা থাকবে ভেবে ওরাও সঙ্গ দিতে চলে আসে।
সকলে মিলে বিভিন্ন আলোচনা করছে, এরমাঝেই খাবার এসে হাজির। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে জাস্ট এক প্লেট খাবার এসেছে।
সবাই হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে।
এর মাঝেই রিয়াদ হুট করে বলে উঠে,

—“ভাই এক প্লেট কেন? নাফিহা কী খাবে না?”

নিহান অন্য একটা প্লেটে হাত ধুঁতে ধুঁতে বলে,

—“আমরা দুইজন একপ্লেটেই খাবো। জানিস না, এক প্লেটে খেলে স্বামী-স্ত্রীর মোহাব্বত বাড়ে।”

নিহানের কথায় সকলেই ঠাট্টা-টিটকারি শুরু করে দিলো।
এদিকে নাফিহা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।
পারছে না নিহানের মুখে টেপ লাগিয়ে দিতে।
এত অসভ্য কেন নিহান?
নিহান এক লোকমা নাফিহার মুখ ধরতেই নাফিহা চোখ গরম করে তার দিকে তাকালো।

—“ঝগড়াঝাটি পরে হবে আগে জলদি গিলো।”

বলেই জোর করে খাইয়ে দিলো।
নিহানের সবচেয়ে কাছের বন্ধু নির্ঝর হাসতে হাসতে বলে,

—“বাপ্রে! বোমমরিচ পোলাটায়ও কতো রোমান্টিক হয়ে গেলো ভাবা যায়! ভাই তোর থেকে তো বেশ টিপস নেয়া যাবে আমার বিয়া নিয়া!”

নির্ঝরের কথায় অন্যরাও হেসে উঠলো।
নিহান খেতে খেতে বলে,

—“আমি তোর মতো আগে থেকেই মেয়ে পটানোর হাজার হাজার টিপস দেখি নাই। যদি দেখতাম এতদিনে বউয়ের সাথে সাথে ৪ বাচ্চার বাপও হয়ে যেতাম।”

নিহানের কথায় নাফিহার সেইরকম বিষম খেলো।
ওদিকে সকলে আবার অট্টহাসিতে ফেটে পরলো।
নিহান জলদি করে নাফিহার দিকে পানি ওগিয়ে দিলো।
নাফিহা ঢকঢক করে সবটা সাবাড় করে ফেললো।
আহিরাকে এক ধমক দিয়েবলে,

—“ওই চোখে দেখোস না এখানে পানির অভাব! জলদি করে এক লিটার পানির বোতল এনে হাজির কর!”

—“তুই তো আরও বড় কানা! দেখোস না দুই জগ ভরা পানিগুলা? বউ পাইয়া তো মাথার বদ-বুদ্ধি সব খাবারের সাথে হজম করে ফেলছিস!”

—“আরে বুঝো না বুড়ো বয়সে বিয়া কইরা এতদিনের স্বাধ মিটাচ্ছে, এ তো… ওমাগোওঅঅঅঅঅঅ নিহাইন্না!!! পা তো আমার ছিলে গেলো। উফফ আম্মা গোহ! ছাড় ভাই আমারে প্লিজ ছাড়!” নির্ঝর অনুরোধের সুরে বললো।
টেবিলের নিচে দিয়ে নিহান তার নাগড়া পরা পা দিয়ে নির্ঝরের পায়ে জোরে চাপ দিয়ে আছে।

নিহান নাফিহাকে খাইয়ে দিতে দিতে বলে,
—“কেন ছাড়বো? কর আরও বদনাম! আমি তো সামান্য পা ছোঁয়ালাম তোর পায়ে।”

—“হোয়াট সামান্য! আচ্ছা যা ভাই মাফ কর আর কিচ্ছু বলুম তাও ছাড় আমারে প্লিজ ভাই আমার!”

—“মনে থাকবে তো?”

—“পাক্কা মনে থাকবে।”
নিহান পা সরিয়ে ফেললো।
এভাবেই হাসি-ঠাট্টার মাঝেই খাবারের পর্ব শেষ হলো।

চলবে!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here