বিরহের নাম তুমি পর্ব-২৪

0
344

#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_২৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
৬৩.
একটা সপ্তাহ্ ভূমিকার নরক যন্ত্রণার মতো কেটেছে। সে যতবার রাসেলকে চোখের সামনে দেখেছে, ততবার তার শ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছে। বুকের কোথায় যেন একটা কঠিন ব্যথা অনুভব করত সে প্রতিটা বার। কষ্ট হয়, খুব কষ্ট হয় মানতে। এই অবুঝ মন কিছুতেই রাসেলের পরিবর্তন মেনে নিতে পারছে না। তবে ভূমি এটাও জানে, তার মানা না মানায় কিছুই যায় আসে না। তার মনে পড়ে যায় প্রথমদিকের কথা। এত এত টেক কেয়ার, এতসব স্বপ্ন সব মিথ্যে ছিল? সবটা অভিনয় ছিল? এর মাঝে কি একটুও ভালোবাসা ছিল না? হয়তো না! ভালোবাসা থাকলে রাসেল নিশ্চয়ই পারত না এভাবে তাকে ধোঁকা দিতে। ধোঁকা! হ্যাঁ, রাসেল তো তাকে ধোঁকাই দিয়েছে। তার সবচেয়ে কাছের মানুষ, তার ভালোবাসার মানুষ। তার স্বামী! এই মানুষটার থেকে পাওয়া কষ্টও কি কোনো নারী সহ্য করতে পারে? পরিবর্তনই যদি হয়ে যাবে, তবে জীবনে আসার প্রয়োজন কী ছিল? আদৌ ছিল কোনো প্রয়োজন? ভেতর থেকে কান্নারা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। মানসিক ভারসাম্যও যেন দিনদিন তার হারিয়ে যাচ্ছে। সে যে কী এক বিভীষিকাময় যন্ত্রণা, তা আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারব না।

‘ভূমি, ভূমি? একটু এদিকে শুনে যাও তো।’ ড্রয়িংরুম থেকে রাসেলের ডাক শুনে সে স্থির হয়। কান্না চাপানোর চেষ্টা করে। তাকে দুর্বল হলে চলবে না। অন্তত রাসেলের সামনে তো নয়-ই। সে দরজা খুলে ড্রয়িংরুমে আসে। কপালে হাত রেখে সোফায় বসে ছিল রাসেল। ভূমিকার উপস্থিতি টের পেয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। বলল,’এই নাও তোমার পাসপোর্ট।’

ভূমিকা রাসেলের হাতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এত সহজেই সে সবটা করে ফেলল? এত দ্রুত? সে শ্লেষের সঙ্গে বলল,’আমি এত বেশি হয়ে গেছি না?’
রাসেল বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে বলল,’মানে?’
‘মাত্র সাতদিনেই আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছ। কতটা চক্ষুশূলই না আমি ছিলাম!’
‘প্রথমত তুমি নিজেই বলেছিলে যাতে তোমার যাওয়ার ব্যবস্থাটা করে দেই। যাবেই যখন, দেরি করে লাভ কী? দ্বিতীয়ত দু’দিন পরপর; স্যরি প্রতিদিন এভাবে আজাইরা প্যারা আমি নিতে পারব না।’
ভূমি পারছে না আর নিজেকে সংবরণ করে রাখতে। দু’চোখ ফেটে অশ্রু নির্গত হতে চাচ্ছে। নিচের ঠোঁট দন্ত দ্বারা চেপে সে কান্না আটকানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ততক্ষণে চক্ষুদ্বয় পানিতে টলমল। সে এদিক-সেদিক তাকিয়ে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করে। এরপর হাসার চেষ্টা করে মৃদু। বলে,’দেবো না আর তোমাকে কোনো আজাইরা প্যারা। তুমি মুক্ত।’
সে রাসেলের হাত থেকে পাসপোর্ট নিয়ে ঘরে চলে যায়। শব্দ করে দরজা লাগিয়ে বিছানার ওপর বসে। মুখের ওপর হাত চেপে ধরে বোবা চিৎকার এবং আর্তনাদের সঙ্গে কাঁদে। তার মনে হচ্ছে কেউ তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। মনের ওপর পাহাড়সম কষ্ট চাপিয়ে দিয়েছে। সে এই কষ্টের ভার সহ্য করতে পারছে না। মুখের ওপর বালিশ রেখে যত জোরে সম্ভব চিৎকার করে সে কাঁদছে।
‘আল্লাহ্ সাহায্য করো আমায় তুমি সাহায্য করো। এ কোন কঠিন পরীক্ষায় তুমি আমায় ফেললে বলো? কষ্ট যখন দেবেই তখন, কষ্ট সহ্য করার মতো শক্তিও তুমি আমায় দাও। আল্লাহ্ গো! তুমি ছাড়া যে এখন আর আমার কেউ নেই সাহায্য করার জন্য। একটু প্রশান্তি তুমি আমার অন্তরে দিয়ে দাও আল্লাহ্। আমার সহায় হও তুমি।’
ভূমির চাপা আর্তনাদ, চিৎকারের সহিত বোবা কান্না বালিশ, চারদেয়ালের ঘরের মধ্যেই আটকে থাকে। রাসেলের কান অব্দি যেতে পারে না। ভূমি নিজেও এটা চায় না। তবে একজন তো শুনেছে নিশ্চয়ই? আল্লাহ্! সে হবে তো ভূমির প্রতি সহায়?

ভূমির অসহায়ত্ব বোধ হয় প্রকৃতিও বুঝতে পেরেছে। তাই ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশটি হঠাৎ করেই মেঘের চাদর শরীরে জড়িয়ে নিল। মৃদু রোদ্দুরটুকুও আর আকাশের কোণে অবশিষ্ট নেই। হঠাৎ করেই সাদা মেঘের ভেলা একটু একটু করে ঘন কালো মেঘে পরিণত হয়ে গেল। আকাশে এখন শুধু ঘনঘটা মেঘের ছড়াছড়ি। অবাক করে দিয়ে শীতকে ছাপিয়ে বৃষ্টির আগমন শুরু হয়। ঝড়ো হাওয়ার তরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশ থেকে ধেয়ে আসা বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা আমেরিকার শহরকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। প্রতিটি গাছ, পিছঢালা পথ, বাড়িঘর যেন নিমিশেই বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেল। অবাক লাগে। প্রকৃতি ভূমির কষ্টটা বুঝলেও, যেই মানুষটার বোঝার কথা ছিল সে বোঝেনি। বিছানা ছেড়ে উঠে সে জানালার ধার ঘেঁষে দাঁড়ায়। খুলে দেয় জানালার থাই গ্লাস। হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ে ভূমির মুখমণ্ডলে। সে দু’চোখ বন্ধ করে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে দু’চোখের কোণা বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। জানালা দিয়ে হাত বাইরে নিয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে বলে,’আল্লাহ্, যার থেকে আমাকে আলাদা করে নিচ্ছ, তাকে ছাড়া ভালো থাকতেও আমায় শিখিয়ে দিও।’

এভাবে সে কতক্ষণ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল তা জানা নেই। চিন্তা-ভাবনা, মস্তিষ্ক এখন সব অস্থির। হৃদপিণ্ডের গতি ক্রমশ যেন বেড়েই চলেছে। সে যে কী এক অশান্তি! দু’হাতে চোখের পানি মুছে নিয়ে আলমারি থেকে কাপড়-চোপড় বের করে। রাসেলের কিনে দেওয়া কোনো কাপড়-চোপড় নেয়নি। যেগুলো বাবার বাড়ি থেকে আনা হয়েছিল আর চাচা দিয়েছিল শুধু সেগুলোই লাগেজে তুলে নিল। রাতে ফ্লাইট তাই এই সুযোগে নিজেও একটু পরিপাটি হয়ে নেয়। বৃষ্টি তখন ঝিরিঝিরি পড়ছিল। রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে যায়। রাসেল ছিল দ্বিতীয় রুমে। চায়ের পানি চুলায় বসিয়ে সে রাসেলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,’চা খাবে?’

রাসেল থতমত খেয়ে তাকিয়ে থাকে। সে যতই ভূমিকে দেখছে ততই বেশি অবাক হচ্ছে। এটা কি তার সেই পরিচিত ভূমি? কই দেখে তো মনে হচ্ছে না। রাসেলকে ছেড়ে যাবে এর পরেও ভূমির মুখ এতটা হাস্যোজ্জ্বল? এও সম্ভব? কিন্তু হায়! এই তুখোড় অভিনেতা নিজে ভালোবাসার অভিনয় করলেও, ভূমির ভালো থাকার অভিনয়টা টের পাচ্ছে না। রাসেলকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভূমি আবার জিজ্ঞেস করল,’ওয়েদার অনেক বেশি ঠাণ্ডা। তাই চা বানাচ্ছিলাম। তুমি চা খাবে?’
রাসেল কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না। যেখানে সে ভূমিকে একেবারেই ছেড়ে দিচ্ছে, তার কাছে আবার চা খাওয়ার আবদার করাটা খুব বেশি বেহায়াপনা মনে হবে। তবে বৃষ্টি হলে রাসেলের চা চাই-ই। ভূমি এটা বেশ ভালো করেই জানে। তাই সে নিজের জন্য নয় বরং রাসেলের জন্যই চা বানাতে কিচেনে গিয়েছে। রাসেলকে দ্বিধাজড়িত অবস্থায় দেখে সে আর দাঁড়াল না। ফের কিচেনে চলে গেল। চা বানিয়ে এনে রাসেলের পাশে রেখে বলল,’নিরবতাকেই সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়েছি। তাই চা নিয়ে এলাম।’
‘খাব না।’ রাসেলের চটপটে উত্তরে ভূমি আহত হয়। ভেতরটায় কষ্টে তেতো হয়ে ওঠে। তবুও সে নিভল না। সুন্দর করে হেসে বলল,’ইচ্ছে তোমার। এরপর কখনো মৃত্যুর সময় এলেও যদি ইচ্ছে হয় ভূমির হাতে একটু পানি খাবে তবে বলে দিচ্ছি, তোমার সেই ইচ্ছেটাও কখনো পূরণ হবে না।’
‘তুমি শোকে পাগল হয়ে গেছ! তাই আবোল-তাবোল বকছ।’
‘কী জানি হতেও পারে!’
‘ওভার কনফিডেন্স নয় কি এসব?’
‘কনফিডেন্স? সে আবার কী শব্দ? কনফিডেন্স তো ছিল আমার তোমায় নিয়ে। তুমি বদলে যাওয়ার সাথে সাথে কনফিডেন্স শব্দটিও আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে।’

রাসেল এ ব্যাপারে আর কোনো কথা বলল না। কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল,’সবকিছু গুছিয়ে নাও। আমরা এখনই বের হব।’
‘সবকিছু গোছানোই আছে। আমরা বের হব মানে? তুমি দিয়ে আসবে নাকি?’
‘এয়ারপোর্ট অব্দি যাব।’
‘পরম সৌভাগ্য আমার।’
‘পিঞ্চ মেরে কথা বলছ কেন?’
ভূমি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। গুটি গুটি পায়ে সে রাসেলের দিকে এগিয়ে যায়। ডান হাতের তর্জনী রাসেলের বুকের ওপর রেখে বলে,’আমার এটুকু কথাই তুমি সহ্য করতে পারছ না। তাহলে তোমার এভাবে বদলে যাওয়াটা আমি কীভাবে মেনে নিচ্ছি বলতে পারো?’
রাসেল নিরব। ভূমি সরে যায় সেখান থেকে। রুম থেকে বের হওয়ার পথে বলে যায়,’আমি তোমার ওপর রাগ করে কিংবা অভিমান নিয়ে ফিরে যাচ্ছি না। আমি হাসিমুখে ফিরে যাচ্ছি। আর আমার এই হাসিমুখে বিদায় নেওয়ার জন্যই, তুমি হাজার চাইলেও আর আমায় ফেরাতে পারবে না।’
‘আশা করছি সেই দিনটি কখনো আসবে না।’
ভূমি প্রত্যুত্তরে বাঁকা হাসি প্রদান করল। সে নিজেও জানে না আদৌ এ দিনটি কখনো আসবে কিনা।

ভূমি ঘর থেকে লাগেজ নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে বসে। তার মন-মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ ফাঁকা। দেশের কেউই এখনো জানে না, সে যে দেশে ফিরে যাচ্ছে তাও একা! এবং সারাজীবনের মতো। এখন থেকে সে রাসেলকে ছাড়াই থাকবে। এসব ভাবতেই তো বুকের ভেতরটা কেমন মোচর দিয়ে ওঠে। কোনোভাবেই সে রাসেলের প্রতারণা মেনে নিতে পারছে না। যতবার এসব প্রসঙ্গ মনে পড়ে ততবার সূক্ষ্ম, তিক্ত অনুভূতিতে গা গুলিয়ে ওঠে। মরে যেতে ইচ্ছে করে তার। এ অনুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দিলো না রাসেল। সে রুম থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করল,’রেডি তুমি?’
ভূমি একবার সেদিকে তাকিয়ে ছোটো করে বলল,’হুম।’
‘চলো তাহলে।’

ভূমি শেষবারের মতো পুরো বাড়িটিতে চোখ বু্লিয়ে নিল। খুব বেশিদিন হয়নি সে এখানে ছিল। তবে যতদিনই ছিল, সময়টা কম ছিল না। বাড়িটির প্রতি কোণায় কোণায় ভালোবাসা,স্মৃতি মিশে আছে। সবকিছুর মায়া ছেড়ে আজ তাকে চিরদিনের মতো চলে যেতে হবে। সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিই তো তাকে ছেড়ে দিলো, সেখানে আর পিছুটান, মায়া এসব রেখে লাভ কী! দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে সে লাগেজ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বাইরে এখন আর বৃষ্টি নেই। ভূমি বলল,’বাইকে যাব না। ট্যাক্সি নাও।’
রাসেল আড়চোখে একবার তাকিয়ে ভূমির কথাই রাখল। মিসেস চৌধুরীর সাথেও একবার শেষ দেখা হলো না। এতকিছু যে ঘটে গেছে এসবও জানায়নি। কী প্রয়োজন ঝামেলা পাকিয়ে? যেখানে আসল মানুষটিই ঠিক নেই! ট্যাক্সিতে কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলেনি। এয়ারপোর্টে নেমে ভূমি দাঁড়ায়। রাসেল ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ভূমির মুখোমুখি দাঁড়ায়। তার অস্বস্তি লাগছিল খুব। ভূমি হেসে বলে,’একদিন এই এয়ারপোর্টে এসে আমি কতই না খুশি ছিলাম! সেদিন সারাজীবনের জন্য তোমার কাছে এসেছিলাম। আর আজ সারাজীবনের মতো তোমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছি।’
রাসেল ভূমির দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে। ভূমির চোখ অশ্রুতে চিকচিক করছে। সে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল,’যা হোক, ভালো থেকো। দুজনে অনেক সুখী হও। আসছি।’
রাসেল ছোটো করে বলল,’হু।’ এরচেয়ে বেশি তার আর কী-ই বা বলার আছে? ভূমি লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্টের ভেতর এগিয়ে যায়। পিছু তাকিয়ে দেখে রাসেল এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সে কয়েক পা পিছিয়ে আসে আবার। কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে মন ভরে রাসেলের মায়া মায়া মুখটি দেখে নেয়। চোখের দিকে তাকিয়ে এক টুকরো হাসি প্রদান করে বলে,’যেই বিরহের চাদরে আজ আমি নিজেকে জড়িয়ে নিলাম, দোয়া করি সেই বিরহের সংস্পর্শে কখনো তোমায় যেন না আসতে হয়! তুমি সইতে পারবে না।’

রাসেল শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ভূমি কিছুক্ষণের মাঝেই রাসেলের দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। এখন আর এত মানুষের ভীরে ভূমিকে দেখা যাচ্ছে না। চলে গেছে সারাজীবনের জন্য!

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here