#বিরহ_শ্রাবণ(দ্বিতীয় খণ্ড)
#পর্ব_২৫
#লেখিকা_সারা মেহেক
খোদেজা মামি ও অনামিকা এমনকি প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের ধারণা অভ্র ভাই ইচ্ছে করে কোথাও যাননি। উনাকে গু”ম করা হয়েছে। সোজা ভাষায় বললে উনি কি”ড”ন্যা”প”ড হয়েছেন৷ প্রথমত আমার এমনটা বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু অনামিকা বললো, অভ্র ভাইয়ের গু”ম হয়ে যাওয়ার পিছনে একটা কারণ তারা অনুমান করছেন। তা হলো, ইয়াসির মামা মারা যাওয়ার পর উনার ভাইয়েরা জমি জমা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে অভ্র ভাইয়ের সাথে দ্ব’ন্দ্ব ফ্যা’সা’দে জড়িয়ে ছিলেন। খোদেজা মামির ধারণা এরই রেশ ধরে অভ্র ভাইকে উনারা গু”ম করেছে। যদিও অভ্র ভাইয়ের চাচারা এ আ’রো’পকে সম্পূর্ণভাবে নাকচ করে দিয়েছেন।
খোদেজা মামি এ কারণে থা’না’য় মিসিং রিপোর্ট ফাইল করিয়েছেন। মামির পরিচিত এক চাচাতো ভাই পুলিশে আছেন বলে এ বিষয়টা গভীরভাবে খতিয়ে দেখছেন।
অনামিকার কাছে এসব শোনার পর আমার আর অভ্র ভাইদের বাড়ি থাকার শক্তি রইলো না। আমি কোনোরকমে ওকে কাজের বাহানা দিয়ে বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি এসে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। সবকিছু কেমন অগোছালো লাগছে আমার কাছে। অনুভূতি, ভাবনা সব জট পাকিয়ে গিয়েছে যেনো।
বিয়ের দিন অভ্র ভাই যখন ঐ ম্যাসেজটা দিয়েছিলেন সে মুহূর্তের জন্য প্রচণ্ড প্র’তা’রি’ত অনুভূত হয়েছিলাম। বলা বাহুল্য, উনার প্রতি আমার মনে অসম্ভব ক্রোধ ও অভিমান জমা হয়েছিলো। বারংবার নিজেকে প্রশ্ন করতাম, অভ্র ভাই কেনো আমাকে মিছে স্বপ্ন দেখিয়ে মাঝপথে ফেলে গেলেন। আজ শুধুমাত্র উনার জন্যই মামির সাথে আমার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক বদলে গিয়েছে চোখের পলকে। না চাইতেও এখন উনি আমার স্বামী। অথচ কোথাও না কোথাও এখনও আমার স্মৃতিপটে অভ্র ভাইয়ের সাথে কাটানো সব স্মৃতি জমা আছে। অনুভূতি আছে কি না জানা নেই। মাঝে মাঝে নিজেকে পুরোপুরি আবেগ অনুভূতি শূন্য একজন মানুষ মনে হয়, নির্জন দ্বীপের এক বাসিন্দা মনে হয়।
এখন ঠিকভাবে ক্লাসেও মনোযোগ দিতে পারি না। রাতের ঘুমটাও পরিপূর্ণরূপে হয় না। কারণ সেদিনের পর হতে যে ক’টা রাত কাটিয়েছি, প্রতি রাতেই অভ্র ভাইকে স্বপ্নে দেখেছি। স্বপ্নে উনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে থাকেন, নিজের সাথে অজানা গন্তব্যের যাওয়ার জন্য আহবান জানান৷ আমিও মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় উনার আহবানে সাড়া দেই। কিন্তু যখনই উনার হাতে হাত রাখতে যাই তখনই আমার ঘুম ভেঙে যায়। ধড়ফড়িয়ে ঘুম হতে উঠে দেখি, ওসব নিছকই একটা স্বপ্ন ছিলো। এমন স্বপ্ন দেখার কারণ হয়তো অভ্র ভাইয়ের সাথে কাটানো দীর্ঘ একটি সময়ের প্রভাব পড়েছে আমার উপর।
কিছু নিরিবিলি ক্ষণে যখন সময় কাটাই তখন অভ্র ভাইয়ের স্মৃতিগুলো আমার মন-মস্তিষ্কে ঘুরে বেড়ায়। আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে, উনার ভালোবাসার রেশ এখনও আমার মনে গেঁথে আছে। হয়তো উনি আমার জীবনে প্রণয় বার্তা বহন করা প্রথম পুরুষ বলে!
কিন্তু আজ অনামিকার কথা শুনে আমার মনে বহু প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে। আসলে অভ্র ভাইয়ের সাথে কি হয়েছে,কোথায় উনি, খোদেজা মামি অভ্র ভাইকে নিয়ে যে সন্দেহ করছেন তা কি আদৌ সঠিক নাকি এর পিছনে অন্য কারণ আছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর আমাকে প্রোজ্জ্বল ভাই দিতে পারবেন। প্রতিটি প্রশ্নের জবাব চাইতে নিজেকে শান্ত করে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। রুমের দরজা খোলা থাকায় নক না করেই ভিতরে ঢুকলাম। রুমে ঢুকে দেখলাম প্রোজ্জ্বল ভাই বিছানায় শুয়ে আছেন। আমি গিয়েই উনার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি আমাকে অভ্র ভাইয়ের কথা বলেননি কেনো?”
অকস্মাৎ আমার কণ্ঠ শুনে প্রোজ্জ্বল ভাই হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলেন। হতবুদ্ধির ন্যায় ক্ষণিকের জন্য আমার দিকে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি বললি, আবারো বল।”
” অভ্র ভাইয়ের সাথে এসব হয়েছে আমাকে আগে বলেননি কেনো?”
প্রোজ্জ্বল ভাই আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক আমার দিকে চেয়ে রইলেন। অতঃপর আমার থেকে দৃষ্টি লুকিয়ে আমাকে পাশ কাটিয়ে উঠে গেলেন। উনার এ নিরুত্তর ভাবভঙ্গিতে বিরক্ত হলাম খানিক। তবুও উনার পিছু পিছু গিয়ে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে প্রোজ্জ্বল ভাই আমার দিকে ফিরে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” কার কাছ থেকে এসব শুনেছিস? ”
আমার এক বাক্যের জবাব,
” অনামিকা।”
প্রোজ্জ্বল ভাই ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে মুখশ্রীতে বিরক্তির একটা ভাব ফুটিয়ে তুললেন। পাশ ফিরে বিড়বিড় করে বললেন,
” নিষেধ করেছিলাম ওকে না বলতে। তারপরেও….”
উনার সম্পূর্ণ কথা শেষ হতে না দিয়ে আমি শক্ত হাতে উনার গাল ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলাম। উনার দৃষ্টি বরাবর দৃষ্টি রেখে নিরেট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
” কেনো নিষেধ করেছিলেন? আমার কি জানার অধিকার নেই? আর এতো কিছু হয়ে গেলো আমাকে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলেন না!”
উনি পুনরায় নিরুত্তর রইলেন। আমি উনার গালের উপর হতে হাত সরিয়ে নিয়ে আবারো বললাম,
” অভ্র ভাই যা করেছেন আমার সাথে করেছেন, উনার কৃতকর্মের ভুক্তভোগী আমি। তাহলে এ ঘটনার সাথে সম্পর্কিত প্রতিটি আলোচনা, পদক্ষেপ কি জানার অধিকার নেই আমার?”
প্রোজ্জ্বল ভাই নিস্তেজ কণ্ঠে ছোট্ট করে জবাব দিলেন,
” আছে। ”
” তাহলে? আমাকে জানাননি কেনো? আপনারা তিনজন সবকিছু জেনেছেন, করেছেন, খোঁজ রাখছেন, অথচ আমাকে কিছুই জানানোর প্রয়োজন বোধ করছেন না!”
এটুকু বলতে বলতে আমার গলা শুকিয়ে এলো। কণ্ঠনালির উপরাংশে শক্ত দলার ন্যায় কান্না অনুভূত হলো। চোখজোড়া অল্পবিস্তর ভিজে এলো। প্রোজ্জ্বল ভাই আমার এমন করুণ অবস্থা দেখে মায়াভরা চাহনিতে আমার দিকে চাইলেন। আমার গালে আলতো হাত রেখে নম্র স্বরে বললেন,
” কান্না করিস না চন্দ্রিমা। তোর অবস্থা বুঝতে পারছি আমি। কিন্তু কান্না করিস না প্লিজ। তুই কাঁদলে আমার ভালো লাগে না। চেয়ারে বস। আমি তোকে সব বলছি। ”
এই বলে উনি আমার পিছন হতে পায়ের সাহায্যে চেয়ার এগিয়ে নিয়ে আমার পিছন বরাবর রাখলেন। আমার দু বাহু ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। আর নিজে দু হাঁটু গেঁড়ে আমার সামনে বসলেন। কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলেন। অতঃপর নত মস্তকে মেঝের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। এরপর মাথা তুলে আমার দিকে চেয়ে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” অভ্রের এ বিষয়টা ইচ্ছা করেই তোকে বলিনি চন্দ্রিমা। কারণ তোর অবস্থা কেমন তা দেখেছি আমি। এমন পরিস্থিতিতে আমি কি করে তোকে অভ্রের কথা বলতে পারি বল? আর আমি অনেকটা সন্দেহের জোরেই খোদেজা চাচিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম অভ্রর কোনো সমস্যা হয়েছিলো কি না। কারণ আমি যতটুকু ওকে জানি ও এমন ছেলে না যে একটা মেয়েকে এভাবে মাঝপথে একা ফেলে চলে যাবে৷ নিশ্চয়ই এর পিছনে কোনো কারণ আছে।
অভ্র আমাকে একদিন ওদের জমি সংক্রান্ত সমস্যার কথা বলেছিলো। যদিও জমিজমার ব্যাপারটা খোদেজা মামির সাথে কথা বলার আগে আমার মাথায় আসেনি। কিন্তু খোদেজা মামি যখন এ ব্যাপারে বিস্তারিত বললেন তখন আমি আবারো ভাবলাম এটা নিয়ে। অনেকক্ষণ ভাবার পর মনে হলো, হ্যাঁ এমনটা হতে পারে। জমিজমার ঝামেলা নিয়ে ওর চাচারা ওকে গু”ম করে দিতে পারে। ”
” আচ্ছা, সব মানলাম। কিন্তু উনার ঐ ম্যাসেজটার মানে কি জানেন? উনি যদি গু”মই হয়ে থাকেন তাহলে আমাকে ওমন ম্যাসেজ দিবেনই বা কেনো। ঐ ম্যাসেজটা পড়লেই বুঝা যাচ্ছে, ওটা ইচ্ছাকৃতভাবে পাঠানো হয়েছে। এর ব্যাখ্যা কি দিবেন প্রোজ্জ্বল ভাই? ”
প্রোজ্জ্বল ভাই দ্বিধান্বিত হয়ে দুপাশে মাথা দুলিয়ে বললেন,
” তা আমি জানি না। অভ্রর ওমন ম্যাসেজের কারণ আমার জানা নেই। এখন আমার প্রথম প্রায়োরিটি অভ্রকে খুঁজে বের করা। ব্যস। ”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। কিন্তু বিড়বিড় করে বললাম,
” জানি না, আপনারা দু বন্ধু মিলে কি করছেন। কেনো করছেন।”
প্রোজ্জ্বল ভাই আমার বিড়বিড় করে বলা প্রতিটা কথা শুনলো। কিঞ্চিৎ অবিশ্বাস্যের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” তোর কি মনে হয় এসব আমরা করছি? ”
আমি নিরস কণ্ঠে জবাব দিলাম,
” জানি না আমি। কিন্তু আপনাদের দুই বন্ধুর কারণেই আমার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছে। না চাইতেও অনেক কিছুর সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে।”
” এসবের কারণে তুই আমাদের দায়ী করছিস চন্দ্রিমা?”
” অবশ্যই। আপনারাই দায়ী আমার এ করুণ পরিস্থিতির জন্য। এক বন্ধু আমাকে ভালোবাসার রঙিন স্বপ্ন দেখিয়ে মাঝপথে ফেলে রেখে গেলো। আর আরেক বন্ধু আমার উপর সহানুভূতি দেখিয়ে সেই মাঝপথ থেকে আমায় উদ্ধার করলো। কিন্তু আপনি কি জানেন আপনার এই লোকদেখানো সহানুভূতি আমাকে কতোটা ভোগান্তি দিচ্ছে?”
প্রোজ্জ্বল ভাই অসহায় চাহনিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। বিবশ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” সত্যি আমার এ বিয়ে করার সিদ্ধান্ত তোকে এতোটা ভোগান্তি দিচ্ছে? ”
আমি জবাব দিলাম না। দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলাম। প্রোজ্জ্বল ভাই আমার থুতনি ধরে নিজেকে আমার দিকে ফিরিয়ে নিলেন। পূর্বের ন্যায় জিজ্ঞেস করলেন,
” আমাকে এতোটাই কি অসহ্য লাগছে তোর কাছে? আমাকে তোর স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারছিস না?”
উনার এমন প্রশ্নে আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম। কেনো যেনো প্রশ্ন দুটো পুরোপুরি অবান্তর মনে হলো আমার কাছে। যেখানে আমাদের বিয়েটা জোরপূর্বক হয়েছে, সেখানে এমন প্রশ্ন করার পূর্বেই তো উত্তর জেনে থাকা দরকার। আমি অনেকটা তাচ্ছিল্যের সুরেই বললাম,
” প্রোজ্জ্বল ভাই, এসব প্রশ্ন মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে যতোটা সহজ মনে হচ্ছে, আমার জন্য এর উত্তর দেওয়া ঠিক ততোটাই কঠিন মনে হচ্ছে। ”
” তোর এ কথার মানে কি বুঝবো চন্দ্রিমা? ”
” যেটা বুঝতে চান সেটাই বুঝে নিন। আমি আর কথা বাড়াবো না। ”
” আচ্ছা। আগের প্রশ্নগুলো বাদ দিলাম। আমি আরেকটা প্রশ্ন করতে চাই। তুই কি এখনও অভ্রকে ভালোবাসিস?”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এহেন প্রশ্নে আমি নিরুত্তর হয়ে পড়লাম৷ তৎক্ষনাৎ কোনো জবাব পেলাম না। মনের মাঝে হাতড়ে হাতড়েও এর উত্তর খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলাম৷ উনার এ প্রশ্নটিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে আমি দৃষ্টি সরিয়ে ফেললাম। আমার এ নিরুত্তর ভঙ্গিতে প্রোজ্জ্বল ভাই ক্ষীণ শব্দে হাসলেন। বললেন,
” মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ চন্দ্রিমা। তাহলে তুই কি ডিভোর্স চাস আমার কাছ থেকে?”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের শেষোক্ত প্রশ্নটি আমার কানে ঝংকার তুললো। আমি তৎক্ষনাৎ উনার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কঠিন স্বরে বললাম,
” সবকিছু আপনার কথার মতো সহজ হয় না প্রোজ্জ্বল ভাই। চাইলাম আর ডিভোর্স হয়ে গেলো, এমনটা হয় না। সবকিছু পরিবেশ পরিস্থিতি মেনে চলে। ”
এই বলেই আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে উনার রুম হতে চলে এলাম। এ মুহূর্তে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের প্রতিটি প্রশ্ন নিতান্তই অবান্তর ও বিরক্তিকর লাগছে আমার কাছে৷ জানি না, কি হয়েছে উনার। উনার এমন উদ্ভট প্রশ্ন করার কারণই বা কি। জানতে চাই না এ মুহূর্তে এসবের কারণ। এ মুহূর্তে একটু নিজেকে শান্ত করতে চাই। এসব দুঃশ্চিতা, চাপ হতে নিজেকে একটু দূরে নিয়ে যেতে চাই। এজন্য এক সেট থ্রিপিসসহ ওয়াশরুমে ঢুকলাম। শাওয়ার ছেড়ে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ।
———-
প্রোজ্জ্বল ভাই ও আমার বিয়ের কথা কলেজের সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম আমি। প্রোজ্জ্বল ভাইকেও এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু গতকাল রিমার সাথে প্রোজ্জ্বল ভাই ও অভ্র ভাইয়ের বিষয়ে কথা বলায় পিছন হতে আমাদেরই এক ব্যাচমেট শুনে ফেলে। ব্যস, একদিনেই আমার আর প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের বিয়ে সম্পর্কে পুরো কলেজ জেনে যায় এবং তারা এটাও জেনে যায় যে, প্রথমে অভ্র ভাইয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা হলেও উনি বিয়ের দিন আমাকে রেখে চলে যান। এ কারণেই প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছে আমাদের পরিবার। বলা বাহুল্য, আমার আড়ালে আমাদের চেনা পরিচিত বেশ ক’জন এ বিষয়ে আলোচনা সমালোচনা করেছে। আমি প্রথমে তাদেরকে এ নিয়ে কথা শোনাতে চাইলেও প্রোজ্জ্বল ভাই আমাকে নিষেধ করেন বিধায় আমি আর এ নিয়ে ঘাটতে চাইনি।
এ কয়দিন ক্লাস শেষে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে বাইকে চড়ে বাসায় ফিরছি। চেষ্টা করছি সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নিতে, সবকিছু স্বাভাবিক করতে। কিন্তু তবুও মনের মাঝে খুঁতখুঁতে একটা অনুভূতি বিরাজ করছে। কারণ যত যা-ই হোক, প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে কিছুদিন আগ পর্যন্তও অন্য এক সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু আজ সে সম্পর্কের নাম বদলে গিয়েছে। আর পরিস্থিতির শিকার হয়ে হয়তো আমাকে এ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই বাকিটা জীবন কাটাতে হবে।
আজ কলেজ থেকে এসেই নানুর রুমে চলে গেলাম। নানু তখন বসে বসে কোরআন পড়ছিলো। আমাকে দেখে শেষ দুটো আয়াত পড়ে কোরআন বন্ধ করে বসলো। নানু জায়নামাজেই বসে রইলো। আর আমি নানুর সামনে গিয়ে বসলাম। নানু আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন,
” কলেজ থেকে ফিরে খুব ক্লান্ত। তাই না?”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
” কলেজ থেকে ফিরে ক্লান্ত না নানু। এই এক সপ্তাহের নতুন সম্পর্কে আমি ক্লান্ত। নানু? আমি কি কখনো এমনটা চেয়েছিলাম? না। তাহলে আমার সাথে এমনটা কেনো হচ্ছে? কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছি আমি?”
নানু আদুরে ভঙ্গিতে ব’কে আমার বাহুতে আলতো চাপড় দিয়ে বললেন,
” ছিঃ, ওসব বলতে নেই চন্দ্রিমা। এ বিয়ে তোর পাপের শাস্তি হবে কেনো। বরং বল, এটা তোর কোনো পূণ্যের উপহার। নাহলে প্রোজ্জ্বলের মতো স্বামী কি পাওয়া যায়?”
” নানু, আমি তো প্রোজ্জ্বল ভাইকে কখনো ঐ নজরে দেখিনি। কিন্তু আচমকা প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্কটা স্বামী স্ত্রীর হয়ে গেলো। তুমিই ভেবে বলো, এতো সহজে কি এটা মেনে নেওয়া যায়? আবার যেখানে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো অভ্র ভাইয়ের সাথে, সেখানে আমার বিয়ে হলো, প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে। ”
নানু মৃদু হাসলো। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
” শোন চন্দ্রিমা, যা হয়েছে, আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আল্লাহ তোর ভাগ্য প্রোজ্জ্বলকে লিখে রেখেছিলো বিধায়ই একটা ঘটনার মাধ্যমেই প্রোজ্জ্বলের সাথে তোর বিয়েটা হলো। আর আমাদেরও ইচ্ছা ছিলো ঘরের মেয়েকে ঘরে রাখা। এখন যা হয়েছে তা তোকে মেনে নিতেই হবে।
আর শোন, গতকাল তোর মামি কথায় কথা বলছিলো, তোর সাথে অতো খারাপ ব্যবহার করা উচিত হয়নি। এখন যা হয়েছে মেনে নিতে হবে। আরোও বলছিলো, তোকে কাছে ডেকে কিছু কথাও বলবে। ”
এতোক্ষণ যাবত গোমড়ামুখো হয়ে থাকলেও নানুর শেষোক্ত কথাগুলো শোনার পর খুশিতে চোখজোড়া চকচক করে উঠলো। এবার বুঝি, মামি আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। সেই আগের মতো ভালোবাসবেন আমাকে।
নানু বললো,
” দেখ চন্দ্রিমা, যা হয়েছে তা মেনে নেওয়ার চেষ্টাটুকু তো কর। বাকিটা আল্লাহ ভরসা। আর এ বিয়ের সম্পর্কে তোর তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। প্রোজ্জ্বল তোর উপর অ’ত্যা’চার করছে এমনটা তো না। এমনটা হলে আমিই বলতাম এ বিয়ের সম্পর্ক শেষ করে দিতে। যেখানে প্রোজ্জ্বল আর আমরা সবাই মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছি, সেখানে তুই কি পারবি না একটু চেষ্টা করতে? আর নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে বলে একটু সময় লাগছে বোধহয় তোর মেনে নিতে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, একটু চেষ্টা করলেই পারবি এ সম্পর্কটা মেনে নিতে।
এখন যা গোসল-টোসল করে নামাজ পড়ে খেয়েনে। আমি নিচে গিয়ে তোর মামিকে খাবার বাড়তে সাহায্য করি। ”
এই বলেই নানু জায়নামাজ ভাঁজ করে উঠে চলে গেলো। আর আমি সেখানেই বসে রইলাম৷ নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম,’ আমি কি আদৌ অভ্র ভাইকে পুরোপুরি ভুলিয়ে এ সংসার করতে পারবো? আদৌ প্রোজ্জ্বল ভাইকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবো? ‘
—————-
আমি আর প্রোজ্জ্বল ভাই একই রুমের একই বিছানায় শুয়ে আছি। এ মুহূর্তে আমার মাঝে এক দমবন্ধকর অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের অবস্থা কেমন জানা নেই। তবে আমার অবস্থা বেশ করুণ। আমি এভাবে উনার সাথে শুয়ে থাকতে পারছি না। কিন্তু এছাড়া আর উপায়ও নেই। আজ বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে মেঝে বেশ ঠাণ্ডা হয়ে আছে। এমতাবস্থায় না প্রোজ্জ্বল ভাইকে নিচে শুয়ে থাকতে বলা যায়, আর না আমার শুয়ে থাকার মতো কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এসব কারণে অগত্যা আমাদের একই বিছানায় শুয়ে থাকতে হচ্ছে। যদিও দুজনের মাঝে দূরত্ব অনেক। তবে এরপরও আমার মধ্যকার অস্বস্তিকর অনুভূতির ইতি ঘটছে না।
আজ সন্ধ্যায় মামি আমার রুমে এসেছিলেন। রুমে এসে বেশ কিছুক্ষণ উনি চুপচাপ বসে ছিলেন। এরপর হঠাৎ উনি বলে বসলেন,
” আমাকে মাফ করে দিস চন্দ্রিমা। আমার অমন ব্যবহার করা উচিত হয়নি। ”
এই বলে মামি আমার মাথায় হাত রাখলেন। আজ এতোদিন পর মামির সেঁধে আমার সাথে কথা বলতে আসা, আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলানো, সবকিছু আমায় আবেগী করে তুললো। এ কদিন যাবত মামির এমন স্নেহের আচরনেরই কমতি অনুভব করছিলো। আর আজ তা মামি পূরণ করে দিলো। সবচেয়ে বড় কথা, মামি আমায় মাফ করে দিয়েছে।
মামির এ আচরণে তৎক্ষনাৎ আমার চোখজোড়া ভিজে এলো। আমি মামিকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলাম। মামিও আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। আমাদের এ আবেগী মুহূর্ত বেশ কিছুক্ষণ স্থায়ী রইলো। এরপর মামি আমাকে নানুর মতোই বুঝ দিয়ে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের রুমে পাঠিয়ে দিলেন। উনার কথা, বিয়ে হওয়ার পর অযথা স্বামী স্ত্রী আলাদা রুমে থাকবে কেনো।
মামির এমন পদক্ষেপ আমি না চাইতেও মেনে নিলাম। কারণ এতোদিন পর মামি আমাকে পুনরায় আপন করে নিয়েছেন। আমি চাই না আমার কোনো আচরণে মামি কষ্টে থাকুক। এজন্য মুখ বুজে এসব সহ্য করে নিলাম।
——————–
অভ্র ভাইয়ের গু’ম হওয়ার ঘটনার প্রায় দেড় সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। কিন্তু এখনও উনার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুলিশ বলছে, আমাদের শহর ভালোভাবে খুঁজেও উনাকে পাওয়া যায়নি। উনারা সন্দেহ করছেন, নিশ্চয়ই অভ্র ভাইকে শহরের বাইরে নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে অভ্র ভাইয়ের চাচাদের গ্রে’ফ”তা’র করা হলেও তারা গু’ম করার বিষয়ে কিছু স্বীকার করতে নারাজ। তাদের ভাষ্য, তারা এমন কিছুই করেননি।
একদিকে আমার মনে হচ্ছে, পুলিশরা অভ্র ভাইয়ের কেসে বেশ ঢিলামো করছেন। তা না হলে একজন জলজ্যান্ত মানুষকে খুঁজে পেতে কিভাবে দেড় সপ্তাহ পার হয়ে যায়! অবশ্য উনাদের এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে উনারা বলেন, কিছুদিন আগেই এক স্থানীয় নেতা গু’ম হয়েছেন। যেহেতু উনি একজন নেতা তাই উপর মহল থেকে উনার কেসটা আগে এবং ভালোভাবে খতিয়ে দেখার চাপ পড়ছে বেশি। এ কারণে অভ্র ভাইয়ের কেসে পুলিশরা বেশি সময় দিতে পারছে না।
.
শেষ বিকেলের শ্রাবণ ছোঁয়া পরিবেশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্থির ও শান্ত আকাশের দিকে চেয়ে আছি। এ আকাশের মাঝেও অদ্ভুত এক প্রশান্তি খুঁজে পাচ্ছি আজ। ভীষণ ভালো লাগছে একলা দাঁড়িয়ে এ মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে।
এ কয়দিনে আমার আর প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সম্পর্কের কিছু উন্নতি সাধন হয়েছে। প্রোজ্জ্বল ভাই যেখানে আগে থেকেই এ সম্পর্কে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, সেখানে আমি নতুন ভাগে আর এক পা এগিয়ে দিয়েছি আমাদের সম্পর্ক উন্নতি করতে। যদিও সবকিছু আমার জন্য এতোটা সহজ হচ্ছে না, তবুও আমি চেষ্টা করছি। হয়তো আমি পারবো অভ্র ভাইকে ভুলে প্রোজ্জ্বল ভাইকে আপন করে নিতে। কারণ এ বাদে আমার কাছে আর কোনো উপায়ও নেই।
উপরের মস্ত বড় আকাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ আমি নিচে তাকালাম। আর তখনই আমার দৃষ্টি আটকে গেলো একজনের উপর। তাকে দেখে আমার হৃৎস্পন্দন থমকে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম। হাত পা দুটো অচল হয়ে এলো। আমার সামনে আমি সেই মানুষটাকে দেখছি যে আমার পুরো পৃথিবী বদলে দিয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ, আমি অভ্র ভাইকে দেখছি। উনি রিকশা থেকে নামছেন। কিন্তু সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে না। হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ, ছেঁড়া শার্ট, উষ্কখুষ্ক চুল। উনাকে এ রূপে দেখে আমার বুক ধক করে উঠলো।
(দুঃখিত প্রিয় পাঠকবৃন্দ। এতোদিন গল্প দেইনি কারণ আমার আইটেম,টার্ম,এসিসম্যান্ট পরীক্ষা চলছিলো। আবার নভেম্বর মাসের ২২তারিখ থেকে ফাইনাল পরীক্ষা। তাই চেষ্টা করবো গল্প দ্রুত শেষ করার। আপনারা ২৪নং পর্বটা আবার পড়ে এসে এটা পড়বেন। আবারো আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, এ বিলম্বের জন্য।
®সারা মেহেক
#চলবে
্