#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৩০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
৭৭.
বিছানার এক কোণে রাজ্যের সমস্ত রাগ নিয়ে বসে রয়েছে সূচনা। রাগে তার কান্নাও পাচ্ছে। সবাই মিলে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিল তাও আবার তাকে কিছু না জানিয়েই। কেন তারা এই সিদ্ধান্ত নেবে? সূচনা তো বলেছে সে কোনো সম্পর্কে জড়াবে না। তবুও তাহলে তারা কেন আদিলের বাড়ি থেকে আসা প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল?
সাথী, সুখী কেউই সূচনাকে বোঝাতে পারছে না। সে রেডি হবে না, আর যাবেও না ওদের সামনে। ফাতেমা এবং সূচনার মা আদিলের বাড়ির সবাইকে আপ্যায়ন করায় ব্যস্ত ছিল। সূচনা এখনও আসছে না দেখে মা নিজেই আসে ওদের রুমে। এসে দেখতে পায় রাগে থমথমে মুখ নিয়ে বসে রয়েছে সূচনা। তিনি সাথী আর সুখীর দিকে তাকাতেই ওরাও অসহায়ভাবে মায়ের দিকে তাকায়। এই দৃষ্টি বলে দিচ্ছে,’কোনোভাবেই রাজি হচ্ছে না।’
এবার তিনি গিয়ে সূচনার পাশে বসেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,’এমন পাগলামি করলে চলে বল? মেয়ে হইয়া যখন জন্ম নিছিস, তখন আজ হোক বা কাল বিয়ে করে তো পরের বাড়িতে যাওয়াই লাগব।’
সূচনা রাগে ফোঁস করে ওঠে। আকারে-ইঙ্গিতে বলে,’আমি বিয়ে করব না মানে, করবই না। তোমরা আমায় না বলে কেন রাজি হলে? আমি যাব না ওদের সামনে।’
গর্ভধারিণী মায়ের সূচনার ইশারাকৃত ভাষা বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না। সত্যিই এবার তার আফসোস লাগছে। বারবার মনে হচ্ছে সূচনার মতামতটা আগে নেওয়া প্রয়োজন ছিল। এখন যদি ওদের সামনে না যায়,ব্যাপারটা অনেক লজ্জাজনক হয়ে পড়বে। মা যখন কোনোভাবেই সূচনাকে বোঝাতে সক্ষম হয়নি তখন সুখীকে বলল,’আস্তে করে গিয়ে আদিলকে একটু ডেকে নিয়ে আয় তো।’
সুখী চলে যেতেই মা বিড়বিড় করে বলে উঠলেন,’এই সময়ে ভূমিটা যে আবার কোথায় গেল!’
‘আপু মনে হয় ছাদে গেছে।’ বলল সাথী
এই সময়ে সুখীর সাথে ঘরে প্রবেশ করে আদিল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় মায়ের দিকে। মা দরজার কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,’সূচনা রাজি হইতাছে না বাবা।’
আদিল আড়চোখে একবার তাকাল সূচনার দিকে। মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বিছানার ওপর আকাশী রঙের শাড়ি আর কিছু প্রসাধনী পড়ে রয়েছে। ওর পরনে নীল রঙের একটা থ্রি-পিস। চুলগুলো হাত খোঁপা করা। আগাগোড়া একবার পরখ করে নিয়ে সে মাকে বলল,’আপনি গিয়ে আব্বু-আম্মুর সাথে গল্প করুন। সূচনার বিষয়টা জানানোর প্রয়োজন নেই কাউকে। আমি দেখছি বিষয়টা।’
মায়ের সঙ্গে সঙ্গে সাথীও চলে গেল ড্রয়িংরুমে। রুমে এখন শুধু সূচনা, আদিল আর সুখী। সাথী যাওয়ার আগে সুখীকে ইশারায় থাকতে বলে গেছে। না হলে হয়তো সুখীও চলে যেত। তবে সে রুমে অবস্থান না করে বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসে থাকে।
আদিল বসে সূচনার মুখোমুখি। রাগে, ক্ষোভে সূচনা তেড়ে আসে তার দিকে। শার্টের কলার দু’হাতে খাঁমচে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে কিছু বলছে। কথাগুলো আদিল বুঝতে না পারলেও, এতটুকু অন্তত বুঝতে পারছে মেয়েটা তার ওপর ভীষণভাবে রেগে আছে। তার এবার একটু সত্যিই কষ্ট লাগছে। কী হতো যদি মেয়েটা একটু কথা বলতে পারত? তাহলে এখন যতখুশি আদিলকে গালাগালি দিত, কথা শোনাতে পারত। এতে মনটা একটু হালকা হতো। সে সূচনার দু’হাত ধরে কলার থেকে হাত সরায়। দু’হাতে সূচনার বাহু ধরে বলে,’রিল্যাক্স সূচনা! তুমি এমন কেন করছ? আমি এমন কী অপরাধ করেছি বলতে পারো?’
সূচনা কাঁদছে। অস্থিরভাবে কাঁদছে সে। আদিল ওর দু’গালে আলতো করে হাত রেখে বলে,’আমি তোমায় ভালোবেসেছি সূচনা, কোনো অন্যায় তো করিনি। আমি জানি, তুমি কোনো সম্পর্ককে বিশ্বাস করো না। ভূমি আপুর সাথে যা হয়েছে, এরপরে হয়তো তোমার জায়গায় থাকলে আমিও সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। আমি তোমাকে বলছি না তুমি আমায় বিশ্বাস করো। আমি চাচ্ছি, অনুরোধ করছি, তুমি আমায় একটা সুযোগ দাও। পৃথিবীর সব মানুষ যদি একই হতো, বিশ্বাস শব্দটিই হয়তো দুনিয়াতে আর থাকত না। তুমি তোমার আব্বু-আম্মুকেই দেখো, আমার আব্বু-আম্মুকে দেখো তারা এতগুলো বছর একসাথে আছে না? তারা কি কেউ কাউকে ছেড়ে দিয়েছে? ঝগড়া, মান-অভিমান যাই হোক না কেন তারা কিন্তু একসাথেই আছে। এখন যদি এটা ভাবো যে, তুমি কথা বলতে পারো না বলে, আমি তোমায় ছেড়ে চলে যাব। তাহলে উদাহরণ হিসেবে আমি তোমার বাবা আর মাকেই দেখাব। তোমার বাবা তো কথা বলতে পারে না। তোমার মা কি তাকে ছেড়ে গেছে? একসাথে আছে না তারা? তাহলে এরপরও কেন তুমি সবাইকে ভয় পেয়ে এক ভাবো? আমি তোমায় অনুরোধ করছি সূচনা, আমায় একটা সুযোগ তুমি দাও।’
সূচনার কান্নার গতি বাড়ে। সে দৃষ্টি নত করে নিরবে কেঁদে চলেছে। পর্দার আড়াল থেকে সূচনাকে বোঝানোর দৃশ্যটি দেখছে ভূমি। সারাজীবন আদিল এমনই থাকবে তো? আদিল আর কোনোকিছু না ভেবে সূচনাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,’বিশ্বাস করতে হবে না। শুধু একটাবার সুযোগ দাও।’
জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই সূচনার দৃষ্টি যায় ভূমির দিকে। ভাসা ভাসা চোখে সে এদিকেই তাকিয়ে রয়েছে। ইশারায় সে সূচনাকে বলে একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য। সেই দৃষ্টি কিংবা ইশারাতে কী ছিল সূচনা জানে না, তবে সে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। সে আর কারো জন্য না হোক, শুধুমাত্র ভূমির জন্যই রাজি হয়েছে। কোনো রকম সাজসজ্জা ছাড়াই সূচনা যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থাতেই আদিলের সাথে এঙ্গেজমেন্ট হয়ে যায়। যাওয়ার আগে সে আড়ালে বলে গেছে,’তুমি সব অবস্থাতেই সুন্দর, স্বচ্ছ এবং স্নিগ্ধ।’
______
৭৮.
পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ হচ্ছে কারো মায়ায় জড়ানো। এবং সবচেয়ে কঠিনতম কাজ হচ্ছে কারো মায়া কাটানো। তবে একটা জিনিস ভারী অদ্ভুত। আমরা মায়ায় জড়িয়ে যাই অজান্তেই। আর সেই মায়া থেকে বের হতে চাই স্বেচ্ছায়। যখনই কোনো ব্যক্তি কারো মায়া ত্যাগ করতে চায়, তখনই বুঝতে হবে মানুষটি ভেতর থেকে ভেঙে গিয়েছে। নতুবা খুব সহজে কেউ কারো মায়া ছাড়তে চায় না। অতীতের সকল পিছুটান, রাসেলের প্রতি ভালোবাসা, মায়া সবকিছু ত্যাগ করে ডিভোর্স লেটারে সই করে দিয়েছে ভূমিকা। এই মুহূর্তে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার শ্বশুরবাড়ির সামনে। ওহ না! কথাটিতে একটা শব্দের কমতি রয়েছে। সে এখন রয়েছে প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ির সামনে। ভূমিকা কষ্টে হেসেই ফেলে। সে অনেকক্ষণ যাবৎ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে বাড়িটিকে দেখে। খুব বেশি সময় সে শ্বশুরবাড়ি ছিল না। তবুও একসময়ে তো এই বাড়িটাই তার সবচেয়ে প্রিয় এবং আপন ছিল। তার স্বামীর পরিচয়ে বাড়িতে ছিল। ডিভোর্স লেটারে সই করার পরপরই ভূমির এই পরিচয়টি অনেকটা কর্পূরের ন্যায়ই উবে গেছে। এখন থেকে ভূমির আলাদা একটা পরিচয় হবে। সে নিজের পরিচয়ে পরিচিত হবে।
দীর্ঘকায় শ্বাস ভেতর থেকে বেরিয়ে আসায় সে একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয়বার প্রলম্বিত শ্বাস ত্যাগ করে সে রাস্তা পার হয়ে মেইন গেইটের সামনে যায়। ব্যাগ থেকে কাগজটি বের করে দারোয়ানকে দিয়ে বলে,’চাচা খামটি রাসেলের মাকে দিয়ে দিয়েন।’
‘জি আচ্ছা।’ বলে দারোয়ান খামটি ভূমির হাত থেকে নিল। ভূমিও আর সেখানে একদণ্ড না দাঁড়িয়ে, নিজ গন্তব্য অফিসে চলে যায়।
রিদি সোফায় বসে টিফি দেখছিল। ঐ সময়ে দারোয়ান এসে খামটি দিয়ে যায়। রেশমা বেগম জিজ্ঞেস করেন,’কে এসেছে?’
‘দারোয়ান। খামটা দিয়ে গেল।’
‘খুলে দেখ তো কী।’
রিদি খামটি খুলে বলল,’ডিভোর্স পেপার। ভাবি সই করে পাঠিয়েছে।’
‘দেখেছিস মেয়ের কাণ্ড! ভালোই হয়েছে। আমার ছেলের ঘাড় থেকে যে নেমেছে আমি এতেই খুশি।’
রিদি একটু হতাশসুরে বলল,’মেয়েটাকে কত ভালো ভেবেছিলাম। অথচ মনে মনে কী ছিল!’
‘আমি তো আগেই বলছিলাম মেয়ে সুবিধার না। বুঝস না, জীবনে এত আরাম-আয়েশ করছে? আমেরিকা দেখার কপাল হইতো রাসেলের লগে বিয়ে না হইলে?’
‘তাই বলে অন্য ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়াবে? এটা আমি সত্যিই আশা করিনি।’
‘ঐসব মেয়ের থেকে আর কী আশা করা যায়? রাসেলরে কত বুঝাইলাম, এই মেয়েরে বিয়ে করিস না। শুনছিল আমার কথা? পরে তো নিজেই প্রমাণ পাইল। বাদ দে। আল্লাহ্ যা করে ভালোর জন্যই করে। এখন তোর ভাইরে ফোন দে তো। দিয়া বল ভূমি সই করে দিছে।’
‘মা একবার ফোন দেই ভাবিকে?’
রেশমা বেগম ধমক দিয়ে বলেন,’ভাবি ভাবি কী? এখন আর ওর সাথে কোনো সম্পর্ক আছে আমাদের? আর রাসেল বারণ করছে, ওর সাথে যেন আমরা কোনো যোগাযোগ না করি। খবরদার! ফোন দিবি না ঐ মেয়েরে।’
_______
৭৯.
বিলাশবহুল রেস্টুরেন্টে বসে রয়েছে রাসেল আর সুমি। ঝাড়বাতিতে পুরো রেস্টুরেন্ট ঝকঝক করছে। দুপুরে যখন রেশমা বেগম ফোন করে জানালেন ভূমি ডিভোর্স লেটারে সই করে পাঠিয়েছে, তখন থেকেই সে খুশিতে আত্মহারা। এবার আর সময় নষ্ট করবে না। সুমিকে সব বলে দেবে। তারপর বিয়ের প্রস্তাব দেবে। একটা ডায়মন্ডের রিং কিনে এনেছে সুমির জন্য। একটু ভয় ভয়ও লাগছে, সব জানার পর সুমি কেমন রিয়্যাক্ট করবে কে জানে!
জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে সুমি বলল,’কী হলো? কখন থেকে চুপ করে আছো। আমার কাল পরীক্ষা আছে। বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবে না। বেশি রাত করে বাইরেও থাকতে পারব না।’
রাসেল হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,’মাত্র বাজে সাড়ে সাতটা। এখনও অনেক সময় আছে।’
‘আচ্ছা বুঝলাম। এখন তো বলো জরুরী তলবের কারণ কী? হঠাৎ শাড়ি পরতে বললে। তুমিও দেখি বেশ পরিপাটি হয়ে এসেছ। যদিও তুমি সবসময়ই পরিপাটি থাকো।’ কথাটা বলে মুচকি হাসল সুমি। রাসেল একটু সময় নিয়ে সুমির হাত ধরল। বড়ো শ্বাস নিয়ে বলল,’কথাগুলো অনেক সিরিয়াস সুমি। আশা করছি, আমার সম্পূর্ণ কথাটা তুমি শুনবে। আর আমায় একটু বোঝার চেষ্টা করবে।’
সুমির মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে বলে,’এমন কী কথা বলো তো?’
‘সুমি, আমি বিবাহিত!’
সুমি বিস্ময় নিয়ে তাকায়। কথা বলার ভাষা নেই তার। রাসেল বলে,’তবে এখন আর আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘আমি কিছু বুঝতেছি না রাসেল। তুমি কি আমার সাথে মজা করছ?’
‘না, সুমি। আমি সবকিছু তোমাকে সত্যি বলছি। তোমার সাথে যখন আমার পরিচয় হয়, তখন আমি বিবাহিত ছিলাম। কিন্তু আমার ওয়াইফের সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল না। ওর ক্যারেক্টার ভালো ছিল না। তখন তুমি আমার জীবনে আসো। তোমায় দেখে আমি বুঝেছি ভালোবাসা কী। তাই আমি তখন তোমায় সত্যিটা জানাতে পারিনি। কিছুদিন যাবৎ আমাদের ডিভোর্স হয়েছে।’
‘এক সপ্তাহের জন্য দেশে কি তাহলে ডিভোর্সের জন্যই গিয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ। সুমি, তুমি আমায় ভুল বুঝছ না তো? বিশ্বাস করো, আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। আমি বিয়ে করতে চাই তোমায়।’
এরপর সে পকেট থেকে রিং বের করে জিজ্ঞেস করে,’উইল ইউ ম্যারি মি?’
এক ঝটকায় রাসেলের হাত সরিয়ে দেয় সুমি। কটমট করে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ভরাট কণ্ঠে বলে,’তোমার থেকে আমি এটা আশা করিনি রাসেল।’
এরপর আর এক সেকেন্ডও সেখানে না দাঁড়িয়ে সে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]