#বিরহ_শ্রাবণ
#পর্ব_৩
#লেখিকা:সারা মেহেক
ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে অভ্র ভাইকে দেখে যেমন চমকে উঠলাম, ঠিক তেমন খানিক বিস্মিতও হলাম। মুখ দিয়ে অস্ফূটস্বরে বেড়িয়ে এলো,
” অভ্র ভাই আপনি!”
আমার এ বিস্ময়ে আঁতকে উঠা চাহনি দেখে মৃদু শব্দে হেসে উঠলেন উনি। আমাকে ধাতস্থ হতে না দিয়েই মুহূর্তেই প্লেট হতে চামচের সাহায্যে একটা ফুচকা ধরলেন আমার মুখের সামনে। ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,
” নাও নাও, দ্রুত খেয়ে নাও। প্রত্যাশা আপু বলেছে, প্রোজ্জ্বল আসার আগেই ফুচকাগুলো সাবাড় করতে। ”
অভ্র ভাইয়ের কথায় আমি দ্বিধাগ্রস্থ চাহনিতে কয়েক সেকেন্ড উনার দিকে চেয়ে রইলাম। উনার এহেন আচরণে কিঞ্চিৎ আড়ষ্টভাব চলে এলো আমার মাঝে। এ আড়ষ্টতা কাটাতে উনার হাত থেকে চামচটা নিয়ে নিজেই ফুচকা মুখে পুরে নিলাম।
অভ্র ভাই মৃদু হাসলেন। ব্যাপারটিকে স্বাভাবিক ধরেই এবার আমার খাটে বসলেন। আগ্রহের সহিত আমার প্রশ্নপত্রের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কয়টা মডেল টেস্ট দিয়েছে?”
কিছুক্ষণ পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনায় খানিক বিব্রতবোধ করলেও উনার সাবলীল প্রশ্নে চট করে স্বাভাবিক হয়ে এলাম। অতঃপর কিঞ্চিৎ হতাশাজনক কণ্ঠে জবাব দিলাম,
” চারটা দিয়েছে। আর সময় বেঁধে দিয়েছে দশটা পর্যন্ত। ”
” আচ্ছা। কোনো প্রশ্ন বুঝতে সমস্যা? সমস্যা হলে বলতে পারো। আমি সলভ করার চেষ্টা করবো। ”
অভ্র ভাইয়ের প্রস্তাবে ক্ষণেই চিন্তার সাগরে ডুব দিলাম আমি৷ ভাবলাম, প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কানে এ কথা চলে গেলে আমায় শাস্তিস্বরূপ আরো মডেল টেস্ট না দিয়ে বসে! এ দোদুল্যমান পরিস্থিতি নিয়েই অভ্র ভাইকে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
” এখন হুট করে প্রোজ্জ্বল ভাই রুমে চলে আসলে বড়সড় একটা বাঁশ খাবো আমি। ”
আমার কথায় অভ্র ভাই মৃদু শব্দে হাসলেন। বললেন,
” প্রোজ্জ্বল দোকানে গিয়েছে চিনি আনতে। বাড়িতে চিনি ছিলো না বলে।
প্রোজ্জ্বল দোকানে যাওয়াতেই প্রত্যাশা আপু তোমার জন্য ফুচকা বানিয়ে নিয়ে আসছিলো। কিন্তু হঠাৎ চাচি রান্নাঘরের কোনো কাজের জন্য আপুকে ডেকেছিলো। তাই আমার হাতে তোমার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে এটা। এবার দ্রুত খাওয়া শেষ করে বলো, কি হেল্প লাগবে। ”
” আচ্ছা। আমি খেয়ে নেই আগে।”
” হুম খেয়ে নাও।”
এই বলে অভ্র ভাই আপনমনে ফোন টিপতে লাগলেন। আর আমি কোনোরকমে ফুচকা খেয়ে শেষ করলাম। এরপর কেমিস্ট্রি কয়েকটার প্রশ্নের ধরণ বুঝে নিলাম। আমাকে প্রশ্ন বুঝিয়ে দিয়ে অভ্র ভাই রুম হতে চলে গেলেন। অভ্র ভাইয়ের সাথে আমাদের পরিবারের ভাব খাতির ছোটবেলা হতেই। সে হিসেবে অভ্র ভাইয়ের সাথে আমারও পরিচিতি এবং ভাব খাতিরও ছোট হতে। অর্থাৎ যখন থেকে আমি মামাবাড়িতে থাকতে শুরু করি। অভ্র ভাইয়ের বোন হওয়ার স্বার্থে অনামিকার সাথেও আমার অনেক মিল। যেহেতু অনামিকা আর আমার বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না তাই অনামিকার সাথে আমার সম্পর্কটা অনেকটা বান্ধবীর মতো।
আর প্রতিবেশী হওয়ার খাতিরে অভ্র ভাই আর প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের বন্ধুত্ব ছোটবেলা থেকেই। পরে অবশ্য এ দুজনের বন্ধুত্বের সাথে ভাইয়াও যোগ দিয়েছিলো। প্রোজ্জ্বল ভাই ও অভ্র ভাইয়ের এমন গলায় গলায় ভাব ও বন্ধুত্ব নিয়ে আমাদের এলাকায় মাঝে মাঝেই তাদের নিয়ে বেশ চর্চা হয়। প্রত্যেকেই এই দুইজনের বন্ধুত্বের ও চরিত্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
অভ্র ভাইদের বাড়ি আমাদের বাড়ির ঠিক সামনের বাড়িটা। সেখানে বিশাল জায়গাজুড়ে ঘরগুলো বানানো। বাড়িতে অভ্র ভাইয়ের বাবা ও মা এবং ছোট বোন অনামিকা আছে। অনামিকা এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে৷
ছোট থেকে একই স্কুল ও কলেজে পড়ে এসেছেন দুজন। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাও দিয়েছিলেন একত্রে। কিন্তু চান্স পাওয়ার সময় প্রোজ্জ্বল ভাই আমাদের শহরের মেডিকেলে চান্স পেলেও অভ্র ভাই চান্স পেয়েছিলেন সদূর কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে। পরে অবশ্য মাইগ্রেশন করে অভ্র ভাই চলে আসেন। সেই থেকে দুজন একই মেডিকেলে পড়েছেন এবং এক বছর আগে পিছে বিসিএস দিয়ে বর্তমানে একই মেডিকেলে চাকরিও করছেন। যেখানে প্রোজ্জ্বল ভাই এনাটমির লেকচারার আর অভ্র ভাই সার্জারি ডিপার্টমেন্টের মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন।
মামা, প্রোজ্জ্বল ভাই, অভ্র ভাই ডাক্তারি পেশার সাথে যুক্ত হওয়ায় আমার মাঝেও মেডিকেলে পড়ার তীব্র ইচ্ছা চলে আসে। অবশ্য আমার ইচ্ছের সাথে মামিরও ভীষণ ইচ্ছে আমি ডাক্তার হয়ে নিজ পায়ে দাঁড়াবো। তার দু মেয়ের মাঝে অন্তত একটা মেয়ে ডাক্তার হোক, এটাই উনার চাওয়া। এ কারণে মামি প্রত্যাশা আপুকে মেডিকেলে পড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রত্যাশা আপু কোনোদিনও ডাক্তারিতে আসার ইচ্ছে পোষণ করেনি। বরং আপুর স্বপ্ন ছিলো, আপু বড় হয়ে ব্যাংকার হবে এবং বর্তমানে একজন ব্যাংকার হিসেবেই কর্মরত আছে আপু।
দশটার মধ্যে মডেল টেস্টগুলো কোনোভাবে শেষ করে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের রুম গেলাম। প্রোজ্জ্বল ভাই মেডিকেল রিলেটেড কি বই যেনো পড়ছিলেন। বই পড়া অবস্থায় উনাকে দেখতে ভীষণ শান্তশিষ্ট গোছের ছেলে বলে মনে হচ্ছে। বইয়ের উপর উনার তীক্ষ্ম চাহনি দেখে যে কেউ প্রথম দফায় ধোঁকা খেয়ে বসবে এই ভেবে যে, এই ছেলে মনে হয় ভীষণ পড়ুয়া এবং জ্ঞানী একটা ছেলে। কিন্তু বাইরের মানুষ না জানলেও বাড়ির ভেতরের প্রতিটা মানুষ জানে প্রোজ্জ্বল ভাই একদমই পড়ুয়া ধরণের ছেলে না। বরং হৈ-হুল্লোড়, খেলাধুলায় পারদর্শী একটি ছেলে। যদিও প্রোজ্জ্বল ভাই কখনো পড়ালেখা ফাঁকি দিয়ে এসব করেনি। বরং খুব কম সময়ের মাঝেই পড়া আত্মস্থ করে উনার শখ বা ফূর্তির কাজ করেছেন উনি।
আমাকে রুমে ঢুকতে বলে প্রোজ্জ্বল ভাই বইটা টেবিলে রাখলেন৷ অতঃপর আমার পানে সেই চিরাচরিত ভ্রুকুটি চাহনিতে কিয়ৎ সময়ের জন্য চেয়ে রইলেন। অতঃপর নিঃশব্দে আমার পানে হাত পেতে মডেল টেস্টের পেপারগুলো চাইলেন। এমসিকিউ পেপারটা উল্টেপাল্টে একবার দেখে নিলেন। অতঃপর আমার দিকে চেয়ে কণ্ঠে খানিকটা সন্দেহ মিশিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” পরীক্ষা ভালো দিয়েছিস তো?”
আমি বেশ আত্নবিশ্বাসের সহিত বললাম,
” হুম। ”
” বুঝে নিস কিন্তু। ভুল হলে মাকে বলে আচ্ছামতো শায়েস্তা করাবো, মনে থাকে যেনো। ”
” ঐ সুযোগ আর পাবেন না আপনি। ”
” না পেলেই খুশি।
আচ্ছা শোন, বাবার ওষুধের সময় হয়ে গিয়েছে। মা তো ঘুমিয়ে পড়েছে আগেই। তুই একবার চেক করে আয় যে বাবা ওষুধ নিয়েছে কি না। ”
” আচ্ছা যাচ্ছি।”
এই বলে আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে মামা মামির রুমে চলে এলাম। তাদের রুম খোলা পেয়ে বুঝতে বাকি রইলো না, মামা এখনো ঘুমাননি।
আমি আলতো শব্দে দরজায় করাঘাত করে রুমে প্রবেশ করলাম। মামা কি যেনো পড়ছিলেন। আমায় দেখে উনি পড়া বন্ধ করলেন। গলার স্বর খাদে নামিয়ে সতর্ক কণ্ঠে বললেন,
” কি রে চন্দ্রিমা? কিছু লাগবে? ”
আমি ধীর পায়ে মামার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম। এক নজর মামির দিকে চেয়ে মামাকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি রাতের ওষুধ খেয়েছেন মামা?”
” হুম খেয়েছি। চল বারান্দায় চল। অনেকদিন তোর সাথে ঠিকঠাক কথা বলা হয় না। ”
” আচ্ছা চলুন মামা। ”
আমি আর মামা বারান্দায় রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। মামা জিজ্ঞেস করলেন,
” তোর পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন? আর পনেরো দিন পর পরীক্ষা না?”
” হ্যাঁ মামা পনেরো দিন পর পরীক্ষা। প্রিপারেশনও বেশ ভালো। আর প্রিপারেশন ভালো না হয়ে যাবে কই। প্রোজ্জ্বল ভাই যেভাবে আমার পিছে পড়ে থাকে!”
” ও বেশি প্রেশার দেয় না তো আবার? এমন হলে বল। আমি ওকে বলে দিচ্ছি, তোকে যেনো বেশি প্রেশার না দেয়। ”
” না মামা। এমন প্রেশার আসলেই দরকার। প্রেশারে থাকলে পড়া হয়। আর প্রোজ্জ্বল ভাই তো চায়ই আমি মেডিকেলে পড়ি। আমারও খুব ইচ্ছা, মেডিকেলে পড়ে ডাক্তার হবো। নিজের পায়ে দাঁড়াবো। আর ধীরে ধীরে তোমাদের বোঝা কমানোর চেষ্টা করবো। তোমরা ছোটবেলা থেকে…..”
আমাকে পুরো বাক্য শেষ করতে না দিয়ে মামা মৃদুস্বরে এক ধমক দিয়ে উঠলেন। কিঞ্চিৎ রাগত স্বরে বললেন,
” খুব বেশি বড় হয়ে গিয়েছিস তাই না? এসব বোঝা-টোঝার কথা কোথ থেকে শিখেছিস? আর একবার যদি এসব নিয়ে কথা বলিস, তাহলে খবরদার ওর পর থেকে আমাকে মামা বলে ডাকবি না।
আমি প্রোজ্জ্বল, প্রত্যাশা আর তোর মাঝে কখনো কোনো পার্থক্য দেখিনি। তোরা তিনজন আমার আগলে রাখা যক্ষের ধন। তোদের খুশিকে আমি সবসময় বেশি প্রায়োরিটি দিয়েছি। তোর মামিও প্রোজ্জ্বল আর প্রত্যাশার মতো তোকে নিজের মেয়ের মতো পালনপোষণ করেছে। তাহলে এসব বোঝার কথা আসলো কোথ থেকে? কখনো শুনেছিস নিজ সন্তান তার বাবা মায়ের কাছে বোঝা হয়? ”
আমি নির্বাক ও নিশ্চুপ। মামার প্রতিটা কথা শুনে আমি আবেগে বদ্ধ হয়ে এলাম। আমার গলা ধরে এলো৷ চোখের কোনায় কিঞ্চিৎ নোনাজল জমলো। এ কথা আমার অজানা নয় যে এ মামা মামি আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। তাদের এ ভালোবাসার মূল্য এ জীবনে পরিশোধ করা আমার পক্ষে অসম্ভব বটে!
আমি হাসিমুখে মামাকে বললাম,
” আচ্ছা মামা৷ আর কখনো এমনটা বলবো না৷ এখন আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন৷ কালকে সকালে হসপিটালে ডিউটি আছে না?”
মামা আমার মাথায় হাত রাখলেন৷ পরম স্নেহের সহিত বললেন,
” হ্যাঁ আছে তো। আর চন্দ্রিমা, ভুলেও কখনো এসব বলিস না ঠিক আছে? এখন তুই গিয়ে শুয়ে পড়। না হয় ইচ্ছে করলে পড়তে বস। ”
” আচ্ছা মামা। ”
মামা ও আমি দুজনেই বারান্দা থেকে চলে এলাম৷ মামার রুম থেকে বের হয়ে আমি সোজা রান্নাঘরে চলে এলাম। আমার জন্য একটু কড়া একটা কফি বানিয়ে রুমে নিয়ে আসলাম। প্রথমে ইচ্ছে ছিলো, রুমের বারান্দায় বসে কফি খাবো। কিন্তু বারান্দায় গিয়েই আমার আমার মত পাল্টে গেলো।
আকাশে আজ বিশাল চাঁদ উঠেছে। একদম পরিপূর্ণ থালার মতো। পূর্ণিমা বলে কথা। এই পূর্ণিমা রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতেই আমি কফি নিয়ে প্রত্যাশা আপুর রুমে গেলাম। ইচ্ছে ছিলো আপুকে নিয়ে পূর্ণিমা উপভোগ করবো। কিন্তু রুমে গিয়ে দেখলাম আপু ফোনে কথা বলছে। এজন্য আর আপুকে বিরক্ত না করে একাই ছাদে চলে এলাম।
ছাদে পা রাখতেই চট করে মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গেলো। পুরো ছাদটা কেমন এক মন ভালো করা রূপালি আলোয় ছেয়ে আছে। অবশ্য শুধু ছাদ বললে ভুল হবে, আজ সারা বাতাবরণ এই চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে।
আমি কফির মগ নিয়ে ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালাম। মগটা রেলিঙের উপর রেখে আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। আজ চাঁদটা বরাবরের মতোই উজ্জ্বল ও রূপালি রূপে দেখাচ্ছে। ছোটবেলায় যেদিন চাঁদকে এরূপে দেখতাম সেদিন প্রত্যাশা আপুকে বলতাম, ‘জানো আপু, আজ চাঁদের মন ভালো। ও কোনো কারণে খুব হাসিখুশি আছে। এজন্যই আমরা এতো সুন্দর আলো পাচ্ছি।’ সেই এতো বছর পর চাঁদের এ মায়াময় রূপ দেখলে আজও মনে হয় চাঁদটা আজও ভীষণ খুশি। সে তার একাকিত্বে খুশি। যদিও তার সখী হিসেবে তারাগুলো তার চারপাশে মিটিমিটি জ্বলছে। আমি কিছুক্ষণ নীরবে চাঁদের দিকে চেয়ে রইলাম। ভালো লাগছে চাঁদকে দেখতে। চাঁদের রূপ উপভোগ করতে। এই একটা জিনিস রোজ রোজ দেখলেও কেনো যেনো বিরক্তি বোধ হয় না৷ রোজ মনে হয় চাঁদের নতুন রূপ দেখি। নতুন করে তার সৌন্দর্য পান করি৷ চাঁদের এ সৌন্দর্য উপভোগ করা নিয়ে নিজেকে এ মুহূর্তে চকোর বলে মনে হচ্ছে। যদিও চকোর এর ন্যায় আমার পাখা নেই। তবে আমাদের উদ্দেশ্য তো এক।
রজনীর এ মোহময় সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিতে আলতো নীরবতাকে আরও গভীর নীরবতায় রূপান্তর করার ভূমিকা পালন করছে ঝিঁঝি পোকারা। সাথে মাঝে মাঝে যোগ দিচ্ছে অদূরে কোনো এক গাছে বসে থাকা একটি পেঁচা। যেখানে ঝিঁঝি পোকার ডাক রজনীকে গাঢ় করে তুলছে সেখানে পেঁচার ডাক রজনীকে ছমছমে রহস্যময়তায় আবৃত করে ফেলছে। রূপালি রজনীর এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কফির কথা বেমালুম ভুলে বসলাম৷ যখন কফির কথা মনে পড়লো তখন কফির মগ নিতেই ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলাম। কারণ রেলিঙে রাখা কফির মগটা তার জায়গা থেকে উধাও। এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে কি মনে করে আমি চট করে পাশে ঘুরে দাঁড়ালাম। অতঃপর যা দেখলাম তাতে ক্ষণেই আমার হাত পা অসার হয়ে এলো। রুদ্ধবাক হয়ে গেলাম নিমিষের জন্য। আমার সম্মুখে চাঁদের আলোর বিপরীতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আলোর বিপরীতে থাকায় ও পিছে গাছের ছায়ায় তার চেহারা স্পষ্ট দেখতে পেলাম না৷ মস্তিষ্ক কিয়ৎক্ষণের জন্য ভাবনাশক্তি বন্ধ করে দিলো। ফলে ভয়ে চিৎকার দিতে উদ্যত হলাম আমি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে মানুষটা কথা বলে উঠলো। তার কণ্ঠ শুনে বুঝতে বাকি রইলো না, আমাকে ক্ষণিকের জন্য হার্ট ফেইল করিয়ে দেওয়া মানুষটি স্বয়ং প্রোজ্জ্বল ভাই। বরাবরের মতোই উনি আমার মাথায় একটা আলতো গাট্টা মেরে বললেন,
” একটু থেকে একটু হলেই ক্যাঁ কু করতে হয়? আরেকটু হলেই তো গলায় মাইক লাগিয়ে পুরো এলাকার লোকজন জড়ো করে ফেলতি!”
এই বলে প্রোজ্জ্বল ভাই হাতে থাকা কফির মগে চুমুক দিলেন। এক ঢোক কফি খেয়ে সন্তোষজনক কণ্ঠে বললেন,
” আর কিছু পারিস না পারিস কফিটা ভালোই বানাতে পারিস। এই এক মগ কফি খেলে সব ক্লান্তি আর ঘুম চট করে উড়ে যায়। ”
প্রোজ্জ্বল ভাই সহজে আমার প্রশংসা করেন না। কিন্তু যখন প্রশংসা করেন শুনতে খানিক ভালোই লাগে। তবে এ মুহূর্তে আমি উনার প্রশংসা শোনার মনমানসিকতায় একদম নেই। আমার কষ্ট করে বানিয়ে আনা কফি উনি আমার অনুমতি ছাড়াই গিলে গিলে খাচ্ছে, এটা কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না আমার। এ কারণে অকপট রাগ নিয়ে বলি,
” মাঝে মাঝে নিজেও তো কফি বানিয়ে খেতে পারেন তাই না? সবসময় আমার জিনিসে ভাগ বসান কেনো? এবার যদি বলি, আমার কফি খেয়ে ফেলার অপরাধে আপনাকে আমার জন্য কফি বানিয়ে আনতে হবে তাহলে?”
ভীষণ মজার একটা কৌতুক শুনেছেন এমন ভাবভঙ্গি করে রেলিঙে উঠে বসলেন প্রোজ্জ্বল ভাই। অতঃপর বেশ রয়েসয়েই বললেন,
” এট ফার্স্ট আমি কোনো অপরাধ করিনি। আর সেকেন্ডলি, আমি কফি বানিয়ে আনলেও তুই ওটা মুখেই দিতে পারবি না৷ বুঝেছিস?”
নাহ, লোকটার সাথে আর কথা বলতে মন চাইছে না৷ পূর্ণিমা রাতের সৌন্দর্য উপভোগের সময়টা উনি পিষে পিষে নষ্ট করে ফেলেছেন। সাধেই কি বলি, যেকোনো ভালো মুহূর্ত খারাপ করতে একদম পারদর্শী উনি! আমি আর কথা না বাড়িয়ে খিটখিটে মেজাজ নিয়ে রেলিঙ ঘেঁষে সম্মুখে মুখ করে তাকালাম। হঠাৎ আমার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো অভ্র ভাইদের উঠোনের উপর। অভ্র ভাই প্লাস্টিকের চেয়ারে দু পা সম্মুখে ছড়িয়ে বসে আছেন। উনার হাত দুটো মাথার পিছনে রাখা। এখান হতে দেখে মনে হচ্ছে উনি চোখ দুটোও বন্ধ করে রেখেছেন। অভ্র ভাইয়ের এ ভাবভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছে, খোলা আকাশের নিচে আরাম করে ঘুমুচ্ছেন উনি।
অকস্মাৎ কি মনে করে উনি চোখ মেলে সরাসরি আমাদের ছাদের দিকে তাকালেন। আমাকে দেখা মাত্রই হাত উঁচিয়ে বোধহয় নিজের উপস্থিতি জানান দিলেন। আমিও হাত উঁচিয়ে আমার উপস্থিতির জানান দিলাম। তৎক্ষনাৎ প্রোজ্জ্বল ভাই বিপরীত দিকে ঘুরতে ঘুরতে বললেন,
” এতো রাত বিরাতে কাকে হাই দিচ্ছিস? বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে ফেলেছিস না কি?”
আমি সরু চোখে খটোমটো গলায় বললাম,
” আপনার মাথায় সারাদিন ওসবই চলে। আমি অভ্র ভাইকে দেখে হাত নাড়াচ্ছিলাম৷ ”
ততক্ষণে প্রোজ্জ্বল ভাইও অভ্র ভাইদের উঠোন বরাবর দৃষ্টিপাত করেছেন। উনি আমার কথার প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে পকেট থেকে ফোন বের করলেন। অভ্র ভাইকে কল দিয়ে বললেন ছাদে চলে আসতে। অভ্র ভাইও উনার কথামতো প্রধান ফটকের সম্মুখে এসে হাজির হলো। কিন্তু এখানে এসে বাঁধলো বিপত্তি। রাত হওয়ায় আমাদের প্রধান গেট তালা দেওয়া রয়েছে। অভ্র ভাই তা প্রোজ্জ্বল ভাইকে জানালে প্রোজ্জ্বল ভাই চাবি আনতে নিচে যেতে উদ্যত হয়। কিন্তু অভ্র ভাই উনাকে থামিয়ে আচমকা একটি কাজ করে বসলেন। বেশ কয়েক কদম পিছিয়ে বাড়ির চারপাশের দেয়ালের প্রাচীর টপকিয়ে লাফ দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন। উনার প্রবেশের এ ধরণ দেখে প্রোজ্জ্বল ভাই টিটকারি মেরে অনেকটা বিড়বিড় করেই বললেন,
” ব্যাটা, তুই তো দেখি পাক্কা একটা ছুপা রুস্তম। ”
এদিকে শান্তশিষ্ট অভ্র ভাইয়ের এরূপ দেখে আমিও খানিক বিষম খেলাম।
বাড়ির ভেতরের লোহার গেট খোলা থাকায় সহজেই বাড়িতে প্রবেশ করলেন অভ্র ভাই। বাড়িডে ঢুকে সোজা চলে এলেন ছাদে। ছাদে আসতেই প্রোজ্জ্বল ভাই কফির মগ আমার হাতে দিয়ে এগিয়ে গেলেন অভ্র ভাইয়ের দিকে। অভ্র ভাইয়ের পিঠে জোরেশোরে একটা ঘা বসিয়ে পূর্বোক্ত কণ্ঠেই বললেন,
” তোমার হাবভাব তো ভালো না মিয়া। পুরোই চো’রের লক্ষ্মণ! ”
অভ্র ভাই হো হো করে হেসে উঠলেন৷ ভ্রু নাচিয়ে দর্পিত কণ্ঠে বললেন,
” মাঝে মাঝে একটু চো’র সাজতে হয়রে ব্যাটা। বলা যায় না, কখন কার প্রিয় জিনিসটা পছন্দ হয়ে যায়৷ তখন তো চু’রি করেই আনতে হবে সেই জিনিসটাকে।”
” শুধরে যা অভ্র। তোর চরিত্রে বিশাল রকমের দো’ষ আছে। অন্যের পছন্দের জিনিস চু’রি করতে যাবি কেনো?”
” অন্যের পছন্দের জিনিসটা আমার মনে ধরলে তো তাকে আর বলেকয়ে নেওয়া যায় না। এজন্যই চু’রি করে নিতে হয়।”
এই বলে চোখ টিপ মারলেন অভ্র ভাই। উনার এ কান্ডে হো হো করে হেসে উঠলেন প্রোজ্জ্বল ভাই। কিন্তু আমি কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম। অভ্র ভাইয়ের কথার অর্থ আমার কাছে একটু উদ্ভট বোধ হলো। তবুও উনার এ কথাটা খানিক ভালোও লাগলো বটে।
®সারা মেহেক
#চলবে?