বিষাদময়_প্রহর পর্ব ২২

0
809

#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
| অতিরিক্ত অংশ |
|| পর্ব ২২ ||

রুমের এক কোণায় গুটিশুটি মেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।
মনে হচ্ছে যেন কোনো এক হিংস্র বাঘের খাঁচায় আমার মতো এক নিষ্পাপ খোরগোশকে বাঘের খাবার হিসেবে রাখা হয়েছে।
ঠিকই আমার সামনে বাঘরূপি নিহান ভাইয়া চোখ-মুখ লাল করে চোয়াল শক্ত করে হিংস্রভাবে তাকিয়ে আছে।
কিছুক্ষণ আগেই তাকে রুমে ডেকে বিয়ের জন্য “না” করে দেই।
মুহূর্তেই নিহান ভাইয়ার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা হিংস্রতায় পরিণত হয়।
রাগে তার কপালের রগও দৃশ্যমান।
এদিকে নিহান ভাইয়ার এমন রূপ দেখে আমার দম যেন যায় যায় অবস্থা।
কই নিহান ভাইয়ার উপর অভিমান করেছি সেটা বোঝাবো তা না, পাগল তো পাগলই হয়।
না জানি কখন কোন দিক দিয়ে আমার উপর আক্রমণ করে আল্লাহ্ মালুম।
যত দোয়া-দরূদ মুখস্থ আছে সব একে একে মনে মনে পড়লাম।
এখনো পড়েই চলেছি এই ভেবে আল্লাহ যেন এই বাঘটার থেকে আমাকে রক্ষা করে।
শেষ অবধি রক্ষা হলো না।
নিহান ভাইয়া সোফায় থাকা একটা ওড়না নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসে।
আমার পিছে দাঁড়িয়ে পেছন থেকেই সেই ওড়নাটা আমার মুখে বেশ জোরে পেঁচিয়ে দিলো।
আমি চোখ বড় বড় করে নিহান ভাইয়ার কান্ড দেখছি।
নিজের ধ্যান ভাঙ্গতেই ওড়নাটা মুখ থেকে সরানোর চেষ্টা করলাম।
বেশি ছুটাছুটি করছি দেখে নিহান ভাইয়া পেছন থেকে ওড়নার মাথা টান দিতেই আমার পিঠ তার বুকে গিয়ে লাগলো।
আমি চোখ বড় বড় করে ফেললাম।
নিহান ভাইয়া কপট রেগে বলতে শুরু করলো,

—“যখনই হাসিখুশি থাকতে চাই তখনই কেন মাথা গরম করিয়ে ছাড়বি তুই? কি সমস্যা তোর আমাকে বিয়ে করতে হ্যাঁ! ৩ টা বছর যে তোর পিছে ছুটছি সেইটা তোর চোখে পরে না? রোজ ভোরবেলা চিঠি পাঠাতাম সেটা চোখে পড়তো না? চিঠিতে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ চোখে পরতো না? আমি দেখতেও খারাপ না! বিয়ে করবো বললে মেয়েরা লাইন ধরে দাঁড়াবে ইনফেক্ট আমার কাজিন অবধি আমাকে বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছিলো। দেখিস না তাদের কি করে রিজেক্ট করি শুধুমাত্র তোর জন্য? তোর জন্য আমি হাজারবার বেহায়া হয়েছি আর তুই বিয়েতে না করবি? অন্যকাউকে পছন্দ তোর? পছন্দ হলে এই ওড়না তোর মুখে না।(বলে আস্তে আস্তে গলায় নিয়ে আসলো তারপর খুব শক্ত করে পেঁচিয়ে বললো,) একদম গলায় পেঁচিয়ে তোরে মেরে ফেলবো তারপর তোর নাগরকে। এতদিন যতোটা খারাপ দেখতি তার চেয়েও বহুগুণ খারাপ হতে রাজি শুধুমাত্র তোর জন্য! কেন বুঝিস না তোকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসি।”

বলেই আমার গলা থেকে ওড়না সরিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো।
আমি এদিকে কাশতে কাশতে শেষ।
আরেকটুর জন্য আমার জানটাই আজরাইল কবজ করে নিয়ে যেত।
উফফ এ কোন হিটলার আমার ঘাড়ে চাপলো!
এ তো দেখছি পরের লাইন না শুনে আমায় প্রায় মেরেই ফেলছিলো!
আমি মুখটা কাচুমাচু করে বললাম,

—“আপনি কাজটা একদম ঠিক করেননি। আমার কোনো পছন্দ নেই, হুট করে বিয়ে ঠিক করায় আমার প্রচন্ড অভিমান হয়েছিলো। আর আগে আপনি আমাকে এড়িয়ে গেছেন দেখে আমি আরও অভিমান করে ছিলাম। কিন্তু আপনি সেসব না বুঝেই আমার গলায় ওড়না পেঁচালেন!!!” ঠোঁট উল্টে বললাম যেন আমি এখনই কেঁদে দিবো।

আমার কথা শুনে নিহান ভাইয়া যেন গলে গেলো।
ওড়না বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার দুগালে হাত রেখে একবার আমার মুখ তো আরেকবার গলায় তাকাচ্ছে।
একসময় আহ্লাদে কন্ঠে বলে উঠে,

—“বেশি লেগেছে জানপাখি? দুঃখিত জানপাখি, আমি আসলে বুঝতে পারিনি। তুমি বিয়ে করবে না বলায় নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি।”

আমি ওনার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালাম।
আমার সামনের চুলগুলো মুখে পরায় উনি এক ফুঁ দিলেন।
আমি হতভম্বের মতো তার দিকে তাকালাম।
উনি হেসে বললো,

—“এবার রাগ কমেছে?”

—“না।”

—“কি করলে রাগ ভাঙ্গবে?”

—“আপনার এই “বিষাদময় প্রহর” হওয়ার ঘটনা বললেই রাগ ভাঙ্গবে।”

নিহান কিঞ্চিৎ পরিমাণ হাসলো।
নাফিহার মুখে আগ্রহের শেষ নেই।
আজ নিহান নাফিহার কথা না রেখে পারলো না।

—“আচ্ছা তাহলে শুনো। তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম নাহিদাকে কলেজ দিয়ে আসার সময়। তখন মনে হয় তোমাদের এইচএসসি পরীক্ষা চলছিলো। আমি সেদিন নাহিদাকে পরীক্ষার হল অবধি দিয়ে এসেছিলাম। তোর সিট জানালার কাছে হওয়ায় খুব সহজেই সেদিন তোর দিকে চোখ পরলো আর তখনই তোর দিকে চোখ আটকে যায়।”

—“তার মানে কী আপনি সব মেয়েদের দিকেই তাকাতেন?” মুখ গোমড়া করে বললাম।

নিহান ভাইয়া আমার মাথায় একটা গাট্টি মারলো!
তারপর আমার হাত ধরে তার পাশে বিছানায় বসিয়ে আবার বলতে লাগলো,

—“মাথা মোটা মেয়ে। এতদিনে কি আমাকে দেখিস নি! আমি কোন মেয়ের দিকে তাকিয়েছিলাম ছাগলি! জীবনে তুই-ই প্রথম মেয়ে যার দিকে আমার নজর গেছিলো।”

—“আচ্ছা বুঝলাম এরপর বলেন।”

—“সেদিন তোর চুলগুলো ছাড়া ছিলো, সামনের চুলগুলোয় তোর দু’গালের অর্ধেকাংশ ঢাকা ছিলো। চোখে গোলাকৃতি চশমা। গাল, নাকও কেমন লাল ছিলো। তুই তখন ঠোঁট উল্টে এক কলমের কালি বের করার চেষ্টা করছিলি। সেদিন তোর সেই কান্ডে আমি নিজের অজান্তেই হেসে ফেলেছিলাম।”

—“ও হ্যাঁ মনে পরেছে, একদিন ভুলবশত কালি ছাড়া কলম নিয়ে গিয়েছিলাম। হলে ঢুকে কলম চেক করার সময় দেখলাম কলমে কালি নেই। আমি সেটাকে কুফা ভেবেছিলাম, প্রথমেই কলমে কালি নেই তাহলে নির্ঘাত পরীক্ষা খারাপ হবে আমার। এ ভেবে আমি কেঁদে দেই এমন অবস্থা। অনেক ঘষাঘষি, ঝাঁকানোর পরও যখন বের হচ্ছিলো না তখন চোখ ছলছল করে উঠেছিলো। যখন হিদকে দেখলাম তখন আর নিজের কান্না চেপে রাখতে পারিনি।”

—“সেই কান্নামাখা চেহারারই প্রেমে পরেছিলাম আমি। সেদিন রাতে হিদের থেকেই তোর সকল ডিটেইলস নেই আর তোর কান্নার কারণটাও জানতে পারি। বিশ্বাস কর সেদিন হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছিলো। সামান্য কলমের জন্য কোনো মেয়েমানুষ তাও ১৮বছর বয়সী একটা মেয়ে এভাবে কাঁদবে কখনো ভাবতে পারিনি।”

—“হইসে আমাকে পঁচানো বন্ধ করে নেক্সট কাহিনীতে যান।”

—“ও হ্যাঁ। সেদিনের পর আমার রাত বল, দিন বল সারাদিনই তোর সেই কান্নামাখা ফেস আমার চোখে ভাসতো। নিজে থেকে কতবার তোকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু আমি পারিনি। তোর কলেজ আমার অফিস যাওয়ার পথেই পরতো তাই প্রায় প্রতিদিনই আমি তোকে দেখতাম, দূর থেকে। তোকে দেখাটা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়। একদিন না দেখলেই কেমন ছটফট লাগতো, নাহিদার থেকে তখন নানা অজুহাত দেখিয়ে দেখিয়ে তোর খবর নিতাম। তবে আমার বুঝতে সময় লেগেছিলো যে তোকে আমি ভালোবাসি। একসময় বুঝলাম, কিন্তু তোর সামনে গিয়ে বলার সাহস হয়নি। তখন ভাবলাম সিক্রেট লাভার হয়ে যাবো এতে বিষয়টা ইন্টারেস্টিং হয়ে যাবে। কিন্তু নাম কি দিবো সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম না। যেহেতু তোকে আমি প্রতিটিদিন, প্রতিটি ঘন্টা মিস করতাম, ফিল করতাম তাই সিক্রেট নাম রাখলাম “প্রহর”। একদিন তোকে এক ছেলে প্রপোজাল দিয়েছিলো, তাকে মেরে হসপিটাল পাঠিয়ে আমার আরেক নাম হলো, “বিষাদ”। সেই থেকে মিলিয়েই আমি তোর “বিষাদময় প্রহর” হয়ে গেলাম।”

—“তাহলে বাস্তবে আমার পিছে লেগে থাকতেন কেন?”

—“এই মজা তুই বুঝবি না। তবে তুই তো ভালো কথার মানুষ না, তোরে এই বয়সেও শাসাতে হয়।”

আমি ভেঙচি কাটলাম।
আমার ভেঙচি কাটা দেখে নিহান ভাইয়া হেসে বলে,

—“এবার তো সব জেনেছিস, এখন তোর রাগ ভেঙ্গেছে?”

—“হু। কিন্তু হুট করে বিয়ে কেন? আর পরিবারকেই বা কি করে রাজি করলেন?”

—“একদিনে সব বলবো না। অপেক্ষা কর, অপেক্ষার ফল মিঠা হয়।”

আমি আর উত্তরে কিছু বললাম না।
নিহান ভাইয়া প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,

—“তাহলে লাঞ্চের পর সুন্দরভাবে রেডি হয়ে যাবি কেমন? মেকাপ আর্টিস্টরা আসবে। আর পারলে দ্বিতীয়বার হাতে মেহেদী দিয়ে নিস।”

—“কেন কেন? মেহেদী তো আছেই!”

—“কালারটা ঝাপসা লাগছে। আমার টকটকে লালরঙা হাত চাই। আমার ইচ্ছে আছে বাসরে বউয়ের হাতের মেহেদীর ঘ্রাণ নিবো। ”

বলেই উনি আমার এক হাত নিজের দু’হাতে মুঠিবদ্ধ করে রাখলো।
নিহান ভাইয়ার কথায় আমার গালদুটো কেমন জ্বলে উঠলো।
নিহান ভাইয়া হেসে বলে,

—“গাল লাল করে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছিস কেন? আমার দিকে তাকা।”

লজ্জায় নিহান ভাইয়ার দিকে তাকাতে পারলাম না।
উনি আমার লজ্জার কারণ বুঝতে পেরে হেসে হেসে আমার হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

—“আসছি।”

বলেই নিহান ভাইয়ার দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
আমি নিজের হাতের দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইলাম।
তারপর কী যেন ভেবে হাতটা নাকের সামনে আনলাম।
নিহান ভাইয়ার শরীরের ঘ্রাণ আমার হাতে বিদ্যমান।
আমি ভাবতেই পারছি না নিহান ভাইয়ার সাথে আজ বাদে কাল বিয়ে।
মনপুরুষকে হুট করে পাওয়াটা স্বপ্নের মতোই লাগবে তার উপর যদি হয় উনি সেলিব্রিটি।
বিয়ের পরে তাকে ডাকবো “সেলিব্রিটি স্বামী” হিহি।
ভাবতেই পারছি না উনি এই ৩ বছর এভাবে প্রহর হয়ে ছিলেন আমারই আড়ালে।
আর প্রকাশে বদরাগী নিহান আফ্রান!

আমার এই সুখের ভাবনাতে এক বালতি পানি ঢাললো ইনু।
লাফ দিয়ে আমার কোলে চুপটি মেরে বসেছে।
আজ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি রাগ লাগছে ইনুর উপর।
এরে শিক্ষা দিতে এরেও বিয়ে দিতে হবে, তারপর ইনু আর ওর বউয়ের মাঝেও আমি বামহাত ঢুকাবো।
ব্যাটা ফাজিল বিড়াল!
নিহান ভাইয়া এরে বকে একদম ঠিক করে।
ইনু মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ “মিঁয়াও” “মাওওউ” শব্দ করে আমার হাত চাটলো।
বুঝলাম ব্যাটার ফন্দি ভালো না।

—“আবার কার সাথে লাইন মারতে গেছিলিরে?”

—“মিঁয়াও!”

—“ঘুমা গিয়ে। আমি তোর মতো বিড়াল না যে তোর মতো একটা বিলাইরে আরেক বিলাইয়ের সাথে সেটিং করায় দিবো। এখন ডিস্টার্ব যদি না করিস তাহলে ডিনারে দামী ক্যাট ফুড খাওয়াবো সাথে চিকেনের হাড্ডি।”

ইনু তৎক্ষনাৎ আমার কোল থেকে নেমে গেলো।
ইনু নামতেই আমি ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে ওযুও করে নিলাম।
যথারীতি নামাজ আদায় করে নিচে গিয়ে খেয়ে আসলাম।
খাওয়ার সময় নিহান ভাইয়াকে দেখিনি হয়তো বাসায় ছিলো না।
খেয়ে-দেয়ে রুমে এসে কিছুক্ষণ রেস্ট করলাম।
ঠিক বিকাল চারটা বাজে মেকাপ আর্টিস্টসহ হিদও ভেতরে প্রবেশ করলো।
যেহেতু আমরা দুই বউ তাই আলাদা আলাদা মেকাপ আর্টিস্ট আমাদের সাজাতে শুরু করলো।
বাড়ির বাগানে হলুদের অনুষ্ঠান বেশ বড় করে হবে।
রাতে যেহেতু অনুষ্ঠান সেহেতু খুবই ঠান্ডা মাথায় এবং ধীরে-সুস্থে তারা সাজ দিচ্ছে।
এর মাঝেই আহিরা আপু আর অর্ণা আপু আসলো।
আহিরা আপু আর অর্ণা আপুর সাথে কয়েক মিনিট কুশল বিনিময় করে আবার সাজতে বসে গেলাম।
সাজগোজ একদম বিরক্ত লাগে আমার কাছে, তবুও কিছু করার নেই।
হিদতো বিন্দাস সেজে চলেছে, এই মেয়ের এত এক্সাইমেন্ট আসে কোথা থেকে আমি বুঝি না।
এদিকে নার্ভাসনেসে আমার অবস্থা খারাপ।
সন্ধ্যায় গিয়ে আমার সাজ কমপ্লিট হলো।

চলবে!!!

বিঃদ্রঃ আজ দুইপর্ব দিলাম আশা করছি গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here