#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৪০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________
১১১.
মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটি কম গতিতে চলছে। শো শো একটা শব্দ হচ্ছে। যদিচ ঠান্ডা এখনো আছে, তবুও সূচনার অদ্ভুত কারণে নাকি গরম লাগছে। এক পায়ের ওপর ব্লাঙ্কেট রাখা। বালিশ খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে সেও ঠেস দিয়ে বসে রয়েছে। আজ তিনদিন হবে তাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আনা হয়েছে। ক্ষতস্থান এখনো শুকায়নি। চলাফেরা করতে ব্যাপক কষ্ট করতে হচ্ছে। চব্বিশ ঘণ্টাই মাকে থাকতে হচ্ছে ওর সাথে। রাত হলেই যন্ত্রণা আরো বেশি হয়। কলেজ, প্রাইভেট সবই বন্ধ। নুসরাত প্রতিদিন পড়া নোট করে হোয়াটসএপে ছবি পাঠায়। সেগুলো দেখেই যতটুকু পারে টুকটাক পড়ে সে।
হাতের বইটি সে পাশে টেবিলের ওপর রেখে চোখ বন্ধ করে। এভাবে শুয়ে বসে থাকতে থাকতে সে চরম মাত্রায় বিরক্ত। বইমেলা শুরু হওয়া সত্ত্বেও ভূমি এখনো যায়নি। ওর কত ফ্যানরা দেখা করার জন্য অনুরোধ করে! কিন্তু ভূমি কোনো না কোনো ভাবে যাওয়ার ডেট পিছিয়ে দিচ্ছে। সূচনা এমন করার কারণ জিজ্ঞেস করলে ভূমি বলেছিল,’তুই এভাবে অসুস্থ হয়ে বাসায় পড়ে থাকবি আর আমি যাব বইমেলায়?’
‘তো কী হয়েছে? তোর প্রথম বই বের হচ্ছে। তোর অবশ্যই বইমেলায় যাওয়া দরকার।’
‘যাব। তুই সুস্থ হলে।’
‘আমার সুস্থ হতে সময় লাগবে। তুই এই শুক্রবারেই যা।’
‘আচ্ছা দেখবনে।’
মেলা প্রসঙ্গে এই ছিল দু’বোনের মুখে আর খাতার কথোপকথন। হাসপাতালে থাকার সময়ে আয়না দেখার সুযোগ তো হয়-ই’নি, এমনকি সে বাড়িতে এসেও আয়না দেখেনি সূচনা। নিশ্চয়ই তাকে অনেক কুৎসিত আর বিদঘুটে লাগছে দেখতে?
‘আরে ময়নাপাখি, কী করছ?’
আদিলের কণ্ঠস্বরে চোখ মেলে তাকায় সূচনা। আড়চোখে একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যা পৌঁনে ছয়টা বাজে। তার মানে আদিলের অফিস ছুটি হয়েছে পাঁচটায়। আর সে সেখান থেকেই সরাসরি এ বাসায় চলে এসেছে। শুধু যে আজই এমনটা হলো, ঠিক তা নয়। এক্সিডেন্টের পর থেকে প্রতিদিনই সে আগে সূচনার কাছে আসে।
সূচনা আদিলের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে। আদিল এসে বসে চেয়ারে। জিজ্ঞেস করে,’ভালো আছো?’
এবারও প্রত্যুত্তরে সূচনা স্মিত হাসি প্রদান করে। কিছুক্ষণ বাদে মা বাটিতে করে গরম গরম হালিম নিয়ে আসে। এক বাটি আদিলের দিকে এগিয়ে দিতেই সে বলে,’সূচনাকে দিন। আমি খাব না।’
‘খাব না বললেই হয়? তুমি আনছ তোমারও খাওয়া লাগব।’
মায়ের সাথে আর জোড়াজুড়ি করল না আদিল। প্রতিদিন আসার সময় সে সূচনার পছন্দমতো কোনো না কোনো খাবার নিয়ে আসবে। মা চলে যাওয়ার পর আদিল কেমন করে যেন বলে ওঠে,’আমি খাইয়ে দেই?’
সূচনা সংকোচে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। সচারচর কারও হাতে খাওয়ার স্বভাব নেই তার। সেখানে আদিল! সে লজ্জায় ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছুই বলতে পারছে না।
কিছুটা অনিচ্ছা এবং কিছুটা অভিমানীস্বরে আদিল বলল,’আচ্ছা সমস্যা নেই। তুমি নিজের হাতেই খাও।’
সূচনা একবার মুখ তুলে তাকাল। কিছুক্ষণ মৌন থেকে কিছু বলতে চেয়েও আবার নিরব হয়ে বসে রইল। খাচ্ছে না দেখে আদিল জিজ্ঞেস করল,’খাও না কেন? খাবে না?’
সূচনা ইশারায় বোঝাল সে নিজের হাতে খাবে না। অস্বস্তির সাথে আদিল পূণরায় সুধালো, ‘আমি খাইয়ে দেবো?’
সূচনা ঘাড় কাৎ করে সম্মতি জানায়।আদিলের চোখে-মুখে আনন্দ উপচে পড়তে লাগল যেন। সে জ্যাকেটের হাতা গুটিয়ে নিয়ে হালিমের বাটি হাতে তুলে নিল। খাওয়ানোর সময় সূচনা একবারও তাকায়নি আদিলের দিকে।
কোচিং থেকে বাড়িতে ফিরে মন শান্ত করা দৃশ্যটি দেখে সুখী বলে,’হায় আল্লাহ্! আমি তো মরেই যাব।’
সূচনা অস্বস্তিতে গাট হয়ে বসে থাকে। সুখী ব্যাগটা টেবিলের ওপর রেখে সূচনার পাশে খাটে বসে বলে,’কী হলো? দুজনে এমন চুপসে গেলে কেন? খাও আর খাওয়াও।’
সূচনা ইশারায় বলল আর খাবে না। সুখী মনমরা হয়ে বলল,’আমি তাহলে চলে যাই?’
‘আরে না! যাবে কেন? বসো এখানে। এই নাও হালিম খাও।’ নিজের জন্য রাখা হালিমের বাটিটা আদিল সুখীর দিকে এগিয়ে দিলো। সুখী না করল না। তিনজনের মাঝে আড্ডার চলার মাঝেই সাথী, ভূমি আর ফাতেমাও অফিস থেকে ফিরে আসে। আদিলের উপস্থিতিতে অবশ্য কেউই অবাক হয়নি। বরং সকলের জানাই ছিল আদিলকে এসে বাড়িতে পাওয়া যাবে। ওরাও আসার সময় বেশকিছু খাবার নিয়ে এসেছে। অসুস্থ হলে এই হচ্ছে এক সুবিধা। অনেক বেশি কেয়ার আর ভালো ভালো খাবার পাওয়া যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে অসুস্থ হলে তখন খাওয়ার রুচিটা আর থাকে না।
ওরা তিনজন ফ্রেশ হয়ে আসার পর ছয়জনে মিলে আড্ডা দিচ্ছে এবার। সকলের কথার মধ্যমণি হচ্ছে সূচনা। সে কী করে,কীভাবে খায়, কীভাবে ঘুমায়, কেমন ফাজিল, ছোটো বেলায় কেমন দুষ্টু ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। গল্প করার মাঝে এই ছয়জনকে অবাক করে দিয়ে সেখানে উপস্থিত হয় আরো কয়েকজন মানুষ। যাদেরকে এসময়ে এখানকার কেউই আশা করেনি। হাতভর্তি ফলমূল নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে শোহেব, শিশির, আসলাম আর নুসরাত। নুসরাতের হাতে অবশ্য মোবাইল ছাড়া অন্য কিছু নেই। সে গম্ভীর আর রাগি দৃষ্টিতে আদিলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ বাদেই হিংস্র বাঘিনীর ন্যায় সে ভাইয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে,’তোমায় কতবার বলেছিলাম আসার সময় আমায় নিয়ে আসার জন্য? কেন আনোনি?’
আদিল কোনো রকম ওর আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বলল,’আমি তো সরাসরি অফিস থেকে চলে এসেছি। মনে ছিল না।’
‘মনে থাকবেও না।’ এবার যেন কিছুটা অভিমানী লাগল নুসরাতকে।
‘এজন্য তুই ওদেরসহ নিয়ে আসবি?’
নুসরাত একবার দরজায় দাঁড়ানো ছেলে তিনটির দিকে তাকিয়ে খুব সাবধানে খাটে গিয়ে সূচনার অন্যপাশে বসল। আসলে সে তো শুধু আসলামকেই বিষয়টা বলেছিল। শিশির আর শোহেবের বিষয়টা তো তারও জানা ছিল না। হঠাৎ করে বাড়ির সামনে এসে দেখা হয়ে গেল। অন্যদিকে শিশিরকে দেখে খুশি আর লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল সুখী। অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছিল তার মাঝে। শোহেব আর ভূমিরও একবার চোখাচোখি হয়ে গেল এই সুযোগে। ওদের বসতে দিয়ে ফাতেমা আর ভূমি গেল খাবারের ব্যবস্থা করতে। রাতে তো আর কাউকে না খাইয়ে পাঠানো যাবে না। রান্নাঘরে এসে যখন ভূমি আলোচনা করছিল কী রান্না করা যায় তখন শোহেব এসে সেখানে উপস্থিত হয়।
ওকে দেখে ওরা চুপ হয়ে যায়। মা জিজ্ঞেস করে,’কিছু বলবে বাবা?’
‘আপনারা কি খাওয়ার আয়োজন করছিলেন? করলে বলব বাদ দিন। এজন্য আগে থেকেই বলতে এসেছি।’
‘কী বলো! না খাইয়া কি যাইতে দিব নাকি?’
‘খেয়েই যাব। আমি বাইরে খাবার অর্ডার করে দিয়েছি। রাতে আর এত কষ্ট করে সবার জন্য রান্না করতে হবে না।’
‘আপনি কেন এসব করতে গেলেন?’ জিজ্ঞেস করল ভূমি।
‘কারণ এই সময়টা আমরা সবাই একসাথে আড্ডা দিয়ে কাটাতে চাচ্ছি। আর আন্টিকেও কষ্ট দিতে চাচ্ছি না।’
খাবার যখন অর্ডার দেওয়া হয়েই গেছে তখন আর কারও কিছু বলার রইল না। শোহেব অনেকবার মা আর বাবাকে জোড়াজুড়ি করেছিল ওদের সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য। কিন্তু মা নাকচ করে বলেছে,’পোলাপানের আড্ডার মধ্যে আমরা কী করমু? তোমরা যাও গল্প করো।’
অতএব মা আর বাবাকে ছাড়াই সকলের আড্ডা একদম ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল। মাঝে মাঝে কাপলযুগলের চোখাচোখিও হচ্ছিল। সন্তর্পণে সকলের দৃষ্টির আড়ালে সূচনার একটি হাত আদিল নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছিল।
সেসময়ে নুসরাত বায়না করে বলল,’চলো না সবাই মিলে একটা ভূতের ছবি দেখি প্লিজ!’
ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুখীও বলল,’হ্যাঁ, হ্যাঁ। অনেক মজা হবে তাহলে।’
ওদের বাচ্চামোতে বাঁধ সাধেনি কেউ। বরং শোহেব ওদের মতো করেই বলল,’হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিও রাজি।’
খাটে এতগুলো মানুষ বসা সম্ভব নয় বলে ফ্লোরে পাটি, জাজিম বিছিয়ে বসার জায়গা করা হয়েছে। সূচনার নিচে বসতে অসুবিধা হবে বলে ওকে খাটেই রেখেছে। বামপাশে বসেছে আদিল আর ডানপাশে সাথী এবং ফাতেমা। বাকিরা সবাই বসেছে নিচে। মুভি চলার সময়ে সকলে নিশ্চুপ থাকে। শোহেব লাইট নিভিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দেয়। তারপর এসে বসে ভূমির পাশে। ভূমি কিছুই বলল না। শোহেব ফিসফিস করে বলে,’বমি, ভয় পেও না। আমি আছি।’
ভূমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। কারণ সে জানে, শোহেবকে কিছু বলা না বলা একই কথা।
মুভি চলাকালীন সময়ে আদিলও সকলের আড়ালে সূচনার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,’ভয় পেলে আমায় জড়িয়ে ধরতে পারো। আমি মাইন্ড করব না। ভয় নেই! কিছু করবও না।’
সূচনা পাশ থেকে ফোন নিয়ে নোটপ্যাডে কিছু টাইপ করে আদিলকে দিলো। সেখানে লেখা ছিল,’আপনি বলেছিলেন না খোলা চুলে আপনার সামনে আসলে আপনি নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন না? এজন্য দেখুন, এখন আমার চুলই নেই।’
আদিল অসহায়ের মতো একবার তাকিয়ে সূচনার ঘাড়ে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল,’তুমি সর্বদা সব অবস্থাতেই আমার কাছে মোহনীয়। আমি তোমায় সব অবস্থাতেই ভালোবাসি।’
_______
১১২.
সকালের ফ্লাইটে দেশে ফিরেছে রাসেল। আমেরিকা যখন ছিল তখন বাড়িতেও যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। আজ হঠাৎ করেই কিছু না বলে-কয়ে দেশে ফিরে আসার হেতু খুঁজে পাচ্ছেন না রেশমা বেগম। বাড়িতে এসে পর্যন্ত শুয়েছে; উঠেছে সন্ধ্যায়। এর মাঝে একটা কিছু মুখেও তোলেনি। তিনি কিছু বুঝতে না পেরে রিদিকে ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছেন।
ভূমির সাথে রিদির সেদিনের দেখা হওয়া এবং কথা হওয়ার বিষয়টিও তিনি জানেন। তার এখন মনে হচ্ছে ভূমির শোকেই ছেলেটার এই অবস্থা। কিন্তু যখন নিজে এসে ডিভোর্স দিয়ে গেল, তখনও তো ছেলেটাকে ঠিকঠাক লাগছিল। তাহলে আবার হঠাৎ করে কী হলো?
রিদি আর রেশমা বেগম ড্রয়িংরুমে বসে রাসেলের ঘুম থেকে ওঠার অপেক্ষা করছিল। রাসেল একদম ফ্রেশ হয়ে বের হয়। তবুও তাকে দেখতে বেশ অগোছালো লাগছিল। দাঁড়ি আর চুলের একদম বিশ্রি অবস্থা। রাসেল এসে ভালোমন্দ কিছু না বলেই যে কথাটা প্রথম বলল তা হলো,’ভূমি কোথায় থাকে তোমরা জানো কেউ?’
মা ও মেয়ে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায়। রেশমা বেগম অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন,’ওর ঠিকানা জেনে তুই কী করবি?’
‘দরকার আছে। তোমরা জানো নাকি বলো।’
‘আমরা কী করে জানব? ওর সাথে আমরা যোগাযোগই বা কেন রাখতে যাব?’
রাসেল একটু চুপ করে থেকে বলল,’ওর আগের নাম্বারটা বন্ধ। ফেসবুকে আমার আইডি ব্লক করে রাখা। অন্য আইডি দিয়ে অবশ্য রিকোয়েস্ট আর ম্যাসেজও দিয়েছিলাম। কিন্তু এতশত মানুষের ভিড়ে হয়তো চোখেই পড়েনি। এখন তাহলে উপায় ওর চাচার বাড়ি।’
রেশমা বেগম ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন,’তুই কি পাগল হয়ে গেলি নাকি? ঐ মেয়ের সাথে তুই কেন যোগাযোগ করবি? আবার ফিরিয়ে আনবি নাকি?’
‘ফিরে যাব। কথা আছে ওর সাথে।’
এবার রিদি বলল,’তুই না ডিভোর্সের সময় কতকিছু বলে গেলি? ভূমি নাকি চরিত্রহীন। তাহলে আবার ওর কাছে ফিরে যাবি মানে? মাথার স্ক্রু কি ঢিলা হয়ে গেছে?’
‘তুই বিয়ে করবি আবার? তাহলে বল আমরা মেয়ে দেখি।’ বললেন রেশমা বেগম।
রাসেল কারও কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই ঘরে ফিরে দরজা লক করে দেয়। এই মুহূর্তে তার কারও সাথেই কথা বলতে ভালো লাগছে না।
__________
১১৩.
সকলের জোড়াজুড়ি আর চাপাচাপির কারণে আজ ভূমিকে বইমেলায় আসতে হয়েছে। সূচনা আর বাবা-মা বাদে সবাই এসেছে। সূচনার জন্যই বাবা-মা বাড়িতে থেকে গেছে। নয়তো ভূমি সবাইকে যেমন জোর করে সাথে এনেছে, ওদেরও আনতো। ওর কেমন যেন ভালো লাগার পাশাপাশি অন্যরকম একটা অনুভূতিও হচ্ছিল। এই অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। উত্তেজনায় ওর শরীর ঈষৎ কাঁপছিল। পাশ থেকে শোহেব বলে,’এইযে অফিস-টফিস সব বাদ দিয়ে আপনার পিছু পিছু চলে এসেছি। এর বিনিময়ে কী দেবেন?’
‘কিছুই না। আপনাদের কারণেই তো সূচনাকে ছাড়া বইমেলায় আসতে হলো। আবার বিনিময়ে চাইছেন?’
‘যাহ্ বাব্বাহ্! সব দোষ এখন আমাদের?’
‘আমাদের না বলে আমার বলেন। মানে আপনার। আপনি যে সূচনাকে উসকিয়েছেন আমায় রাজি করানোর জন্য, আমি কিন্তু সেটা জানি।’
‘তা তো আপনার ফ্যানদের কথা ভেবেই বলেছি।’
‘বেশ তো! ফ্যানদের কাছ থেকেই চেয়ে নিন।’
‘আপনি খুব নিষ্ঠুর বমি।’
‘এখানে অন্তত ঐ বাজে নামটাতে ডাকবেন না প্লিজ! তাহলে সত্যি সত্যি কিন্তু আপনার ওপর বমি করে দেবো।’
‘আস্তাগফিরুল্লাহ্! নাউজুবিল্লা। আমার ফুলের মতো চরিত্র নিয়ে কোনো কথা বলবেন না।’
‘মানে? আপনার চরিত্র নিয়ে কখন কথা বললাম?’
‘মাত্রই বললেন।’
‘কখন?’ ভূমির চোখে বিস্ময়।
‘এইযে বললেন বমি করবেন। কেন বমি করবেন? আমি তো আপনার সাথে কিছু করিনি।’
ভূমি এবার রাগে কটমট করে তাকায়। শোহেব ভয়ে সেখান থেকে সরে ফাতেমার পাশে দাঁড়ায়। মেলার ভেতর ঢোকার আগে ভূমিকে একটু দূরে সরিয়ে আনে শোহেব। হুড়মুড়িয়ে কতগুলো বাচ্চা এসে বলে,’ভাইয়া একটা ফুল নেন।’
শোহেব জিজ্ঞেস করে,’ভুল দিয়ে আমি কী করব?’
‘ক্যান? আপারে দিবেন।’
‘তোমাদের আপা ফুল নেবে না।’
‘নিব। আপনি কিন্না দিলেই নিব।’
‘ওমা! ফুল দেওয়ার জন্য কিনতেও হবে?’
একটা বাচ্চা হেসে বলল,’তাইলে কি মাগনা দিমু নাকি? আমরাও তো টেকা দিয়া কিন্না আনছি।’
শোহেব সরল হেসে একটা গোলাপ ফুলের ক্রাউন কিনে নেয়। ভূমির মাথায় দিয়ে বলে,’নিজের প্রথম প্রাপ্তির জন্য বইমেলায় এসেছেন, আপনাকে স্বাগতম ভূমিরানী।’
নিজেদের স্টলে যাওয়ার পর অনেকে আসে ভূমির সঙ্গে দেখা করতে। সবার সাথে গল্প করে, ছবি তোলে। শোহেব একটা বই নিয়ে এসে বলে,’আমাকে একটা অটোগ্রাফ দিন ম্যাম।’
ভূমি হেসে বইটি নিয়ে অটোগ্রাফ দেয়। তখন পাশ থেকে একটা মেয়ে অবাক হয়ে বলে,’ভূমিকা আপু না?’
ভূমি পাশ ফিরে তাকায়। মেয়েটির চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সে আবেগে ভূমিকে জড়িয়ে ধরে। এদিকে ভূমি যেন কথা বলতেই ভুলে গেছে। মেয়েটি আনন্দিত কণ্ঠে বলে,’আমি আপনার ফ্যান আপু। ফেসবুকে আপনার লেখা অনেক পড়েছি। কিন্তু সত্যিই জানতাম না আপনাকে আজ বইমেলায় পেয়ে যাব। আমি আজ ভীষণ খুশি।’
ভূমি নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে শুধু। সে মনে মনে ভাবে পৃথিবীটা কত ছোটো তাই না? নাকি পৃথিবীটা আসলেই গোল? অথবা হতে পারে সবই আল্লাহ-র লীলাখেলা। নয়তো যেই মেয়েটির জন্য আজ তার সংসার ভাঙল সেই মেয়েটিই নাকি তার ফ্যান? এমনও হয়? ভূমি সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বলল,’ভালো আছেন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্ আপু। আপনি ভালো আছেন?’
‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ্।’
‘আপু আমায়ও একটা নামসহ অটোগ্রাফ দিয়ে দিন।’
ভূমি স্টল থেকে একটা বই নিয়ে নাম জিজ্ঞেস না করেই লিখতে যাচ্ছিল তখনই জিজ্ঞেস করল,’আপনার নাম?’
‘সুমি।’
ভূমি অটোগ্রাফ দিচ্ছে তখন সুমি বলল,’আপু একটা ছবি তুলতে পারি আপনার সাথে?’
‘শিওর।’
‘এক মিনিট। আমার হাজবেন্ডকে ডাক দিচ্ছি।’
ভূমির বুকটা ধক করে কেঁপে ওঠে তখন। ‘আমার হাজবেন্ড’ তার মানে রাসেল! বিয়ে করে ফেলেছে। এতে তার সমস্যা নেই। তবে আবার সেই মানুষটার মুখোমুখি হতে হবে তাকে? যে আত্মবিশ্বাস এতদিন সে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিল তা ভেঙে যাবে না তো? সে অস্থির হয়ে পড়ছিল ভেতরে ভেতরে।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]