#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৩৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
৮৬.
ক্লাসে বেঞ্চের এক কোণায় বসে খাতায় রসায়ন সাবজেক্টের বিক্রিয়া করছিল সূচনা। নুসরাত যে কখন পাশে এসে বসেছে, সে খেয়াল করেনি। অনেকক্ষণ যাবৎ নুসরাতও চুপ করে থাকে এটা ভেবে যে, সূচনা তার উপস্থিতি টের পায় নাকি এটা দেখার জন্য। যখন দেখল ফলাফল শূন্য তখন সে নিজেই গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,’এহেম! এহেম! আজকাল তো দেখছি আমি কারও নজরেই পড়ছি না। কলেজের বাইরে ভাইয়া, আর কলেজে এসে পড়াশোনা। আমাকে কি আর কারও দেখার সময় আছে এখন?’
সূচনা চকিতে ঘাড় বাঁকিয়ে নুসরাতকে দেখে। ওর অভিমানী কথাগুলো শুনে স্মিত হাসে। নুসরাত ভেংচি কেটে বলে,’ও হাসিতে ভাইয়া ফাঁসে, আমি নই হুহ!’
সূচনা এবার খিলখিল শব্দ করেই হেসে ফেলে। এরপর ইশারায় জিজ্ঞেস করে,’কাল সবাই আসলো। তুমি কেন এলে না?’
নুসরাত নড়েচড়ে বসে। ব্যাগের ওপর দু’হাত রেখে বলে,’এর জন্য আগেই স্যরি। আমার স্কুল লাইফের বেস্টফ্রেন্ডের জন্মদিন ছিল গতকাল। ওকে সময় দিতে গিয়ে ট্রিট মিস হয়ে গেল। ব্যাপার না, ভাই-ভাবি তো আমারই। এক্সট্রা ট্রিট আমি নিয়ে নেব পরে।’
কথাটা বলে দুজনই হাসল। একটুখানি সময় মৌন থেকে নুসরাত লাফিয়ে উঠে বলল,’দেখেছ বানাতে চেয়েছিলাম বেস্টফ্রেন্ড আর হয়ে গেলে ভাবি! আল্লাহ্ চাইলে কী না হয় বলো? তবে তুমি কিন্তু সেদিন আমার প্রস্তাব নাকচ করেছিলে। তোমার ধারণা ছিল, আমিও অন্য সবার মতো তোমায় ছেড়ে যাব। যাইনি, দেখেছ? পৃথিবীতে সবাই এক হয় না। ব্যতিক্রম মানুষ এখনও এই পৃথিবীতেই বাস করে। ছেড়ে তো যাই-ই’নি বরং একদম পাকাপোক্তভাবে বাড়িতে তোলার ব্যবস্থা করেছি।’
সূচনা হাসল নাকি নিরবে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল জানা নেই। নুসরাত এবার সূচনার বাহুতে নিজের বাহু দ্বারা মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে,’তোমাদের প্রেম কেমন চলছে শুনি একটু?’
সূচনা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়। নুসরাত হেসে ফেলে বলে,’আরে বলো, বলো। আমরা আমরাই তো।’
সূচনা খাতার সাদা পৃষ্ঠা বের করে লিখে,’কোনো প্রেম-ই চলছে না আমাদের মাঝে। সে তার মতো কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আর আমি আমার পড়াশোনা নিয়ে।’
‘সেকি! তোমরা দুজনই নিরামিষ নাকি? আহারে! আমার ভবিষ্যৎ ভাতিজা-ভাতিজির জন্য আমার এখনই কষ্ট লাগছে। যদি তোমাদের নিরামিষ স্বভাব ওরাও পায়? তাহলে ওরা প্রেম করবে কীভাবে?’
এ কথায় সূচনা কিঞ্চিৎ লজ্জা পায়। নুসরাতটা বড্ড বেশি বকে এখন। কী থেকে যে কী বলে ফেলে নিজেও জানে না। তাকে নিশ্চুপ দেখে নুসরাত নিজেই বলল,’থাক সমস্যা নেই। আমার মতো ফুপি থাকতে ওদের কোনো সমস্যাই হবে না।’
সূচনা ইশারায় বই দেখিয়ে দিয়ে বোঝাল,’পড়ো।’
নুসরাত মুচকি হেসে বলল,’থাক। আর লজ্জা পেতে হবে না। আমিও পড়ছি এখন।’
ক্লাস শেষ করে এক প্রকার টেনে-টুনেই নুসরাত সূচনাকে বাসায় নিয়ে গেল। আগে এই বাড়িতে আসতে তার একটুও লজ্জা লাগত না। কিন্তু আদিল তাকে পছন্দ করে এই বিষয়টা বোঝার পর থেকে এবং বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই সমস্ত সংকোচ তাকে ঘিরে ধরেছে। লজ্জা, অস্বস্তি তার নিত্যকার বন্ধু হয়ে যায় এই বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথে।
________
৮৭.
লাঞ্চ টাইম হওয়াতে ক্যান্টিনে বসে খাবার খাচ্ছিল ভূমিকা আর ফাতেমা। আরও অনেকেই এখানে আছে। তবে সবাই যে যার মতো খাওয়া এবং গল্পে মশগুল। ভূমিকা অল্পকিছু খাবার খেয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে হঠাৎ। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ফেসবুকের নোটিফিকেশন চেক করে। কতশত ম্যাসেজের ভিড় তার ইনবক্সে। কিন্তু সেদিকে খুব কম সময়ই দেওয়া হয়। সারাদিন অফিস করে বাড়ি ফেরার পর দু’চোখ ঘুম ছাড়া আর কিছু বোঝে না তখন।
ভূমিকা সার্চ অপশনে গিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। সার্চলিস্টের প্রথমেই রয়েছে রাসেলের আইডি। প্রতিদিন নিয়ম করে হলেও সে একবার রাসেলের আইডি ভিজিট করবেই। নতুন কোনো পোস্ট কিংবা ছবি কোনোটাই রাসেল আপলোড করে না। তবুও পুরনো পোস্ট, ছবি এসবই ঘুরে-ফিরে ভূমিকা দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। এখনও তার কাছে সবটা স্বপ্নই মনে হয়। বিশ্বাস করতে ইচ্ছেই করে না। মানুষ অদ্ভুত নাকি জীবন অদ্ভুত মাঝে মাঝে সে ভেবে পায় না। প্রলম্বিত শ্বাস ত্যাগ করে রাসেলের আইডিতে ক্লিক করে। কভার ফটো আপলোড করেছে রাসেল। ছবিটা দেখে বুকের মাঝখানটায় পূণরায় তার চিনচিনে ব্যথা অনুভব হয়। আশ্চর্য! এত কষ্ট কেন হচ্ছে? এক সময়ে এই মানুষটাকে সে ভালোবাসত বলে? না! সে তো এখনও এই মানুষটিকে মনে মনে ভালোবাসে। কৃষ্ণবর্ণের মিষ্টি হাসিমুখের ছেলেটির পাশে রয়েছে সুন্দর পরীর মতো একটা মেয়ে। মেয়েটা আর কেউ নয়। সুমি! এক হাতে রাসেল সুমির কোমর জড়িয়ে ধরে রেখেছে। সুমির এক হাত রাসেলের পিঠের ওপর এবং অন্য হাত রাসেলের বুকের ওপর। দুজনই কিছু একটা দেখে বোধ হয় হাসছিল। ক্যাপশনে লেখা ‘ক্যান্ডিড ফটো।’ এক সময়ে রাসেলের এই হাসিটাতে ভূমি কত হারিয়েছে। কত মুগ্ধ হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। না, আর বেশিক্ষণ ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না। সে দোনোমনা করে ডাটা অফ করে। বার দুয়েক জোরে শ্বাস নেয়। তার অস্থিরতা দৃষ্টিগোচর হয় ফাতেমার। জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে?’
ভূমি হাসার চেষ্টা করে বলল,’কিছু না।’
‘রাসেলের আইডি দেখছিলি?’
ভূমি চমকে তাকায়। উত্তরে কিছুই বলে না। ফাতেমা নিজেই বলল,’অস্বাভাবিক কিছু না। তবুও তুই নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছিস এখন। আস্তে আস্তে আরও পারবি। কিছু অভ্যাস পরিবর্তন কর তাহলে দেখবি আরও ভালো থাকতে পারবি। আমি লক্ষ্য করেছি, মাঝে মাঝে তুই গান শুনে কাঁদিস। আমি যদি ভুল না হই, তাহলে ঐ গানগুলোর সাথে তোর আর রাসেলের অতীতের স্মৃতি মিশে রয়েছে। তোর উচিত গানগুলো আর না শোনা; উপরন্তু ফোন থেকে ডিলিট করে দেওয়া। আর এইযে তুই রাসেলের আইডি প্রতিদিন নিয়ম করে ভিজিট করিস, এটাও বন্ধ করা উচিত। আর এজন্য সবচেয়ে ভালো হয়, তুই যদি ওকে ব্লকলিস্টে রাখিস।’
এতগুলো কথা একসাথে বলে থামল ফাতেমা। ভূমিকা নিরব শ্রোতা হয়ে সব শুনে বলল,’সুমির সাথে কভার ফটো আপলোড করেছে দেখলাম।’
‘তার মানে রাসেল ভালো আছে। ও কি তোর বিরহে পুড়ছে? পুড়ছে না তো! দিনশেষে দেখবি প্রতারকগুলোই ভালো থাকে। শুধু কষ্টে মরে তারাই, যারা সম্পর্কের প্রতি লয়্যাল থাকে। প্রতারকরা এখন ভালো থাকছে থাকুক। কিন্তু মৃত্যুর পরেও তো একটা জীবন আছে তাই না? বিয়ে একটা পবিত্র সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের সাথে, স্ত্রীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সে এত সহজে ছাড় পেয়ে যাবে? পাবে না। একটা কথা শুনিসনি? আল্লাহ্ ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না। আল্লাহ্’র ওপর ভরসা রাখ। যেহেতু তুই লেখালেখিটা ভালো করিস তাই জবের পাশাপাশি মেইন ফোকাস লেখালেখিতে দেওয়ার চেষ্টা কর। রাসেল যেন এটা ভেবে হলেও অশান্তি বোধ করে যে, তুই ওর জন্য থেমে নেই। তুই ওকে ছাড়াই ভালো থাকতে পারিস। জীবনে সফল হয়ে দেখিয়ে দে ওকে। বুঝতে পেরেছিস?’
ভূমিকা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে হাসে। হাসিটা ভীষণ সুন্দর। এই হাসিতে বিন্দুমাত্রও মিথ্যে নেই, অভিনয় নেই। ফাতেমার কথায় সে অনুপ্রাণিত হয়েছে। মনে জোর পেয়েছে। ফাতেমা উঠে যাওয়ার আগে ভূমির কাঁধে হাত রেখে বলে,’সময় শেষ। চল।’
‘তুমি যাও। আমি আসছি।’
‘জলদি আসিস।’
ফাতেমার ছুটি হবে রাত দশটায়। এদিকে ভূমির ছুটি হয়েছে সাতটায়। সূতরাং তাকে এখন একাই বাড়িতে ফিরতে হবে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে রিকশা খুঁজছিল। একটা রিকশা যখন পেয়েই গেল তখন রিকশাওয়ালা এক সঙ্গে দুজন মানুষের ডাকে থেমে যায়। একবার সে বামে তাকাচ্ছে তো একবার ডানে। কী নিরীহ লাগছে তাকে! এদিকে রাস্তার দু’ধারে থাকা দুটি মানুষও কিছুক্ষণ মৌন থেকে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। অহংকারি, দাম্ভিক, ঠোঁটকাটা লোকটিকে দেখে ভূমির চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। ওদিকে ভূমিকে দেখতে পেয়ে শোহেবের ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে যায়। সম্মতি ফিরতেই দুজনেই তড়িঘড়ি করে রিকশায় গিয়ে বসে। আচমকাই যেন বাজ পড়ে এবার। ভূমিকা কটমট করে বলে,’আশ্চর্য! আমি রিকশা আগে ডেকেছি। আপনি উঠলেন কেন?’
‘কী আজব! মেয়ে মানুষ মানেই যে মিথ্যার ড্রাম তা আরও একবার প্রমাণ পেলাম।’
‘কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?’
‘এটাই বলতে চাচ্ছি যে, আপনি একটা মিথ্যাবাদী।’
‘মুখ সামলে কথা বলবেন।’
‘আমি মুখ সামলেই কথা বলছি। তবে সত্যি কথা বলেছি শুধু। আপনি রিকশা আগে ডাকেননি বরং আমরা একসাথেই ডেকেছি।’
‘তো কী হয়েছে? আমি তো আগে এসে উঠেছি রিকশায়।’
‘এইযে আবার মিথ্যা কথা! আমরা একসাথেই রিকশায় উঠেছি।’
‘আপনার সমস্যা কী? আপনার যাবেন এই রিকশায়? তো যান!’ এই বলেই ভূমি রিকশা থেকে নেমে হাঁটা ধরে। কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো বসে থাকে শোহেব। এতক্ষণে রিকশাওয়ালা কথা বলে। জিজ্ঞেস করে,’কই যাইবেন বাজান?’
শোহেবের হুঁশ ফিরতেই সেও রিকশা থেকে নেমে যায়। ‘কোথাও না’ বলে সেও হাঁটা ধরে। দু’কদম আগাতেই পেছন থেকে রিকশাওয়ালা বলে,’এইডা কিছু হইল বাজান? আপনি যাইবেন না তাইলে আগেই নাইমা যাইতেন। আমি ঐ আম্মারে নিয়া যাইতাম। হুদাই আমার খ্যাপটা নষ্ট করলেন!’
রিকশাওয়ালাকে ভীষণই মনঃক্ষুণ্ণ দেখাল। শোহেব ফিরে এসে পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট রিকশাওয়ালার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল,’এইটা রাখেন।’
তারপর আর উত্তরের অপেক্ষা না করেই, ভূমি যেদিক দিয়ে যাচ্ছে সেদিকেই হাঁটা ধরে।
মানুষের আনাগোনা নেহাৎ-ই কম নয় আশেপাশে। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছে ভূমিকা। মেজাজ তার প্রচণ্ড রকম খারাপ। এই লোকটার সাথে তার কোন কুক্ষণে আজ দেখা হওয়া লাগল? ভূমি তো এটাই ভেবে পায় না, শিশিরের মতো ছেলের ভাই হয় কীভাবে এই লোক? যত্তসব!
‘এইযে এই! কী যেন নাম? এইযে শিশিরের আপু?’
উদ্ভট সম্বোধনে ভূমি থমকে দাঁড়ায়। রাগান্বিত দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় পেছনে। শোহেব একদম কাছাকাছি চলে এসেছে তখন। ভূমি কোমরে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,’সমস্যা কী আপনার?’
‘আপনি এমন কেন? আমি কি একবারও রিকশা থেকে নেমে যেতে বলেছিলাম?’
‘আমি এমনই। তো নামব না কী করব? আপনার সাথে বসে ঝগড়া করব? এত এনার্জি বা সময় কোনোটাই আমার নাই।’
‘কসম! এত ঝগড়ুটে মেয়ে আমি আমার জিন্দেগিতে দেখিনি। আমার প্রাক্তনও ঝগড়া করত; তবে আপনার মতো নয়।’
‘অদ্ভুত! আপনার প্রাক্তনের সঙ্গে আমায় তুলনা করছেন?’
‘তুলনা করছি না। বললাম জাস্ট।’
‘আপনার কী চাই এখন সেটা বলুন। ফলো করছেন কেন?’
‘আপনার কাছে আমি কী চাইব? কিছুই না।’
‘আপনি একটা বিরক্তিকর মানুষ, জানেন আপনি?’
‘হ্যাঁ।’
ভূমি হকচকিয়ে যায়। কী বলবে সে এই লোকটাকে? এর সাথে তো কথা বলাই বৃথা। ভূমি চুপচাপ হাঁটা ধরে। পাশাপাশি হাঁটছে শোহেবও। সে খুব শতর্কস্বরে বলে,’কিছু বললেই আপনি এমন ক্যাটক্যাট করেন কেন?’
‘আমি এমনই। আমায় কিছু বলতে আসেন কেন?’
‘আমি কি জানতাম নাকি আপনার সাথে আমার দেখা হবে আজ? তাও এমন বাজেভাবে।’
‘আপনার গাড়ি কোথায়? বড়োলোক মানুষ রিকশায় ঘোরেন কেন?’
‘এটা কেমন প্রশ্ন ছিল? প্রথমত আমি কোনো বড়োলোক নই। আর দশটা মানুষের মতোই সাধারণ একজন মানুষ। আল্লাহ্ সহায় হয়েছে তাই হয়তো এতদূর আসতে পেরেছি। তার মানে তো এই নয় যে আমার রিকশায় ঘোরা বারণ? একচুয়ালি, নিজের গাড়ি থাকলে যেকোনো জায়গায় ইজিলি পৌঁছানো যায়। এই সুবিধার জন্যই গাড়ি কেনা। নয়তো আমার রিকশায় চড়তেই বেশি ভালো লাগে। শিশিরের আজ একটা গানের কনসার্ট আছে। তাই বায়না ধরল আমার গাড়িটা নিয়ে যাবে। একমাত্র ছোটো ভাই, না করি কী করে বলুন?’
ভূমি এ কথার প্রত্যুত্তরে আর কিছু বলল না। তবে লোকটাকে একটু পরিবর্তন লাগছে। অহংকারি, দাম্ভিক ভাবটা এই মুহূর্তে নেই। অদ্ভুত একজন লোক!
________
৮৮.
সবুজ পাড়ের একটা লাল-খয়েরী সুতির কাপড় পরে বসে রয়েছে সূচনা। বিকাল থেকে এখনও পর্যন্ত সে আদিলদের বাড়িতেই রয়েছে। কতবার করে যেতে চেয়েছে! কিন্তু হবু শাশুড়ি আর নুসরাত কিছুতেই যেতে দিচ্ছে না। বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে সূচনা এই বাড়িতে আছে। ও বাড়িতে ফিরতে একটু দেরি হবে। সূতরাং তার জন্য দুশ্চিন্তা করার জন্যও কেউ বসে নেই।
শাড়িটা আদিলের মায়ের। একদম নতুন শাড়ি। আজই ভাঁজ ভাঙল এবং প্রথম পরল সূচনাই। তার ধবধবে ফরসা অঙ্গে লাল-খয়েরী শাড়িটা একদম ফুঁটে উঠেছে। কলেজ থেকে সরাসরি এ বাড়িতে আসায় পরার মতো জামা-কাপড় তো আর তার ছিল না। গায়ে ছিল কলেজের ইউনিফরম। নুসরাত অবশ্য নিজের জামা পরতে বলেছিল। কিন্তু তখন মা মৃদু ধমকে বলেছিল,’তোর সব জামা-ই তুই একবার হলেও পরেছিস। ও সেগুলো পরবে কেন? ও বরং আমার শাড়ি পরুক।’
ব্যস! সূচনারও না করার আর উপায় ছিল না। যেখানে তিনি এত শখ করে তার শাড়ি পরাতে চেয়েছেন, সেখানে কি আর না করার উপায় আছে?
নুসরাতের জামা পরতে বারণ থাকলেও ব্লাউজটা কিন্তু নুসরাতেরই ছিল। মায়ের অগোচরে সে কানে কানে বলেছিল,’শাড়িটা আম্মু কিনেছিল ভাইয়ার হবু বউয়ের জন্যই। বেশিদিন হয়নি। মাস ছয়েক হবে। ভাইয়া দেশে ফিরলেই আম্মু শাড়িটা দেখিয়ে বিয়ের জন্য শুধু ঘ্যানঘ্যান করত। আর ভাইয়া বলত, এখনও অনেক সময় আছে। পড়া শেষ হোক। আগে চাকরী পাই তারপর। আম্মু বলত, তাহলে মেয়ে দেখে রাখি? ভাইয়া তাতেও রাজি ছিল না। অথচ তোমায় দেখার পর হাওয়া বদল হতে সময় লাগেনি। তাই আমার যতদূর মনে হচ্ছে, মায়ের এতদিনের শখ পূরণ করার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছিল না। তাই আমায় ধমক দিয়ে তোমায় শাড়ি পরাল। বুঝেছ?’
কথাগুলো বলতে বলতেই নুসরাত হাসতে থাকে। কখনো কখনো আবার সূচনার গায়ে ঢলে পড়ে। এদিকে নতুন সব অনুভূতির সাথে পরিচিত হতে থাকে সূচনা। মা হাতে নুডলস্-এর বাটি নিয়ে এসে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখে। নুসরাতকে বলে,’হাসতে হাসতে ওর ওপর এরকম ঢলে পড়তেছিস কেন? ভর্তা বানিয়ে ফেলবি নাকি?’
‘ইশ! কত্ত দরদ। আমার আর দাম-ই নাই এই বাড়িতে।’
‘থাকবে না কেন? তোর শাশুড়িও তোকে এভাবে আদর করবে দেখিস।’
‘কচু করবে।’
‘করলে করবে। এখন তুই সরে বোস। আমার পুতুলের মতো বউমার ওপরে এভাবে ঢলে পড়িস না। ব্যথা পাবে।’
নুসরাত গাল ফুলিয়ে সরে বসে। মা মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে রান্নাঘরে চলে যায়। সূচনা আদুরে হাতে নুসরাতকে জড়িয়ে ধরে। নুসরাত মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,’হয়েছে! আর ভালোবাসা দেখাতে হবে না। কেউ আর এখন আমায় ভালোবাসে না।’
সূচনা ইশারায় বলে,’আমি তো তোমায় ভালোবাসি। সবাই-ই তোমাকে ভালোবাসে। শুধু ইচ্ছে করে তোমায় রাগায়।’
নুসরাত হেসে ফেলে। দুজনে খাওয়ার মুহূর্তে কলিংবেল বেজে ওঠে।
‘ভাইয়া এসেছে।’ বলে লাফিয়ে ওঠে নুসরাত। লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে চলে যায় দরজা খুলতে। এদিকে সূচনা পড়ি কি মরি করে উঠে দাঁড়ায়। কোনদিকে যাবে, কোথায় লুকাবে বুঝতে পারছে না। শাড়ি পরে সে কিছুতেই আদিলের সামনে দাঁড়াতে পারবে না। লজ্জায় মরেই যাবে! দরজা খুলে ফেলেছে নুসরাত। সূচনা দ্রুত দৌঁড়ে নুসরাতের রুমে ঢুকতে যায়। কিন্তু রুম বাইরে থেকে লাগানো। দরজা খোলার সময় নেই। তাই সে আর কোনোকিছু না ভেবেই পাশের রুমে ঢুকে পড়ে। টাইলসের ওপর পা রাখতেই বুঝতে পারে খালা একটু আগে রুম মুছে গেছে। ফ্যানও ছেড়ে গেছে ফ্লোর শুকানোর জন্য। সে আর কোনো কিছু না ভেবে আলমারির পাশে থাকা ছোট্ট চিপা জায়গাটাতে লুকিয়ে পড়ে আর কপাল চাপড়াতে থাকে। কপাল চাপড়ায় এজন্যই যে, যার থেকে লুকাতে এত বন্দোবস্ত সেই তার রুমে এসেই সে ঠেকেছে। ধিক্কার সূচনা! ধিক্কার! তুমি এত বোকা কেন? আর তোমার লুকাতেই বা হবে কেন শুনি? শাড়িই তো পরেছ! কোনো খারাপ পোশাক তো আর নয়। তাহলে শাড়ি পরে ঐ মানুষটার সামনে যেতে তোমার এত আপত্তি কোথায়? এতই যখন লজ্জা তাহলে আগেই কেন চলে গেলে না? সে তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে এই অপেক্ষায় কেন রইলে? নিজের মন যখন নিজেকে এভাবে কথা শোনাচ্ছিল তখন সে মনের ঘোর প্রতিবাদ করে জানায়, আমি তো যেতেই চেয়েছিলাম। আন্টিই তো দিলো না। বারবার বলল, আদিল পৌঁছে দিয়ে আসবে। আমার কী দোষ হ্যাঁ?
পায়ের শব্দ শুনে তটস্থ হয়ে যায় সূচনা। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটানো শব্দ হচ্ছে। হায় আল্লাহ্! যদি সে ধরা পড়ে যায়? তাহলে কী লজ্জাকর একটা পরিস্থিতিই না সৃষ্টি হবে। ইশ! ভাবতেই তার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।
আদিল ঘরে এসে বিছানার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে। সূচনা লুকিয়ে একটু তাকায়। চোখ কি বন্ধ করে রেখেছে? এই সুযোগে কি সে একটা ভোঁ দৌঁড় দেবে? তার চিন্তাভাবনায় এক মগ পানি ঢেলে আদিল উঠে বসে। শাড়ির আঁচল খাঁমচে ধরে চোখ বন্ধ করে বারবার আল্লাহকে ডাকছে সূচনা। দরজা লাগানোর শব্দ হলো। লোকটা বাইরে চলে গেল? হায় হায়! তাহলে তো সে রুম থেকে বের হতে পারবে না। আতঙ্কিত হয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে কয়েক সেকেণ্ড নিরব থাকে। তার সামনে, হ্যাঁ তার ঠিক সামনেই আদিল দাঁড়িয়ে রয়েছে কোমরে দু’হাত রেখে। দুজনের মধ্যে ব্যবধান এক হাতের মতো। সে ভূত দেখার মতো চমকে গিয়ে গগনবিদারী চিৎকার দেয়। তবে সেই চিৎকার রুমের বাইরে যায় না। আদিল ডানহাতে ওর মুখ চেপে ধরেছে। আস্তে করে বলে,’চুপ! চুপ! আমিই তো। এত ভয় পাওয়ার কী হয়েছে?’
সূচনা আস্তে আস্তে শান্ত হয়। বুকে ধুকপুকানি শব্দটা আরও বেড়ে গিয়েছে। এক ঝটকায় মুখের ওপর থেকে আদিলের হাত সরিয়ে দেয়। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কালো প্যান্টের সাথে সাদা শার্ট পরেছে। শার্ট ইন করা। হাতা ফোল্ড করা। চু্লগুলো কিছুটা এলোমেলো।
‘এত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছ যে? আমি কিন্তু বিয়ের আগেই কিছু করতে পারব না।’
আদিলের কথা শুনে সূচনার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। কী নির্লজ্জ লোক! আদিল মুখটিপে হাসছে। সূচনা দৌঁড় দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। তার আগেই খপ করে হাত ধরে ফেলে আদিল। দেয়ালের সাথে চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে বলে,’শাড়িতে তোমাকে অপূর্ব সুন্দর লাগছে। কৃষ্ণচূড়ার মতো!’ এই বলে সে বুকপকেটে রাখা বেলীফুলের মালাটি বের করে। সূচনার ডান হাতে মালাটি পরিয়ে দেয়। সূচনা অবাক হয়। তার মানে সে জানত, সূচনা এই বাড়িতেই আছে। আদিল তার হাতের পিঠে আলতো চুমু খেয়ে বলে,’এভাবে খোলাচুলে আমার সামনে আসবে না। তাহলে কিন্তু আমি নিজেকে আর আটকে রাখতে পারব না।’
চলব…..
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]