#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৪৫ (অন্তিম পর্ব)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
১২৬.
‘কীরে ভাই? নিচে তাকিয়ে থাকলে ছবি তুলবি কেমনে? আগে ছবি তো তোল!’ আদিলের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা, পাগলামি, ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দের উচ্ছ্বাস স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে।
জয় কোনো রকমভাবে বলল,’হ্যাঁ, দিচ্ছি। দাঁড়াও। ক্যামেরাটা একটু ঠিক করে নিই।’
তারপর সে ক্যামেরা নিয়ে এক সাইডে চলে যায়। সূচনার আড়দৃষ্টি তখনো জয়ের দিকেই স্থির ছিল। জয়ের বন্ধু অমিত বলে,’এইটা সূচনা না দোস্ত?’ তার চোখে-মুখেও খেলছিল বিস্ময়ের ঘোর। জয় ছোটো করে উত্তর দিলো,’হুম।’
আদিল আর অপেক্ষা করতে না পেরে নিজেই ওদের কাছে এসে উপস্থিত হয় এবং তাড়া দিয়ে বলল,’হলো তোর?’
জয় মলিন হেসে বলল,’হ্যাঁ।’
আদিল সূচনাকে সাথে নিয়ে নানানরকম পোজ দিচ্ছিল। কাঁপা কাঁপা হাতে ক্যামেরা ধরে রেখেছিল জয়। এই প্রথমবার তার ছবি তুলতে হাত কাঁপছে। অথচ এর আগে কতশত মানুষের ছবি সে তুলেছে! ছবি তোলা শেষ হলে আদিল সকলের উদ্দেশ্যে এনাউন্স করে বলে,’আমি সূচনাকে ডেডিকেটেড করে একটা গান গাইতে চাই আজ।’
সকলে তো খুশিতে বাকবাকুম করে ওঠে। অসংখ্য লাইটের ঝকমকে আলো আর মানুষজনের সামনে সূচনা হাসিমুখে নিজেকে প্রেজেন্ট করেছিল। তার মনের ভেতর না জানা প্রশ্নের উত্তরগুলো জানার জন্য যে চঞ্চলতা জাগ্রত হয়েছে, তা নেভানো যে বড্ড কঠিন। তবুও তার এই চঞ্চলতা যেন অন্য কারও দৃষ্টিতে আটকা না পড়ে, সেজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাও সে করে যাচ্ছে।
আদিল যখন সূচনার হাত ধরে গান গাইছিল তখন চারদিকে মুগ্ধ দৃষ্টি সব এই সুন্দর কাপলযুগলের দিকে নিবদ্ধ ছিল। আর এ সবকিছু কাঁপা হাতে শ্যুট করছিল জয়। সে যেন ক্রমান্বয়ে নিজের কাছে হেরেই যাচ্ছিল। আর তাই ক্যামেরা ওর সঙ্গী তাসিনের হাতে দিয়ে সে নির্জনে এক জায়গায় গিয়ে চুপ করে বসে থাকে। কিছুক্ষণ বাদে অমিতও সেখানে এসে উপস্থিত হয়। পাশের একটা চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে?’
জয় বিমর্ষ হয়ে বলে,’ছবি তোলার শখটাই যে একদিন নিজের সবচেয়ে বড়ো কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে সেটা কে জানত বল তো?’
.
জয়ের জায়গায় এবার ফটোশ্যুট করছিল তাসিন এবং সিয়াম। একই তো সূচনার ভেতরের অস্থিরতা, তারমধ্যে এত এত পোজ নিয়ে ছবি তুলতে তুলতে সে বিরক্ত হয়ে গেছে। তার এই একটুখানি বিরক্তিমাখা চেহারা এবং ভেতরকার সামান্যতম কষ্টও যেন আদিলের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারল না। তাই সে ক্যামেরাম্যানদের উদ্দেশ্য করে এবং বাকিদের বলল,’এবার অন্যদের ছবি তোলো। আমরা একটু বিশ্রাম নিই।’
সে সূচনাকে নিয়ে নিজেদের জায়গায় বসে। সূচনার একটা হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে,’খারাপ লাগছে?’
সূচনা মায়া মায়া দৃষ্টিতে তাকায় আদিলের দিকে। সে তো মাঝে মাঝে এটাই ভেবে পায় না যে, এমন কোন পূন্য সে করেছিল যার দরুণ আল্লাহ্ তার জীবনে আদিলকে পাঠিয়ে দিয়েছে। একটা মানুষকে এত কেন ভালো হতে হবে? কেন সে এত ভালোবাসে সূচনাকে? সে কি জানে, এভাবে সে একটু একটু করে অজান্তেই সূচনাকে কতটা নিজের করে নিয়েছে? সূচনা যে বড্ড কঠিনরকম মায়ায় আটকে গেছে। এই মায়া থেকে বেরোনো সম্ভব নয় কিছুতেই নয়। তবুও আশঙ্কা যেন তার পিছু ছাড়ে না।
সূচনা ভারী একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে স্মিত হেসে দু’দিকে মাথা নাড়ায় এবং অবচেতন মনে জড়িয়ে ধরে আদিলকে। উপস্থিত অনেকের সাথেই দৃশ্যটি জয়ের চোখেও আটকে যায়। আর সে ধীরে ধীরে অগ্নিদগ্ধে দগ্ধিত হতে থাকে। সূচনা বদলে গেছে। সে ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে।
জয়ের সঙ্গে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে জারিফ,প্রীতি আর চাচা-চাচিও ওদের মধুর দৃশ্যটি দেখে নিয়েছে। ফোন ছিল ভূমির হাতে। ভিডিয়ো কলে সে এখানকার আয়োজন ওদেরকে দেখাচ্ছিল। জারিফের অপারেশন হয়ে গেছে। আরেকটু সুস্থ হলেই সকলে মিলে দেশে ফিরে আসবে। শোহেব ভূমির বাহুতে বাহু দ্বারা হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,’কিছু তো শেখো ছোটোবোনের থেকে।’
ভূমিকা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে ফোনের দিকে ইশারা করে। ইশারার অর্থ ছিল,’ফোনের অপরপ্রান্তে চাচা-চাচিও রয়েছে।’
কিন্তু শোহেব তো শোহেবই! সে ভূমিকার কথা থোড়াই পরোয়া না করে বলল,’ধুর! এত সাউন্ডের মধ্যে আমাদের কথা শুনতে পারবে না।’
তখন ওপাশ থেকে চাচা বললেন,’ভূমি ফোন রাখছি আমরা। তুই ইনজয় কর।’
ভূমিও হাসিমুখে বলল,’ঠিক আছে চাচা।’
ফোন রাখার পর দু’হাত বগলদাবা করে ভ্রুঁ নাচিয়ে বলে,’কী সমস্যা এবার বলেন।’
শোহেব বাচ্চাদের মতো করে বলে,’তোমার বোন কত সুইট, রোমান্টিক। তুমি এমন নিরামিষ কেন? একটু জড়িয়ে-টড়িয়ে ধরলে কী এমন হয়?’
‘মিস্টার শোহেব, আজ বাদে কাল ওদের বিয়ে। সো ওরা জড়িয়ে ধরতেই পারে তাই না?’
‘কী বলো তুমি এসব? আজ বাদে কাল কী আবার; তুমি বললে তো আমি কয়েক মিনিটের মধ্যেই তোমাকে বিয়ে করতে পারি। শুধু তুমি রাজি হয়ে যাও। এবার একটু জড়িয়ে ধরবে?’
‘ফালতু বকবক বাদ দিয়ে চলেন এবার। ওদের হলুদ দিতে হবে।’
হলুদের সময়ে তাসিন আর সিয়ামই ছবি তুলছিল। তখন আদিল ওদের বলে,’জয় কোথায়? ওকে ডাকো।’
তাসিন সূচনার বিষয়টা অল্পসল্প জানে বলে মিথ্যে বলল,’জয়দা হঠাৎ করে একটু অসুস্থ হয়ে গেছে তো, তাই আমরাই ছবি তুলছি।’
‘কী বলো? বেশি অসুস্থ?’
‘না, না তেমন কিছু নয়। মাথা ব্যথা।’
‘দাঁড়াও আমি কাউকে পাঠাচ্ছি মেডিসিন আনতে।’
‘আরে না ভাইয়া। আপনি বসেন। অমিতদা নিয়ে এসেছে।’
‘ঠিক তো?’
‘হ্যাঁ।’
জয় হঠাৎ করে অসুস্থ হয়েছে শুনে সূচনারও একটু খারাপ লাগছে। তবে তার কেন জানি একটু সন্দেহও লাগছে। আসলেই অসুস্থ তো? যদিও ভাবনাটা নিতান্তই নিম্ন পর্যায়ের ছিল।
সবার মোটামুটি হলুদ মাখানো শেষ। এখন বন্ধুদের পালা। বন্ধুরা হলুদ দেবে মানেই হলো তুলকালাম কাণ্ড করে বসবে এটা আদিল ভালো করেই জানে। তাই সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,’দাঁড়া, আমি একটু জয়কে দেখে আসি।’
শিশির আর আসলাম ওকে চেপে বসিয়ে বলে,’জয়কে তোর দেখে আসা লাগবে না। আমরাই ওকে নিয়ে আসছি। তুই শুধু এখানে চুপ করে বোস।’
এরপর শিশির শোহেবকে বলল,’ভাইয়া জয় আর অমিতকে নিয়ে আসো তো। এতক্ষণে তো মাথা ব্যথা সেরে যাওয়ার কথা।’
এরপর সূচনার দিকে তাকিয়ে বলে,’ভাবি আপনি এখান থেকে সরে যান।’
শোহেবও অভয় দিয়ে বলল,’হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আমি ডেকে আনছি। তোরা ওকে হলুদ মাখা।’
এরপর আর কী! সব বন্ধুরা হলুদ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার মতো। সঙ্গে যোগ হয়েছে ওর কাজিন মহলও।
শোহেব গিয়ে যখন জয় আর অমিতকে ডাকল, তখন জয়ের বাহানা করার আর কিছু ছিল না। সুখী, সাথী জয়কে দেখে বলল,’ভাইয়া আমাদের একটু ছবি তুলে দিন না। ঐ ভাইয়াগুলা তো বরের ভিডিয়ো করছে।’
জয় মলিন হেসে বলল,’হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।’
সূচনা ওদের থেকে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। জয় ক্যামেরা নিয়ে যখন দাঁড়াচ্ছিল তখন সুখী গিয়ে সূচনাকে টেনে এনে বলে,’এখানে দাঁড়াও। তোমার সাথে আমার সিঙ্গেল ছবিই নেই তেমন।’
সূচনা অনিচ্ছা নিয়েই সুখীর পাশে দাঁড়ায়। জোরপূর্বক ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসিররেখা ফুটিয়ে তোলে। তবে সে সরাসরি জয় কিংবা ক্যামেরা কোনোটার দিকেই তাকাতে পারছে না। এদিকে জয়ও ছবি তুলতে অস্বস্তিবোধ করছিল। অমিত তখন ওর হাত থেকে ক্যামেরা নিয়ে বলল,’তোর তো শরীর ভালো না। তুই ওখানে গিয়ে বোস। আমি উনাদের ছবি তুলে দিচ্ছি।’
বেশ কয়েকটা ছবি তোলার পরে সূচনা ওদের থেকে সরে দাঁড়ায়। সুখী, সাথী,নুসরাত, ফাতেমা ওরা ছবি তুলছিল। অন্যদিকে শোহেব আর ভূমিও কাপল ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিল। বেশিরভাগ দাওয়াতে আসা লোকজন অন্যপাশে তখন খাওয়া-দাওয়া করছিল। এখানে এখন যারা রয়েছে তারা সকলেই রিলেটিভ এবং যে যার মতো করে ব্যস্ত রয়েছে। শুধু জয় এবং সূচনাই আলাদা আলাদা। অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে সূচনা গুটিগুটি পায়ে জয়ের দিকে এগিয়ে যায়। জয়ের দৃষ্টি ছিল ফ্লোরের দিকে। আলতা রাঙা ফরসা দুটি পা, এবং হলুদ শাড়ি চোখের দৃশ্যপটে ফুটে ওঠায় সে মাথা তুলে তাকায়। নির্বাক চাহনী নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে সূচনা। সে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ায় বসা থেকে। অনেক অনেকক্ষণ শুধু নিষ্পলকভাবে তাকিয়েই থাকে। যেন কতদিনের তৃষ্ণা এতদিন সে জোরপূর্বক আটকে রেখেছিল। লুকিয়ে রেখেছিল। আর যখন কাঙ্ক্ষিত মানুষটি অবশেষে সামনে এসে দাঁড়ালোই তখন সব অনুভূতিও যেন পূণরায় বাঁধনহারা হয়ে স্পষ্টভাবে সূচনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, বলে দিচ্ছে,’আমিও তোমায় ভালোবাসি সূচনা।’
সূচনার চোখের পাতাও যেন ভারী হয়ে আসছিল। অপরপ্রান্তে জয়ের চক্ষুযুগলে তখন স্পষ্ট অশ্রুকণা চিকচিক করছিল। সে খেয়াল করে, সূচনার মাথার ফুলটা পড়ে যাচ্ছে। সে কাঁপাকাঁপা হাতে ফুলের দিকে হাত বাড়ায়; তখনই ঝড়ের বেগে সেখানে আদিল চলে আসে এবং পেছন থেকে সূচনাকে জড়িয়ে ধরে সামনে দাঁড় করায়। ততক্ষণে আদিলের বন্ধুরাও এগিয়ে এসেছে। ওরা হাসতে হাসতে বলে,’কীরে ব্যাটা বউয়ের আঁচলের নিচে লুকাচ্ছিস কেন?’
আদিল আকুতি করে বলে,’ভাই, অনেক হলুদ মাখিয়েছিস। এবার প্লিজ বন্ধ কর!’
ওদের কথোপকথন চলছিল। সূচনা পাশে তাকিয়ে খেয়াল করে জয় একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছে। এবং এক পর্যায়ে সে সূচনার দিকে তাকিয়ে একটুখানি হেসে উলটাপথে হাঁটা শুরু করে। বেরিয়ে যায় কমিউনিটি সেন্টার থেকে।
______
১২৭.
রেশমা বেগম চেষ্টা করছেন রাসেলকে আবার বিয়ে করাতে। কিন্তু এমন নেশাখোর ছেলেকে কেই বা মেয়ে দেবে? আর কোন মেয়েই বা চাইবে সারাক্ষণ নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা একটা ছেলেকে বিয়ে করতে? তবুও আপ্রাণ চেষ্টা তিনি করছেন। এতে যদি ছেলেটাকে ভালো পথে আবার আনা যায়।
রিদি এসে জানায়,’মা, মেয়ে একটা আছে হাতে। কিন্তু তার আগে তোমার ছেলেটাকে তো একটু সভ্য বানাতে হবে। ওরে দেখলেই তো মেয়েরা না করে দেবে। একটু সেলুনে পাঠাও। চুল কেটে আসতে বলো।’
রেশমা বেগম হতাশসুরে বললেন,’মেয়ে দেখতে হবে না আর। রাসেল বিয়ে করবে না।’
‘তাহলে কী করবে? দেবদাস হবে?’
‘জানিনা আমি কিছু। ওরে আর কিছু বলবও না। ওয় ওর মতো থাক। ওর যদি কখনো মনে হয়, ভালো হবে, বিয়ে করতে চায় তাইলে সেদিনই বিয়ে করাব।’
‘মানুষজন কত কথা বলে জানো!’
‘বললে আর কী করব? সবই তো আমার কপাল। পাপের ফল মনে হয়!’
‘আমার তো এখন মনে হয় দোষ তোমার ছেলেরই। ওয় হয়তো ভাবিকে ছাড়ছে।’
রেশমা বেগম কিছু বলেন না। শুধু প্রত্যুত্তরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
রাসেল সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ফেসবুকে যায়। বাসায় তার বেশিরভাগ সময়ই কাটে নেশা করে আর ইউটিউবে পড়ে থেকে। কী করে, না করে সে নিজেও জানে না। সার্চ লিস্টের প্রথমেই ভূমির আইডি। প্রোফাইলে আজ নতুন ছবি; তাও কাপল। গত কয়েক সপ্তাহ্ তার নেশার পরিমাণ অনেক বেশি ছিল বিধায় ফোনের কোনো খেয়াল ছিল না। এখন তার নিজের কোনো টাকা নেই। মায়ের থেকে নিয়ে, বাসায় চুরি করে যা টাকা নিতে পারে তা দিয়েই কোনো রকম নেশাপানি করে। তবে আগের তুলনায় কমই। তাই আজ মনে হলো একবার ভূমির আইডিটা ঘুরে দেখবে। কাপল ছবিটা দেখে ওর বুকের ভেতরের চিনচিনে ব্যথাটা পূণরায় শুরু হয়। আইডিতে সে আরও একটা জিনিস খেয়াল করে। ‘শোহেব চৌধুরী’ নামে এক আইডির সাথে ভূমির আইডি এঙ্গেজডের রিলেশনশিপ পোস্ট। সে এবার কাপল ছবিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। ভূমির পরনে হলুদ সুতী একটা শাড়ি। পাশে দাঁড়ানো অফ হোয়াইট কালার পাঞ্জাবি পরা ছেলেটাই বোধ হয় শোহেব। ভূমিও ভালো আছে। শুধু ভালো নেই সে। সেও চায় ভালো থাকতে। কিন্তু পারে না। হয়তো তার কর্মের ফল ভোগ করা এখনো শেষ হয়নি। তার বুকের চিনচিন ব্যথাটা ক্রমান্বয়ে আবার বাড়তে শুরু করে। সে আর তাকিয়ে থাকতে পারছে না স্ক্রিনের দিকে। ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে সে জোরে জোরে সিগারেট ফুঁকতে থাকে। নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হয়ে, কাঁশি শুরু হয়ে যায়।
______
১২৮.
পার্লারের বিশাল আয়নাটির সামনে বসে রয়েছে সূচনা। একজন অভিজ্ঞ মেয়ে যত্নসহকারে সূচনার চুল বেঁধে দিচ্ছে। মুখের সাজগোজ অনেক আগেই শেষ। সূচনা আজ প্রথম নিজেই নিজেকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছে। সত্যি বলতে ওকে দেখতে পুতুল বউয়ের মতোই লাগছিল। গোপনে তার ভেতর থেকে দীর্ঘনিশ্বাস বের হয়। গায়ে হলুদের সকল ক্লান্তি দু’চোখে ভর করেছিল রাতে। তবুও সে অপেক্ষা করেছিল জয় হয়তো তাকে ফোন অথবা ম্যাসেজ করবে। কেন সে কিছু না বলে-কয়ে এভাবে গুম হয়ে ছিল অন্তত সেটা বলবে। কিন্তু এমন কিছুই হয়নি।
সূচনার সাথে ভূমি, সুখী, সাথীসহ আরও অনেকে সাজতে এসেছিল। সকলের মোটামুটি সাজা শেষ। এখন শুধু সূচনার অর্নামেন্টস আর মাথায় ঘোমটা দেওয়াটা বাকি। এর মাঝে আদিল ফাতেমাকে কল করে বেশ কয়েকবার খোঁজ-খবর নিয়েছে। এরপর সাজা শেষ হয়ে গেলে ওরা সবাই মিলে সোজা কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে যায়। আজ মানুষজন বোধ হয় গতকালের তুলনায় বেশিই মনে হচ্ছে। সূচনাকে একটা চেয়ারে বসানো হয়। তার মিনিট পাঁচেক পরেই আদিল বরপক্ষ নিয়ে চলে আসে। কনেপক্ষ গেট আটকে ধরে দশ হাজার টাকা চাঁদা ধরেছে। আদিল শালিকাদের আবদারে রাজি থাকলেও বেঁকে বসেছিল ওর বন্ধুমহল আর কাজিনরা। বেশ কিছুক্ষণ দু’পক্ষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়। অবশেষে বরপক্ষকে কনেপক্ষের কাছে হার মেনে দশ হাজার টাকাই দিতে হয়। ভেতরে গিয়ে সূচনাকে দেখেই মুচকি হাসে আদিল। সূচনা একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। আদিল গিয়ে পাশে বসে বলে,’এই পরীটা আজ থেকে আমার নিজের মানুষ হবে। ঘুম থেকে উঠেই আমি পরীটার মুখ দেখতে পাব। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। একটা চিমটি কাটো তো।’
ওর পাগলামিতে সূচনা মাথা নত করে হাসে। আদিলও তখন হাসিতে যোগ দেয়। আজ জয় বাদে বাকি তিনজন এসেছে আর জয়ের বদলে অন্যজনকে পাঠিয়েছে। ছবি তোলার সময় এটা খেয়াল করে আদিল ওদের জিজ্ঞেস করে,’জয় কোথায়?’
উত্তরে অমিত বলে,’ওর একটু কাজ পড়ে গেছে ভাই। তাই আসতে পারেনি।’
‘এটা কেমন কথা হলো? বিয়ের কয়দিন আগে ওকে বলে রেখেছি আমার বিয়ের তিনদিন যেন ও ফ্রি থাকে।’
উত্তরে ওরা আর কী বলবে। চুপ করে থাকে। তবে মেজাজ গরম হয়ে যায় আদিলের। ও একটু আড়ালে গিয়ে জয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলে। সূচনা দূর থেকে তাকিয়ে একবার দেখে শুধু। তবে কথা কিছুই শোনা যাচ্ছে না। আচ্ছা, জয় কেন আসলো না আজ?
সূচনা কলেজের বেশ কয়েকজনকেই ইনভাইট করেছিল। তবে ওরা কেউ গায়ে হলুদে না এলেও আজ বিয়েতে এসেছে। এজন্য সূচনাও ভীষণ খুশি। নুসরাতও ক্লাসমেটদের পেয়ে আনন্দিত হয়ে ওঠে। সকলের একটু আড়ালেই প্রায় ইউসূফ বলে,’কত চেষ্টা করলাম তোমাকে পটানোর! তা আর হলো কই? দেখো, উল্টা সেজেগুজে এখন তোমার বিয়ে খেতে চলে এসেছি।’
কথাটা বলে সে নিজেই হাসে। নুসরাতও কথাটা শুনে ফেলে। তাই সে ইউসূফের পিঠে কিল বসিয়ে বলে,’এখন থেকে আমার ভাবিকে বোনের নজরে দেখবা।’
ইউসূফ একটু ঢং করে বলে,’সবই কপাল!’ ওর কথার স্টাইল শুনে নুসরাত, সূচনা দুজনই হাসে।
সময়ের অবসান ঘটিয়ে আদিল-সূচনার বিয়ের মিনিট দশেক পরে জয় এসে হাজির হয়। তখন সবাই মিষ্টি খাওয়া এবং দুই পরিবার তাদের আনন্দ ভাগাভাগিতে ব্যস্ত ছিল। জয়ের আগমন আর কারও দৃষ্টিতে তখন না পড়লেও সূচনার দৃষ্টিতে ঠিকই পড়েছে। সে সকলকে পাশ কাটিয়েই ওর কাছে যায়। দুজনই দুজনের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রয়েছে। জয় মুচকি হেসে বলে,’তোমায় অনেক সুন্দর লাগছে সূচনা।’
সূচনার ঠোঁট ভেঙে কান্না চলে আসে। জয় তড়িঘড়ি করে বলে,’এই, এই! আজকের দিনে একদম কান্না নয়। আজ তো খুশির দিন। যদিও জানি, বিদায়ের সময় এমনিতেই কাঁদবে।’
মন কি আর বারণ শোনে? সে তো অবাধ্য ভীষণ। জয় ধরে আসা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’বিয়ে হয়ে গেছে?’
সূচনা কাঁদতে কাঁদতেই উপর-নিচ মাথা ঝাঁকায়। এতগুলো দিন সে মনের মাঝে যত প্রশ্ন পুষে রেখেছিল আজ সব এলোমেলো হয়ে গেছে। সে পারছে না কিছু জিজ্ঞেস করতে। সে পারছে না তার চোখের পানিকে সংবরণ করতে। জয় ওর কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি বের করতেই সূচনা স্তব্ধ হয়ে যায়। জয় স্মিত হেসে বলে,’ডায়েরিটা চিনতে পেরেছ?’
সূচনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ভেজা চোখে তাকিয়ে থাকে; যেন তার চোখ দুটোই প্রশ্ন করছে,’তুমি এই ডায়েরি কোথায় পেলে?’
জয় বলে,’মনে আছে, আমাদের শেষ দেখা হওয়ার কথা? এরপরেরদিন আমাদের দেখা করার কথা থাকলেও দেখা হয়নি। তার কারণটাও তুমি নিশ্চয়ই জানো না। তার কারণ তোমার এই ডায়েরি। আচ্ছা পরে কখনো ডায়েরির কথাটা মাথায় এসেছিল তোমার? হয়তো এসেছিল! তবে গভীরভাবে ভাবোনি। আমায় নিয়ে তোমার লেখা অব্যক্ত কথাগুলি ডায়েরিতে স্থান পেয়েছিল। যা আমাদের শেষ দেখা হওয়ার দিন জানতে পারি। ভুলবশত তুমি ডায়েরিটা ফেলে গিয়েছিলে বলেই হয়তো তখন জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু কি জানো, তোমার অনুভূতিকে আমি প্রশ্রয় দিতে পারিনি। কারণ আমাদের মাঝে যে ছিল বিশাল এক দেয়াল। ধর্মের দেয়াল! পৃথিবীর সমস্ত শক্ত, কঠিন দেয়ালগুলোও যদি কখনো আমায় ভাঙতে বলা হতো, তবে বিশ্বাস করো আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা আমি করতাম। কিন্তু এই অদৃশ্য দেয়াল তুমি, আমি, আমাদের কারও পক্ষেই ভাঙা সম্ভব নয়। মানুষের মন বড়োই অদ্ভুত। নিষিদ্ধ মানুষের প্রতি আমাদের ভালোবাসা সবসময়ই তীব্র থাকে। তাই শত কষ্ট বুকে চেপে হলেও কিছু না বলেই আমি গ্রামে চলে গেছিলাম। কাকি আর দিগন্তকেও বলেছিলাম, তুমি আমায় খুঁজতে গেলে যেন তারা মিথ্যা বলে। তুমি যতবার আমায় খুঁজতে গিয়েছ, ততবারই এ কথা জানার পরে আমার ইচ্ছে করত সব ভুলে, সব দেয়াল ভেঙে তোমার কাছে ফিরে আসি। কিন্তু! পারিনি জানো? এই দেয়াল ভাঙার সাধ্য যে আমার নেই। তাই সকল যোগাযোগ ছিন্ন করে আমায় চলে যেতে হয়েছিল। তোমার ভালোর জন্য। আর দেখো, আজ তুমি সত্যিই ভালো আছো। আদিল ভাইয়ার মতো একজন জীবন সঙ্গী পেয়েছ। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, একজন খাঁটি মানুষ পেয়েছ তুমি। মজার বিষয় কি জানো, আমাদের গ্রামের বাড়িও কিন্তু এক জায়গায়। তাই ছোটো থেকেই ভাইয়াকে আমি চিনি। তবে হ্যাঁ, তুমি কিন্তু ভুলেও কখনো ভাইয়ার গ্রামের বাড়ি যাবে না।’ এইটুকু বলে হাসার চেষ্টা করে জয়। তারপর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,’তাহলে ভীষণ কষ্ট হবে সূচনা।’
সূচনা নির্বাক, নিস্তব্ধ। আজ যে সে আর কিছু বলার মতোই খুঁজে পাচ্ছে না। সে শুধু নিরবে কাঁদছে। জয় এবারও হাসার চেষ্টা করে বলে,’তবে দূর থেকেও আমাদের বন্ধুত্ব থাকবে। যেমনটা পরিচয়ের শুরুতে ছিল। দূর থেকেই তোমার জন্য আমার আশির্বাদ থাকবে। অনুভূতিগুলো জানার আগে সেই সময়গুলো কত সুন্দর ছিল তাই না?’
সূচনা এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ডায়েরিটা হাতে নেয়। তার সেই কলমটাও ডায়েরির মাঝে ছিল। সে সাদা পাতায় লেখে,’সূচনা সুন্দর হলেও উপসংহারে কেন এত বিষাদ? চলো না, আমরা আবার সেই সূচনাতেই ফিরে যাই!’
‘আমি এখনও সূচনাতেই আবদ্ধ আছি।’ মলিন হেসে বলে জয়। একটুদূরে দেখতে পায় ভূমি আর শোহেব এদিকেই আসছে। তাই সে ডায়েরিটা নিয়ে ব্যাগে ভরে রাখতে রাখতে বলে,’অতীতের সমস্তকিছু না হয় স্মৃতি হিসেবে আমার কাছেই থাকুক? ডায়েরিটা আমি রেখে দিলাম।’
সূচনার হাতে তখনো কলমটি ছিল। অন্য হাতে ছিল টিস্যু। সে টিস্যুতে লেখে,’ধর্মের দেয়াল ভাঙা যেমন সম্ভব নয়, তেমনই আমার আর পিছু ফিরে তাকাবারও উপায় নেই। তুমি যত দ্রুত পারো আমায় ভুলে যেও। জীবনটাকে সুন্দর করে সাজিও।’
জয় এবারও মলিন হেসে বলে,’তুমি আমার মোহ নও সূচনা; তুমি আমার অনুভূতি। মোহ এক সময় কেটে যায়, কিন্তু অনুভূতির রেশ আজীবন থেকে যায়।’
এরপর ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে থাকে। সূচনাও পরিস্থিতি বুঝতে পেরে হাতের উলটোপিঠে চোখের পানি মুছে নেয়। ভূমি তখন এসে বলে,’একা একা ছবি তুললে হবে? আদিলের সাথে তো তুলবে হবে তাই না? চল, চল।’
শোহেব তখন জয়ের পিঠ চাপড়ে বলে,’অবশেষে তাহলে তুমি এলে ভাই। তবে যাই বলো, তোমার ছবি তোলার হাত কিন্তু দারুণ।’
জয়ও জোরপূর্বক হেসে বলল,’থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া।’
স্টেজে সূচনা আর আদিল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আদিল সূচনার একটা হাত শক্ত করে ধরে মাইক্রোফোন হাতে নেয়। সকলের উদ্দেশ্যে বলে,’আমি জানি না, আমাদের নিয়ে কারও কোনো সমস্যা রয়েছে কিনা। আপাতদৃষ্টিতে না থাকলেও অনেকে হয়তো নিজেদের মাঝে বলাবলি করতে পারেন। সূচনা কথা বলতে পারে না সত্ত্বেও ওকে পছন্দ করে কিংবা ভালোবাসে এমন মানুষের অভাব ছিল না। তাদের মাঝে আমি ভাগ্যবান যে, সূচনাকে আমি নিজের করে পেয়েছি। তাই আজকের এই শুভ দিনটিতে সকলের কাছে অনুরোধ করব, কেউ কানা-ঘুষা না করে আমাদের জন্য মন থেকে দোয়া করবেন।’
এরপর সে সূচনার দিকে তাকিয়ে হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরে বলে,
‘তোমার রূপ, সৌন্দর্যকে আমি কখনো ভালোবাসিনি। তোমার নীরবতাকেই আমি ভালোবেসে এসেছি।’
সকলের হাত তালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে জায়গাটি। এই দৃশ্যটি জয় নিজে ভিডিয়ো করেছে। সে নিজেও কান্নারত দৃষ্টিতে স্মিত হাসে ওদের দিকে তাকিয়ে। হাত তালি দিতে দিতে স্বগতোক্তি করে বলে,’আমি তোমাকে শেষ পর্যন্ত চেয়েছিলাম সূচনা। কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায় ছিল না।’
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বিদায়ের পালা আসে। বাবা-মায়ের ঘর শূন্য করে, অন্যের ঘর পূর্ণ করতে সমস্ত কষ্ট বুকে চাপা দিয়েও মেয়েকে বিদায় দেন বাবা-মা। আদরের বোনটিকে এভাবে বিদায় দিতে কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে ভূমিকারও। সে বোনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে। কান্না করে সূচনাও। তারও ইচ্ছে করছে না এভাবে আপন মানুষগুলোকে ছেড়ে যেতে। শোহেব ভূমি আর ওর বাবা-মাকে সামলে নেয়। বিদায়ের মুহূর্তে এতদিনের একসাথে থাকা সঙ্গীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে ফাতেমা, সাথী এবং সুখীও। অথচ এরা প্রত্যেকেই জানে, সূচনা ঐ বাড়িতে অনেক ভালো থাকবে। সুখে থাকবে। কিন্তু প্রিয় মানুষের বিদায় কে-ই বা পারে সহ্য করতে? এখানে বড়ো ভাইয়ের দায়িত্বটা পালন করে শোহেব। সে সূচনাকে গাড়িতে বসানোর জন্য এগিয়ে নেয়। সূচনা অনেক দেখেছে, বড়ো ভাই থাকলে সাধারণত তারাই গাড়িতে উঠিয়ে দেয়। ভাই তো তারও আছে। তবে সে যে থেকেও নেই। আজ এই স্থানটা যেন শোহেবই পূরণ করে দিলো। সূচনা আবেগী হয়ে শোহেবকেও জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। যেন বলতে চাইছে, তার প্রিয় মানুষগুলোকে যেন সে দেখে রাখে। বোন না থাকার যে কষ্টটা এতদিন শোহেবের মাঝে ছিল, সূচনার বিদায়বেলায় হঠাৎ করেই মনে হলো তারও সেই স্থানটা পূরণ হয়ে গেছে। কে জানে, তার চোখের কোণেও হয়তো দু’ফোঁটা অশ্রু এসে জড়ো হয়েছে। সে সূচনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’কান্না করে না বোনু। আমি বাবা-মা আর ভূমিকে দেখে রাখব।’
সূচনা যাওয়ার আগে শেষবারের মতো বাবা-মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বাবা-মায়েরও ইচ্ছে করছে না কলিজার টুকরাকে এভাবে বিদায় দিতে। বাবা সূচনার গালে অজস্র চুমু খান। মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। মা সূচনা জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে থাকে। বিদায় বেলায় সূচনা সবাইকে দেখতে পেলেও জয়কে দেখতে পায়নি। সে গাড়িতে বসেও কান্না করে। আদিল ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে।
ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িটি চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। দূর থেকে এতক্ষণ জয় সূচনার বিদায়পর্ব দেখছিল। তার প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সামনে যায়নি। কী দরকার, শেষ সময়ে এসে পরীটাকে পিছুটানে ফেলার? গাড়িটি একেবারে দৃষ্টির বাইরে যাওয়ার পর জয়ও ঘুরে দাঁড়ায়। হাতের উলটোপিঠে চোখের পানি মুছে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,’কী এক বিচিত্র যন্ত্রণা যে তুমি সূচনা, কী এক বিরহ তুমি জানো না। তোমায় না পাওয়ার শোক আমার আজীবন থেকে যাবে। আমার ঈশ্বর আর তোমার আল্লাহ্’র কাছে আমার একটাই অনুরোধ, যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে তাহলে সেই জন্মে যেন আমাদের এক করেই পাঠায়। সেই জন্মে যেন ভালোবাসার নাম হয় সূচনা; বিরহ নয়!’
(সমাপ্ত)
_____
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।
অনেক অপেক্ষার পর অবশেষে গল্পটি শেষ করতে পারলাম। ভুলত্রুটি অবশ্যই থাকতে পারে, সেগুলো একজন পাঠক হিসেবে আপনারাও ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন।
গল্পটা সম্পর্কে আমি নিজে কিছু বলতে চাই। এখানে রাসেল নামক প্রতারকের শাস্তি দেখানো হলেও বাস্তব জীবনে কিন্তু এমনটা খুব কমই হয়। মানে, বাস্তবে প্রতারকরাই ভালো থাকে। উদাহরণ হিসেবে গল্পের অন্য একটি চরিত্র সুমিকে দেখলেই বুঝতে পারবেন। আপাতদৃষ্টিতে লক্ষ্য করলে দেখবেন, সে পরবর্তীতে রাসেলের সাথে প্রতারণা করার পরও কিন্তু সুমি সুখে আছে। আমার এ কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হলো, মেয়েরা ভীষণ আবেগী হয় ভীষণ! এরা অল্পতে যেমন ভালোবাসতে পারে আবার অল্পতে ভেঙেও পড়ে। ভূমিকা চরিত্রটির মাধ্যমে আমি এটা বোঝাতে চেয়েছি, জীবনের যত কঠিন মুহূর্তই আসুক না কেন, প্লিজ মেয়েরা! তোমরা ভেঙে পড়বে না। যেভাবে পারো মনকে শক্ত রাখার চেষ্টা করবে। ভূমিকা কিছু করে দেখিয়েছে। তোমরাও পারবে। এখন এজন্য লেখিকা, গায়িকা, অভিনেত্রীই যে হতে হবে বিষয়টা এমনও নয়। যেকোনো আত্মসম্মানজনক কাজ করেও, নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়। ভালো থাকাটা নির্ভর করে একান্তই নিজের ওপর। তাই ভেঙে পড়লে চলবে না।
আর সূচনা চরিত্রটির কথা নতুন করে কিছু বলার নেই। আমাদের সবার মাঝেই কমবেশি কমতি থাকে। তাই কেউ নিজের কোনো কমতিকে দুর্বলতা ভাববেন না। শক্ত মনোবল রাখবেন।
আরও একটা বিষয় খেয়াল করলে দেখবেন, গল্পের মেইন চরিত্রগুলোর প্রায় সকলের মাঝেই কিছু না কিছু বিরহ রয়েছে। এখন কার জন্য কার বিরহ সেটা আমি বলব না। সব যদি আমিই বলে দেই, তাহলে আপনারা উপলব্ধি করবেন কী?
তো সবাই ভালো থাকবেন, দোয়া করবেন। হ্যাপি রিডিং।]