বিষাদময়_প্রহর পর্ব ১৬

0
775

#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১৬ ||

—“ওই ছেলের সাথে তুমি কি কথা বললা?”

হঠাৎ কারো কন্ঠে চমকে উঠে পিছে ফিরলো নাহিদা।
নাহিদার চোখমুখে যেন বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট, আদ্রানকে দেখতে পেয়ে।
আদ্রানের চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে।
নাহিদা নিজেকে সামলে বললো,
—“সেটা আমার পার্সোনাল বিষয়, আপনাকে কেন বলতে যাবো?”

আদ্রান এতক্ষণ বেশ কষ্ট করে নিজের রাগ দমিয়ে রেখেছিলো কিন্তু নাহিদার এমন ত্যাড়া কথায় সে আর নিজেকে দমাতে পারলো না।
ধপাধপ পা ফেলে নাহিদার সামনে এসে নাহিদার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

—“অনেক বাড় বেড়েছিস তুই না? সেদিন সামান্য পিচ্ছি বলায় তোর এতো তেজ! এতদিন অনেক সহ্য করেছি আর নয়। আজ তুই আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিস। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি আমি কি কি করতে পারি।”

বলেই আদ্রান নাহিদাকে ছেড়ে দিয়ে ধপাধপ পা ফেলে চলে গেলো রাস্তার ওপর পাশে।
নাহিদা এখনো হ্যাবলার মতোই তাকিয়ে আছে আদ্রানের যাওয়ার পানে।
হুট করে তার মুখমন্ডলে খুশির ঝিলিক দেখা গেলো।
নাহিদা নাচতে নাচতে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো।
আজ সে ভিষণ খুশি।
নাহিদা কিছু একটা বেশ ভালোভাবেই আন্দাজ করেছে। সে ভাবলো,

—“ইশ! আদ্রান ভাইয়ার সাথে আরও আগে এই প্রয়োগ কাজে লাগালে তো এতদিনে তো জামাই, বাচ্চা নিয়ে সুখে ঘর-সংসার করতে পারতাম। আমিও না আসলেই বলদ।”

ভেবেই নিজের মাথায় এক চাপড় মারলো নাহিদা।
তবে আজ সে বাসায় যাবে না বলে ঠিক করলো।ডাইরেক্ট নাফিহার বাড়ির দিকেই রওনা হলো।
আজ নাফিহা ভার্সিটি আসেনি অসুস্থতার জন্য তাই তার সাথে সময় কাটাতেই যাচ্ছে।

—“ওরে ইনু থাম রে ভাই আমার! আর বিছানা এলোমেলো করিস না, এমনেই পেটের যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি এখন তোর এইসব অকাজ কুকাজের দায়ভার কে নিবে হ্যাঁ? এই বিছানা কি তুই গুছিয়ে দিবি? আজব! ইনুউউউ!”

কিন্তু ইনুও শুনতে নারাজ।
সে এখন ব্যস্ত খাবলিয়ে খাবলিয়ে বালিশের তুলা বের করতে।
তুলোতে পুরো ঘর ভরে গেছে।
মনে হচ্ছে যেন আমি কোনো তুলার রাজ্যে চলে আসছি আর এই বেদ্দপ্টার থামার নামই নেই।
পেটে ধরে আল্লাহর নাম নিতে নিতে চেয়ার থেকে উঠে ইনুর থেকে কেড়ে নিলাম বালিশটা।
ইনু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না দিয়ে তুলায় ভরা বিছানায় গড়াগড়ি খেতে লাগলো।
আমি পুরো রুমে করুণ দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নিলাম।
মা এগুলো দেখলে আমায় আস্ত রাখবে না।
জিনিয়া এখন প্রাইভেট কোচিং নিয়ে বেশ ব্যস্ত কারণ আর মাত্র ২মাস পর ওর এসএসসি পরীক্ষা, তাই বেচারী ঠিকমতো নিশ্বাস নেয়ার মতোও সময় পায় না।
জিনিয়ার জন্য এখন আমি মায়ের সাথে ঘুমাই কারণ, জিনিয়ার রাত জেগে পড়াশোনা।
ওদিকে আমাদের বাড়ির কাজ দীর্ঘদিন বন্ধ ছিলো বিধায় অনেক কাজই পরে আছে।
গত তিনদিন আগে থেকেই আবার নতুন করে কাজ শুরু হয়েছে।
প্ল্যানিং আছে জিনিয়ার এসএসসির পরেই আমরা আমাদের বাড়িতে গিয়ে উঠবো।
আর এই ফ্লাটের ফার্নিচার সরিয়ে দিয়ে আমরা এই ফ্লাট ভাড়া দিবো বলে ঠিক করেছি।
আজ ভার্সিটি যাওয়া হলো না পেটের ব্যথার জন্য।
ব্যথাটা মূলত গ্যাস্ট্রিকের থেকে।
বেশ কিছুদিন খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো না করার ফলে গ্যাস্ট্রিকটা সেইভাবে ধরেছে আমাকে যার দরুন এই উটকো ঝামেলা।
ইদানীং আমি-ই বা কি খাবো?
সারাদিন তো বই আর নিহান ভাইয়াকে নিয়েই পরে থাকি।
অবশ্য তার সাথে সামনাসামনি মাসে ১ বা ২ বারের মতো দেখা হয় এর বেশি না।
কিন্তু প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি, ম্যাগাজিনে তাকে দেখা যেন আমার রুটিন হয়ে গেছে।
জানি না নিহান ভাইয়ার প্রতি কীভাবে এতটা দুর্বল হয়ে গেলাম কিন্তু হ্যাঁ তাকে একবারের জন্যেও না দেখলে সব কেমন ঝাপসা এবং অন্ধকারের ন্যায় লাগে।
তাকে ভাবতে এক অজানা অনুভূতি সারা শরীরে প্রশান্তি বইয়ে দেয়।
এতোকিছু জানিনা তবে এটাই জানি তাকে ছাড়া আমার চলে না।
মন চায় ছুটে যাই তার কাছে তারপর মনের সব কথা শেয়ার করি, তাকে সামনে বসিয়ে তাকে একপলকে দেখে চলি।
কিন্তু নিহান ভাইয়ার যা রাগ, তার সামনে গিয়ে তার রাগি চেহারা দেখলেই আমার সব কথা ফুস হয়ে নিভু নিভু মোমবাতির মতো অবস্থা হয়ে যায়।
এখন কেন যেন তার সাথে দু’একটা কথা বলতে গেলেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়।

আমার ভাবনার মাঝেই মা এসে হাজির হলেন।
তারপর রুমের এই অবস্থা দেখে আমি আর ইনু খুব কড়া বকা খেলাম।
হয়তো এই বকাবকি ঘন্টাখানেকের আগে থামতো না যদি না ১০ মিনিটের মাথায় হিদ এসে হাজির হতো।
হিদকে দেখে মন চাচ্ছিলো ওরে জড়ায় ধরে একটা চুম্মা দেই।
পিউর চুম্মা।
এই না হলে কলিজার দোস্ত! যে সবার আগে এসে আমার বিপদে হাজির হয়।
আম্মু হিদকে দেখে বেশিকিছু বললেন না।
শুধু বললেন যেন এই রুম সাফ করে ফেলি।
বলেই মা চলে গেলেন নিজের ঘরে।
মা যেতেই আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম।
এতক্ষণ তো মনে হচ্ছিলো আমি দম আটকে মরেই যাবো।
হিদ রুমের এমন বেহাল দশা দেখে ইনুকে তুলার বিছানা থেকে কোলে নিয়ে রুমের বাইরে বসিয়ে দিয়ে ইনুর মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো হিদ।
হিদের কান্ডে আমি না হেসে পারলাম না।

আমি বসে বসে কথা বলছি আর হিদ পুরো ঘর পরিষ্কার করে দিচ্ছে।
এতো করে মানা করলাম আমিই করবো পরে কিন্তু কে শুনে কার কথা?
আমিও মাঝে মধ্যে ফাউ ফাউ ভুলে যাই এই মেয়ে নিহান ভাইয়ার আপন বোন।
এরও তো নিহান ভাইয়ের মক্ত রক্তের শিরায় শিরায় জেদ আছে।
তাই এসব বিষয়ে কথা বলে সময় নষ্ট না করে ওরে চুপচাপ করতে দিলাম।

হিদ বাসায় এসে দেখে তার বাসায় তার চাচা-চাচী এবং আদ্রান লিভিংরুমে একসাথে বসে আছে।
তার অপরপাশে নিহান আর তার বাবা হেসে হেসে বলছে তাদের সাথে।
হিদকে নিহানের মা দেখতেই হাসিমুখে বলে উঠে,

—“ওইতো নাহিদা এসে গেছে। এখন আপনারা রিং পরিয়ে নিন।”

নাহিদার মাথায় যেন বাজ পরলো।
কি বলছে তার মা এসব?
কে কাকে রিং পরাবে আজিব!
নাহিদা কিছু বলার আগেই নিহানের মা এসে নাহিদার হাত ধরে আদ্রানের পাশে বসিয়ে দিলো।
নাহিদার সব যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
কিছুই বুঝতে পারছে না সে, হচ্ছেটা কি?

নাহিদা তো আন্দাজ করেছিলো আদ্রান নিহানের কাছে তাদের ব্যাপারটা খুলে বলবে কিন্তু আদ্রান তো এক্কেবারে বাবা-মাকে নিয়ে হাজির!
নাহিদা অতি শোকে যেন মূর্তির মতো হয়ে আছে।
আর কেউও তার অনুমতি নিলো না, তারা নিজেদের মতো করেই ব্যস্ত।
সবার এমন ভাব যে তারা আগে থেকেই জানে নাহিদা বিয়েতে রাজি।
আসলেই নাহিদা রাজি আছে তাই মনের সংকোচ নিয়ে প্রকাশ করলো না।
কেইবা চায় না তার ভালোবাসার মানুষটিকে সারাজীবনের মতো পেতে।
এখানে যে নাহিদার বেলায়ও ব্যতিক্রম নেই।
অবশেষে দুজনের এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেলো।
কিন্তু নাহিদার মনে একটা খটকা থেকেই গেলো।
আদ্রান এতো জলদি সব ম্যানেজ করলো কি করে?

ইদানীং খেয়াল করছি কেউ আমার পিছু নেয়।
সে আমি যেখানেই যাই না কেন, কিন্তু কে পিছু নেয় তা এখন অবধি ঠাহর করতে পারিনি।
আজও ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে মনে হলো কেউ আমাকে ফলো করছে।
খুবই সাবধানে ঘাড় কিছুটা ঘুরিয়ে বকঝার চেষ্টা করলাম কেউ পিছে আছে কি না।
হ্যাঁ আছে সেই কালো হুডিওয়ালা লোকটি।
আমার মনে কিছুটা ভয় লাগলো তাই জলদি জলদি পা চালাতে শুরু করলাম।
এই ফলোয়ারকে আমার মোটেই সুবিধার লাগে না।
হঠাৎ অদূরে একজনকে দেখে আমি থমকে দাঁড়ালাম।
ভয়টা যেন আমার আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেলো কারণ সামনেরই একটা মসজিদ থেকে ফয়সাল নামের সেই ছেলেটা বের হচ্ছে।
তার পোশাকে আরও অবাক হলাম।
আগে তার গলায় বিভিন্ন অলংকার, হাতে বেল্টের মতো কিছু আর হাতের প্রায় প্রতিটি আঙ্গুলেই বিভিন্ন রিং থাকতো।
কিন্তু এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন।
সে এখন পাঞ্জাবি, পাজামা পরিহিত। মাথায় টুপি।
সেসব অলংকার তার গায়ে নেই।
ফয়সালের এমন রূপ দেখে আমি যেন ভুলেই গেলাম আমাকে কেউ ফলো করছিলো।
ফয়সাল আমার সামনে দিয়েই গেলো কিন্তু সে একবারের জন্যে হলেও আমাকে বা আশেপাশের কোনো মেয়ের দিকে তাকায়নি।
তার দৃষ্টি একদম মাটির দিকে।
আদৌও কি মানুষ এতটা বদলাতে পারে?
এসব ভেবেই পিছে ফিরে ফয়সালের চলে যাওয়া দেখতে লাগলাম।
হুট করে কারো কন্ঠে পিছে ফিরে দেখলাম নিহান ভাইয়া।
নিহান ভাইয়াকে দেখে আমি যে কতোটা খুশি হলাম বলে বুঝাতে পারবো না।
কিন্তু খুশিটা চেহারায় ফুটিয়ে আনলাম না।
থাক না সুখগুলো মনের কুঠুরিতে অপ্রকাশিত হয়ে।

নিহান ভাইয়া ভ্রু কুচকে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত পর্যবেক্ষন করতে করতে বলে,

—“কিরে এই ভরদুপুরে রাস্তায় হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বাসা-বাড়ি নাই নাকি ভিক্ষা করতে নামছিস!”

গেলো মেজাজটা চোটে।
এই ফালতু লোকটা কোনোকালেই ভালোভাবে কথা বললো না।
এরে কি জম্মের পর মধু খাওয়ায় নাই আশ্চর্য!

—“আমি নাহয় এখানে ভিক্ষা করছি কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন? উপর মহলের লোকরা কি আপনাকে লাথি দিয়ে পলিটিক্স থেকে বের করে দিসে?” অনেকটা রেগেই বললাম।

—“তারা আমাকে লাথি দিয়ে বের করলে আগে তোরে তুলেই আছাড় মেরে আমার রাগ কমাইতাম। যদিও তাতেও কাজ না হতো আরও কয়েকবার আছাড় মেরে তোরে গুম করে দিতাম।”

নিহান ভাইয়ার এমন উত্তরে আমি তাজ্জব৷ বনে গেলাম।
তারপর আমতা আমতা করে বলি,

—“এসবের মধ্যে আমাকে টানলেন কেন?”

—“কারণ তুই-ই হয়তো আমাকে বদদোয়া দিবি।”

ভেংচি কাটলাম নিহান ভাইয়ার কথায়।

—“এই তোরে না বলসি মুখ বাঁকা করবি না কয়বার বলব?”

বলেই কয়েক কদম এগিয়ে আসলো।
আমি কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে কিছুটা সরে গিয়ে খুবই জলদি করে বলি,

—“কি জন্য আসছেন?”

—“ও হ্যাঁ ভালো কথা। নাহিদা বললো তোকে নিয়ে নাকি শপিং এ যাবে। আমি তোকেই কল করতাম কিন্তু তখনই তোকে গাড়ি থেকে এখানে দেখতে পাই। তাই ভাবলাম তোকে যেহেতু পেলাম সেহেতু তোকে এখান থেকেই নিয়ে যাই।”

নিহান ভাইয়ার কথায় আমি ছোট করে জাস্ট “ওহ” বললাম।
তারপর নিহান ভাইয়ার পিছে পিছে তার গাড়ির দিকে চললাম।
আমি মনে মনে ভাবছি আজ কি এই নেতাসাহেবের মিটিং টিটিং নেই?

চলবে!!!

বিঃদ্রঃ গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here