#বিরহ_শ্রাবণ
#পর্ব_২০
#লেখিকা:সারা মেহেক
দু পরিবারের সম্মতিতে ঠিক এক মাস পর বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো। বিয়ের তারিখ পাকাপোক্ত করার পর মামি সবার জন্য মিষ্টি নিয়ে গেলো৷ আমি রান্নাঘরেই ছিলাম। এখানে দাঁড়িয়েই সবটা শুনলাম। বিয়ের তারিখ পাকাপোক্ত হওয়ার কথা শোনার পর মনের মাঝে এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হলো। এ এক মিশ্র অনুভূতি। লজ্জা, ভয়, আড়ষ্টতা সব মিলিয়ে একাকার হয়ে এলো। বুকের মাঝে অনবরত ধুকপুকানি চলছে। মুখখানা লজ্জায় উষ্ণ হয়ে আসছে। হাত দুখানা অল্প বিস্তর কাঁপছে। শেষমেশ অভ্র ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হলো, এ ভাবতেই রাজ্যের বিস্ময়ে আমার চোখজোড়া বড় হয়ে এলো। এতোদিন অভ্র ভাই শুধু ছিলো আমার প্রতিবেশি, ভাইয়ার বন্ধু। অথচ এক মাস পর উনাকে আমি নিজের স্বামী বলে পরিচিত দিবো! ভাবতেই লজ্জায় শরীর শিউরে উঠছে।
অভ্র ভাইরা চলে গেলে আমি রান্নাঘর হতে বেরিয়ে আসি। চেয়েছিলাম সবার আড়াল হয়ে নিজের রুমে চলে যাবো। কিন্তু তার হলো কই! সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়েই মামা পিছন হতে ডাকলেন আমায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মামার ডাকে নত মস্তকে উপস্থিত হলাম ড্রইংরুমে। ড্রইংরুমে তখনও নানু,মামি,প্রত্যাশা আপু, প্রোজ্জ্বল ভাই উপস্থিত ছিলেন। উনাদের দেখে আমি আরোও আড়ষ্ট হয়ে এলাম। মামা আমাকে ডেকে নিয়ে নিজের পাশে বসালেন। আমার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন,
” আমার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাতে খুশি তো তুই?”
এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে ব্যর্থ হলাম আমি৷ মৃদু হেসে বললাম,
” জানি না মামা। তোমরা আমার অভিভাবক। আমার ভালোর জন্য তোমরা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছো, নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে নিয়েছো। সেজন্য এ সিদ্ধান্তে আমার বলার কিছু নেই। ”
” আচ্ছা, একটা প্রশ্নের জবাব দে চন্দ্রিমা। ”
” জি মামা।”
” তুই কাউকে পছন্দ করতি না তো? সত্য কথাটা বলবি। যদি তুই কাউকে পছন্দ করে থাকিস তাহলে বিয়ে ক্যান্সেল করে দিবো। জানি, প্রশ্ন এ আগেই করা উচিত ছিলো। কিন্তু আমার একদম খেয়াল ছিলো না। ”
” না না মামা৷ আমি কাউকে পছন্দ করি না। আর এটা একদম সত্য বলছি। পছন্দ থাকলে নিশ্চয়ই প্রত্যাশা আপুকে বলতাম যেনো আপু বিয়ের কথা এগুতে নিষেধ করে। ”
আমার জবাবে মামা যে বেশ খুশি হলেন তা উনার চেহারার প্রতিক্রিয়া দেখে অনুমান করলাম। মামা বললেন,
” আলহামদুলিল্লাহ। শুনে খুব খুশি হলাম মা।
আচ্ছা, তুই রুমে যা। আমরা কিছু কথাবার্তা বলবো। ”
মামার কথায় আমি সোফা ছেড়ে উঠে নিজের রুমে চলে এলাম৷
————–
ফিজিওলজির কঠিন কঠিন ডেফিনিশন মুখস্থ করতে করতে মাথা গরম হয়ে এসেছে আমার। এরই মধ্যে এক ক্লাসমেটের তিনবার কল এসেছে। আমার সাথে কিছু পড়া ডিসকাস করতেই কল করেছিলো সে। প্রথমবার কল করায় তেমন বিরক্ত হইনি। কিন্তু দ্বিতীয়বার এবং তৃতীয়বার কল করায় প্রচন্ড বিরক্ত হই। এর ফলে এখন ডেফিনিশনও মাথায় ঢুকছে না৷
পড়তে পড়তে আবারো কল এলো৷ এবার আমি নিয়ত করি সেই ক্লাসমেটকে কড়া কড়া কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিবো৷ সেই উদ্দেশ্য নিয়েই কল রিসিভ করে বললাম,
” তোমার বোধহয় পড়া সব শেষ। এজন্যই আমাকে কল করে ডিস্টার্ব করছো তাই না? এটা কোন ধরণের ম্যানার্স?”
” কে ডিস্টার্ব করছিলো তোমাকে?”
ওপাশ থেকে অভ্র ভাইয়ের কণ্ঠ শুনে রীতিমতো চমকে গেলাম। কান হতে ফোন নামিয়ে দেখলাম অভ্র ভাইয়ের নাম্বার উঠে আছে। ইশ, না দেখে কি ভুল করে বসলাম! আমি আবারো কানে ফোন নিলাম। বললাম,
” ঐ এক ক্লাসমেট করছিলো। তারই সাথে কথা বলছিলাম। ”
” ওহ। তোমার কি মুড খারাপ?”
” কিছুটা। পড়া মুখস্থ করতে করতে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।”
ওপাশ হতে অভ্র ভাইয়ের মৃদু হাসির শব্দ শোনা গেলো। বললো,
” একটু রেস্ট নাও। তারপর পড়তে বসো। এখন না হয় চেয়ার ছেড়ে উঠে একটু বারান্দায় আসো। আজ বাইরে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশ। ”
আমি বই রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে বারান্দায় চলে এলাম। বারান্দায় আসতেই আমার দৃষ্টি আটকে গেলো অভ্র ভাইয়ের উপর। আমার বারান্দা হতে অভ্র ভাইদের বাড়ির উঠোন দেখা যায়। অভ্র ভাই সেখানেই একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন। উনার দৃষ্টি আমার উপর আবদ্ধ। এতো দূর হতে উনার চাহনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না৷ তবে এটা স্পষ্ট যে উনি আমার দিকে অন্যরকম চাহনিতে চেয়ে আছেন।
অভ্র ভাই প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর পূর্বের তুলনায় অপেক্ষাকৃত নরম গলায় বললেন,
” আমি কখনো ভাবিনি, এই দীর্ঘ অপেক্ষার পর অনায়াসে তোমাকে পেয়ে যাবো। আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম, এই বুঝি তুমি বিয়েতে ‘না’ করে দিবো। কিন্তু তোমার পক্ষ থেকে যখন উত্তরটা পজিটিভ এলো, তখন যে কি আনন্দ লাগছিলো তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।
তবে সরি, এভাবে হুটহাট বাবা মাসহ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসা। কিন্তু কি করবো বলো, তোমাকে আমার অনুভূতি বলার পর আমার তর সইছিলো না। তুমি খুশি তো এ বিয়েতে?”
অভ্র ভাইয়ের প্রতিটি কথা এতোক্ষণ যাবত মন্ত্র মুগ্ধের ন্যায় শুনছিলাম আমি। হঠাৎ উনার শেষোক্ত প্রশ্নে আমি বিহ্বল হয়ে পড়লাম। এখন এ প্রশ্নের কি জবাব দিবো আমি! আমি যে আমার অনুভূতিগুলো বুঝে উঠতে পারছি না। আমার অনুভূতিগুলো আমার নিজের নিকটই অব্যক্ত হয়ে পড়েছে।
আমি জবাব দিলাম,
” জানি না। এসব যে এভাবে হুটহাট হয়ে যাবে তা ভাবতে পারিনি। তবে আমি বুঝতে পারছি, আমার মাঝে সবকিছুর এক মিশ্র অনুভূতি তৈরী হয়েছে। আর আপনাকে ওভাবে মেনে নিতে আমার কিছু সময় প্রয়োজন। আশা করি সে সময়টা পাবো। ”
” অবশ্যই। তোমার যতোটা সময় প্রয়োজন তুমি নাও। আমি তোমাকে সময় দিতে প্রস্তুত। কারণ এখন আমি নিশ্চিত যে দিনশেষে তুমি আমারই হবে। আমার আর কোনো ভয় বা বাঁধা নেই। আজ আমি অনেক খুশি চন্দ্রিমা। আমার চার বছরের অপেক্ষার মিষ্টি ফল হিসেবে কয়েকদিন পরই তোমাকে পেতে চলেছি। এতো বছর অপেক্ষা করেছি, সেখানে আর না হয় কয়েকদিন অপেক্ষা করি। ”
উনার এরূপ কথায় আমি মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না যেনো। ঠিক এ মুহূর্তে উনার কথা ও বাচনভঙ্গি আমায় তীব্রভাবে আকর্ষণ করলো। মন চাইলো, অভ্র ভাইকে একবার সামনাসামনি দেখি, মন চাইলো জিজ্ঞেস করি, ‘আচ্ছা অভ্র ভাই, আপনি আমায় এতো ভালোবাসেন কেনো? আমি কি এতোটাই স্পেশাল আপনার জন্য? আমি কি সত্যিই আপনার এ মিষ্টি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য?’
আমি এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। নম্র কণ্ঠে বললাম,
” থ্যাংকইউ অভ্র ভাই আমাকে এ সময় দেওয়ার জন্য। ”
” আরে কি বলো! এতে থ্যাংকইউ বলার কি আছে! তোমার যে আসলেই সময় দরকার সেটা বুঝতে পারছি। সো এসব থ্যাংকইউের কোনো প্রয়োজন নেই। ”
এভাবে আমাদের কথা চলতে লাগলো। কথার এক পর্যায়ে কি মনে করে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের রুমের বারান্দার দিকে তাকালাম। উনার রুম আর আমার রুম পাশাপাশি হওয়ায় বারান্দাও পাশাপাশি হয়েছে। উনি বারান্দায় এসে আমার দিকে একবার চাইলেন এবং সামনে অভ্র ভাইয়ের দিকে একবার চাইলেন। কিন্তু কিছু না বলেই উল্টো পথে ফিরে গেলেন। অবশ্য তার কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই উনি ফিরে এসে বললেন,
” অভ্রর সাথে কথা বলা শেষ হলে একটু ছাদে আসিস। ”
এই বলেই উনি চলে গেলেন। উনি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার আর অভ্র ভাইয়ের কথা শেষ হলো। আমি তৎক্ষনাৎ ফোন রেখে ছাদে চলে এলাম। দেখলাম, প্রোজ্জ্বল ভাই ছাদের ঠিক মাঝ বরাবর বসে আছেন। আমি গিয়ে উনার পাশে বসতেই উনি বললেন,
” দ্রুতই কথা শেষ হয়ে গেলো যে?”
উনার কথার অন্যরকম সুরে খানিক অবাক হলাম। মনে হলো, উনি বোধহয় খানিক খোঁচা দিয়েই কথাটা বললেন। তবে আমি স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলাম,
” দ্রুত না। আপনার আসার অনেকক্ষণ আগে থেকেই কথা হচ্ছিলো। ”
” ওহ। ”
এই বলে উনি খানিক সময় নিশ্চুপ রইলেন। উনার এরূপ আচরণে আমি বেশ অবাক হলাম। কারণ প্রোজ্জ্বল ভাইকে কখনো এভাবে দেখিনি আমি। উনার মাঝে কেমন এক মনমরা, উদাসীন ও হতাশার ভাব বিরাজ করছে। হঠাৎ উনার এ পরিবর্তন দেখে আমি প্রশ্নই করে বসলাম,
” প্রোজ্জ্বল ভাই? আপনার কি মন খারাপ কোনো কারণে?”
প্রোজ্জ্বল ভাই তৎক্ষণাৎ পাশে ফিরে আমার দিকে চাইলেন। অনেকটা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললেন,
” কি বলিস! এমন কেনো মনে হলো তোর? আমার মন খারাপ থাকবে কেনো?”
” সেটা কি করে জানবো আমি? তবে আমার মনে হলো, আপনার মন খারাপ কোনো কারণে। কারণ আপনার চেহারায় স্পষ্ট তা ফুটে উঠেছে। ”
” তাই? আমার চেহারায় কি আমার মনের কথা ফুটে উঠে?”
উনার নিষ্প্রভ কণ্ঠের এ জটিল প্রশ্নে আমি থতমত খেলাম। উত্তর ভাবতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলাম। অতঃপর বললাম,
” জানি না প্রোজ্জ্বল ভাই। তবে এ মুহূর্তে আপনার মন খারাপের ভাব ফুটে উঠেছে আপনার চেহারায়। ”
আমার জবাবে প্রোজ্জ্বল ভাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বিড়বিড় করে বললেন,
” আমার মন খারাপের কারণ কেনো জানিস না তুই?”
উনি বিড়বিড় করে বললেও উনার কথা আধো আধো বুঝতে পারলাম আমি। অনেকটা দ্বিধান্বিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
” আমার কি জানা উচিত ছিলো আপনার মন খারাপের কারণ?”
প্রোজ্জ্বল ভাই আমার প্রশ্নে হাসলেন। এ হাসি কোনো সাধারণ হাসি নয়। এ হাসি ছিলো তুচ্ছতাচ্ছিল্যের হাসি। উনার এরূপ হাসি আমার গায়ে বিঁধলো। বোধ হলো, প্রশ্নটা করে কোনো ভুল করে বসেছি। আমি আর কথা বাড়ালাম না। সামনের দিকে ফিরে বসে রইলাম। প্রোজ্জ্বল ভাইও সামনের দিকে ফিরলেন। কিছুক্ষণ বাদে বললেন,
” জানিস চন্দ্রিমা? ছোট থেকে তোকে নিজের সামনে বড় হতে দেখেছি। কখনো ভাবিনি এভাবে তোর বিয়ে ঠিক হবে, এভাবে তুই আমাদের সবাইকে একা রেখে চলে যাবি। ”
উনার এ কথার প্রত্যুত্তরে আমি সরল মনে জবাব দিলাম,
” দূরে কোথায়? কয়েক কদম হাঁটলেই তো আমাকে দেখতে পাবেন। ”
উনি হাসলেন। বললেন,
” শুধু কি বাইরের দূরত্ব দিয়েই ব্যবধান হয় রে পাগলি? ওসব তুই বুঝবি না। তুই এখনও অবুঝ। বড্ড অবুঝ। এতো অবুঝ কেনো তুই? বয়স তো বাড়ছে, সাথে কি একটু বুঝও বাড়ার দরকার না?”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কথায় আমি বেশ বিরক্ত হলাম। অনেকটা কড়া গলায়ই বললাম,
” ধ্যাত, আপনার সাথে কথা বলে কেমন যেনো লাগছে। এতো ম’রা ম’রা কথা বলছেন কেনো? আর আমি অবুঝ না বুঝলেন? আমি কি এমন অবুঝের মতো কাজ করলাম শুনি? আচ্ছা বাদ দিন, আপনার সাথে এখন কথা বলতে মন চাইছে না। আমি গেলাম। আমার পড়া আছে।”
এই বলেই আমি উঠে চলে এলাম৷ কোনো সন্দেহ নেই আজ প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এরূপ আচরণ ও কথাবার্তায় আমি যারপরনাই বিরক্ত হয়েছি। উনি তো কখনো এমন ছিলেন না। তাহলে আজ এমন আচরণ কেনো! অদ্ভুত!
———-
” চন্দ্রিমা, দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। এখনও রেডি হোসনি?”
রুমের বাইর থেকে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের তাড়া পেয়ে দ্রুত ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। আমায় রুম হতে বের হতে দেখে উনি ভ্রুকুটি করে তাকালেন। বললেন,
” রেডি হতে যদি এতো সময়ই লাগে, তাহলে সকাল সাতটা থেকে রেডি হতে পারিস না? নিজেও লেট করিস। আমাকেও লেট করাস।”,
এই বলে উনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলেন। উনার পিছু পিছু আমিও নিচে নামলাম। মুখ দিয়ে টু শব্দটুকুও বের করলাম না৷
প্রোজ্জ্বল ভাই পার্কিং করা বাইক নিয়ে গেটের বাইরে বের হলেন। আমিও গেট হতে বের হয়ে বাইকের পিছে চড়ে বসলাম। বাইকে বসার পর উনি জিজ্ঞেস করলেন,
” বসেছিস ঠিকমতো?”
আমি উনার কাঁধে হাত রেখে বললাম,
” হুম বসেছি। আপনি স্টার্ট দিন। ”
প্রোজ্জ্বল ভাই বাইক স্টার্ট দিলেন, দু সেকেন্ডও হলো না, এমন মুহূর্তে অভ্র ভাই সেখানে উপস্থিত হলেন। উনিও বাইক নিয়ে বেরিয়েছেন আজ। বাইকটা আমাদের পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে বললেন,
” চন্দ্রিমা, আমি হসপিটালে যাচ্ছি। চলো, তোমাকে কলেজে দিয়ে আসি। ”
অকস্মাৎ আগমন ঘটা অভ্র ভাইয়ের এহেন প্রস্তাবে আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। কারণ আমি ইতোমধ্যে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের বাইকে বসে আছি। এমতাবস্থায় উনার বাইক হতে নেমে অভ্র ভাইয়ের বাইকে উঠা কি আদৌ ঠিক হবে?
” যা চন্দ্রিমা। অভ্রর সাথেই যা। এখন থেকে তো ওর সাথেই তোর চলাচল করতে হবে।”
মৃদু হেসে আমার এ দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটালেন প্রোজ্জ্বল ভাই। উনার এরূপ কথার প্রত্যুত্তর স্বরূপ অভ্র ভাই বললেন,
” প্রোজ্জ্বল, এখন থেকে তুই আর কষ্ট করিস না। যেদিন আমার সকালে ডিউটি থাকবে সেদিন আমিই চন্দ্রিমাকে দিয়ে আসবো। ”
প্রোজ্জ্বল ভাই মৃদু হেসে বললেন,
” আর কিসের কষ্ট। তোরই তো সময় এখন।
যা চন্দ্রিমা, দ্রুত যা। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। ”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের তাড়া পেয়ে আমি দ্রুত উনার বাইক হতে নেমে অভ্র ভাইয়ের বাইকে চড়ে বসলাম। আমি উঠতেই অভ্র ভাই বাইকে স্টার্ট দিয়ে চালানো শুরু করলেন। মুহূর্তেই আমরা প্রোজ্জ্বল ভাইকে পিছনে ফেলে চলে আসলাম।
কলেজে যাওয়ার পথে আচমকা বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির এ হঠাৎ আগমনে কয়েক সেকেন্ডের আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। অভ্র ভাই তড়িঘড়ি করে একটা বন্ধ দোকানের সামনে বাইক রেখপ আমায় নিয়ে নেমে পড়লেন। আমরা আশ্রয় নিলাম দোকানের শাটারের ঠিক সামনের জায়গাটায়। ততক্ষণে পূর্বের তুলনায়ও প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আষাঢ়ে বৃষ্টির এ তীব্রতা দেখে এ মুহূর্তে আমার প্রবলভাবে ইচ্ছা জাগলো বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু আজ কলেজের পথযাত্রী হওয়ায় এ ইচ্ছাকে দমন করে রাখতে হলো। তবে বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছা দমন করলেও বৃষ্টি ছোঁয়ার ইচ্ছা দমিত করে রাখতে পারলাম না। ডান হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁলাম। আহ কি প্রশান্তি! এমন শীতল ঝিরিঝিরি পরিবেশে বৃষ্টি ছোঁয়ার আনন্দই যেনো অন্যরকম। এ মিষ্টি শীতল অনুভূতি আরো গভীরভাবে অনুভব করতে আমি চোখজোড়া বন্ধ করলাম৷ চারপাশে গাড়ির যান্ত্রিক শব্দেও অন্তঃস্থল দিয়ে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা অনুভব করার চেষ্টায় মত্ত হলাম।
অকস্মাৎ কারোর হাতের স্পর্শে তড়িতে চোখ মেলে চাইলাম। দেখলাম আমার হাতের নিচেই অভ্র ভাইয়ের হাত। আমি চকিতে উনার দিকে চাইলাম। উনি মুগ্ধ হেসে আমার দিকে চেয়ে বললেন,
” তোমার সাথে বৃষ্টি ছোঁয়ার অনুভূতি উপলব্ধি করতে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলাম চন্দ্রিমা।
তুমি কেমন বলো তো, আমাকে এতো ব্যাকুল করছো কেনো?”
উনার এ প্রশ্নে আমি মুহূর্তেই লজ্জায় মিইয়ে এলাম। সাথে সাথে নত দৃষ্টিতে সামনে তাকালাম। অভ্র ভাই মানুষটা ভীষণ খারাপ। উনি মাঝে মাঝে এমন কথা বলে যে, লজ্জায় উনার সামনে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে যায়। উনার সাথে দু সপ্তাহের এ কথাবার্তায় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি, উনি ইচ্ছাপূর্বকই আমাকে এরূপ কথা শোনান। যেনো আমি আরো লজ্জায় পড়ে যাই।
আমাদের মাঝে আর কোনো কথা হলো না। বৃষ্টি শেষ হলেই আমরা দ্রুত বাইকে উঠে পড়ি। আজ আধ ঘণ্টা দেরি হয়ে গিয়েছে। নি’র্ঘা’ত প্রোজ্জ্বল ভাই আজ ভীষণ ব’ক’বে’ন আমায়। উনি হলেন সময়ের পাক্কা মানুষ। আর উনার ক্লাসেই যদি আধ ঘণ্টা দেরি করে ঢুকি তাহলে উনি কি কান্ডটাই না বাঁধিয়ে ফেলবেন!
অভ্র ভাই স্পিড বাড়িয়ে আমাকে দ্রুত কলেজে পৌঁছিয়ে দিলেন। উনার বাইক হতে নেমেই আমি এক প্রকার দৌড়ে ক্লাসে পৌঁছে গেলাম৷ ক্লাসে পৌঁছুতেই প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কঠোর দৃষ্টির সম্মুখীন হলাম। ভাবলাম আজ বুঝি উনি ক্লাসেই ঢুকতে দিবেন না আমায়। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে উনি ক্লাসে ঢুকার অনুমতি দিলেন। তবে ক্লাসে ঢুকার সাথে সাথেই উনি বলে বসলেন,
” সময়ের এতোটা অবহেলা আমার পছন্দ না। কারোর সাথে যদি সময় কাটানোর একান্তই ইচ্ছা থাকে, তাহলে সেটা ক্লাস টাইমের বাইরে কাটানো উচিত। ক্লাস টাইমে না। নেক্সট ক্লাসে এমন দেরি হলে আর ক্লাস করতে আসবে না। ”
প্রোজ্জ্বল ভাই সবার সামনে এভাবে খোঁচামূলক কথা বলবেন তা কখনো ভাবিনি আমি৷ ক্লাসে সবার সামনে এভাবে বলায় বেশ অপমানিত বোঊ করলাম আমি। সাথে উনার উপর ভীষণ রাগ হলো। আমি কোনো প্রকার প্রত্যুত্তর না দিয়ে পিছনের একটা সিটে গিয়ে বসে পড়লাম।
————-
আজ ঘোর বর্ষায় দিনদুনিয়া আঁধারে ছেয়ে গিয়েছে। প্রান্তিক আষাঢ়ের বৃষ্টি অন্যান্য সময়ের চেয়ে কি কারণে যেনো দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠলো। সাঁঝ ছুঁইছুঁই মুহূর্তের বৃষ্টিতে পরিবেশ রাতের ন্যায় রূপ ধারণ করলো। এমনই মুহূর্তেই বৃষ্টিকে আরোও একটুখানি উপভোগ্য করতে কফি বানানোর জন্য রুম হতে বের হলাম।
সিঁড়ির কাছে পা রাখতেই হঠাৎ প্রোজ্জ্বল ভাই তড়িঘড়ি করে নিজের রুম হতে বেরিয়ে এলেন। তীব্র উৎকণ্ঠিত গলায় বললেন,
” চন্দ্রিমা, আমাদের এক্ষুণি হসপিটালে যেতে হবে। আংকেল এক্সিডেন্ট করেছে। স্পট ডে’ড। অভ্র হসপিটালেই আছে। এক্ষুণি সবাইকে নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে। দ্রুত রেডি হয়েনে। ”
®সারা মেহেক
#চলবে