বিরহ শ্রাবণ (দ্বিতীয় খণ্ড) পর্ব ২৪

0
830

#বিরহ_শ্রাবণ(দ্বিতীয় খণ্ড)
#পর্ব_২৪
#লেখিকা_সারা মেহেক

আমাকে অবাক করে দিয়ে শারমিন আপু বললো,
” তোমাদের বিয়ে উপলক্ষে গিফট আনবো, সে কথাও মনে নেই আমার। এখানে এসে মনে পড়েছে। তবে এর পরেরবার অবশ্যই কিছু আনবো। ”

শারমিন আপুর এমন কথায় মনে হলো উনি আমায় ইচ্ছে করে খোঁচা দিচ্ছেন। যদিও উনার চাহনি এবং কথার ধরণে মোটেও এমন কিছু মনে হলো না। তবুও আমি জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি কি আমায় এ বিয়ে নিয়ে খোঁচা দিচ্ছেন শারমিন আপু? ”

শারমিন আপু আমার প্রশ্নে সশব্দে হেসে উঠলেন। আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন,
” আরে মেয়ে! কি যে বলো না! আমি খোঁচা দিবো কেনো?”
এই বলে আমি নিশ্চুপ হয়ে রইলো। কিন্তু আমাকে ওভাবেই জড়িয়ে ধরে রাখলো শারমিন আপু। কয়েক সেকেন্ড পর উনার ফুঁপিয়ে কাঁদার শব্দ আমার কর্ণাধারে পৌঁছালো। চমকে উঠলাম আমি। তৎক্ষনাৎ উনাকে ছাড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপু কাঁদছেন কেনো?”

শারমিন আপু কাঁদতে কাঁদতেও হাসলেন। ঠিক পূর্বের মতো সেই মিষ্টি হাসি। তবে এ হাসি উপরে উপরে যতোটা মিষ্টি দেখালো ভেতরে ঠিক ততোটাই তেঁতো এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। আমি স্পষ্টত অনুভব করছি উনার এ হাসির পিছনে ঠিক কতোটা কষ্ট লুকিয়ে আছে। শারমিন আপু কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করলেন। তবুও পারলেন না। কিন্তু ঐ অবস্থাতেও উনার ঠোঁটে হাসি উনি বজায় রাখলেন। বললেন,
” দেখো না চন্দ্রিমা, আমার চোখে কি যেনো ঢুকে গেলো। আমি কিন্তু কান্না করছি না। ”
এই বলে উনি সরাসরি প্রোজ্জ্বল ভাইকে বললেন,
” প্রোজ্জ্বল, বিশ্বাস করো, আমি কাঁদছি না। চোখে কি যেনো ঢুকে গেলো। চোখ দিয়ে পানি পড়া বন্ধই হচ্ছে না। ”
এই বলার পর শারমিন আপু আর হাসলেন না। উনার সেই হাসি উবে গেলো। উনি এবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। হাত দিয়ে মুখখানা ঢেকে জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন। উনার এ অবস্থা দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ফলস্বরূপ নীরবে কাঁদতে লাগলাম।

কিছুক্ষণ পর শারমিন আপুর কান্না কিছুটা কমে এলে উনি বেশ শক্তি প্রয়োগ করে চোখের জল মুছলেন। অতঃপর পুনরায় অধরে সেই হাসি লেপ্টে বললেন,
” আমি আগে থেকেই প্রোজ্জ্বলকে পছন্দ করতাম। ভেবেছিলাম বউ হলে ওর-ই বউ হবো। কিন্তু দেখো, আমার ভাগ্যে ও ছিলো না চন্দ্রিমা। ওর ভাগ্যে তুমি ছিলে। এ বিয়েতে তোমাদের কোনো দোষ দিবো না আমি। সব দোষ আমার ভাগ্যের। আর ভাগ্যের এ সিদ্ধান্ত চাইলেই বদলাতে পারবো না। এজন্য এখন চাইছি, তোমরা দুজনে সুখে থাকো। একে অপরকে ভালোবেসে সারাজীবন আগলে রাখো। আর আমার জন্য দোয়া করো চন্দ্রিমা, যেনো আমি প্রোজ্জ্বলকে সারাজীবনের জন্য ভুলে সামনে এগুতে পারি। ”

শারমিন আপুর এ কথা শোনা মাত্র আমি প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের দিকে চাইলাম। উনি দু হাঁটু উঁচু করে হাত ঠেকিয়ে বসে আছেন। উনার প্রতিক্রিয়া এখন এমন যে, সব দোষ বোধহয় উনারই ছিলো। হয়তো শারমিন আপুর এ পরিস্থিতির জন্য উনি নিজেকে দায়ী করছেন! কে জানে!

শারমিন আপুর এরূপ কথা শুনে কোথাও না কোথাও নিজেকেও দোষী মনে হচ্ছে আমার। আমি বললাম,
” শারমিন আপু, যা হয়েছে তাতে আমাদের কারোরই পুরোপুরি হাত ছিলো না। আপনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন বুঝতে পারছি। কিন্তু আমিও এমন বিয়ে চাইনি আপু। জানেন? প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে বিয়ের পর থেকে মামি আমার সাথে কথা বলে না। তাহলে আপনিই বলুন, এমন পরিস্থিতিতে কি করে এ বাড়িতে থাকা সম্ভব। এর চেয়ে আমি বলছিলাম, আমি প্রোজ্জ্বল ভাইকে ডিভোর্স দিয়ে দেই। এরপর হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করি। কারণ আমাদের মধ্যে আগে যে সম্পর্ক ছিলো তা কখনোই ফিরে আসবে না। আর আমি প্রোজ্জ্বল ভাইকে ডি’ভো’র্স দিয়ে দিলে আপনি এ বাড়ির বউ হয়ে আসবেন। তখন মামিও খুশি হবে।”

শারমিন আপু আমার এ কথায় এক গাল হেসে দিলো। আমার মাথায় আলতো করে গাট্টা মেরে বললো,
” বোকা মেয়ে! এমন কেউ বলে! বিয়েই তো হলো গতকাল। আর আজই ডি’ভো’র্স! ডিভোর্স দেওয়া এতো সহজ না চন্দ্রিমা। তুমি একে যতোটা সহজ ভাবছো এটা ঠিক ততোটাই কঠিন। তুমি বলছো, ডি’ভো’র্স দিয়ে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করবে। এটা কি এতোই সহজ? তুমি কি জানো না সমাজ ডি’ভো’র্সী মেয়েদের কেমন ট্রিট করে?
আর বললামই তো, এ ঘটনায় দোষ কারোর নয়। ভাগ্যে যা ছিলো তাই হয়েছে। আমি খালার সাথে কথা বলবো এ ব্যাপারে। যেখানে আমাকে নিয়ে এ সিচুয়েশন ক্রিয়েট হয়েছে,সেখানে আমাকেই এটা শুধরাতে হবে। আর আমাদের বিয়ে হলেই বা কি হতো? প্রোজ্জ্বল তো আমাকে পছন্দই করে না। ভালোবাসা তো দূরে থাকুক। সেখানে শুরু থেকেই এক তরফা ভালোবাসা দিয়ে কি করে সংসার করা সম্ভব। তাই না প্রোজ্জ্বল? ”
শেষোক্ত প্রশ্নটি আপু প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো। প্রোজ্জ্বল ভাই সাথে সাথে দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো। হয়তো উনি শারমিন আপুর সামনে এ কথা স্বীকার করতে কুণ্ঠিত বোধ করছেন!

শারমিন আপু এবার পুরোপুরি কান্না থামিয়ে ভালোভাবে মুখখানা মুছে নিলেন। অতঃপর আমার গালে হাত রেখে মিষ্টি হেসে স্নেহের সুরে বললেন,
” চন্দ্রিমা, আমি এ ঘটনার জন্য তোমাদের দায়ী মনে করি না। তাই এ দ্বিধাদ্বন্দে না থেকে সংসার জীবন শুরু করো। সবকিছু মানিয়ে নাও। আর রইলো খালার কথা। আমি সবটা সামলো নিবো। দেখে নিও। ”

শারমিন আপুর এ আশ্বাসেও আমার মন ভরলো। কারণ আমি যে অভ্র ভাইকে ভালোবাসি। আমি বললাম,
” আপু? আমি কি করে এ সংসার শুরু করবো? আমি যে অভ্র ভাইকে………”

” এখানো অভ্রের নাম মুখে নিচ্ছো কেনো তুমি? যে মানুষটা বিয়ের আশা দিয়েও বিয়ের দিন তোমাকে ছেড়ে চলে যায় সে আর যাই হোক, সৎ পুরুষ না। আমি বলবো, অভ্র একটা কা’পুরুষ। একদম কা’পুরুষের ন্যায়ই কাজ করেছে ও। ”

আপুর মুখে অভ্র ভাইকে নিয়ে এরূপ কথায় ভীষণ ব্যথিত হলাম আমি। সাথে সাথে বললাম,
” আপু, প্লিজ উনাকে নিয়ে এমন কিছু বলবেন না।”

” কেনো চন্দ্রিমা? এখন আমি বলবো, এসব যা হয়েছে সবকিছুর মূল খোদ অভ্র। ও বিয়েতে না করলে কিছুই হতো না।
এখন হাজারো বললেও কিছু হবে না চন্দ্রিমা। যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। বিয়েটাকে তুমি মেনে নাও। আর আমার মনে হয় এ বিয়ে তুমি খুব সহজেই মেনে নিতে পারবে। কারণ প্রোজ্জ্বলের সাথেই তুমি জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছো। তাই ওকে মেনে নেওয়া কি সহজ না?”

শারমিন আপুর এ যুক্তি শুনে আমি আর কথা বাড়ালাম না। কারণ যাই বলি না কেনো, উনি এ বিয়ে মেনে নিতেই বলবেন। তাই এ মুহূর্তে নীরবে থাকাই ভালো।
শারমিন আপু বললেন,
” আচ্ছা, আমি খালার সাথে কথা বলে আসি। এর আগে একটু হাত মুখ ধুতে হবে। চলো তো চন্দ্রিমা।”
এই বলে উনি উঠে আমাকেও সাথে নিয়ে গেলেন।

———-

শারমিন আপু মামির সাথে কি কথা বলেছে জানা নেই। তবে এখন আমি মামির সাথে কথা বলতে গিয়েও পারছি না। এর মূলে রয়েছে সাহসের অভাব। এ মুহূর্তে উনার সাথে কথা বলার জন্য প্রচণ্ড সাহসের দরকার। কিন্তু সেই সাহসই অর্জন করতে পারছি না।
প্রায় দশ মিনিট আমার রুমে হাঁটাহাঁটি করে অবশেষে মামির কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম। মামির রুমে গিয়ে নক করতেই উনি অনুমতি দিলেন। উনার অনুমতি পেয়ে আমি সাথে সাথে রুমে ঢুকে পড়লাম। দেখলাম, মামি চোখ বুজে শুয়ে আছেন।
আমি গিয়ে উনার পায়ের কাছে বসে পড়লাম। বেশ ভয় নিয়ে, খানিক রয়েসয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” মামি? একটু কথা বলার ছিলো আপনার সাথে।”

মামি তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে বললেন,
” চন্দ্রিমা তুই! তোকে না আমার সামনে আসতে নিষেধ করেছি?”

” মামি প্লিজ, আমার কথাটা শুনুন না। ”

মামি এবার রেগেমেগে উঠে বসলেন। ঝাঁঝ নিয়ে বললেন,
” কি শুনবো হ্যাঁ? শোনার মতো কিছু হয়েছে? তুই যা তো এখান থেকে।”

আমার চোখজোড়া এবার নোনাজলে ভিজে এলো। বুঝলাম,শারমিন আপুর কথাতেও গলেনি উনার মন। উনি এখনও আমাদের উপর রেগে আছেন। আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,
” মামি, আপনি আমার উপর এতো রেগে থাকলে আমি কি করে বাঁচবো বলুন৷ আপনিই আমার মা। আর মা সন্তানের উপর রেগে থাকলে তার জীবন অতিষ্ঠ হতে সময় নেয় না। মামি, দয়া করে ক্ষমা করে দিন আমাকে। ”

মামি এবার হয়তো কিছুটা শান্ত হলেন। তবুও পূর্বের চেয়ে খানিক কম ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
” তুই আমার কাছে যেমন প্রিয়, শারমিনও আমার কাছে তেমন প্রিয়। এখানে ভুলটা তোর হয়েছে, শারমিনের না। তাই ভুলের মাশুল তো দিতেই হবে তাই না? আজকে শারমিন কথা বলতে এসেও কেঁদেছে। মেয়েটা হয়তো কাঁদতে চায়নি। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে কেঁদে ফেলেছে। তবুও ও কিন্তু তোদের দুজনকে একসাথে থাকার কথা বলেছে, আমাকে মাফ করে দিতে বলেছে। কিন্তু আমি এতোটাও উদার নই। তোদের এতো সহজে ক্ষমা করতে পারবো না আমি।
এখন আমার চোখের সামনে থেকে দূর হো। ”
এই বলে মামি আমার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি আর কথা বাড়ালাম না। কারণ এখন কথা বাড়িয়েও লাভ হবে না জানি। তাই চলে এলাম।

রুমে এসেই শারমিন আপুকে কল দিলাম। আপুকে সবটা বললে আপু খুব ভালোভাবেই বললেন কিছুদিন অপেক্ষা করতে। মামিকে সময় দিতে। মামি আমাদের যেমন ভালোবাসে, তাতে উনি বেশিদিন আমাদের উপর রাগ বা অভিমান করতে থাকতে পারবেন না।
শারমিন আপুর কথা অনুযায়ী এমনটা করারই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। ভাবলাম, মামিকে এতোটাও জোর করবো না। সময় দিবো উনাকে। নিশ্চয়ই উনি খুব দ্রুত মাফ করে দিবেন আমাদের। এই আশা নিয়েই শুয়ে পড়লাম আমার রুমে।

————-

পরেরদিন কলেজ শেষে বাড়িতে না গিয়ে আগে অভ্র ভাইদের বাড়িতে গেলাম। স্বাভাবিকভাবেই খোদেজা মামি আমার সাথে কথা বললেন না। স্পষ্টভাবে এড়িয়ে চললেন আমাকে। অনামিকাও প্রথমে কথা বললো না। তবে বেশ ক’বারের অনুরোধে ওর মন গললো। অতঃপর ওর কাছ হতে অভ্র ভাইয়ের সম্পর্কে যা জানলাম তাতে আমার শরীর হিম হয়ে এলো।
®সারা মেহেক

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here