#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_২৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________
৬৮.
মাথায় হাত রেখে বসে আছে বসে আছেন সেলিম মিয়া। পাশেই বিছানার এক কোণে বসে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছেন তার স্ত্রী। তাতে বিশেষ কোনো লাভ হচ্ছে না। বারবার চোখ থেকে পানি উপচে পড়ছে। সামনের চেয়ারে বসে কাঁদছে ভূমিকা। বারান্দার দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে সূচনা। এক ফালি সোনালি রোদ্দুর তার কালো চুলগুলোতে কিরণ ছড়াচ্ছে। এই মুহূর্তে ওরা সবাই আছে নুসরাতদের বাড়িতে। ওদের পারিবারিক কোনো বিষয়ে কথা বলতে যেন কোনো সমস্যা না হয় এজন্য আলাদা একটা রুম দেওয়া হয়েছে। দিশেহারা হয়ে পড়েছে সূচনার বাবা-মা। মেয়ের সংসার ভাঙার খবর যে কতটা কষ্টকর একজন বাবা-মায়ের কাছে এটা শুধু ভুক্তভোগীরাই বুঝবে। এমন সোনার সংসার দমকা হাওয়ায় ভেঙে গেল?
‘তোর চাচাকে জানাইছিস এসব?’ বড়ো মেয়ের উদ্দশ্যে প্রশ্ন করলেন মা।’
ভূমিকা নিচুস্বরে বলল,’না।’
‘কেন জানাস নাই? বলতে তো হবেই। ঐ ছেলেকে এত সহজে ছাড়া যাইব না। ওর মায়রেও জানাইতে হইব।’
‘এসবের কোনো দরকার নেই। চাচা আর জারিফকে সব জানাবে কিন্তু বুঝিয়ে বলবে। যেন ঝামেলা না করে।’
‘কীসের ঝামেলা? এগুলা মানুষের কাজকর্ম? ওর শাস্তি পাইতে হইব না?’
‘আমরা কে শাস্তি দেওয়ার? কী-ই বা করতে পারি আমরা? সবকিছু তো আর আগের মতো হবে না। শোনো মা, আসল মানুষটিই ঠিক নেই। সে আমাকে চায় না। যা-ই করি না কেন সংসার তো আর আগের মতো ঠিক হবে না। তাই দরকার নেই কিছু করার। তোমরা শুধু আমাকে সাপোর্ট করো। আমার পাশে থেকো তাহলেই হবে। এই সময়ে তোমরা ছাড়া আমার আর কোনো ভরসা নেই।’
নুসরাত ট্রে তে করে চা-বিস্কুট নিয়ে আসায় এ ব্যাপারে কথোপকথন আর আগায়নি। নাস্তা রেখে সে আর দাঁড়ায়নি, চলে গেছে। মা ভূমিকে জিজ্ঞেস করলেন,’তাইলে কী করবি? গ্রামে যাবি?’
গালে লেপ্টে থাকা চোখের পানিটুকু মুছে বড়ো করে দম নেয় সে। বলে,’না। গ্রামে টিকতে পারব না আমি। এখানেই থাকব। ফাতেমা খালামনির সাথে কথা হয়েছে। সে আমার একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে দেবে বলেছে। ওখানে না হলে চাচাকে বলব। সূচনার হোস্টেলেই একটা রুম নিয়ে থাকব।’
‘তোদের দুই বোনরে ঢাকায় একলা রাইখা আমরা গ্রামে কী করমু? আমরা তাইলে হাঁস-মুরগি, গরু এগুলা সব বিক্রি কইরা সামনের মাসে ঢাকায় চলে আসমু।’
‘যা ভালো মনে হয়।’
ভূমি যতটা সম্ভব নিজেকে স্ট্রং রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু মায়ের মন মানতে চায় না। সে একটু পরপরই কাঁদতে থাকে। এদিকে ভূমির চোখের পানি ফুরিয়ে এলো বলে। শুধু রাত গভীর হলেই তার বাঁধ না মানা কান্নাকে আটকানো যায় না। কষ্ট তার হয়। সেও কাঁদে সবার থেকে বেশি। তবে নিরবে! সেদিন বিকেলেই সূচনার বাবা-মা গ্রামে ফিরে যান। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারাও ঢাকায় ফিরে আসবেন। মেয়ের পাশে থাকবেন।
______
৬৯.
সপ্তাহ্ খানেকের মাঝে ভূমির একটা চাকরী হয়ে যায়। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। ওভার টাইম করলে আটটা পর্যন্ত অফিসে থাকতে হয়। তবে এতটুকু ব্যস্ততাই ভূমির জন্য যথেষ্ট ছিল না। সে আরও ব্যস্ত থাকতে চায়। সব রকম কষ্ট থেকে দূরে থাকতে চায়। রাসেলকে ভুলে থাকতে চায়। তাই সে অফিস থেকে এসে বই পড়ে। বিভিন্ন উপন্যাসের বই। আজ অফিস থেকে ফিরেই সে নীলক্ষেত চলে যায়। এখানে কম দামে ভালো ভালো বই পাওয়া যায়।
ফুটপাতে সে একটার পর একটা বই দেখে। সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ বইটির কথা অনেক শুনেছে ভূমি। কলেজ লাইফ থেকেই পড়ার ভীষণ ইচ্ছে ছিল। তবে ঝোঁক তেমন ছিল না। এজন্যই বোধ হয় পড়বে পড়বে করেও পড়া হয়ে ওঠেনি আর। বইয়ের পাতা উলটেপালটে দেখার সময়ে পাশ থেকে একজন পুরুষালী কণ্ঠ বলে ওঠে,’এই বইটা সমরেশ মজুমদারের অন্যতম একটা মাস্টারপিস বই। সব মেয়েদের অবশ্যই বইটা পড়া উচিত বলে আমি মনে করি।’
চকিতে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় ভূমি। দেখতে পায় সুন্দর গড়নের উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের ছেলেটিকে। দু’ঠোঁটে লেগে আছে সুন্দর হাসি। হাসলে ছেলেটির গালে টোল পড়ে। অজান্তেই তার আজ অনেক বছর বাদে নিজের বড়ো ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। কত বছর হবে ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ নেই? তিন বছর? নাহ্! এরচেয়ে বেশিই হবে। ভূমির ভাবনায় ছেদ ফেলে ছেলেটি আবার বলে উঠল,’কী হলো?’
ভূমি হেসে ফেলে। বলল,’কিছু না। তুমি এখানে?’
‘আমি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে টিসএসসিতে যাচ্ছিলাম। আপনাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম।’ বইয়ের তাক থেকে ‘ইনজয় ইউর লাইফ’ বইটি তুলে নিয়ে কথাটি বলল আদিল।
ভূমি ছোটো করে বলল,’ওহ।’
‘তারপর কেমন আছেন আপনারা?’
‘আপনারা বলতে?’ ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ বাঁকা করে পালটা প্রশ্ন করল ভূমি।
আদিল হেসে ফেলে। একটু লজ্জিতভাবে বলে,’মানে আপনি আর আপনার ছোটো বোন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ্ দুজনই ভালো আছি।’
‘আপনার ছোটো বোনটা না একটু কেমন জানি।’
‘কেমন?’
‘গম্ভীর টাইম।’
ভূমি স্মিত হেসে বলল,’ও এমনই। তবে আসলে ঠিক গম্ভীর বলা যায় না। ও তো আর সবার মতো কথা বলতে পারে না। ওকে চুপচাপ থাকতে হয়। এজন্য হয়তো গম্ভীর লাগে।’
‘ইশ! না আপু। নুসরাতের সঙ্গে যখন থাকে তখন কী হাসাহাসি যে করে বিশ্বাস করবেন না আপু!’
‘তাই? খুব হাসে?’
‘হ্যাঁ, খুব। নুসরাত কুটকুট করে কী সব যেন বলে, আর সূচনা খিলখিল করে হাসে। শুধু আমার সামনে এলেই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যায়।’
ভূমিকা একটু মুখটিপে হেসে বলল,’এটা তো ঠিক নয়।’
‘আপনি একটু বলবেন?’
‘কী বলব?’
‘আমার সাথে যেন এমন না করে।’
ভূমিকা এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বইটি দামাদামি করে কিনে নেয়। আদিলও ওর হাতের বইটি কিনে ভূমিকে দিয়ে বলে,’ছোটো ভাইয়ের তরফ থেকে সামান্য উপহার।’
ভূমি সাদরে গ্রহণ করে বলে,’বই কখনো সামান্য উপহার হয় না। আর সেখানে যদি উপহার দেয় ছোটো ভাই! তাহলে এটার মান তো অনেক অনেক উপরে।’
‘আহা! দিল খুশ হো গায়া মেরি বেহেনা।’
ভূমি এবার শব্দ করে হেসে ফেলে। আদিল তাকে অফার দিয়ে বলে,’আপু চলেন টিসএসসিতে যাই।’
‘আমি? আমি গিয়ে কী করব?’
‘আড্ডা দিবেন আমাদের সাথে।’
‘না, অন্য একদিন।’
‘আরে চলেন তো। দেখবেন আপনার ভালো লাগবে।’
এক প্রকার আদিলের জোড়াজুড়িতেই ভূমিকে ওর সাথে যেতে হলো। গিয়ে দেখল সাত, আটটা ছেলে আদিলের বয়সী। ওরা সবাই প্রথমে ভূমিকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আদিল সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল,’আমার আপু, ভূমিকা।’
বন্ধুরা সবাই জানে আদিলের শুধুমাত্র একটাই বোন, নুসরাত। তাহলে এই ভূমিকা কে, কেমন বোন এসব কোনো প্রশ্ন না করেই নিজেরাও খুব সুন্দর করে ভূমিকার সাথে মিশে যায়। ওদের মতো করে এত সহজভাবে প্রথমে মিশতে পারছিল না ভূমি। তবে বেশিক্ষণ লাগেনি সহজ হতে। বড়ো বোন মনে করেই একেকজন সম্মান প্রদান করছিল ওকে। ওদের মধ্যে দু’জন আছে বেশ ভালো গায়। ওরা দুজনই গান ধরে,
‘আমার একলা আকাশ থমকে
গেছে; রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।’
এই গানটি শোনামাত্র পূণরায় সেই পুরনো অতীতের বিষাদময় স্মৃতির কথা মনে পড়ে বুকের ভেতর ভূমির মোচর দিয়ে ওঠে। যতই ভুলে থাকার চেষ্টা করা হচ্ছে, ততই যেন বেশি মনে পড়ে যাচ্ছে। এই গানটা রাসেল আর ভূমিকার অনেক বেশি প্রিয় ছিল। বিয়ের পর রাসেল ভূমিকে এই গানটি প্রথম শুনিয়েছিল। কী সুন্দরই না ছিল সেদিনের সেই মুহূর্তগুলো! সেই সময়ে অজান্তেই ওদের দুজনের সঙ্গে ভূমিও কণ্ঠ মেলায়। সুরে সুরে মেতে ওঠে জায়গাটি। ভূমির গানের কণ্ঠ শুনে অবাক হয়ে যায় উপস্থিত সকলে। বাকি বন্ধুরা তিনজনের এই সুন্দর মুহূর্তটুকু ফোনে ভিডিয়ো করে নেয়। আদিলের যেই দু’বন্ধু গান গায় ওরা ফেসবুকে বেশ ফেমাস। দুজনেরই একটি ফেসবুক পেইজ আর ইউটিউব চ্যানেল আছে। আদিল ঐ পেইজের এডমিন। ও তৎক্ষণাৎ পেইজে গিয়ে ভিডিয়ো লাইভে এসে ক্যামরা তাক করে তিনজনের দিকে। কয়েক মিনিটেই ভিউ আসে দু’হাজারেরও বেশি। এতদিন ওদের ভক্তরা শুধু দু’বন্ধুর গানে মুগ্ধ হলেও আজ নতুন করে ভূমির কণ্ঠ শুনেও তারা মুগ্ধ। ভূমির মুখ দেখা যাচ্ছিল না। ওর মাথার পেছনেরটুকু শুধু দেখা যাচ্ছিল। ভূমির মুখোমুখি বসে ছিল আদিলের দু’বন্ধু আসলাম এবং শিশির।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! আসলাম এবং শিশিরের হাজার হাজার ফ্যানের মধ্যে অন্যতম একজন রাসেল। সেও আজ লাইভটি দেখে থমকে যায়। ভূমিকে না দেখতে পেলেও কণ্ঠ চিনতে তার একটুও বেগ পেতে হয় না। পেটের ভেতর কেমন যেন গুলিয়ে আসে। কেমন যেন একটা অসাড় অসাড় অনুভূতি। সে কিছুক্ষণের জন্য দিশেহারা হয়ে পড়ে। সে মনকে প্রশ্ন করছে,’এটা ভূমি তো?’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]